নতুন উদ্যোক্তাগণ ব্যবসার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিবেন?

আপনি যদি নতুন উদ্যোক্তা হন, আপনার ব্যবসার ক্ষেত্র যদি ছোট হয় তাহলে বলার অপেক্ষা থাকে না যে আপনার কাঁধে অনেক দায়িত্ব থাকে। যেকোনো জিনিসই শূন্য থেকে শুরু করে উপরে ওঠানো বেশ কঠিন। নতুন পরিবেশ, নানারকম নতুন পরিস্থিতি এ সময়টাকে আরো কঠিন করে তোলে। অনেকেই বুঝতে পারেন না সে সময়ে কোন জিনিসটাকে আগে প্রাধান্য দিতে হবে। এরকম ছোটখাটো ব্যবসার শুরুর দিকে যে আপনাকে অত্যন্ত কৌশলী হয়ে সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে শুধু তাই নয়, সাথে চালিয়ে যেতে হবে প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্মও। চারিদিকের নানারকম পরিস্থিতিতে অনেক সময়ই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও পদক্ষেপ চোখের আড়াল হয়ে যেতে পারে। ফলে হারিয়ে যেতে পারে উপরে ওঠার সুযোগ।

ব্যবসার শুরুতে আপনার মনে হতেই পারে যে সবকিছু আপনি নিজেই করবেন। কিন্তু ব্যবসার পরিধি বাড়ার সাথে সাথেই আপনি নিজে সবকিছু সামলাতে পারবেন না। আপনার হেল্পিং হ্যান্ড এর দরকার হবে। তখন আপনি হয়তো কর্মচারী নিয়োগ করবেন, অথবা ফ্রিল্যান্সার নিয়োগ দিবেন অথবা এক্সপার্টদের হাতে কাজ ভাগ করে দিবেন। মনে রাখবেন কাজ ভাগ করে নেয়া কোনো দুর্বলতা নয় বরং ব্যবসা দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে এটি বেশ কাজের একটি পদক্ষেপ। আপনি যদি বুদ্ধিমান, সৎ এবং কাজ জানা লোকবল নিয়ে দল গঠন করতে পারেন, তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে সাফল্যের পথটা আপনার জন্য সহজ হয়ে উঠবে। চলুন জেনে নেই, ব্যবসায়ের প্রাথমিক ক্ষেত্রে আপনার কোন কোন বিষয়ের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

নতুন উদ্যোক্তাগণ ব্যবসার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো মেনে চলবেন 

১) আর্থিক দিক

যেকোনো ব্যবসার প্রথম ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অর্থ। ব্যবসা ছোট হোক বা বড়, অর্থের দিকে সবার আগে আপনাকে মনোযোগ দিতে হবে। ব্যবসায়িক অর্থের যোগান, আয়, খরচ ও সর্বোপরি নগদের প্রবাহ (Cash flow) সম্পর্কে আপনার স্পষ্ট জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি, যেন আপনি আপনার ব্যবসা সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারেন। আপনি নিজে আর্থিক দিকগুলো সামলান অথবা আপনার অ্যাসিসটেন্ট থাকুক, আপনি সবসময় এটি খেয়াল রাখবেন যেন আপনার আয় ও খরচের হিসেবের সঠিক ট্র‍্যাক থাকে৷ কখনোই যেন ছোট একটি বিষয়ও এক্ষেত্রে বাদ না পড়ে। এছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে যে সকল খরচ আবশ্যিক, ট্যাক্স, লাইসেন্স ও অন্যান্য জরুরি আর্থিক বিষয়গুলোর দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে সবসময়ই আর্থিক বৈধতাও নিশ্চিত করতে হবে যেন শুরুর আগেই শেষ না হয়ে যায়, অথবা জরিমানা ও অন্যান্য বিষয় বাবদ অতিরিক্ত খরচ না হয়।

নতুন উদ্যোক্তাগণের জন্য পরামর্শ

২) কাস্টমার সার্ভিস

যেকোনো ব্যবসার প্রাণ হলো তার কাস্টমার। আপনি যত চমৎকার কাস্টমার সার্ভিস দিবেন, আপনার ব্যবসার প্রসার তত দ্রুত হবে। তাই নতুন অবস্থাতেই সুন্দর ইতিবাচক কাস্টমার সার্ভিস নিশ্চিত করুন। কাস্টমারের বিশ্বাস ও সন্তুষ্টি অর্জনকে মূল লক্ষ্য বানান। কাস্টমারের সাথে মার্জিত আচরণ, তাদের সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেয়া, পণ্যসমূহের সঠিক মান সম্পর্কে জানানো, তাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠায় আশ্বস্ত করা, যেকোনো সমস্যার চটজলদি সমাধান দেয়ার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকুন। আপনার কর্মীদেরও এসব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দিন।

আপনি যদি একটি ব্যতিক্রম ও উন্নতমানের কাস্টমার সার্ভিস দিতে পারেন, তাহলেই নতুন নতুন কাস্টমার আকৃষ্ট হবে। কাস্টমারদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে তাদের সাথে বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন এবং দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করুন। তাদের জন্য বিভিন্ন অফার দিন এবং তাদের সাপোর্টের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। সবসময় চেষ্টা করুন ইতিবাচক সার্ভিস নিশ্চিত করার পর যেন তারা পরবর্তীতে বিশ্বাস করে এবং বার বার আপনার কাছেই ফিরে আসে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যটি নিতে।

৩) মার্কেটিং

ব্যবসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মার্কেটিং। আপনার পণ্য যতই আকর্ষণীয় ও অভিনব হোক না কেন, যদি সেটি পরিচিতি লাভ না করে, কেউ সেগুলো সম্পর্কে না জানে তাহলে ব্যবসার প্রসার লাভ করা সম্ভব না৷ এজন্য আপনাকে বিজ্ঞাপন ও প্রচারে ইনভেস্ট করতে হবে। বর্তমানে মার্কেটিং সেক্টর বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নানারকম মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভি চ্যানেল, মোবাইল অ্যাপস ও ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের কারণে বিজ্ঞাপন ও প্রচার হয়ে উঠেছে বেশ সহজলভ্য। এছাড়াও নানারকম মেলা, ট্রেড শো সহ অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে পণ্যের প্রচার বাড়ানোর জন্য৷ আপনাকে এটি নিয়ে গবেষণা করতে হবে, বুঝতে হবে ঠিক কোথায় বিজ্ঞাপন দিলে আপনি আপনার পণ্যের টার্গেট কাস্টমার পাবেন। কীভাবে ও কোথায় বিজ্ঞাপন ও প্রচার বৃদ্ধি করলে ব্যবসার প্রসার বাড়াতে পারবেন সেটি নিয়ে অ্যানালাইসিস করুন এবং পরিকল্পনা করুন যে কীভাবে আগাবেন। গুছিয়ে পরিকল্পনা করে কাজ করলে ব্যবসার বিজ্ঞাপন ও প্রচার সর্বোচ্চ কাজে লাগানো সম্ভব।

নতুন উদ্যোক্তাগণ মার্কেটিং করবেন যেভাবে

৪) নেটওয়ার্কিং

একটি ছোট ব্যবসার মালিক হিসেবে অন্যান্য পেশাদার ব্যবসায়ী ও আপনার কমিউনিটির সদস্যদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং ইভেন্টগুলোতে যোগ দিন। পরিচিত হোন আপনার সমমনা ব্যক্তিত্বদের সাথে। নানারকম ব্যবসায়ী, শিল্প গ্রুপ ও সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করুন। এ ধরনের ইভেন্ট ও গ্রুপগুলো থেকে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে আপনি ব্যবসার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পারবেন। বিভিন্ন সমস্যা ও তা থেকে বের হওয়ার জন্য সমাধান পাবেন। নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। ফলে আপনার ব্যবসা সংক্রান্ত জ্ঞানের পরিধি বাড়বে। একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারলে এটি আপনাকে বৈরী পরিবেশে যেমন শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সাহায্য করবে তেমন কাস্টমার তৈরি, ব্যবসার নানা দিকের প্রসার বাড়াতেও সাহায্য করবে। এছাড়া আপনি নতুন নতুন স্কিল ডেভেলপ করতে পারবেন, বর্তমানের বাজার, ব্যবসার পরিস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কেও সবসময় জানতে পারবেন।

৫) সময় ব্যবস্থাপনা

সময় আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। সময় ব্যবস্থাপনা বা টাইম ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো না হলে ব্যবসায় উন্নতির চেয়ে অবনতি ঘটবে বেশি। ব্যবসার ক্ষেত্রে সময়ের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন হতে হবে। আপনাকে চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং রুটিন তৈরি করতে হবে প্রত্যেকটি কাজের জন্য৷ এছাড়া ক্যালেন্ডার, ডায়েরি এসবের মাধ্যমেও ট্র‍্যাক করুন প্রতিদিনের সব কাজ। সাধারণত দিনের বেলায় কাজ বেশি করা যায়, সেক্ষেত্রে আপনি একা যদি সবদিকে সামলাতে না পারেন আপনার কর্মী অথবা সহযোগীদের বিভিন্ন কাজ ভাগ করে দিতে পারেন। এতে একই সময়ে অনেকগুলো কাজ একসাথে সম্পন্ন হবে, ফলে আপনি ব্যবসায়ের অন্যান্য দিকেও ফোকাস করতে পারবেন। সময় ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করলে ব্যবসায়ে দ্রুত প্রসার লাভ করা সম্ভব।

৬) ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা

ব্যবসা মানেই সেখানে ঝুঁকি থাকবে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় অনেক বেশি ঝুঁকি থাকলে ব্যবসা দাঁড় করানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ অনেক সময়ই ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অনেকেই এড়িয়ে যান। তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনার পণ্যের বাজার, টার্গেট কাস্টমার, এই পণ্যের বর্তমান ক্রয়-বিক্রয় হার ইত্যাদি লক্ষ্য করুন। আপনার ব্যবসার সম্ভাব্য ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা খুঁজে বের করুন। যেমন- বাজারদরের ওঠানামা, পণ্যের ও কাঁচামালের সহজলভ্যতা কেমন, মজুদ করে রাখা সম্ভব কি না, চাহিদা কমলে কতটা কমতে পারে, বিক্রির হার কমার সম্ভাবনা, প্রাকৃতিক ও নানাবিধ কারণে তৈরি হওয়া দুর্যোগ হলে ব্যবসার ক্ষতির সম্ভাবনা কতটুকু ইত্যাদি সকল ঝুঁকির দিকগুলো বিবেচনা করুন এবং এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্ল্যান করুন এবং প্রস্তুত থাকুন। কারণ প্রস্তুতি ছাড়াই হুট করে যেকোনো ক্ষতি বা বিপদ সামলানো বেশ কঠিন কাজ৷ আর প্রাথমিক পর্যায়ে সামান্য ক্ষতিও বড় রকমের প্রভাব ফেলে। তাই ছোট ব্যবসা হলেও ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকির দিকগুলো বিবেচনা করে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া উচিত।

ব্যবসাতে ঝুঁকি

যেকোনো ব্যবসাই প্রসারিত হয় সুদুরপ্রসারি চিন্তাভাবনা, সূক্ষ্মভাবে সকল কাজ পরিচালনা, দক্ষতা ও বুদ্ধির সাথে সবকিছু মোকাবেলা করার মাধ্যমেই। ব্যবসা যতই ছোট হোক না কেন, এটিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে মূল ক্ষেত্রগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে শক্তিশালী ভিত্তি তৈরির মাধ্যমেই এগিয়ে নেয়া যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *