ম্যাগি কীভাবে এত বছর ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে?

ভারতীয় উপমহাদেশের ব্র্যান্ড হিস্ট্রির কথা বলি বা খাদ্যতালিকার কথা বলি, ম্যাগি এ অঞ্চলের অন্যতম আইকনিক ব্র্যান্ড হিসেবে গত কয়েক দশকে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, এটা আমাদের ছোটবেলার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশই বলা চলে। কিন্তু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ১৯৮৩/৮৪ এর দিকে ম্যাগি বা ইন্সট্যান্ট নুডুলস এই দুইটাই ছিলো একেবারেই এলিয়েন প্রোডাক্ট বা একদমই অজানা অপরিচিত খাবার সামগ্রী। ঠিক সে জায়গা থেকে সবচেয়ে বড় সাপ্লাই ফুড চেইন ম্যাগি কীভাবে তৈরি করলো তা নিয়েই আজকে আমরা জানবো।

ইন্সট্যান্ট নুডুলস এতটা অপরিচিত একটি পণ্য হওয়া সত্যেও ‘nestle’ নিজেরাই এই ফুড চেইনে প্রায় ৯৩৭ কোটি টাকার মার্কেট তৈরি করেছে প্রায় ৩৪ বছরে। এদিকে আরো জায়ান্ট প্রতিদ্বন্দ্বী যেমন- Unilever, ITC limited, Marico এর মতো লিডিং কোম্পানি থাকা স্বত্ত্বেও, Maggie’ নিজেই মার্কেটে ৬০% এর মত জায়গা দখল করে রেখেছে।

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় এমন-

১.’Nestle’ কীভাবে এরকম অপরিচিত একটি খাবারে এতবড় একটি মার্কেট তৈরি করে ফেললো?

২.সেটি কীভাবে আবার একেবারে একক আধিপত্য তৈরি করে ফেললো বাকিদের পেছনে ফেলে?

৩.আমাদের আসলে তাদের এই জিনিয়াস মার্কেটিং কৌশল থেকে কী শেখার আছে?

শুরুটা যেভাবে হয়েছিলো

১৯৫০ সালের দিকে জাপান তখনো দ্বিতীয় বিশ্বের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের কাটিয়ে তুলছে। সেই সময় সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যেতো নুডুলস। কিন্তু সমস্যা হলো যত পরিমাণ চাহিদা সেসময়ে ছিলো তত পরিমাণ সাপ্লাই চেইন ছিল না। কারণ, নুডুলস বানাতে প্রচুর সময় লাগত, পরিমাণেও কম তৈরি করা হতো চাহিদা অনুযায়ী। ঠিক তখনই এক অতি উৎসুক জাপানিজ বিজ্ঞানী ‘Momofuku Ando’ (1910-2007) তিনি চিন্তা করলেন কীভাবে এর সমাধান করা যায়। সময় এবং সাপ্লাই চেইনকে কীভাবে সমানতালে নিয়ে আসা যায়! পরবর্তীতে তিনি প্রায় ১০০ ভাবে চেষ্টা চালানোর পর এই ইন্সট্যান্ট নুডুলস তৈরি করতে সক্ষম হন। যেটা একধরনের রেভ্যুলশনারি প্রোডাক্ট হিসেবে জাপানসহ পুরো পৃথিবীতে প্রসেস ফুডের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এদিকে তখন খুব দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা জাপানিক ইকোনোমকিতে এটি ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বেসিক নুডুলস থেকে ৫/৬ গুণ বেশি কস্টলি হলেও সবাই ইন্সট্যান্ট নুডুলসকেই বেশি গ্রহণযোগ্যতার জায়গা দিয়েছিলো।

 

পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার শুরুটা

তখন জাপানে ইন্সট্যান্ট নুডুলস মার্কেট দখল করা কোম্পানিটি হলো ‘Nissin’। যেটি কি না প্রায় ৬০% মার্কেট নিজের আয়ত্তে রেখেছিলো। এরপর আসলো আসল গেইম চেঞ্জিং স্টেপ। আর সেটি হলো, ইউএস এক্সপোর্ট। অর্থাৎ, যখন জাপানিজ কোম্পানিগুলো আমেরিকায় এই ইন্সট্যান্ট নুডুলস রপ্তানি শুরু করলো তখনই মার্কেটে এটি হিট হয়ে গিয়েছিলো। প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করলো। আর তখনই ‘Nestle’  এই সবকিছু খুব সচেতনভাবে এই সবকিছু নজরদারিতে রাখছিলো এবং তাদের পরবর্তী ধাপ কীভাবে রাখতে পারে তা নিয়ে পরিকল্পনা করছিলো। কারণ তারা বুঝতে পারছিলো ইন্সট্যান্ট নুডুলস একটা যুগান্তকারী প্রোডাক্ট হিসেবে মার্কেট দখল করতে চলেছে। তখন ‘Nestle’ যে কাজটি করলো সেটি ছিলো আরো যুগান্তকারী। জাপানে এতবড় মার্কেট এখনো ফাঁকা থাকার পরেও, বিলিয়ন ডলার মার্কেট বাগিয়ে নিতে পারার সুযোগ থাকার পরেও তারা জাপানিজ মার্কেটে নিজেদের প্রোডাক্ট নামায়নি।

প্রশ্নটা এখানেই। কেন?

এর দুটি কারণ হতে পারে।

প্রথমত, জাপানিজরা খুব একটা লিবারেল ছিল না। একটা বিদেশী পণ্য এসে তাদের মার্কেট গ্র্যাব করবে এই ব্যাপারে তারা কতটুকু আগ্রহ প্রকাশ করতো, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

দ্বিতীয়ত, এমন কোনো একচেটিয়া বা একচ্ছত্র ভাবে রাজত্ব করছে যেটি কিনা (nissin) এমন কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতায় জড়ানোর কী দরকার যেখানে বিশ্ব মার্কেটে ‘Nestle’ এর নিজের এই মুহুর্তে একচ্ছত্র বিস্তার করার সুযোগ আকাশচুম্বী।

এভাবেই তারা জাপান ছাড়া অন্যদেশ বা অঞ্চলগুলোতে মার্কেট এক্সপ্লোর করা শুরু করে। আর ঠিক এভাবেই ”Nestle’ Maggi noodles চলে আসে বা প্রবেশ করে এই ইন্ডিয়ান মার্কেটে। তবে প্রবেশ করলেও কী?! এই সময়েও তো ইন্সট্যান্ট নুডুলস এখনো এই মার্কেটে একটি অচেনা, একদম ধারণার বাইরের কোনো পণ্য, খাদ্যসামগ্রী। ব্যাপারটা এমন যে, ইন্ডিয়ান বাবা- মা কে বলা হচ্ছে সকালবেলা ইতালিয়ানদের মতো পাস্তা খেয়ে দিন শুরু করার জন্য তার সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করা। তাও আবার সেটি প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকায় নিয়ে আসার যে একটি ব্যাপার। বাচ্চাদের টিফিন, পার্টনারের লাঞ্চ, গেস্টকে স্ন্যাকস দেয়া, সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে সব জায়গায় এই ইন্সট্যান্ট নুডুলস ঠিক কীভাবে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছিলো আর ‘Nestle’র এখানে কী মাস্টারমাইন্ড কাজ করেছিলো তা ই জানার বিষয়।

 

ইন্ডিয়ান মার্কেটে আধিপত্যের উত্থান

এখানেই নেসলে তাদের সাকসেসটা দেখাতে পেরেছিলো। তারা খুব ভালোভাবে তাদের ‘customer and consumer’ ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলো বা ধরেছিলো বলা চলে। আপনি যদি নুডুলসটাকে একটা প্রোডাক্ট হিসেবে দেখেন, আপনি খেয়াল করবেন এটি যে কেউ খেতে পারবে বা খাবে। এর কোনো নির্দিষ্ট অডিয়েন্স নেই। এই প্রেক্ষাপট থেকে কী ভাবা যায়? তারা পুরো ইন্ডিয়ান মার্কেটেই এটি সেল করতে চাওয়ার কথা? যে সবাই তো খেতেই পারবে। এই ৭৪০ মিলিয়ন পিপলের ইন্ডিয়ান মার্কেটে তারা তড়িঘড়ি করে সবাইকে তাদের কাস্টমার বানিয়ে ফেলতে চাওয়ার কথা। কিন্তু এখানেই নেসলে অন্যদের থেকে আলাদা। তারা কোনো সাধারণ ব্র্যান্ড না। তারা বুঝতে পেরেছিলো কে বা কাদেরকে টার্গেট করতে হবে। কাদের টার্গেট করলে এটি অটোমেটিক ভাবে ছড়িয়ে পড়বে ভাইরাসের মতো। এখানেই তারা এই ফান্ডামেন্টাল মার্কেটিং আইডিয়াটা বুঝতে পেরেছিলো। এভাবেই তারা খুঁজতে এবং বুঝতে চেষ্টা করলো ঠিক কারা তাদের আদর্শ কাস্টমার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, তারা পেলো দুইটা ক্যাটাগরি। এরা হলো ‘মায়েরা এবং তাদের সন্তানেরা’।

এর পেছনের কারণ কী?

একটা এলিয়েন প্রোডাক্ট বা হুট করে বিদেশ থেকে চলে আসা এরকম কোনো প্রোডাক্ট তখনই জায়গা করে নিতে পারবে যখন সেটি মিনিংফুলি কোনো সমস্যার সমধান করতে পারবে। নেসলের ক্ষেত্রে, এখানে দুইটি প্রাইমারি স্টেকহোল্ডার ছিলো। এক- কাস্টমার অর্থাৎ মা, যিনি প্রোডাক্টটা কিনবেন। দুই- কনজিউমার অর্থাৎ বাচ্চারা যারা প্রোডাক্টটা খাদ্যাভ্যাস হিসেবে গ্রহণ করবে। সেই সময়ে, দুই ধরনের মায়েরা ছিলেন।

১.গৃহিনী বা হোমমেকার ২. ওয়ার্কিং মাদার

এই দুই পক্ষেরই একটা প্রধান চিন্তার ব্যাপার ছিলো, তাদের সন্তানদের হেলদি এবং একইসাথে টেস্টি এরকম কোনো খাবার সার্ভ করা। যখন বাচ্চারা স্কুল থেকে আসে এবং স্কুলের টিফিনে এক ধরনের গতানুগতিক খাবার খায়, স্কুল থেকে এসে আবার স্ন্যাকস বা বিকেলের নাস্তায় তাদের সেই খাবার খাওয়ানো সম্ভব হয় না। হোমমেকার মায়ের সারাদিন সাংসারিক কাজকর্মের পর, কিছুটা বিশ্রামেরও প্রয়োজন পড়ে। এই সময়ে তাদের দরকার এরকম কিছু, যেটি কি না সময় কম নেয়, তাড়াতাড়ি বানানোও যায় আবার গতানুগতিক খাবার থেকে আলাদা ও সুস্বাদু।

 

মার্কেটিং এর যাত্রা ও প্রভাব

ব্যাপার হলো তখন পণ্য তো ছিলো, সেটা সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার উপায় ছিলো একমাত্র টেলিভিশন। তাই টিভি কমার্শিয়ালের মার্কেটিং এর উপরই মোটামুটি সম্পূর্ণটা নির্ভর করতো। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় ম্যাগি। এইযে সময় সাশ্রয়ী ব্যাপারটার সাথে মিলিয়ে তারা ট্যাগ লাইন তৈরি করে ‘দো মিনিট ম্যায় ম্যাগি’। যে কমার্শিয়ালে দেখায় মা কত চটজলদি বাচ্চাদের জন্য ম্যাগি তৈরি করতে পারে আর বাচ্চারাও কত আনন্দের সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে তা গ্রহণ করছে, কখনো বন্ধুদেরও ডেকে নিয়ে আসছে খাওয়াতে। এইযে একটা ফ্রেন্ডলি ইম্প্রেশন, এখান থেকেই ম্যাগির মোড় ঘুরে যায়।

নেসলে শুধু এখানেই থেমে থাকেনি। নেসলে স্কুল বাচ্চাদের কাছেও পৌছে গিয়েছিলো বিভিন্ন ইভেন্ট বা এক্টিভিটির মাধ্যমে। পাশাপাশি তাদের প্রচুর গিফট হ্যাম্পার ক্যাম্পেইন থাকতো বাচ্চাদের জন্য। আপনি যদি এখনো ম্যাগি কেনেন তাহলে দেখবেন গিফট দেয়ার একটা কন্সেপ্ট সবসময়ই নেসলে জুড়ে দেয় নিজেদের সাথে, কিছু না কিছু ছোটখাটো গিফট পাওয়া যায় নেসলে এর ফ্যামিলি প্যাক নুডলস এর সাথে। এর পাশাপাশি নেসলে বাইরে বা লোকাল এরিয়াতেও তাদের ক্যাম্পেইন করা শুরু করে এবং সার্বজনীন প্রোডাক্ট হিসেবে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করতে এবং দাড় করাতে শুরু করে। তারা এতটাই ভালো ফলাফল পেতে শুরু করে যে প্রতিবছর তারা প্রায় ৪ মিলিয়ন নতুন কন্টাক্ট রিসিভ করছিলো। সেই প্রেক্ষিতে তারা প্রচুর টিভি চ্যানেল কমার্শিয়াল তৈরি করা শুরু করে যখন আমি আপনি কার্টুন নেটওয়ার্কে আমাদের পছন্দের কার্টুন দেখায় মগ্ন, তখন ম্যাগি কমার্শিয়ালও আমাদের পছন্দের তালিকায় আমাদের অজান্তেই প্রবেশ করে।

কিন্তু ইন্ডিয়ান মার্কেটে কি কোনো কম্পিটিটর নেই? বা তৈরি হয়নি এত বছরেও? তারা কেন এতদিনেও নেসলে এর বা ম্যাগি এর এই একচ্ছত্র বিস্তারে বাধা হতে পারেনি। সমাধানটা আসলে এমন যে, নেসলে প্রায় ২৫ বছর ধরে একটা শক্তপোক্ত সাপ্লাই চেইন মেইনটেইন করছে যেটি ভাঙা এতটা সহজ ছিল না। ইন্সট্যান্ট নুডুলস মার্কেটের ‘end to end’ নিয়ন্ত্রণ অনেকটা ম্যাগির হাতেই ছিলো। তাই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো এমন একটি মনোপলি ক্রিয়েট করা।

শুধু যে ইন্ডিয়াতেই এই জনপ্রিয়তা রয়ে গিয়েছে তা কিন্তু নয়, বরং পুরো ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট বা ভারতীয় উপমহাদেশের অঞ্চলগুলোতেও সমানতালে জনপ্রিয়তা অর্জন করে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় এই ইন্সট্যান্ট নুডুলস ফর্ম ‘maggi noodles’। যা একই সাথে সময় সাশ্রয়ী এবং মায়েদের একান্ত ভরসার জায়গা।

1 thoughts on “ম্যাগি কীভাবে এত বছর ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে?

Leave a Reply to Mohua Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *