স্টোরি টেলিং | গল্পের মাধ্যমে ক্রেতার মনযোগ আকর্ষণ করুন

Building A StoryBrand | Donald Miller | Kendrobindu

একটা সময় ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল বাস্তব দুনিয়ার মাটিতে। সফর করে, প্রচুর খাটাখাটনি করে, হাটেঘাটে ঘাম ঝরিয়ে মানুষ ব্যবসা করেছে, মুনাফা আদায় করে নিয়েছে। সে সময় নিজের পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য মাধ্যম ছিল কম, প্রতিবন্ধকতা ছিল অনেক। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই অবাধ দুনিয়ায় নিজের পণ্য ছড়িয়ে দেবার কাজটি হয়ে উঠেছে অনেক বেশি সহজ। শুধু প্রয়োজন কিছু কৌশলী আর সময়োপযোগী পদক্ষেপের। ব্যবসা এখনো বাস্তব জগতেই আছে, কিন্তু এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে গেছে ভার্চুয়াল জগতেও। অনলাইনে মার্কেটিং এর সহজতা ও কম পরিশ্রমে প্রচুর মানুষের কাছে নিজের পণ্যকে পরিচিত করাবার যে বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটা অফলাইনের ব্যবসাকে আগের চেয়ে করে দিয়েছে আরও অনেক বেশি সহজ।

তাই অনলাইন মার্কেটিং বর্তমানের ব্যবসায়ীদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। অনলাইনে যেহেতু সহজেই বিপুল সংখ্যক মানুষকে একসাথে পাওয়া যাচ্ছে এবং সেই সূত্রে তাদের কাছে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রসারের সুযোগটাও থাকছে, তাই অনলাইনে মার্কেটিং করার ক্ষেত্রে কৌশলগুলো জানা ও দক্ষতার সাথে সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারাটা একবিংশ শতাব্দীতে ব্যবসার জন্য খুব জরুরি একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের লেখায় আমরা এমনই একটি সহজ; হ্যাঁ একদম সহজ একটি কৌশল নিয়ে আলোচনা করবো, যার সার্থক প্রয়োগ আপনার অনলাইন মার্কেটিংকে এনে দিবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের মুখ। তো চলুন, শুরু করা যাক।

এটা প্রমাণিত সত্য যে, মানুষ গল্পের মাধ্যমে বেশি প্রভাবিত হয়। গল্পের মধ্য দিয়ে তার কাছে কোনো তথ্য পৌঁছে দেওয়া হলে সেটা তার মাথায় বেশি ভালোভাবে গেঁথে থাকে। আপনার পণ্য বা সেবাটির সাথে মানুষের এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ এই গল্প বলা বা স্টোরি টেলিং এর মাধ্যমে খুব সহজেই গড়ে উঠে। আর এই যুগে আপনি যদি এই বিষয়গুলো এখনো আয়ত্ত করতে না পারেন তাহলে কখনই আপনার কোম্পানি কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের মুখ দেখতে পারবেন না।

এখন কথা হচ্ছে এই গল্প বলা বা স্টোরি টেলিং আসলে কি? আর এই গল্পটি হবে কার? আপনার কোম্পানির নাকি কাস্টমারের? শুধু স্টোরি টেলিং দিয়ে কাস্টমার আকৃষ্ট করাই কি আপনার কাজ ? নাকি আপনার দেয়া Plan of Action যদি কাস্টমারকে পছন্দ করাতে হবে?

মার্কেটিং-এ স্টোরি টেলিং (Story Telling) হল গল্পের আকারে ক্রেতার মনযোগ আকর্ষণ করা। এই পদ্ধতিতে গল্পের আকারে আপনার কাস্টমারের নিত্যদিনের কোন এক  সমস্যার ব্যাপারে বলতে হয়, যেন তা কাস্টমারের ইমোশন অর্থাৎ আবেগকে ছুঁয়ে যায়। যেহেতু, এখানে ক্রেতার আবেগ নিয়ে কাজ করা হয় তাই এটি যেমন কার্যকর তেমনি সংবেদনশীল। এই পদ্ধতিতে সাধারণত ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করা হয়। ব্যবসার সাথে স্টোরি টেলিংয়ের খুব ভালো একটা সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান ফেসবুকের সবচাইতে ভালো বিজ্ঞাপন মাধ্যম হলো এই গল্প বলা বা স্টোরি টেলিং।

একটা সময় ছিল এবং এখনও অনেকেই আছে যারা ব্যবসায়ী বা ই-কমার্সে অনভিজ্ঞ, প্রোডাক্টের দু একটা ছবি দিয়ে ক্যাপশন লিখে রাখে মূল্য জানতে ইনবক্স করুন, অথবা অর্ডার করতে ইনবক্স করুন। এ ধরনের ক্যাপশনগুলো মানুষের চিরচেনা হয়ে গেছে তাই গ্রাহকরা এ ধরনের পোস্টগুলো দেখলে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করে না।

কিন্তু আপনি যদি এগুলো গল্প আকারে ইমোশনালি তুলে ধরেন, তাহলে গ্রাহকের মনে গেঁথে যাবে। এবং দেখতে পাবেন অনেকেই আপনার লেখার ভক্ত হয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে এখানে কাস্টমারের গল্পটাই মুখ্য আপনার ব্যাবসা নয়।

আপনি একটি পোস্ট করলেন আর সেই পোস্ট যদি রিচ না হয় তাহলে সেল হবে কিভাবে? আপনি গল্প আকারে লিখে দিলে আপনার গল্পের কারণে আপনার পোস্ট রিচ হয়ে যাবে, আর গল্প পড়তে পড়তে বেশ কিছু কমেন্ট চলে আসবে যা আপনার পোস্টটি রিচ হতে অনেক সাহায্য করবে। আর এভাবেই আপনার প্রোডাক্ট বা আপনার পোস্ট সঠিক কাস্টমারের ঠিকানায় পৌঁছে যাবে।

স্টোরি টেলিংয়ের যদি সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয় তাহলেও দেখবেন, আমরা যখন কোনো গল্প পড়ি তখন আমাদের মস্তিষ্কে একটি হরমোনের সৃষ্টি হয় যা আমাদেরকে সেই গল্পের মাধ্যমে প্রভাবিত করে এবং এর ফলে আমাদের মাঝে কিছু আবেগের সৃষ্টি হয় যা আমাদেরকে সেই গল্প বা গল্পকারের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে স্টোরি টেলিং লেখার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা খুব একটা অভ্যস্ত নয়। অনেকেরই দিন চলে যায় কিভাবে কি লিখব কোথায় থেকে শুরু করবো এইসব ভেবে। তাই আর চিন্তা না করে আসুন জেনে নেই এই স্টোরি কিভাবে লিখবো…

স্টোরি টেলিংয়ের সবচাইতে বড় পার্ট হলো ইমোশোনাল অ্যাটাচমেন্ট। আপনার লেখা যত ইমোশনাল হবে ততবেশি গ্রাহককে আটকে রাখা যাবে আপনার লেখার মধ্যে। যেহেতু, এখানে ক্রেতার আবেগ নিয়ে কাজ করা হয় তাই এটি যেমন কার্যকর তেমনি সংবেদনশীল। আর আপনি যদি গল্পটাকে ইমোশনালি ফুটিয়ে তুলতে পারেন তাহলেতো কোনো কথাই নেই পাঠকের সংখ্যা বেড়েই চলবে। আর এভাবেই আপনার পোস্টগুলো ভাইরাল হতে থাকবে।

এখন বড় কথা হলো কিভাবে আমরা এই ইমোশনাল স্টোরি লিখবো?

এই বিষয়ে ডোনাল্ড মিলার তার লিখা বই Building a StoryBrand (বিল্ডিং এ স্টোরি ব্র্যান্ড)-এ খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন। ডোনাল্ড মিলার একজন আমেরিকান লেখক, পাবলিক স্পিকার এবং একজন ব্যবসায়ী। তিনি “StoryBrand” নামক মার্কেটিং এবং কনসালটেন্সি কোম্পানির সিইও। মার্কেটিংয়ের উপর তার লেখা একটি অন্যতম বই “Building a StoryBrand”. যারাই সেলস, মার্কেটিং বা ব্র্যান্ডিং-এ আগ্রহী তাদের জন্য এই বইটি পড়া অতিব জরুরী।

এই বইটি মূলত গল্প বলা নিয়ে। কাস্টমার সাধারণত নিজেদের গল্প শুনতে চায়, তারা আপনার গল্প শুনতে চায় না। মিলার এই বইয়ে খুব সুন্দর ভাবে যে বিষয় গুলো তুলে ধরেছেন তা হলো একটা স্টোরি কিভাবে সাজাতে হবে, স্টোরি টেলিং এর শুরুতে কি থাকবে মাঝে কি থাকবে শেষে কি থাকবে?

এই গল্পের বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে মিলার ৭টা সুন্দর একদম বেসিক স্টেপ সাজিয়ে দিয়েছে। এই সাতটা স্টেপ যদি কেউ ফলো করে তাহলে যেকোন ব্র্যান্ড স্টোরি এতো সিম্পল ও অর্গানাইজড হবে যে কাস্টমারের কনভার্সন রেট অনেকগুন বেড়ে যাবে।

মিলারের মতে পৃথিবীর ৯৯% গল্পই এক রকম। এই গল্পে প্রথমত একটা চরিত্র থাকবে সেই চরিত্রের একটা প্রবলেম হবে সেই প্রবলেমের একটা সল্যুশন প্রয়োজন হবে সেই সল্যুশনের জন্য সে একটা গাইড খুঁজবে যে গাইড তাকে তার সমস্যা থেকে মুক্তির পথ দেখাবে এরপর হয় চরিত্রটি জয়ী হবে অথবা পরাজয় বরণ করবে। এই ফরম্যাটটা কিন্তু জানা বেশ জরুরী, কেননা StoryBrand বইয়ের মূল অংশই হলো এই সাতটি ধাপ।

যদি পয়েন্ট আকারে এই সাতটি ধাপ লিখি তাহলে, প্রতিটি গল্পের—

  1. একজন ক্যারেক্টার থাকবে
  2. ক্যারেক্টারের একটা প্রবলেম রয়েছে
  3. ক্যারেক্টারটি সেই প্রবলেমের সল্যুশন খুঁজছে
  4. সল্যুশনের জন্য ক্যারেক্টারের একটা গাইড প্রয়োজন
  5. গাইড Plan of Action দিবে
  6. ক্যারেক্টার এই Plan of Action অনুসারে প্রবলেম সলভ করার চেষ্টা করবে
  7. এবং ফাইনালি ক্যারেক্টারটি প্রবলেম সলভ করতে পারবে

এই গল্পে আপনি হচ্ছেন সেই গাইড যিনি কিনা ক্যারেক্টারকে সমাধান খুঁজে দিবেন। মিলার এখানে বলেছেন, এই পুরো জার্নিতে কাস্টমার হলো গল্পের নায়ক। এই কাস্টমারের একটা প্রবলেম হবে এবং সেটির সল্যুশন দরকার। এখন কাস্টমারের এই প্রবলেম সল্যুশনের জন্য একজন গাইড প্রয়োজন। ঠিক এই জায়গায় গল্পে আপনার এন্ট্রি হলো। আপনার প্রোডাক্ট, সার্ভিস বা মার্কেটিং হলো এখানে গাইড। আপনার মার্কেটিং মেসেজ কাস্টমারকে এই সল্যুশনের কথা বলবে। কাস্টমার যদি মনে করে আপনার দেয়া Plan of Action অনুসারে তার সমস্যার সমাধান সম্ভব, সে তখন আপনার প্রোডাক্ট ব্যবহার করবে এবং শেষে যেয়ে তার সমস্যার সমাধান করবে।

এখানে কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, শুধু স্টোরি টেলিং দিয়ে কাস্টমার আকৃষ্ট করাই আপনার কাজ নয়। আপনার দেয়া Plan of Action কাস্টমারকে পছন্দ করাতে হবে। একজন বিক্রেতা হিসেবে কাস্টমারের সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আপনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন না। কাস্টমার আপনার প্রোডাক্ট কিনলো, নিজের সমস্যার সমাধান করলো; শুধুমাত্র তখনই আপনার স্টোরি টেলিং সফল বলে গণ্য হবে।

এতো কথা বলার কারণ হলো, মিলার বলতে চেয়েছেন, আপনি যদি স্টোরি টেলিং এর এই মৌলিক ধাপগুলো অনুসরণ করেন তাহলে নিশ্চিতভাবে আপনার ব্যবসার প্রোডাক্ট কিংবা সার্ভিস, তার কাস্টমারকে খুঁজে পাবে।

আপনার স্টোরি টেলিং এর মূল লক্ষ্য থাকবে কাস্টমারকে Plan of Action দেয়া। আপনি যদি এই কাজটি যথাযথ ভাবে না করেন তাহলে কাস্টমার কখনোই আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস মার্কেটের অন্যান্য প্রোডাক্ট বা সার্ভিস থেকে কেন ভালো, এই পার্থক্য করতে পারবে না।

সুতরাং একজন গাইড হিসেবে কাস্টমারের সমস্যাকে খুঁজে বের করার সক্ষমতা আপনার থাকতে হবে এবং স্টোরি টেলিং এর মাধ্যমে মার্কেটিং মেসেজ সাজানোর সময় চেষ্টা করতে হবে প্রবলেমের সার্ফেস লেভেলের কথা না বলে মূল সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা বলা।

ডোনাল্ড মিলার এই ফর্মূলাটির নাম দিয়েছেন এসবি৭ ফর্মূলা। আপনি যদি আপনার একটি স্টোরি ব্র্যান্ড তৈরি করতে চান, আপনি যদি আপনার মেসেজ আপনার টার্গেটেড অডিয়্যান্সের নিকট সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে চান তাহলে যতো দ্রুত সম্ভব “বিল্ডিং এ স্টোরি ব্র্যান্ড” বইটি পড়ে ফেলুন। আমি বিশ্বাস করি এই বইটি আপনার ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে দিবে।

আপনি যদি “বিল্ডিং এ স্টোরি ব্র্যান্ড” বইটি পড়ে এই ফর্মূলাটি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারেন তাহলে আপনার কাস্টমার আপনার ব্র্যান্ডের প্রেমে পড়ে যাবে আর আপনার বিজনেস কম্পিটিটর আপনার কোম্পানির ধারে কাছেও আসতে পারবেনা।

আজ এ পর্যন্তই। পরবর্তী ব্লগে এই বই থেকে আরও দারুন কিছু কৌশল নিয়ে আপনাদের সাথে আলোচনা করবো। ততোদিন সবাই ভালো থাকুন। আমাদের আজকের এই আলোচনাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই একটি কমেন্ট করে জানাবেন এবং আরও অনেকের উপকারের স্বার্থে শেয়ার করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *