লাইফ স্কিল কোনগুলো এবং সেগুলো কেন শিখে রাখা জরুরি?  

যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতির জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকা উচিত – এ কথা তো আমরা সবাই বলি। কিন্তু মানি আসলে কয়জন? অল্প বয়সে হয়ত কাজ করার কথা কেউ বলে না, তবে সত্যি কি জানেন? বড় হওয়াটা জীবনের সবচেয়ে কঠিন অংশের একটি। আপনি যদি লাইফ স্কিল সম্পর্কে না জানেন, তাহলে যত বড় হবেন, তত সবকিছু নিয়ে কনফিউজড হতে থাকবেন। জীবনে চলার পথে আমাদের সবারই দরকারি কিছু স্কিল শিখে রাখা দরকার। এগুলোকে বলে লাইফ স্কিল। চলুন আজ জেনে নেই এই স্কিল কোনগুলো এবং কেন এগুলো শিখে রাখা জরুরি।

লাইফ স্কিল কী?

এটি এমন এক স্কিল যেটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনে সব ধরনের কাজ করার জন্য প্রয়োজন হয়। কাপড় সেলাই করা থেকে শুরু করে বেসিক বাজেট করতে পারা – সবকিছুই লাইফ স্কিল এর অন্তর্ভুক্ত। আপনি যখন বড় হতে থাকবেন, তত ধীরে ধীরে প্রতিটি কাজের জন্য দক্ষতার প্রয়োজন হবে।

লাইফ স্কিল কোনগুলো?

হাউজকিপিং স্কিল

১) বেসিক হাউজকিপিং স্কিল

হাউজকিপিং স্কিল এর মধ্যে প্রয়োজনীয় দুটি স্কিল হচ্ছে বিছানা গোছানো ও কাপড় ধোয়া। এই দুটো স্কিল সবারই থাকা উচিত। নিজের ঘর থেকে শুরু করে কলেজ হোস্টেল, যেখানেই আপনি যান না কেন, ঘর যদি নোংরা থাকে, তাহলে কোনো কাজেও যেমন মন বসবে না, তেমনই স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে না। ঘর ছোট হোক, কিন্তু সেটা গুছিয়ে রাখা জরুরি। আপনি যদি এই কাজগুলো না জানেন তাহলে বেসিক ঘর পরিষ্কার করা দিয়ে শুরু করতে পারেন। ঘর পরিষ্কার রাখলে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা জার্ম দূর হয়ে যাবে।

২) রান্না করা

লাইফ স্কিল

রান্না জানা মানে যে আপনাকে দামি হোটেলের শেফের মতো রান্না জানতে হবে তা নয়। নিজে যেটুকু খেয়ে বেঁচে থাকা যায় অন্তত সেটুকু জানা প্রয়োজন। হতেই পারে রান্না করতে আপনি খুব একটা পছন্দ করেন না, কিন্তু বিশ্বাস করুন সব সময় বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ হওয়ার চেয়ে ঘরেই চট করে কিছু বানিয়ে নেয়া বেশ হেল্পফুল।

৩) টুকিটাকি সেলাই

ঘর থেকে বের হতে যাবেন ঠিক তখনই দেখলেন যে শার্টটা আজ পরেছেন সেটার একটা বোতাম ছুটে গিয়েছে। এখন আবার নতুন করে শার্ট আয়রন করে পরার চেয়ে বোতামটা সেলাই করে নিলেই কাজ হয়ে যাচ্ছে। বোতাম লাগানোর মতো ছোট কাজটি যদি আপনার জানা থাকে তাহলে চট করেই ঝামেলা এড়িয়ে চলতে পারেন। ঠিক এভাবেই কাপড়ের কোনো জায়গায় ছিঁড়ে গেলে সুই সুতো দিয়ে আপনি নিজেই সেলাই করে নিতে পারবেন। এই লাইফ স্কিলটি বেশ কাজে আসে বিপদের সময়।

৪) হোম রিপেয়ার

হোম রিপেয়ার করা মানেই যে আপনাকে প্রো লেভেলের ইলেকট্রিশিয়ান বা প্লাম্বার হতে হবে, তা নয়। ঘরের ছোট ছোট কিছু কাজ জানা থাকলে সময়ও বেঁচে যাবে। ফ্যান ঠিক করা, লাইট লাগানো, ফ্রিজের কানেকশনে কোনো সমস্যা হলে সেটা জেনে রাখার মতো কাজগুলো শিখে রাখতে পারেন।

টেকনিক্যাল স্কিল

১) লেখালেখি

লেখালেখি পারাটাকেও বেসিক লাইফ স্কিল এর একটি হিসেবে মানা হয়। আমি বলছি না যে আপনাকে ব্লগ বা কোনো ধরনের মাস্টারপিস লিখতে হবে। তবে কোনো বাক্য সাধারণত লিখতে হয় বা কী ধরনের এক্সপ্রেশন দেয়া প্রয়োজন সেটা অন্তত জানা থাকা উচিত। যদি সম্ভব হয় একটি ক্রিয়েটিভ রাইটিং স্কিল ক্লাস বা অনলাইন রাইটিং কোর্স করে নিতে পারেন।

লাইফ স্কিল এ রাইটিং

২) পাবলিক স্পিকিং

লেখালেখি, কথা বলা – বিশেষ করে পাবলিক স্পিকিং এর মতো বিষয়ে কিছুটা আয়ত্ত থাকা উচিত। এতে সাহসেরও দরকার হয় বলে সবার মাঝখানে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন মধ্যমণি। পাবলিক স্পিকিং আয়ত্তে থাকলে যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় কথা বলতে আপনি পিছপা হবেন না। যেমন- পারিবারিক কোনো আয়োজন বা অফিসের কোনো মিটিং – যে কোনো জায়গাতেই আপনি কথা বলতে পারেন নির্দ্বিধায়।

৩) ইফেক্টিভ কমিউনিকেশন

লেখালেখি হোক বা কথা বলা – কমিউনিকেশনের জন্য দুটোই খুব জরুরি লাইফ স্কিল। সবাইকেই অন্যের সাথে যে কোনো দরকারে কথা বলতে হয়। তবে যদি মনের কথা ভালো করে বোঝানোই না যায়, তাহলে কমিউনিকেশনের অর্থ হয় না। আপনার স্বামী/স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু, বা অফিসের কোনো কলিগ সবার সাথেই কথা বলার সময় যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াতে হবে।

৪) কম্পিউটার স্কিল

বর্তমানের এই যুগে কমবেশি কম্পিউটার স্কিল সবারই থাকা জরুরি। ইন্টারনেটে কীভাবে সার্চ করতে হয় বা কীভাবে ই-মেইল লিখতে হয় সেটা আমরা সবাই জানি। তবে কিছুটা অ্যাডভান্স লেভেলের হলে কোনো ক্ষতি নেই। টেকনোলজি বেশ পাওয়ারফুল ও ইউজফুল টুল হতে পারে, যা কিনা আপনার জীবনকে সহজ করে দিতে পারে।

সারভাইভাল স্কিল

১) নিজেকে নিরাপদ রাখার উপায় জানা

সারভাইভাল স্কিল

মানুষ মানেই নিরাপত্তা চায়। তবে পরিস্থিতি কখন কী হয় সেটা তো আর আমাদের হাতে নেই। অনিরাপদ যে কোনো পরিস্থিতিতে পড়লে সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য কী কী করা উচিত সেটা আমাদের সবারই জানা উচিত। আপনাকে আমি বলছি না যে আপনি কোনো কাজে ঝুঁকি নিবেন না, কিন্তু ঝুঁকি নেয়ার আগে কিছু সতর্কতাও জেনে রাখা উচিত। সম্ভব হলে কী ভাবছেন বা কী করতে যাচ্ছেন তা সম্পর্কে কাছের কোনো বন্ধুকে জানিয়ে রাখতে পারেন।

২) বেসিক ফার্স্ট এইড

আপনি কি জানেন যদি হুট করে কোথাও কেটে যায় তাহলে কী করতে হয়? হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক হলে বা কোনো আঘাত পেলে কী করণীয় সেটা কি জানেন? স্বাভাবিকভাবেই আমরা যখন সুস্থ থাকি, তখন এগুলো নিয়ে কয়জন ভাবি? তবে এটাও সত্যি যে, আপনি যদি এই অসুস্থতাগুলো সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন, তাহলে শুধু আপনার জন্যই নয়, আপনার আশেপাশে যারা আছেন তাদের সবার জন্যই ভালো হবে। এমন অবস্থায় সবাই অল্পবিস্তর প্যানিক করবেই, আপনার যদি ফার্স্ট এইড সম্পর্কে জানা থাকে তাহলে নিজের জ্ঞান দিয়েই যে কোনো পরিস্থিতি আপনি ঠান্ডা মাথায় সামলাতে পারবেন।

৩) ইলেকট্রিসিটি ছাড়া থাকা

আপনি কখনো ক্যাম্পিং করতে গিয়েছেন? ক্যাম্পিং এ গেলে কিন্তু প্রকৃতির সাথেই সময় কাটাতে হয়। যে কোনো ধরনের টেকনোলজি এমনকি লাইট, টেলিভিশন এগুলো ছাড়াই সময় কাটাতে হয়। জানতে হয় ইলেকট্রিসিটি ছাড়া কীভাবে বাঁচতে হয়। রান্নাও করতে হয় স্টোভে। তাই কখনো সুযোগ হলে ক্যাম্পিং করে আসুন। জীবনের কঠিন বাস্তবতা অনেকটাই কাছ থেকে বুঝতে পারবেন।

৪) ম্যাপ পড়তে পারা

আমাদের সবার হাতেই এখন স্মার্টফোন আছে। যার মাধ্যমে ম্যাপ দেখে রাস্তা চেনা বেশ ভালো একটি দক্ষতা। কিন্তু যদি এমন কোনো জায়গায় আপনাকে যেতে হয় যেখানে মোবাইলে নেটওয়ার্ক থাকে না, তাহলে? এজন্য জিওগ্রাফি সম্পর্কে বেসিক নলেজ থাকা এবং সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত রাখা জরুরি। ম্যাপ স্কিলটা ঝালিয়ে নিলে লোকেশন সম্পর্কে কনফিউশন থাকবে না। আর সত্যি বলতে জিপিএস এর বদলে ছেলেমেয়েকে পৃথিবী চেনানোর জন্য ম্যাপ রিডিং হতে পারে বেস্ট একটি আইডিয়া।

reading map

৫) রিজ্যুমে ও কভার লেটার লিখতে পারা

আপনি যদি চাকরি খুঁজতে যান সবার আগে আপনাকে রিজ্যুমে ও কভার লেটার সাবমিট করতে হবে। কিন্তু আপনি যদি নাই জানেন এগুলো কীভাবে লিখতে হয়, তাহলে কী করে চাকরি পাবেন? তাই এই দুটো লেখা অবশ্যই শিখে রাখা উচিত। অনেক প্রতিষ্ঠানেই এগুলো লেখা শেখানো হয়। আপনি চাইলে সেগুলোতে অথবা অনলাইন কোনো ক্লাসে জয়েন করতে পারেন।

মানি ম্যানেজমেন্ট স্কিল

১) বাজেট করা

লাইফ স্কিল এর মধ্যে অন্যতম আরও একটি স্কিল হচ্ছে বাজেট করতে পারা। আপনি যতই ইনকাম করুন বা যতই খরচ করুন না কেন, একমাত্র ঠিকঠাকভাবে বাজেট করলে অর্থনৈতিক শান্তি ও নিরাপত্তা মিলবে। এই স্কিলটি আমাদের সবারই একদম অল্প বয়স থেকে শেখা উচিত।

২) ঋণ না করা

আমরা যখন অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা বলছি, তখন যদি এর মাঝে ঋণের বোঝা চেপে যায়, তখন কোনো কিছুই পরিকল্পনামত হয় না। আর এ থেকে কীভাবে বাঁচবেন সেটা শিখতে পারাটাই অন্যতম একটি লাইফ স্কিল। যত দ্রুত সম্ভব ঋণ পরিশোধ করে তা থেকে বের হয়ে আসা উচিত।

৩) ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স করা

আমাদের মধ্যে কয়জন আছেন যারা ব্যাংক স্টেটমেন্ট ঠিকমতো চেক করেন? কোথা থেকে কী কিনলেন, কোন রেস্টুরেন্টে কত টাকা খরচ হলো, অনলাইন বিল কত এলো – এসব একবার কার্ড থেকে খরচ করার পর আমাদের কি এই রেকর্ডগুলো মনে থাকে? অথচ আপনার জানা থাকা উচিত কখন কীভাবে কত টাকা আপনি খরচ করছেন। এই খরচের সাথে একাউন্টের টাকা যদি ব্যালান্স করে রাখতে পারেন তাহলে দেখবেন খরচের প্যাটার্নটাও বদলে গিয়েছে।

Bank Account Balance

রিলেশনশীপ স্কিল

১) পার্টনারের কথা শোনা

যে কোনো সম্পর্কে কমিউনিকেশন খুব জরুরি একটি বিষয়। এর মানে হচ্ছে আপনি আপনার পার্টনারের কথা শুনছেন, শুধু নিজেরটা ভাবছেন না, ইমপ্যাথেটিক হচ্ছেন এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে কঠিন পরিস্থিতিকে সামলাচ্ছেন। কথা বলার সময় শব্দ চয়ন খুবই জরুরি একটি বিষয়। কথা যেমন একে অপরকে কাছে আনে, তেমনই দূরেও সরিয়ে দেয়। তাই বলার আগে চিন্তা করুন এবং অন্যজন কী বলছে মন দিয়ে শুনুন। এতে আপনার রিলেশনশীপও স্ট্রং হবে।

২) একে অপরকে সম্মান করা

সাকসেসফুল ম্যারিজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে মিউচুয়াল রেসপেক্ট থাকা। পারফেক্ট ম্যারেজ মানে স্বামী স্ত্রী উভয়ের প্রতিই উভয়কে সম্মান করতে হবে। সে কী বলতে চায়, সেটা শুনতে হবে। অনেক সময় হয়ত মতের মিল হবে না। এমন হলে সরাসরি বিপক্ষে না যেয়ে আপনার পয়েন্ট অফ ভিউ তাকে বুঝিয়ে বলুন। আর ভালোবাসা প্রকাশের জন্য একে অপরকে যথেষ্ট সময় দিন। সপ্তাহে অন্তত একদিন বাইরে যান, প্রতিদিন অন্তত এক বেলা একসাথে খাবার খান, গল্প করুন, ভালোবাসুন, বিশ্বাস রাখুন।

লাইফ স্কিল এর প্রথাগত কোনো সংজ্ঞা আসলে সেভাবে নেই। যেগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম সেগুলোর সবই লাইফ স্কিল। আবার এগুলোর বাইরেও আছে। তবে বলা যায়, আপনি যদি অন্তত এই স্কিলগুলো নিজের মাঝে রপ্ত করতে পারেন তাহলে একজন সঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *