অফিসের প্রচলন কবে ও কীভাবে হয়েছিল? চলুন জেনে নেই অফিস শুরুর ইতিবৃত্ত

রোজ সকালে পরিপাটি হয়ে যে অফিসে আপনি যান, যেখানে কাজ করার জন্য মাস শেষে নির্দিষ্টি একটি স্যালারি পান, সারাদিন কলিগদের সাথে সময় কাটান- আপনি কি জানেন সেই অফিসের প্রচলন কীভাবে হয়েছিল? কত গল্পই তো আমাদের অজানা থাকে। এটাও তেমনই একটি গল্প, তাই না? কখনও কি ভেবে দেখেছেন অফিসের প্রচলন আসলেই কীভাবে হয়েছিল? আজ আপনাদের জন্য থাকছে সে বিষয়েই বিস্তারিত।

অফিসের প্রচলন যখন থেকে শুরু হয়

প্রাচীন আমলের অফিস

অফিস শব্দটির উৎপত্তি লাতিন শব্দ ‘অফিশিয়াম’ থেকে। এটা কোনো নির্দিষ্ট জায়গাকে বোঝায় না। এর অর্থ হচ্ছে ফরমাল পোশাক পরিহিত কোনো ব্যক্তি। ‘অফিস’ শব্দটি সর্বপ্রথম চালু হয় ১৩৯৫ সালে। এটি এমন এক জায়গাকে বোঝাতো যেখানে ব্যবসায়িক লেনদেন করা যেত।

ব্যবসায়িক লেনদেনের পরে এক সময় প্রশাসনিক কাজের শুরু হয়। তখন থেকে অফিস নামের ধারণাটি শুরু হয়। তবে এর ব্যাপক প্রসার শুরু হয় রোমান সাম্রাজ্যে। প্রশাসনিক জগতে অফিসের প্রচলন হয়েছিল এই সাম্রাজ্যেই। কেন এই সময়ে অফিসের প্রচলন বেড়ে যায় তা জানতে হলে আগে জানা প্রয়োজন এই সাম্রাজ্যের কিছু বিষয় সম্পর্কে। যেমন- সে সময় সেখানে কত মানুষ কাজ করত, শহরে জনগণের সংখ্যা কত ছিল, মিলিটারিতে কতজন যোগ দিচ্ছে, পরের বছর কতটুকু শস্য উৎপাদন করা সম্ভব হতে পারে, আগের বছর কতটুকু রৌপ্য বাণিজ্য হয়েছিল ইত্যাদি।

মধ্যযুগে অফিসের প্রচলন

কৃষক যখন ক্ষেত থেকে দূরে ফসল নিয়ে বিক্রি করতে যেতেন, ব্যবসায়ীরা মেডিটেরিয়ান পোর্টে ব্যস্ত থাকতেন বাণিজ্য নিয়ে- এসব হিসাব জমা রাখার দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। আগের বছরের তুলনায় বর্তমান বছরে কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হলো সেটা বোঝার জন্য সব হিসাব কোথাও না কোথাও লিখে রাখতে হতো। এ কাজগুলো যারা করতেন তাদের বলা হতো ‘স্ক্রিবা’। তারা প্রাচীন রোমের উচ্চপদস্থ কেরানি ছিলেন। তারা রাজ্যের কোষাগারে কাজ করতেন। সেই সাথে সরকারি বিভিন্ন বিষয় যেমন- বর্তমান আইন, নতুন আইন, আদমশুমারি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে রেকর্ড রাখতেন।

প্রাচীনকালে এ কাজগুলো করা হতো সাধারণত বড় বড় মন্দির বা প্রাসাদে বসে। এগুলোর জন্য এমন জায়গা বাছাই করা হতো যেখানে কাজ শেষে কাগজ গুটিয়ে রাখা যেত। এগুলোকে বলা হতো স্ক্রল রুম।

মধ্যযুগীয় অফিস ‘চ্যান্সেরি’

মধ্যযুগে অফিসের যে পুনরাবৃত্তি হয়েছিল সেটিকে বলা হতো চ্যান্সেরি। এটি ছিল প্রশাসনের মধ্যযুগীয় কেন্দ্র। এখানে বসেই লেখা হতো বেশিরভাগ সরকারি চিঠি, রাজ্যের বিভিন্ন আইন-কানুনের কপি ও রেকর্ড। লেখা শেষে সেগুলো সংরক্ষণও করা হতো। হেড অব চ্যান্সেরি পরিচিত ছিলেন চ্যান্সেলর নামে। অনেক দেশে এই নামটি এখনো প্রচলিত আছে।

বেসরকারি অনেক সংস্থা যেমন- ব্যবসায়িক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক এবং লিখিত রেকর্ড ও ডকুমেন্টসের জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ার অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছিল মধ্যযুগে। মঠগুলোতে ডেস্ক, চেয়ার ও স্টোরেজ শেলফ রেখে ওয়ার্কস্টেশন বানানো হতো। সেখানে বসেই সন্ন্যাসীরা পড়াশোনা করতেন এবং পান্ডুলিপির কপি করতেন।

আধুনিক অফিস

মধ্যযুগে বেশিরভাগ মানুষ বাড়িতে বসে কাজ করতো। ধারণা করা হয়, ১৭ শতকে এসে অফিশিয়াল কাজের টার্নিং পয়েন্ট আসে। আমস্টারডাম, লন্ডন ও প্যারিসের অফিসে বসে কাজ করতেন উকিল, সরকারী কর্মচারী ও নতুন চাকরিজীবীরা। এ সময় থেকেই মূলত কাজের ধরনে বিভক্তি তৈরি হয়। অফিসে কাজকে বলা হতো বেশি জরুরি এবং বাড়ির কাজকে বলা হতো আরামের ও গোপনীয়।

১৯৬০ সালের দশকে অফিস ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শিকাগো ও নিউ ইয়র্ক অফিস টাওয়ার থেকে শুরু করে যুদ্ধ-পরবর্তী শহুরে করপোরেট অফিসগুলো। বাড়িতে বসে কাজ ও অফিসের কাজের মধ্যে এ শতকে এসে পার্থক্য দেখানো শুরু হয় সবচেয়ে বেশি।

আধুনিক অফিস

প্রথম অফিসের নকশা

অফিসের গোড়াপত্তন হয়েছিল প্রাচীন রোমে। কিন্তু তখনও সত্যিকারের অফিস বলতে যা বোঝায় সেটা শুরু হয়নি। অফিসভবন বলতে যা বোঝায় সেটা ১৮ শতকের আগ পর্যন্ত শুরু হয়নি। তবে সকলেই বুঝতে শুরু করে অফিসের কেন প্রয়োজন। করমাগত তখন ব্রিটিশ রাজত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং বিভিন্ন বাণিজ্যে তারা নিজেদের যুক্ত করা শুরু করেছিল। যার কারণে হিসাব নিকাশ সহ বিভিন্ন কাজের জন্য অফিস দরকার হয়ে উঠতে থাকে। ১৭২৬ সালে লন্ডনে ‘দি ওল্ড অ্যাডমিরাল্টি অফিস’ নামে প্রথম অফিস ভবন চালু হয়। রয়্যাল নেভির বেশিরভাগ কাগুজে কাজ করা হতো এ ভবনে। এ ছাড়া অ্যাডমিরাল্টি বোর্ডরুম এবং মিটিংরুমগুলো ব্যবহার করা হতো মিটিংসহ নানা কাজে। এখনো সেটি সেভাবেই ব্যবহার হয়ে আসছে।

শুরুর পরিকল্পনা

প্রাচীন সময়ের আধুনিক অফিসগুলো তাদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল। অফিসের ডেস্কে বসে পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার সময় কর্মীদের দক্ষতার ওপরও বিশেষ করে জোর দেওয়া হতো। ২০ শতকে যখন অফিসের পরিকল্পনাগুলো জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে, তখন ‘টেইলরিজম’ পদ্ধতির অনুসরণ করা শুরু হয়। এই পদ্ধতিতে উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ আগের কাজের সময়ের মধ্যেই কম কর্মী দিয়ে একই পরিমাণ জিনিস উৎপাদন করতে হবে। এই পদ্ধতিটি তৈরি করেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ফ্র্যাংক টেইলর। ওনার নাম অনেকের কাছেই পরিচিত। শিল্প-দক্ষতা বাড়াতে তার বেশ অবদান আছে। টেইলরের এই পদ্ধতি নিয়ে অবশ্য বেশ সমালোচনাও আছে। বলা হয়, এই পদ্ধতিতে মানবিক ও সামাজিক উপাদানগুলো একত্রে বিবেচনা করা হয়নি এবং কর্মীদের তুলনায় কর্তারা বেশি লাভ করছেন। একই সময়ে, উচ্চবিত্তরা নতুন নকশার অনেক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে এবং তাদের কর্মীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যে। ইলেকট্রিক লাইটিং, এয়ার কন্ডিশন এবং টেলিগ্রাফ সিস্টেম চালু হওয়ার কারণে স্থাপত্যবিদরা অফিসের কাজ করার জন্য আলাদা ভবন নকশা শুরু করেন। কারণ তখন তারা বুঝতে পারেন, ফ্যাক্টরির সঙ্গে এখন থেকে আর অফিসকে সংযুক্ত করে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। যখন থেকে লিফট ও স্টিল ফ্রেমের কনস্ট্রাকশন কাজ শুরু হয়, তখন থেকে কাজের ধারায় আরও বদল আসে। নকশা করার সময়ও মানা হয় অনেক নিয়ম। বলা যায়, অফিসের ইতিহাসের বদল হতে শুরু করে তখন থেকেই।

যত কমার্শিয়াল ব্যাংক তৈরি হতে থাকে, তত কাজের জন্য জায়গা তৈরি হয়। প্রাইভেট অফিস ও খোলা জায়গায় কাজ নিয়ে পরিকল্পনা শুরু হয়, যুক্ত করা হয় টাইপরাইটার, কিছু অফিসে চালু হয় স্টাফ কিচেন অথবা ক্যান্টিন। জনসন ওয়াক্স কোম্পানির প্রথম ওপেন প্ল্যান অফিস নকশা করেন ফ্র্যাংক লয়েড রাইট। এই অফিসটি নকশা করা হয় উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে খেয়াল রেখে। এখানে একই সঙ্গে এক জায়গায় কাজ করতে পারতেন ২০০ স্টাফ। এত মানুষ একসঙ্গে থাকলেও এখানে উজ্জ্বল আলো, গরম আবহাওয়া ও সিলিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। অফিসের নতুন রূপ দিতে এই উপাদানগুলো অনেকের জন্যই ছিল নতুন ধারণা।

ব্যুরোল্যান্ডশেফট

অফিসের প্রচলন

১৯৬০ সালের শুরুতে কর্মক্ষেত্রগুলো বেশি মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে ও যাওয়া-আসা বাড়াতে অফিসের ধারণায় বেশ কিছু বদল আনে। এই নকশাকে বলা হয় ব্যুরোল্যান্ডশেফট। এটি ছিল সম্পূর্ণ জার্মান একটি কনসেপ্ট। এটিকে বলা হতো অফিস ল্যান্ডস্কেপ। উত্তর ইউরোপে জনপ্রিয় হওয়ার পর পুরো দুনিয়ায় এটি ছড়িয়ে যায়। কাজের জায়গায় একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ যে জরুরি এবং সেজন্য কিছুটা জায়গার প্রয়োজন সেটি নিয়েই কাজ করা হয় এই কনসেপ্টে। টেইলারিজমের থেকে কিছুটা আলাদা ছিল এই পদ্ধতি। এখানে ডেস্ক ও দল একসঙ্গে বসে কাজ করতে পারত। তবে নির্দিষ্ট ফাঁকা জায়গাও থাকত প্রতি ডেস্কের মধ্যে। এতে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতাও বাড়ে।

অফিস প্রযুক্তি

অফিসের সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে প্রযুক্তিগত কারণে। ১৯ ও ২০ শতকের একদম শুরুর দিকে, মোর্সের টেলিগ্রাফ, বেলের টেলিফোন এবং এডিসনের ডিক্টেটিং মেশিন কাজের ধারণা ও অফিসের নকশায় যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। টেলিকমিউনিকেশন শুরু হয়ে আলাদা করে দিয়েছিল ফ্যাক্টরি ও ওয়্যারহাউজকে এবং পার্থক্য এনেছিল সাদা ও নীল কলারের কর্মীদের মধ্যে। কাজের ক্ষেত্রে এসব প্রযুক্তি শুরু হলেও অন্যরা যতদিনে এসবে অভ্যস্ত হচ্ছিল, ততদিনে আমেরিকা এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করেছিল পুরোদমে।

১৯৬৪ সালে, ভবিষ্যৎ অফিসের জন্য সিলেক্টরিক টাইপরাইটারে যখন রেকর্ডিংয়ের জন্য ম্যাগনেটিক কার্ড আবিষ্কার করা হয়, তখন প্রযুক্তি দুনিয়ায় আসে ব্যাপক পরিবর্তন। এই ওয়ার্ড প্রসেসর তথ্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারত। কম্পিউটারে কাজ করার সেই ছিল শুরু এবং এই স্বয়ংক্রিয়তাই সমাজে বেকারত্ব শুরুর প্রথম ভয় তৈরি করে।

সিলেক্টরিক টাইপরাইটার

বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে আধুনিকতা অবশ্য অফিস আবার আগের সময়ে ফিরিয়ে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে। কারণ অনলাইন সংযুক্তির কারণে বেশির ভাগ মানুষ বাড়ি থেকে এখন সহজেই কাজ করতে পারছে। ইতিমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য আইডিয়ার প্রতি বেশি জোর দিচ্ছে। তারা কাজ করছে ‘যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায়’ এই রীতিতে। ইয়াহু ও আইবিএমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অফিসের বাইরে বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *