বর্তমানে ক্যারিয়ার গড়তে যেসব সফট স্কিল আপনাকে সবার চেয়ে এগিয়ে রাখে তাদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কমিউনিকেশন। প্রথনে শুনলে স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, যোগাযোগ আর এমন কঠিন কি! কিন্তু সঠিকভাবে তথ্য আদানপ্রদান করতে পারলে আপনার এই যোগাযোগ দক্ষতাই আপনাকে আর দশজনের চেয়ে কর্মক্ষেত্রে আলাদা করবে। চাকরি অথবা ব্যবসা, এমনকি পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও যোগাযোগ দক্ষতা সবার জন্যই প্রয়োজনীয়। আপনার কথা বলার ধরন, প্রকাশভঙ্গি, শারীরিক ভাষা ইত্যাদি সব মিলেই আপনার কমিউনিকেশন স্কিল প্রকাশ পায়।
কমিউনিকেশন স্কিল কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
কমিউনিকেশন স্কিল বলতে বোঝায় তথ্য আদানপ্রদানের সঠিক ক্ষমতা, যে ক্ষমতার মাধ্যমে আপনি আপনাকে দেয়া তথ্য সঠিকভাবে বুঝে নিতে পারেন এবং অন্যান্যদের যে তথ্য দিতে চাচ্ছেন তা যথাযথভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন। তথ্য আদান প্রদানে ফাঁকফোঁকর থেকে গেলে হতে পারে “মিসকমিউনিকেশন”, আর এর জন্য হয়ে যেতে পারে বড় ধরনের কোনো সমস্যা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি যদি কোনো কাজে ক্লায়েন্ট এর সাথে যোগাযোগ করেন এবং মিসকমিউনিকেশনের কারণে আপনারা একপক্ষ আরেকপক্ষের তথ্য বুঝতে না পারেন, তাহলে আপনি ক্লায়েন্ট থেকে ভুল তথ্য পাবেন, যার ফলে ক্লায়েন্ট ভুল সেবা পেতে পারে। এতে ক্লায়েন্ট স্যাটিসফেকশন আসবে না এবং কাজ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। এজন্য কমিউনিকেশন স্কিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়।
কমিউনিকেশনের সেভেন সি
১৯৫২ সালে অধ্যাপক স্কট এম.কাটলিপ এবং অ্যালেন এইচ. সেন্টার প্রথম কমিউনিকেশন এর ” Seven C” এর ধারণাটি তুলে ধরেন। এই সেভেন সি যোগাযোগ দক্ষতাকে কার্যকর এবং পরিপূর্ণ করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলুন জানা যাক এই সেভেন সি সম্পর্কে।
১) Clarity (স্পষ্টতা)
কমিউনিকেশন এর প্রথম C হচ্ছে Clarity বা স্পষ্টতা। আপনি যা বোঝাতে চান তা স্পষ্টভাবে বলা বা বুঝিয়ে দেয়াই হচ্ছে স্পষ্টতা। এ ক্ষেত্রে মূলভাবের উপর জোর দিতে হয় এবং সঠিক ভাষা ব্যবহার করতে হয়। যেমন, হয়ত পরে জানাচ্ছি, সঠিক বলা যাচ্ছে না, ধারণা করা যায় এ ধরনের কথাগুলো বক্তব্যের অস্বচ্ছতা নির্দেশ করে বা সম্পূর্ণ কোনো তথ্য দেয় না। কথার স্পষ্টতা বজায় রাখলে হলে এ ধরনের কথা এড়িয়ে চলাই ভালো। এছাড়াও একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর জোর দিয়ে তার উপর ফোকাস ধরে রাখাটাও ক্ল্যারিটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
২) Conciseness (সংক্ষিপ্ততা)
Conciseness বা সংক্ষিপ্ততা হচ্ছে কমিউনিকেশন এর দ্বিতীয় C। এর মানে হচ্ছে মূলভাবকে যথাসম্ভব ছোট এবং উপযুক্ত করে প্রকাশ করা। সহজভাষায় ঘটনার মূলভাব যদি অনেক বড় হয়, তাহলে শ্রোতার জন্য জিনিসটা ঠিকভাবে মনে রাখা কষ্টকর, এ থেকে কমিউনিকেশন গ্যাপ হয়ে যেতে পারে। বিরক্তির সৃষ্টিও হতে পারে। তাই, মূলভাব সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য রাখা কমিউনিকেশনকে সহজ ও সুন্দর করে দেয়।
৩) Concreteness (নির্দিষ্টতা)
তৃতীয় C, Concreteness বা নির্দিষ্টতা বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট তথ্য ও ফ্যাক্ট দিয়ে বক্তব্যকে জোরালো করা। যোগাযোগে নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলে শ্রোতা-বক্তার মাঝে তৈরি হতে পারে কনফিউশন। যেমন “ব্যবসায় বেশ উন্নতি হচ্ছে” এর জায়গায় যদি “ব্যবসায় লাভ ৫০% পর্যন্ত বেড়েছে” বলা হয় তাতে উন্নতি কতটুকু বেড়েছে তার একটা নির্দিষ্ট হার বোঝানো যায়। যথেষ্ট বিস্তারিত বর্ণনা এবং তথ্য শেয়ার করে বক্তব্যের নির্দিষ্টতা নিশ্চিত করা কমিউনিকেশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৪) Correctness (শুদ্ধতা)
চতুর্থ C, Concreteness বক্তব্যের শুদ্ধতাকে নির্দেশ করে। বক্তব্যের শুদ্ধতা বেশ কিছু জিনিসের উপর নির্ভর করে। অশুদ্ধ বক্তব্য আপনাকে দুর্বলভাবে উপস্থাপন করে এবং তথ্যের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। বেশ কিছু উপায়ে শুদ্ধতা নিশ্চিত করা যায়, যেমন- সঠিক ও প্রমাণিত তথ্যের ব্যবহার, ভাষা ব্যাকরণগত ভুল না করা, লিখিত তথ্য হলে প্রুফরিডিং করে নেয়া, ঠিকঠাক সাইটেশন ও ক্রেডিট দেয়া ইত্যাদি। বক্তব্যের শুদ্ধতা আপনার বক্তব্যকে দৃঢ় ও গ্রহণযোগ্য করে তুলবে এবং গ্রাহক সন্তুষ্ট থাকবেন। অপরদিকে ভুলভাল বানান, আন্দাজের উপর প্রকাশ করা তথ্য, যতিচিহ্নের ভুল ব্যবহার এসব আপনার বক্তব্যকে হালকা করে দিবে। আপনি যদি দুটি পণ্যের মধ্যে তুলনা করেন, তাহলে যেটির গায়ে সঠিক ও পরিপূর্ণ তথ্য যেমন মেয়াদ, মূল্য দেয়া আছে সেটিকেই বাছাই করবেন, তাই নয় কি? কারেকশন এজন্যই কমিউনিকেশনে গুরুত্বপূর্ণ।
৫) Consideration (বিবেচনা)
Consideration দিয়ে বোঝানো হয় পরিস্থিতি বিবেচনা করতে পারার ক্ষমতা যা একটা মতপ্রকাশে প্রভাব ফেলে। তথ্য প্রকাশের সময় পরিস্থিতি বিবেচনা ও শ্রোতার প্রতি সহানুভূতি দেখানোটাই কনসিডারেশন। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হয় বক্তব্য যেন শ্রোতার অবস্থা অনুযায়ী এবং সহজবোধ্য হয় যাতে শ্রোতা কথাটি বুঝতে এবং অনুভব করতে পারেন। শ্রোতার প্রতি সম্মান দেখানো, তার অবস্থান বিবেচনা করা এবং বক্তব্য যেন তাকে স্পর্শ করতে পারে এই বিষয়টা খেয়াল রাখাই বিবেচনা। তথ্য সহজবোধ্য ও বিবেচনামূলক না হলে শ্রোতা অনাগ্রহী হতে পারেন অথবা অসম্মানিতবোধ করতে পারেন যা পরবর্তীতে মিসকমিউনিকেশন এর কারণ হতে পারে। তাই যোগাযোগের সময় এই দিক খেয়াল রাখা জরুরি। যেমন, একজন স্কুলের ছাত্র ও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের সাথে আপনি একইভাবে কথা বলতে পারবেন না, দুজনের সাথে ভিন্ন ভিন্নভাবে কথা বলতে হবে। কারণ দুইজনের পরিস্থিতি ও চিন্তাভাবনা ভিন্ন। শ্রোতার পরিস্থিতি অনুযায়ী মানাতে পারা একটি বড় গুণ।
৬) Completeness (পরিপূর্ণতা)
Completeness বা পরিপূর্ণতার মানে হচ্ছে কথা বা লেখা এমন হতে হবে যা গ্রাহকের সকল কৌতূহল নিবারণ করতে পারে। অর্থাৎ যে তথ্য শেয়ার হবে সেই তথ্য হতে হবে পরিপূর্ণ। বক্তব্য পরিপূর্ণ না হলে তা অস্পষ্ট থেকে যায় এবং তার প্রফেশনালিজম প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একইসাথে তার ভাবগাম্ভীর্যতা কমে যায়। গ্রাহকের সন্তুষ্টি পূর্ণ হয় না।
পরিপূর্ণতার ফলে সময় ও অর্থের অপচয় কম হয়, গ্রাহক-শ্রোতা সন্তুষ্ট থাকেন এবং কাজের গতিবৃদ্ধি ও মান উন্নত হয়। উদাহরণ দেয়া যায় এভাবে, আপনি যদি কাউকে কোথাও নিমন্ত্রণ করতে চান, তাহলে দিন, সময় ও ভেন্যু যদি একবারেই সুন্দর করে জানিয়ে দেন, তাহলে তার বার বার আপনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না এবং দুইপক্ষেরই সময় বাঁচলো।
৭) Courtesy (ভদ্রতা)
একটা ভালো কথাও মুহূর্তেই খারাপ হয়ে যায় যদি সেটিকে ভদ্রভাবে উপস্থাপন না করা হয়। তাই, কমিউনিকেশন এর সর্বশেষ C দিয়ে নির্দেশ করা হয় Courtesy বা ভদ্রতা। যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভদ্রতা ও সম্মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকসময় ফলাফল এর উপরেই নির্ভর করে। কথায় আছে, একটি সুন্দর কথা পুরো দিনটাকেই সুন্দর করে দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি আপনি ব্যবসা করেন এবং কোনো ক্রেতা আপনার সেবায় অসন্তুষ্ট থাকে, তাহলে তার যাথে ভদ্রভাবে ডিল করলে আপনি যে ফলাফল পাবেন, অভদ্রতা থাকলে তা হতে পারে একেবারেই উলটো। আপনার ব্যবহারের উপর নির্ভর করে আপনি কয়েকজন সম্ভাব্য ক্রেতা হারাবেন নাকি পাবেন। তাই ভদ্রতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
দিনশেষে আমাদের জীবনের প্রতিটি পরতেই কমিউনিকেশন এর পদক্ষেপ রয়েছে। উদাহরণ আমরা নিজেদের জীবনেই দেখতে পাই। জন্মের পর শিশুর প্রথম যোগাযোগের মাধ্যম হয় কান্না, এরপর সে আস্তে আস্তে ইশারা ইঙ্গিত, হাত দিয়ে এটা ওটা নির্দেশ করা, সবশেষে শেখে ভাষা। এইভাবে আমাদের জীবনের ধাপে ধাপে কমিউনিকেশন ডেভেলপ করে। ঠিকঠাক কমিউনিকেশন করা ও জানার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এর দ্বারা আমরা ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। কর্মজীবনে সফট স্কিল হিসেবে কমিউনিকেশনকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্কিলের একটি বলেই ধরা হয়। এর ফলে তথ্য ঠিকঠাক আদান প্রদান হয়, শেয়ারিং এর মাধ্যমে দূরত্ব কমে এবং কর্মক্ষেত্রে সফলতা বৃদ্ধি পায়। আপনার কমিউনিকেশনের ধরন যদি ঠিকঠাক ও আকর্ষণীয় হয়, তবে আপনার দিকে সবার মনোযোগ থাকবে, কর্মক্ষেত্রে ভালো কিছুতে সুযোগও এসে যেতে পারে। বলা হয়, একজন ভালো নেতা তিনিই যিনি সঠিকভাবে তার অনুসারীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। কমিউনিকেশন দুই দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যান্য সকল স্কিল এর মতই কমিউনিকেশন শেখা ও আয়ত্ব করতে সময়, পরিশ্রম ও বার বার অনুশীলন করা জরুরি। এভাবে দক্ষতা বাড়ে ও জিনিসটা সহজাত হয়ে আসে। সফলতার ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন রাস্তা অনেকটাই সহজ করে দিতে পারে এবং এই স্কিলকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে আপনিও খুলতে পারেন সাফল্যের দ্বার।