একটা বিজনেস, অথবা স্টার্ট আপ শুরু করা আমাদের অনেকের স্বপ্ন। আয়োজন করে নিজের একটা ব্যবসা শুরু করা, নিজেই নিজের বস হওয়া, গৎবাঁধা ৯-৫ টা চাকরির বাইরে বের হয়ে নিজেই নিজের শিডিউল ঠিক করা, এগুলো ভাবতেই ভালো লাগে। তবে, সফলতার গল্পগুলো সবার মুখে মুখে ছড়ালেও, কয়জন ব্যর্থতার গল্পগুলো মনে রাখে? একটা বিজনেস নিজের হাতে শুরু করলেও, তার যতটা না সফল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে ব্যর্থ হবার ঝুঁকি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুরু করার প্রথম ২ বছরের মধ্যেই প্রায় ৯০% স্টার্ট আপ ব্যর্থতায় ডুবে যায়।
কোনো ব্যবসাকেই আসলে সম্পূর্ণ নিশ্চিত বা ফিউচার প্রুফ বলা যায় না। কখনো না কখনো সমস্যার মুখোমুখি হতেই হয়, ছোট হোক বা বড়, সব ধরনের স্টার্ট আপই কমবেশি ক্ষতির মুখোমুখি হয়। তবে আমরা চাই, আমাদের স্টার্ট আপ যেন ব্যর্থ না হয়, এটা নিশ্চিত করতে আমরা কী করতে পারি? করার মত অনেক কিছুই আছে, তবে শুধুমাত্র সফলতার দিকে না তাকিয়ে ব্যর্থতাগুলো দেখা পেতে পারে। সফল স্টার্ট আপ অবশ্যই আমাদের লক্ষ্য হবে, তবে তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ স্টার্ট আপ গুলোর কাহিনী ও জানতে হবে। কী কারণে সেগুলো ব্যর্থ হল, প্ল্যানিংয়ে ভুল ছিল কিনা, বা প্রোডাক্ট নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছিল কিনা এরকম অনেক কারণই থাকতে পারে।
বেশিরভাগ স্টার্ট আপ কীভাবে ব্যর্থ হয়?
সফল স্টার্ট আপগুলো কীভাবে তাদের সফলতা পায়, এ নিয়ে অনেক গবেষণা ও আলোচনা হলেও, ব্যর্থ স্টার্ট আপগুলো ঠিক কীভাবে বা কেন ব্যর্থ হয়, এ সম্পর্কে খুব বেশি আলোচনা হতে শোনা যায় না। কিন্তু একটা নতুন পদক্ষেপ নিতে হলে দুটো সম্পর্কেই ধারণা থাকা জরুরী।
উদাহরণ হিসেবে আমরা একসময়ের বিখ্যাত কোম্পানি ইয়াহুর কথা মনে করতে পারি। ইয়াহু নিউজ, মেইল, সার্চ ইঞ্জিন সবগুলোই ছিল অত্যন্ত সফল ও পরিচিত। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবার জটিলতা ও বিভিন্ন ভুলের কারণে ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের।
এ থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি, একটা স্টার্ট আপ, কোম্পানি বা পদক্ষেপ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ছোট বড় ভুলের কারণে এক ধাক্কায় শেষ হয়ে যেতে পারে অনেক দিনের পরিশ্রম। তবে সব ব্যর্থতা কিন্তু সমান নয়, সবার পরিস্থিতিও একরকম থাকে না। এক একটা স্টার্ট আপ বা বিজনেসের ব্যর্থতার পিছনে একেকরকম কারণ থাকে। কোনোটায় হয়ত প্ল্যানিং এ ভুল থাকে, কোনোটায় মার্কেটিং এ, আবার কোনোটা প্রোডাক্টের মধ্যেই ভুল থাকে। যেসব ভুলের জন্য অনেক বড় করে শুরু করা স্টার্ট আপও ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে, এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ নিয়েই আজকে আমরা আলোচনা করব।
১. প্রোডাক্ট মার্কেট ম্যাচ না হওয়া
বেশিরভাগ রিসার্চ বলে, মার্কেটে প্রয়োজন না থাকা স্টার্ট আপ ফেইলিওর এর সবচেয়ে বড় কারণ।
মনে করুন, আপনি নতুন কোনো প্রোডাক্ট আসা নিয়ে খুব আগ্রহী, তার চমৎকার ডিজাইন, নজরকাড়া লুক আর ঝাঁ চকচকে ডিজাইন আসার আগেই আপনার মন কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু প্রোডাক্টটা আসার পর দেখতে পেলেন, এটা তেমন একটা দরকারি নয়। খুব গুরুত্বপূর্ণ বা উল্লেখযোগ্য কোনো কাজে লাগে না। অথবা এর কমদামি অল্টারনেটিভ রয়েছে। তখন নিশ্চয়ই আপনি সেটা আর টাকা খরচ করে কিনতে চাইবেন না?
উদাহরণ হিসেবে আমরা গুগল গ্লাসের কথা বলতে পারি। গুগল যখন যথেষ্ট পরিচিতি আগে থেকেই পেয়েছে, তখন ২০১৩ সালে গুগল রিলিজ করে স্মার্ট গ্লাস ক্যাটাগরির প্রোডাক্ট গুগল গ্লাস। মোটামুটি সবাই তখন ধরে নিয়েছিল ভবিষ্যতে এরকম প্রোডাক্টেরই জয়জয়কার হবে! সায়েন্স ফিকশন মুভি ও টিভি শো তে এ ধরনের প্রোডাক্টই তো আমরা ব্যবহার করতে দেখেছি। কিন্তু এত হাইপ তোলা আর ভরসা জাগানোর পরও গুগল গ্লাস কেন ব্যর্থ হলো?
এর একটা বড় কারণ হলো, তখনকার সময়ে এই প্রোডাক্টের খুব একটা দরকার বা ব্যবহার ছিল না। গুগল গ্লাস যে ধরনের কাজ করে, তা যে কেউ ক্যামেরা বা এন্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করে করতে পারে। এছাড়াও এটাকে ফ্যাশনেবল নয়, এবং প্রাইভেসি কনসার্ন বলেও ক্রিটিসাইজ করা হয়। সাধারণ গ্লাসের চাইতে ওজনে ভারি হওয়ায় খুব একটা ইউজার ফ্রেন্ডলিও ছিল না এই প্রডাক্ট। এটির দামও ছিল প্রায় ১,৫০০ ডলার, সাধারণ ক্রেতাদের সামর্থ্যের অনেক বাইরে। সব মিলিয়ে প্রোডাক্ট মার্কেট ম্যাচ না হওয়ায় এবং লসের মুখোমুখি হওয়ায় ২০১৫ সালে গুগল এর প্রোডাকশন বন্ধ করে দেয় এবং মার্কেট থেকে ডিসকন্টিনিউড ঘোষণা করে।
অপরদিকে, প্রোডাক্ট মার্কেট ম্যাচ না করলেও, ভিন্নভাবে মার্কেটিং করে কীভাবে প্রোডাক্ট হিট করে দেয়া যায়, এর উদাহরণও আছে। বাবল র্যাপের মতো সিম্পল একটা প্রোডাক্টই কীভাবে মার্কেটে জনপ্রিয়তা পেল, এটাও আমরা দেখতে পারি। বাবল র্যাপ এর প্রথম মার্কেটিং করা হয় টেক্সচারড ওয়ালপেপার হিসেবে, কিন্তু মার্কেটে এটা তেমন একটা চলেনি। এরপর এটাকে গ্রিন হাউজে ইনসুলেটর বা তাপ ধরে রাখার প্রোডাক্ট হিসেবে মার্কেটে তোলার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সেটাও সফলতা পায়নি। অবশেষে ১৯৫৯ সালে কম্পিউটার ও টেকনোলজিক্যাল প্রোডাক্টের সেনসিটিভ ও ভঙ্গুর পার্টস ট্রান্সপোর্টের জন্য একে প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হয় টেস্ট পারপাসে। তারপর থেকে বাবল র্যাপ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্যাকেজিং প্রোডাক্টের একটি।
কাজেই, মার্কেটে প্রয়োজনীয়তা আছে এমন প্রোডাক্ট বানাতে হবে, কারণ দিনশেষে কাস্টমারের কাছে শুধুমাত্র প্রোডাক্টের ব্যবহারিতাই মুখ্য।
২. ঠিকমতো প্ল্যানিং ও এক্সিকিউশন এর অভাব
“প্ল্যানিং অ্যান্ড এক্সিকিউশন” আমরা সবসময় একসাথেই দেখি। কারণ প্ল্যান যতই শুনতে ভালো শোনাক, ঠিকঠাক এক্সিকিউশন না হলে সেই প্ল্যানের কোনো কার্যকারিতা নেই, একইভাবে এক্সিকিউশন ঠিকমতো হলেও প্ল্যানেই যদি ভুল থাকে, তাহলে পরিশ্রমই হয় বেকার। তাই, সফলতা চাইলে প্ল্যানিং ও এক্সিকিউশন, দুইটাতেই ভালোভাবে নজর দিতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি নোকিয়া ব্র্যান্ডের কথা। মোবাইল ফোনের জগতে নোকিয়ার কথা কে না জানে! নব্বই দশকে মোবাইল ফোন বলতেই মানুষ বুঝতো নোকিয়া। এমনকি মানুষ কৌতুকও করে যে, দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলেও নোকিয়ার কিছু হবে না, হাতুড়ি দিয়ে নোকিয়া ফোনকে আঘাত করলে হাতুড়িই ভেঙে যাবে। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল মার্কেট দখল করে নেবার আগ পর্যন্ত নোকিয়াই ছিল মোবাইলের জন্য সবার এক নম্বর পছন্দ। তাহলে? কখন কীভাবে নোকিয়া সবার আড়ালে চলে গেল?
নোকিয়ার প্রধান ভুল ছিল ইনোভেশনকে সিরিয়াসলি না নেয়া এবং সে অনুযায়ী প্ল্যান না করা। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি অ্যাপল প্রথম আইফোন রিলিজ করে, এবং তার কয়েকমাস পরেই HTC dream নামে প্রথম অ্যান্ড্রয়েড বাজারে আসে। নোকিয়া তখনো অ্যান্ড্রয়েড কনসেপ্টকে সিরিয়াসলি নেয়নি। অবশেষে ২০০৮ সালের ২ ডিসেম্বর নোকিয়া হাই এন্ড স্মার্টফোন জগতে n97 মডেল রিলিজ করে। কিন্তু আগে থেকেই পিছিয়ে যাওয়ায় নতুন করে আর কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। তাদের মূল কম্পিটেটর স্যামসাং এর মাঝে অনেক এগিয়ে যায়। নোকিয়া মূলত হার্ডওয়্যার এর দিকে ফোকাস করতে গিয়ে সফটওয়্যার ও টেকনোলজির দিকে গুরুত্ব দিতে ভুলে যায়। ফলে যে গতিতে নতুন নতুন টেকনোলজি ও ফিচার স্মার্টফোনে যুক্ত হচ্ছিল, নোকিয়া তার সাথে তাল মিলাতে পারেনি। যে কারণে এখন আর আগের মতো নোকিয়ার জয়জয়কার নেই। সুতরাং প্ল্যানিং ও এক্সিকিউশন ঠিকভাবে না করার কারণেই নোকিয়া এই দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে এবং নিজেদের বিশাল কাস্টমার বেস হারিয়ে ফেলেছে।
আবার, এর ঠিক অপরপিঠটাও সমানভাবে সত্যি ও কার্যকর। চমৎকার প্ল্যানিং ও এক্সিকিউশন এর বদৌলতে অনেক কোম্পানি এগিয়ে গেছে এক লাফে কয়েকধাপ। এর একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল স্পটিফাই। স্পটিফাই এর বেশ সুনাম আছে ইউজারদের এক্টিভিটি খেয়াল করে সেই অনুযায়ী সাজেশন ও মার্কেটিং দেয়া। স্পটিফাই এর অনেকরকম পদক্ষেপের মধ্যে একটি হল ‘এন্ড অফ দ্য ইয়ার’ ক্যাম্পেইন। তাদের সবচেয়ে কার্যকর মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির মধ্যে এটা একটা, এবং সব ধরনের গ্রাহকদের কাছে এটা অনেক পরিচিতি ও ভালোবাসা পেয়েছে।
মূলত এই ক্যাম্পেইনে প্রত্যেক ইউজার তার সারা বছরের এক্টিভিটির উপর ভিত্তি করে করা একটা পার্সোনাল প্লেলিস্ট পায়। এটি গ্রাহকদেরকে পার্সোনাল লেভেলে কানেক্ট করে ও হাজার হাজার ফলোয়ারকে একইসাথে স্পেশাল ফিল করায়, যার ফলে ফ্রিতেই একটা মার্কেটিং হয়, একই সাথে কাস্টমার লয়ালটি বাড়ে। তাই, আইডিয়া যতই লোভনীয় হোক, প্ল্যানিং ও এক্সিকিউশন এ ভুল করলে রেজাল্ট খারাপ হবেই।
৩. একটি ভালো টিম ও লিডারশিপের অভাব
আপনার আইডিয়া বা কাজ যতই ভালো হোক, যদি আপনি একটি দক্ষ টিম বিল্ড আপে ব্যর্থ হন, তাহলে আপনার ঠিকঠাক করা কাজও নষ্ট হয়ে যাবে। আপনার টিম হতে হবে কাজের প্রতি প্যাশনেট, কমিটেড, এবং যে কাজের জন্য হায়ার করা হচ্ছে সে সংক্রান্ত দক্ষতা থাকতে হবে।
আপনি শুনলে অবাক হতে পারেন, তবে প্রায় ৩০% এরও বেশি স্টার্টআপ ফেইল করে, কারণ তাদের ম্যানেজমেন্ট টিম বিভিন্ন ইস্যু হ্যান্ডেল করতে পারে না।
টিম বিল্ডিং এর ক্ষেত্রে কিছু জিনিস আপনার খেয়াল রাখতে হবে। এগুলো হলো যাদেরকে হায়ার করছেন তাদের মধ্যে বিশেষ কিছু গুণাবলি থাকা। এর মধ্যে সবার প্রথমেই আসে আগ্রহ। যাকে হায়ার করা হবে, আসলেই এ ধরনের কাজে আগ্রহী কিনা, উৎসাহ নিয়ে কাজ করছে কিনা এগুলো খেয়াল রাখতে হবে। একই সাথে এ ধরনের কাজে সে দক্ষ কিনা, যে পরিমাণ জ্ঞান দরকার তা তার আছে কিনা। যদি দক্ষ কাউকে দলে নিতে পারেন তাহলে আরো ভালো হয়। আগে থেকেই যার দক্ষতা আছে, সে আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারবে। টাকা বাঁচানোর জন্য অদক্ষ কাউকে নিয়োগ দেয়া হলে, সাময়িকভাবে আপনার খরচ কম হলেও পরবর্তীতে এই একটা ভুলই হতে পারে সম্পূর্ণটা ধ্বসে পড়ার কারণ।
উদাহরণ হিসেবে আমরা মাইস্পেস এর কথা বলতে পারি। ফেসবুক দুনিয়া জুড়ে বিখ্যাত ও প্রচলিত হবার আগে সোশ্যাল মিডিয়া বলতে সবাই মাইস্পেসকেই বুঝত। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা বা পরিচিতি কোনোটাই এখন আর টিকে নেই। কোন ভুলের কারণে মাইস্পেস এমন পিছনে পড়ে গেল? উত্তরটা হচ্ছে এর ভুল মানেজমেন্ট এবং ঠিকমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারার অক্ষমতা। ফেসবুক মাইস্পেসের প্রাথমিক কম্পিটেটর ছিল, একে প্রথমে পাত্তা না দেয়া, পরে কপি করার চেষ্টা করা, সবশেষে নিজেদেরকেই বদলে ফেলার চেষ্টা ছিল মাইস্পেসের স্ট্র্যাটেজিক ভুল।
মূলত মাই স্পেস এর প্রধান ইনকাম সোর্স ছিল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট সার্ভিস থেকে। তাই পার্টনার এবং ইনভেস্টররা এইদিকে বেশি গুরুত্ব দিতে মাই স্পেস কে তাগাদা দেন। অতিরিক্ত এডের কারণে নিয়মিত ইউজাররা বিরক্ত হয়ে পড়ে এবং মাইস্পেস ছেড়ে দিতে থাকে। এছাড়াও টেকনিক্যাল সাইডে মাই স্পেস অনেক পিছিয়ে ছিল। এর পার্টনার ও ইনভেস্টররা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ায় এত জনপ্রিয় একটা প্ল্যাটফর্ম মুখ থুবড়ে পড়ে।
আবার ফেরত যাই সফলতায়। টিমওয়ার্কের সফলতার উদাহরণ আমাদের আশেপাশে হাজার হাজার। তবে এখানে এমন একটা উদাহরণ দেয়া হবে, যেটা একই সাথে মানবজাতির উন্নতির একটা চূড়ান্ত মাইলস্টোন অতিক্রম করেছে, এবং প্রযুক্তিকে এগিয়ে দিয়েছে কয়েক ধাপ। হ্যা, এখানে এরোপ্লেন আবিষ্কর্তা দুই ভাই উইলভার রাইট ও অরভিল রাইট এর কথাই বলা হচ্ছে। এটা খুব আধুনিক বা রিসেন্ট কোনো উদাহরণ নয়, তবে মানবসভ্যতার ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। এই দুই ভাই মূলত ছিলেন টিম ওয়ার্ক এর এক অনন্য উদাহরণ।
অত্যন্ত কম বয়সে নিজেদের বাইসাইকেল শপ থেকে তাদের শুরুটা হলেও, শেষটা গিয়ে ঠেকেছে আকাশে, রীতিমত আকাশেই!শুরু করেছিলেন সেলফ অয়েলিং বাইসাইকেল বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে, আর শেষটা ছিল মহাকাব্য! রাইট ব্রাদারস সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, টিমওয়ার্কের জোরে মহাকর্ষ অভিকর্ষকেও বুড়ো আঙুল দেখানো যায়।
সুতরাং, টিম ওয়ার্ক মেকস দ্য ড্রিম ওয়ার্ক। বড় কিছুতে পা বাড়াতে হলে, একটি স্ট্রং টিমের গুরুত্বকে কখনোই কম ভাবা যাবে না।
৪. ফাইন্যান্সিয়াল মিস ম্যানেজমেন্ট
ফাইন্যান্সিয়াল মিস ম্যানেজমেন্ট একটা নতুন বিজনেসের জন্য একদম চোরাবালির মত মরণফাঁদ হয়ে উঠতে পারে। ঠিকঠাক ফাইন্যান্সিয়াল ব্যাক আপ পাওয়া এবং সেটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে ভালো রেজাল্ট আনতে পারা একজন উদ্যোক্তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজে ব্যর্থ হলে বিজনেস ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, এমনকি অনেক বিজনেস শুধু মাত্র এই কারণে বেশ বড় লসে পড়েছে এবং বন্ধও হয়ে গেছে।
ফান্ড নিয়ে অব্যবস্থাপনা হলে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়, যা বড় হয়ে বিজনেসকে শেষ করে দিতে পারে। যেমন প্রোডাকশনে ব্যাঘাত ঘটা, মার্কেটিং ঠিকমত না করতে পারা, কম্পিটিশনে পিছিয়ে পড়া, প্রোডাক্টের কোয়ালিটিতে কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি।
ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট ঠিকঠাক ভাবে করার জন্য প্রথমেই যেটা দরকার, সেটা হল সম্ভাব্য সব খরচ লিস্ট করা, এবং প্রায়োরিটি অনুযায়ী প্ল্যানিং। কোনো দিকে ফান্ড নিয়ে সমস্যা হলে তার কোনো ক্রিয়েটিভ সমাধান খুঁজে বের করা, ঠিকমত সব দিকের খরচ ম্যানেজ করতে পারা, ব্যবসার কোন খাতটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোন খাতে কতটুকু খরচ করতে হবে এসব ব্যাপারে সঠিক হিসাব ও বরাদ্দ থাকতে হবে।
ফান্ডিং ঠিক মত ম্যানেজ না করতে পারলে কি হয় সে উদাহরণ আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই বেশ কিছু ফেইলড স্টার্ট আপ ফলো করলে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্রাউডমিক্স। ২০১৩ সালে শুরু করা এ স্টার্ট আপটি মিউজিক স্ট্রিমিং, শেয়ারিং এবং ব্যান্ড এর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য বানানো হয়েছিল, এবং এর বেটা ভার্সন শুধুমাত্র ইনভাইট অনলি এবং মিউজিশিয়ান ও ডিজে দের সাথে কোলাব করে করা হয়েছিল। ফাইন্যান্সিয়াল মিস ম্যানেজমেন্ট এমনই এক জিনিস, যে মাত্র তিন বছরের মাথায় ২০১৬ সালে অ্যাপের অফিশিয়াল ভার্সন রিলিজ করার আগেই স্টার্ট আপ বন্ধ হয়ে যায় এবং কোম্পানির নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে।
এর পিছনে কারণ ছিল ফান্ডিং এর অপচয় এবং বেখেয়ালি ব্যবহার। ভালোভাবে অ্যাপ রিলিজ করা এবং কোনো রকম প্রফিট আসার আগেই কোম্পানি বড় করতে, এবং জাঁকজমক দেখাতে গিয়ে ক্রাউড মিক্স খরচ করে ফেলে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার। বিশাল অফিস নেয়া, তাতে রাজকীয় ডেকোরেশন করা, অ্যাপ রিলিজ ও ট্রায়ালের আগেই বারবার নতুন ফিচার যুক্ত করতে থাকা, অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত স্টাফ হায়ার করা, কোম্পানির ইমেজ রক্ষার্থে বড় বড় প্রয়োজনীয় খাতে খরচ করা এসব করে তারা প্রায় পুরো ফান্ডিংই শেষ করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত কোম্পানির সিইও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, এবং আর কোনো ইনভেস্টর আগ্রহী না হওয়ায় কোম্পানি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে, অবশেষে বন্ধ হয়ে যায়।
আবার যদি প্ল্যানিং ঠিকঠাক থাকে, এবং ম্যানেজমেন্ট ভালো হয়, তাহলে ফান্ডিং কম হলেও তাকে বাড়ানো যায়। এর উদাহরণ হিসেবে আরেকটি সোশ্যাল মিডিয়ার কথাই বলা যাক। রেডিট এর নাম আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। মানুষ বিভিন্ন পার্সোনাল অভিজ্ঞতা, প্রশ্ন, চিন্তাভাবনা সেখানে শেয়ার করে এবং কমিউনিটিও গঠন হয়। কিন্তু, রেডিটের শুরুটা কি এত বড় ও জনপ্রিয় ছিল? উত্তর হচ্ছে, না। ২০০৫ সালে তরুণ দুই উদ্যোক্তা নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে রেডিট শুরু করেন। উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি ফোরাম তৈরি করা, যেখানে মানুষ নিরাপদে ও নিঃসংকোচে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে। তাদের স্বল্প ফান্ডই তারা ফোরামটাকে সুন্দর করতে ব্যবহার করেন। এমন একটি প্ল্যাটফর্ম বানান যেটা ব্যবহার করতে সহজ, বড় কোনো জাঁকজমক নেই, এবং যেখানে ব্যবহারকারীরা ইজি হতে পারবেন। ছোট পরিসরে শুরু হওয়া থেকে বর্তমানে বিশ্বের টপ লেভেলের অনলাইন কমিউনিটি প্লাটফর্ম গুলোর মধ্যে রেডিট একটি অন্যতম নাম হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালে এর ভ্যালু ছিল প্রায় দশ বিলিয়ন ডলার।
৫. প্রোপার মার্কেট রিসার্চের অভাব
যেকোনো বিজনেস বা স্টার্টআপ ওপেন করার আগে সর্বপ্রথম ধাপ হচ্ছে প্রপারলি মার্কেট রিসার্চ করা। এটা একদম হোমওয়ার্কের মত, না করলে সফলতার হার প্রায় শূন্য। মার্কেট রিসার্চ বলতে শুধুমাত্র কারেন্ট মার্কেটে কী প্রোডাক্ট চলছে তা নয়, বরং যে প্রোডাক্ট নিয়ে আমি কাজ করতে চাইছি সেটা সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করা, সাপ্লাই চেইন নিয়ে ঠিকঠাক ধারণা থাকা, যদি ফিজিক্যাল প্রোডাক্ট হয় তাহলে সেই প্রোডাক্টের প্রোপার সোর্সিং করতে পারা, কোনো সমস্যার মুখোমুখি হলে অল্টারনেট সলিউশন বের করতে পারা এর সবগুলোই মার্কেট রিসার্চ এর মধ্যে পড়ে। মার্কেট রিসার্চ না করলে স্টার্ট আপের প্রতি ধাপে ধাপে ব্যর্থতার আশঙ্কা বাড়তেই থাকে।
মার্কেট রিসার্চ এর অভাবে সফল ব্যবসাও যে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে তার একটা উদাহরণ নিয়ে আমরা কথা বলি। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ান তরুণী নিকি দুরকিন তার নিজস্ব ফ্যাশন এপ্লিকেশন লঞ্চ করেন নাইন্টি নাইন ড্রেসেস নামে। এটা মূলত ভার্চুয়াল মডেল ক্লোজেট টাইপের বিজনেস ছিল যার মূল লক্ষ্য ছিল এক দুইবার ব্যবহার করা সেকেন্ড হ্যান্ড ডিজাইনার ড্রেস সেল করার একটা কমিউনিটি হওয়া। প্রথম বছর বেশ সফল ছিল নাইন্টি নাইন ড্রেসেস, এবং বেশ ভাল প্রফিটও এসেছিল। কিন্তু তাহলে কেন এই স্টার্ট আপটা ফেল করল? কারণ হচ্ছে, টেক বিজনেস সম্পর্কে নিকির ধারণা খুব কম ছিল। বড় হওয়ার সাথে সাথে অ্যাপ কন্ট্রোলে যেমন কমপ্লিকেশন বাড়তে থাকে, তারই সাথে অন্যান্য সমস্যাও দেখা দেয়। যেমন, শিপিং। নাইন্টি নাইন ড্রেসেস অস্ট্রেলিয়া বেসড প্লাটফর্ম হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া এবং ইউএসএ এর মধ্যে প্রোডাক্ট শিপিংয়ে তাদের ঝামেলায় পড়তে হয়। সব মিলিয়ে যতটুকু জনপ্রিয়তা বেড়েছিল, সে অনুসারে লাভ হচ্ছিল না। নিকি একাই এটা মেনটেইন করতে গিয়ে বিপদে পড়েন, অবশেষে ২০১৪ সালে প্ল্যাটফর্মটি বন্ধ করে দিতে হয়।
মুদ্রার ঠিক উল্টো পিঠে আছে চায়না বেসড হোলসেল মার্কেট আলিবাবা। ১৯৯৯ সালে চীনের ছোট এবং মাঝারি ব্যবসা গুলোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম খুলতে চেয়েছিলেন জ্যাক মা। তার এই স্বপ্ন থেকেই আলিবাবার জন্ম। ছোট পরিসরে শুরু করেও তার লিডারশিপ, বুদ্ধিমত্তা এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ায় আলিবাবা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ই কমার্স প্ল্যাটফর্ম গুলোর একটি। চীনের বিশাল বাজার কে কাজে লাগিয়ে সহজেই পরিসরে নিতে পেরেছিলেন জ্যাক মা। তোমার চাহিদায় প্রথমে বিজনেস টু বিজনেস স্ট্রাটেজিকে কাজে লাগিয়ে হোলসেলারদের সাথে রিটেলারদের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া হয় আলিবাবায়। মডেল সফল হওয়ার পরে ধীরে ধীরে খুচরা কাস্টমারের প্রতি মনোযোগ দেয় আলিবাবা এবং taobao, tmall এগুলো চালু করে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের কাঁচামাল সোর্সিং করে আলিবাবা থেকে। সময়ের প্রয়োজনে মার্কেট রিসার্চ, এবং সে অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদের এগিয়ে রাখাই আলিবাবা কে অরণ্য করেছে এবং এক ধাক্কায় তাদের বিজনেস মডেল কে ফেলে দিয়েছে অনেক দূর। এ থেকেই বোঝা যায় অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার প্রভাব ঠিক কতখানি।
সবশেষে বলা যায়, স্টার্ট আপ ব্যর্থ হওয়া মানেই সবকিছু একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বরং ব্যর্থতা থেকেও শেখার আছে অনেক কিছুই। এমনকি, অনেক বড় বড় বিজনেস আছে, যারা এরকম ভুলে সাময়িকভাবে পিছিয়ে পড়লেও, পরবর্তীতে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে গেছে, এবং অনেক বেশি সফলতা অর্জন করেছে। বলা হয়, ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অফ সাকসেস, ব্যর্থ হতে হতেই সফলতা এক সময় ধরা দেয়। তাই, হতাশ না হয়ে ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার মাধ্যমেই আরো বড় সফলতা ধরা দেবে।