ব্যবসা তো ভালোই হচ্ছে, তবু ম্যানেজমেন্টের কারণে কর্মীরা কেন চাকরি ছেড়ে দেয়?

একজন ব্যবসায়ী হিসেবে ভালো কর্মীদের গুরুত্ব সম্পর্কে আপনি ভালোই জানেন। কারণ তাদেরকে সহজে যে খুঁজেও পাওয়া যায় না! তবে এমন কর্মীদের শুধু সময়মতো বেতন দিয়েই আটকে রাখা যায় না। কর্মীরা কেন আপনার সাথে কাজ করবে? কেন আপনার প্রতিষ্ঠানের ভালোর জন্য দিনরাত খাটবে? কারণ তাদেরকে টাকার পাশাপাশি আরও সুবিধা দিতে হবে। যদি এমন না হয়, অথবা ম্যানেজমেন্ট বা লিডারশীপ খারাপ হয়, তাহলে আপনি আপনার সবচেয়ে গুণী কর্মীদের হারিয়ে ফেলবেন।

খারাপ ম্যানেজমেন্ট ও লিডারশীপের কারণে কেন চাকরি ছাড়া হয়?

বসের সাথে কর্মীর সম্পর্কের কারণে সম্পর্ক ভালোও হতে পারে, আবার ভেঙেও যেতে পারে। একজন ম্যানেজার চাইলে কাজের পুরো মহলকে আনন্দময় করে রাখতে পারে। আবার অন্যদিকে, বস ভালো না হলে অফিস যত বড়ই হোক না কেন, কাজ করাটা বোঝা মনে হয়।

যে কোনো কর্মক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট ভালো হওয়া খুব জরুরি। শুধু কর্মীদেরই না, পুরো ব্যবসাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটার দরকার। বস নিজেও যদি নিজের মধ্যে খারাপ ম্যানেজমেন্টের অভ্যাসগুলো রপ্ত করে থাকেন, তাহলে তাতেও ব্যবসার ক্ষতি হতে পারে। যদি আমরা ছোট ব্যবসার কথা বলি, তাহলে বলতে হয় কর্মীদের প্রতিদিনের জীবনে বসদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। খুব কঠিন কোনো অ্যাকশনের কারণে টিম মেম্বারদের আচরণ থেকে শারীরিক অবস্থা- সবখানেই এফেক্ট পড়তে পারে। যদি এফেক্টগুলো নেগেটিভ হয়, তাহলে খুব কম চান্স আছে কর্মক্ষেত্রে তাদের রয়ে যাওয়ার।

কর্মক্ষেত্রে বস যা চান সেটাই কর্মীদের করতে হয়। কাজে যোগদান করার পর যদি তাদের চাওয়া পূরণ না হয়, তাহলে বেশিদিন তারা কাজ করতে পারেন না। বিশেষ করে বস যদি তাদের সামগ্রিক ভালোলাগার উপর দখলদারিত্ব করেন, সেক্ষেত্রে রিজাইন দেয়ার চান্স বাড়ে।

কীভাবে বোঝা যায় যে কর্মীরা ভালো নেই?

  • যদি তারা সব সময় স্ট্রেসড থাকে
  • ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স ঠিক না থাকলে
  • তাদের এফোর্ট প্রশংসা না পেলে
  • একে অন্যের প্রতি যত্নবান না হলে
  • ওয়ার্কপ্লেসে নিরাপদ বোধ না করলে

বেশিরভাগ কর্মী মনে করেন, খারাপ ম্যানেজমেন্টের সাথে কাজ করার জন্য জীবনে সময় খুব কম। এবং এটাই সত্যি। বস চমৎকার হলে কাজের পরিবেশও চমৎকার হয়, দুর্দান্ত সব কাজ করা যায় সবাই মিলে। যদি এমনটা না হয়, তাহলে তারা চলে গেলে তাদেরকে কি সত্যিই কোনো দোষ দেয়া যায়?

ক্ষুদ্র ব্যবসায় ম্যানেজমেন্ট ভালো না- কীভাবে বুঝবেন?

একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে আপনার কাজ হচ্ছে কর্মীদের সাথে সঠিক আচরণ করা। যদি আপনার মাঝে ম্যানেজমেন্টের ভালো গুণাবলী না থাকে, তাহলে ধরে নিন আপনি নিজেই আপনার কর্মীকে নতুন জায়গায় চলে যাওয়ার জন্য বাধ্য করছেন। ম্যানেজমেন্ট যে ভালো নয় সেটা বোঝার জন্য কয়েকটি পয়েন্ট সম্পর্কে চলুন জেনে নেয়া যাক।

১) কি ম্যাট্রিক না বোঝা

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হলেও আপনাকে একজন কর্মী নিয়োগ দিতে হবে কাস্টমারের চাহিদা পূরণ করার জন্য। সার্ভিস দেয়ার মাধ্যমেই ব্যবসা ধীরে ধীরে বড় হয়। একটা নতুন প্রোডাক্ট লাইন বা অ্যাসেটের মতো, নতুন কর্মীও রেভেনিউ অ্যাড করতে পারে। কর্মী হয়ত নিজে সেটা সরাসরি বিক্রি করতে পারে অথবা অন্য যে কর্মী বিক্রি করতে পারে তার কাছে নিয়ে যেতে পারে। একে বলা যায় রেভেনিউ পার ফুল টাইম ইকুইভ্যালেন্ট। কোম্পানির টোটাল রেভেনিউ থেকে এর ফুল টাইম ইকুইভ্যালেন্ট দিয়ে ডিভাইড করে এটিকে হিসেব করতে হয়। এটার মাধ্যমে বোঝা যায় কর্মীরা নিয়মিত কতটুকু রেভেনিউ এনে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে কর্মীদের ইফেক্টিভনেস বোঝা যায়। ইফেক্টিভ ইমপ্লয়ী মানে ওয়েল ট্রেইনড আর রাইট পজিশনে থাকে তারা। ব্যবসায়ীদের এই কি ম্যাট্রিকস বোঝা জরুরি।

২) যদি টিম মেম্বাররা অতিরিক্ত কাজ করে

একদিকে বস যদি চান অফিসে এমন কর্মী থাকুক যারা চমৎকার কাজ করবে, তাহলে তাদের কাজের ফ্লেক্সিবিলিটি থাকা প্রয়োজন। যে কর্মীরা ওভারলোড নিয়ে কাজ করে তারা অল্প সময়েই ব্যাকফায়ার করে। এতে প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়, স্ট্রেস বাড়ে, অসন্তোষ তৈরি হয়। সেই সাথে যদি দায়িত্ব বাড়ে, প্রমোশন না হয়, লোকে অল্পতেই হতাশ হয়ে যাবে। এজন্য অফিসে যদি ওভারলোড নিয়ে কাজ করা কর্মী থাকে তাহলে ব্যাড ম্যানেজমেন্টের অনেক বড় একটি উদাহরণ এটি।

কর্মক্ষেত্রে আপনি আপনার কর্মীর সাথে সঠিক আচরণ করছেন কিনা এটা আগে নিশ্চিত করুন। মাঝে মাঝে চেক করুন, তাদেরকে যে কাজ দেয়া হয়েছিল সেটা তারা নিয়মিত করছে কিনা। কর্মী যখন হতাশ হয়ে যাবে তখন আপনার কাছে এলে যেন তারা আরাম বোধ করে এমন পরিস্থিতি আপনাকেই তৈরি করতে হবে। সবাই মিলে কাজের চাপ কমানোর চেষ্টা করুন, সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজে বের করুন। এতে করে কর্মীদের মাঝে দারুণ বন্ডিং তৈরি হবে।

৩) ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়া

কর্মীদের সাথে কাজের মাধ্যমে সময় কাটালে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী পণ্য উৎপাদন ও টাকা তৈরির দিকে এতটাই মনোযোগী হন যে, কর্মীদের জানার সুযোগই পান না। কারণ তাদের কাছে কর্মীদের কোনো গুরুত্বই নেই। আর দিনশেষে এসবের কারণে সম্পর্ক তো খারাপ হয়ই, পরিবেশ হয়ে ওঠে টক্সিক, ফলাফল দিন দিন খারাপ হতে থাকে।

আপনি যদি একজন বস হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে যা যা করতে হবে-

  • শেখাতে হবে
  • ট্রেনিং দিতে হবে
  • মেন্টর হতে হবে
  • লিড দেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে
  • ডেভেলপ করতে হবে
  • ইমপ্লিমেন্ট করতে হবে
  • রেজাল্ট আনতে হবে

আর ভুলে যাবেন না, যারা আপনার ব্যবসার জন্য কাজ করে যাচ্ছে, তারা শুধু কর্মী নয়- তারাও মানুষ।

৪) ভুল মানুষকে পুরস্কৃত করা

প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে কর্মীরা চাবেই তাদের কাজ প্রশংসিত হোক। সেটা যত ছোটই হোক না কেন। আবার কাজ অনুযায়ী বড় কিছুও হতে পারে, যেমন- প্রমোশন। কর্মীরা যদি সঠিক কাজের মূল্যায়ন পায়, তাহলে তাদের কাজের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। আর এটাই হওয়া উচিত। শুধু নিজেদের পছন্দের লোক, পরিশ্রমীদের মূল্যায়ন না করা, ভুল মানুষকে নিয়োগ ও প্রমোশন দেয়া যে কোনো কর্মক্ষেত্রকেই সাংঘর্ষিক করে তুলতে পারে।

এটা যে কোনো ভেন্ডর বা তৃতীয় পক্ষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে। আপনার কর্মীর নীতি কেমন হবে সেটা কোনো তৃতীয় পক্ষ যেন নির্ধারণ করতে না পারে। আপনার সাথে যারা কাজ করছে তারা শুধু আপনারই টিম। আর তাদেরকে আপনিই সবচেয়ে ভালো জানেন। তাই নিজে সিদ্ধান্ত নিন তাদের ভালো মন্দের ব্যাপারে।

৫) কর্মীদের উৎসাহ না দেয়া

যে ব্যবসায়ীরা তাদের কর্মীদের নতুন কাজের ব্যাপারে উৎসাহ দেয় না, কাজ শেখার স্বাধীনতা দেয় না বা নতুন স্কিল শিখতে আগ্রহী করে না – তাদের কর্মীরা কখনো ভালো ফিডব্যাক এনে দিতে পারে না। ব্যবসার জন্য কী জরুরি আর কী নয়, সেটা তারা বুঝতে পারে না। কর্মীদের যদি স্বাধীনতা ও শেখার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে তারা নিজেদের উন্নতি করতে পারে, কোম্পানির জন্য দারুণ সুযোগ তৈরি করতে পারে, সর্বোপরি কর্মক্ষেত্রে কাজ করা নিয়ে তাদের আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। যদি আপনি বস হয়ে এই কাজগুলো না করেন, তাহলে তারা কখনোই মোটিভেটেড হবে না। দিনে দিনে তারা কাজের প্রতি আগ্রহ হারাবে, রিজাইন দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবে।

৬) যোগাযোগে অনীহা

খারাপ ম্যানেজমেন্টের অন্যতম আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে যোগাযোগ ভালো না হওয়া। লিংকড ইনের দেয়া একটি তথ্যমতে, কর্মীরা যদি ম্যানেজমেন্টের থেকে পরিষ্কার নির্দেশনা না পায় তারা অনেক ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যায়। টিম মেম্বারদের জানা থাকতে হবে তারা এই কাজ কেন করছে, কার জন্য করছে। নইলে অনেক কনফিউশন তৈরি হবে, পারফরম্যান্স খারাপ হবে, কর্মীদের পারফরম্যান্স খারাপ হবে।

একজন ব্যবসায়ী হিসেবে, কর্মীদের শুধু ধারণা দিয়ে রাখলে চলবে না। তাদেরকে পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে তাদের কী কী করণীয় সে সম্পর্কে। প্রত্যেক কর্মীকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে হবে এবং ব্যবসার সফলতায় অবদান রাখতে হবে। আর এটা কেবল তখনই সম্ভব যখন সবাই প্রতিদিন কোম্পানির মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে ভালোভাবে জানবে।

৭) কোনো ফিডব্যাক না দেয়া

ম্যানেজমেন্ট ভালো না হওয়ার কারণে কর্মীদের মধ্যে ভালো ফিডব্যাক দেয়া যায় না বা সেই প্র্যাকটিস তৈরি হয় না। শুধু বাৎসরিক একটা রিভিউ দেয়াই সবকিছু নয়, আবার মিটিং এ শুধু বড় বড় নীতিকথা শোনানো বা সমালোচনা করাই সব নয়। কর্মীদের নিয়মিত কাজ করার জন্য কাজে মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করাতে হবে, স্কিল বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে, ভালো ফলাফল নিয়ে আসলে উৎসাহ দিতে হবে। এছাড়া তারা সেই সাপোর্ট পাবে না যার সাহায্যে তারা নিজেরা বড় হতে পারে বা ব্যবসা লাভজনক হতে পারে।

কর্মীরা যেন বছরের বিভিন্ন সময় পারফরম্যান্সের জন্য প্রশংসা পায় সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এই ফিডব্যাকই ঠিক করবে কোম্পানি কতটুকু ভালোভাবে গাইডেন্স দিচ্ছে।

কোম্পানি ব্যবসা বড় করতে চাইলে অবশ্যই কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। আর কর্মীদের ভালো থাকার জন্য পরিবেশ যেন টক্সিক না হয়, তাদের মানসিক অবস্থা যেন ভালো থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে ম্যানেজমেন্টেরই। নইলে ব্যবসা বড় করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। কর্মীরা যেন আপনাকে ছেড়ে না যায়, কোম্পানির প্রতি লয়্যাল থাকে, সেজন্য আপনি কী করছেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *