সন্তান পৃথিবীতে আসার আগে যে নারীরা কর্মক্ষেত্রে বেশ ভালোভাবে কাজ করতেন, নতুন মা হওয়ার পর যেন তাদের পুরো পৃথিবীই বদলে যায়। বেশ লম্বা একটা সময় কাজ থেকে দূরে থাকা হয় বলে আবারও কাজে ফেরার পর সবকিছু নতুন লাগতে থাকে। সেই সাথে নিজের শারীরিক দুর্বলতা ও সন্তানের ভালো থাকা নিয়ে বেশ ভাবনা হয়। এমতাবস্থায় অনেক নতুন মা কর্মজীবনকে বিদায় জানান, যারা থাকেন তাদের বেশ কষ্টসাধ্য পরিস্থিতি পার করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে নতুন মায়েরা অ্যাডজাস্ট করতে পারেন যদি তারা সবার কাছ থেকে সাপোর্ট পান। সেই সাথে নিজেরও কিছু দিকে খেয়াল রাখতে হয়।
কাজে ফেরার আগে কোন চিন্তা বেশি হয়?
সন্তান জন্মদানের যে আনন্দ একজন মা উপভোগ করেন, সেটা অনেকটাই কমে যেতে থাকে অফিসে ফেরার চিন্তার পর থেকে। একদিকে সন্তানকে সারাদিন সামনে না দেখতে পারার চিন্তা, অন্যদিকে অফিসে আগের মতো মানিয়ে নেয়া যাবে কিনা সেই চিন্তা। অফিস নিয়ে অনেক এলোমেলো চিন্তা বারবার ভাবনায় আসে। যেমন- আমি যে কাজগুলো করতাম সেগুল কি আমার মনে আছে? আমার অবর্তমানে তারা কি আরও ভালো কাউকে খুঁজে পেয়েছে? আমি একইসাথে কীভাবে একজন ভালো মা ও ভালো কর্মী হবো? – এই চিন্তাগুলো একদম অমূলক নয়। অনেকদিন পর ঘর থেকে বের হয়ে কাজে ফেরা, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়া, নতুন দায়িত্ব বুঝে নেয়া এসব শুরুর দিকে একটু চাপ মনে হবেই। তবে হতাশ হলে চলবে না। শত দায়িত্বের মাঝে এই কাজও আপনি করতে পারবেন।
কর্মক্ষেত্রে নতুন মায়েরা যেভাবে অ্যাডজাস্ট করবেন
আগে থেকেই পরিকল্পনা করা
নতুন মায়েরা কর্মক্ষেত্রে ফেরার জন্য বেশ এক্সাইটেড থাকেন। কিন্তু সমস্যা হয় যখন ম্যাটারনিটি লিভ শুরু হয়ে যায় কিন্তু সেভাবে কোনো কাজ প্ল্যানই করা হয় না। ম্যাটারনিটি লিভ থেকে ফিরে অফিসে জয়েন করার পর সন্তানের জন্য চিন্তা হয় বলে বেশিরভাগ মায়েরাই অস্বস্তিতে ভোগেন। এই সময়টা তাদের জন্য খুবই স্ট্রেসফুল থাকে। তাই অফিসে জয়েন করার পর যেন খুব বেশি সমস্যা না হয় সেজন্য আগে থেকেই কিছু পরিকল্পনা করে রাখতে হবে।
ম্যাটারনিটি লিভ শুরু হওয়ার আগে থেকেই কিছু পরিকল্পনা করে রাখুন। এতে স্ট্রেস কম হবে। সিনিয়রের সাথে কথা বলে জানিয়ে রাখুন কবে থেকে আপনার লিভ শুরু হচ্ছে, কী কী কাজ বাকি রইলো, কোন দায়িত্ব কাকে দিয়ে যাচ্ছেন। রিমোটলি যদি কোনো কাজ করা পসিবল হয় সেটাও জানিয়ে রাখুন। ফিরে এসে কী কী সুবিধা পেলে আপনার জন্য ভালো হয় সে বিষয়ে আগে থেকেই কথা বলে নিন।
নিজের প্রয়োজন বুঝুন
নতুন একজন মানুষ পৃথিবীতে আসা মানে কাজের শিডিউলে বেশ বড় একটা পরিবর্তন আসা। আগে হয়ত আপনি অনেক দেরি করে কাজ শেষ করে ঘরে ফিরলেও সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন আপনাকে আপনার বাউন্ডারি নিজেরই সেট করতে হবে। তাই নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন-
কী কী বদল এসেছে আপনার জীবনে?
- ডে কেয়ার থেকে সন্তানকে পিক করার জন্য আপনাকে কতক্ষণ আগে অফিস থেকে বের হতে হবে?
- অফিস শেষে সন্ধ্যার কোনো পার্টিতে কি আপনি থাকতে চান নাকি বাড়ি ফিরে সন্তানের সাথে সময় কাটাতে চান?
- কাজের শেষে কোনো ইভেন্টে যগদান করতে হলে আপনাকে কত আগে নোটিশ দিয়ে জানাতে হবে?
এমন কিছু বাউন্ডারি আপনি আগে থেকেই সেট করে নিন। তাহলে অফিসের বাকি কর্মীদেরও এগুলো জানা থাকবে।
বিশ্বস্ত চাইল্ডকেয়ার খুঁজে বের করুন
সবার বাড়িতেই সন্তানকে দেখে রাখার মতো মানুষ থাকে না। তখন চাইল্ডকেয়ার ছাড়া উপায়ও থাকে না। এই সিদ্ধান্ত নেয়া যদিও বেশ কঠিন। কিন্তু আপনার যদি সব সময় সন্তান নিয়ে চিন্তা হতে থাকে, তাহলে কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন না ভালো করে। তাই এমন একটি চাইল্ডকেয়ার খুঁজে বের করুন যেখানে আপনি সন্তানকে রাখতে নিরাপদ অনুভব করবেন, আপনার সন্তান যত্নে থাকবে। তাদের সম্পর্কে রিসার্চ করুন, মাঝে মাঝে সেখানে যেয়ে সবার সাথে কথা বলুন, ন্যানিদের সম্পর্কে জানুন এবং অন্যান্য অভিভাবকদের সাথেও কথা বলুন।
কর্মক্ষেত্রে জয়েন করার আগে সম্ভব হলে মাঝে মাঝে শিশুকে সেখানে রেখে অভ্যাস করুন। আপনিও যান, সেখানে শিশুর সাথে সময় কাটান, এতে সেও বুঝতে শিখবে যে জায়গাটা একদম নতুন নয়। মা এখানেই আছে। মাঝে মাঝে দাদি বা নানির বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন, সন্তানকে কয়েক পরিবেশে রেখে অভ্যস্ত করিয়ে নিতে পারেন আগে থেকে। এতে কাজে ফেরার আগেই অভ্যাস হয়ে যাবে। সন্তানের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, কী কী প্রয়োজন সেগুলো সম্পর্কে মাও জানতে পারবেন।
ব্রেস্টফিডিং করালে পাম্পিং স্ট্র্যাটেজি জেনে রাখুন
যে কোনো কর্মজীবী মাকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানাবে পাম্পিং টাও এক ধরনের জব। সারাদিনে কাজের ফাঁকে এটাও কোনো না কোনোভাবে ম্যানেজ করে নিতে হয়। কাজে ফেরার আগে থেকেই নিশ্চিত হয়ে নিন যে এর সাথে আপনি কমফোর্টেবল হবেন। পাম্প ব্যাগ, পাম্প পার্টস যা যা লাগে আগে থেকেই গুছিয়ে রাখুন। দুই সেট করে রাখবেন সব। এতে করে এক সেট আগের রাতে পরিষ্কার করতে না পারলেও পরের দিন অন্য সেট নিয়ে যাওয়া যাবে।
আপনার অফিসে কি ল্যাকটেশন রুম আছে? যদি থাকে তাহলে ম্যানেজার বা এইচ আরের সাথে কথা বলে সেই রুমে বসে পাম্পিং করানোর বিষয়ে শেয়ার করুন। আপনার কি চাবির প্রয়োজন আছে? আপনার সাথে কি আরও নতুন মা আছে? আপনারা কি সময় নির্ধারণ করে নিয়েছেন? যদি এমন রুম না থাকে, তাহলে ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আগে থেকেই জানিয়ে রাখুন অফিসে ফিরে আপনার কী কী প্রয়োজন হবে।
অর্গানাইজড থাকুন
প্রতিদিনের একটা টু ডু লিস্ট বানিয়ে নিন। অফিস ও বাসার জন্য কিছু কাজ ভাগ করে নিন। সেগুল লিস্ট করে রাখুন। কোন কাজটি আগে করতে হবে ঠিক করে নিন। সেই অনুযায়ী একটা একতা করে কাজ গুছিয়ে ফেলুন।
নতুন রুটিনের সাথে মানিয়ে নিন
শুরুতেই আপনাকে বেশ কিছু এক্সট্রা সতর্কতা মেনে চলতে হবে। যেহেতু অনেকদিন পর অফিসে যাওয়া এবং নতুন একজন মানুষের দায়িত্বও সাথে, তাই কিছু বিষয় আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হবে। কী কী খাবার নিবেন, কোন কোন জিনিস সাথে নিতে হবে, কোন পোশাক পরবেন, শিশুর সারাদিনের খাবার ও খেলনা গোছানো – এমন নানা দিক সামলে তবেই নতুন জীবনে প্রবেশ করতে হবে। শুরুতে একটু কঠিন লাগলেও ধীরে ধীরে সব মানিয়ে নিতে পারবেন। অফিসে কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিবেন, রাতে জলদি শুয়ে পড়বেন, বাড়ি ফিরে খানিকটা বিশ্রাম নিবেন। এতে ক্লান্তি কম হবে।
কাজে ফিরে সাথে অবশ্যই এক্সট্রা নার্সিং প্যাড রাখুন। হেলদি ও নিউট্রিশিয়াস স্ন্যাকসও ডেস্কে রাখুন যেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে খেতে পারেন।
সাহায্য চাইতে লজ্জা পাবেন না
কাজে ফেরার পর প্রতিদিনের কাজ করতে কিছুটা দ্বিধা হতে পারে। মনে রাখবেন, সাহায্য চাওয়াতে কোনো লজ্জা নেই। যদি আপনি কাজে সেটেল হতে না পারেন, তাহলে সহকর্মীদের সাথে কথা বলুন। বাড়িতে কাজ করতে যেয়েও সমস্যা হয়, তাহলে পার্টনার অ পরিবারের অন্যদের সাথে কথা বলুন। সন্তান যদি অসুস্থ হয় বা চাইল্ডকেয়ারে রাখা পসিবল না হয়, তাহলে কীভাবে কাজ সামলাবেন সেটা নিয়ে আগে থেকেই প্ল্যান করে রাখুন, সিনিয়রকে জানিয়ে রাখুন।
নিজের প্রতি ধৈর্য রাখুন
এই সময়টাকে ট্র্যানজিশন বলা হয় কারণ এই সময়ের সাথে মানিয়ে নিতেও ধৈর্য লাগে। এটা সত্যি যে আপনাকে কাজও করতে হচ্ছে, আবার প্যারেন্টিং এর বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়েও বেশ পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। কিন্তু একইসাথে সব করা কিছুটা কঠিন। আপনি অফিস থেকে ফিরে প্রথম দিন খুব ক্লান্ত থাকবেন, প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত এই ক্লান্তিবোধ আপনাকে টানতে হতে পারে। তবে সময়টা সবার জন্য সমান নয়। কারও জন্য বেশি, কারও জন্য কম। কিন্তু সময় তো লাগেই।
এজন্য নিজেকে দোষ দেয়া যাবে না, ভয় পাওয়া যাবে না। কাজের আনন্দ নিতে হবে, প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতে হবে। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার তাড়া থাকবে, সন্তানকে দেখার তাড়া থাকবে, অফিসেরসময় কেন শেষ হচ্ছে তা নিয়ে তাড়াহুড়ো থাকবে। কিন্তু এসব কিছুই একটা সময় অভ্যাস হয়ে যাবে। তাই ধৈর্যহারা হওয়া যাবে না।
নতুন মা হয়ে যখন কর্মক্ষেত্রে ফিরবেন, দেখবেন ফ্রি টাইম বলতে তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না। তাই বলে সব সময় কাজ কাজ করে বিশ্রাম নেয়ার কথা ভুললেও হবে না। পর্যাপ্ত ঘুম এ সময় খুব জরুরি। তাছাড়া নিজের জন্যও কিছুটা সময় রাখুন। মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য হালকা ব্যায়াম করতে পারেন। মোট কথা, নিজেকে মানিয়ে নেয়াটা এ সময় বেশ বড় একটা চ্যালেঞ্জ। তাই বলে হেরে যাওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে এগিয়ে যান, নিজে সুস্থ থাকুন, তাহলে সন্তানও ভালো থাকবে।