রতন টাটা | মানুষকে ভালোবেসে বড় হয়েছিলেন যিনি

আপনাকে যদি বলা হয়, এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি বিশ্বের অন্যতম ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানি বা  গৌতম আদানির চেয়েও বেশি সম্পদশালী হতে পারতেন কিন্তু আপনি কখনোই তার নাম ভারতীয় বিলিওনিয়ার কিংবা বিশ্ব বিলিওনিয়ারদের মাঝে শোনেননি তবে কি আপনি বিশ্বাস করবেন? বিশ্বাস না করলেও সত্য এটাই যে এমন একজন মানুষই ছিলেন রতন টাটা। যার ছিল দারুণ ব্যবসায়িক বুদ্ধি, বিচক্ষণতা এবং মানুষের জন্য অপরিসীম মায়া। ভারতের অন্যতম পুরোনো ব্যবসার কর্ণধার, অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী হওয়া স্বত্ত্বেও কেন তার নাম কখনো আপনি বিলিওনিয়ারদের মাঝে শোনেননি? আজকে তাই জানাবো। চলুন একটু জেনে নিই ভারতের অন্যতম বড় ও পুরোনো কোম্পানির এক জনদরদী কর্ণধারের কথা।

টাটা কোম্পানির শুরুর কথা

রতন টাটা সম্পর্কে জানার আগে আমরা একটু জেনে নিই টাটা কোম্পানির শুরুর কথা। প্রায় দু’শো বছর আগে ১৮২২ সালে ভারতের গুজরাটের এক গ্রামে পারসিয়ান এক প্রিস্ট ফ্যামিলিতে জন্ম নেন নাসেরওয়ানজি টাটা নামের এক বালক। ছোটকাল থেকেই তিনি ছিলেন বেশ কৌতূহলী এবং সবসময় তিনি বড় কিছু করতে চাইতেন। কথিত আছে পুরো গ্রামে তিনি একমাত্র মানুষ ছিলেন যার মনে হতো যে গ্রামের জন্য গ্রামের বাইরে যেয়ে বড় কিছু  করা প্রয়োজন। তাই মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি নিজের গ্রাম ছেড়ে স্ত্রী এবং ছেলে সহ পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে, উদ্দেশ্য ছিল কোনো ব্যবসা দাঁড় করানো। 

সেসময় তুলোর বিজনেস তাকে বেশ আকর্ষণ করে এবং তিনি তুলো এক্সপোর্টের বিজনেস শুরু করেন। নাসেরওয়ানজি টাটা ব্যবসায়ের থেকে যা লাভ করতেন তার অনেকটাই খরচ করতেন ছেলে জামশেদজি টাটার পড়াশোনার পেছনে। তিনি নিশ্চিত করেন যেন তার ছেলে সেসময়ের সবচেয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। তাই জামশেদজি টাটা সেসময় ইংলিশ শিক্ষায় শিক্ষিত হন। তার বয়স যখন ১৮ হয় তখন তার বাবা অর্থ্যাৎ নাসেরওয়ানজি টাটা সিদ্ধান্ত নেন তার ব্যবসা আরো বড় করার জন্য তাকে হংকং পাঠাবেন। সালটি ছিল ১৮৫৯, উড়োজাহাজ তৈরিরও ৫৫ বছর আগের কথা, সেসময় জাহাজে চড়ে দিনের পর দিন ভ্রমণ করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে হতো। সেই সময়েই জামসেদজি টাটা নিজের স্ত্রী এবং সন্তানসহ হংকং এ পাড়ি জমান। বাবার মতো ব্যবসার ক্ষেত্রে তারও ছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি। পুরো জীবদ্দশায় তিনি চীন, জাপান, ইউরোপ এবং আমেরিকায় ব্যবসা ছড়িয়ে দেন। ১৮৬৮ সালে জামশেদজি একটি ট্রেডিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে টাটা গ্রুপ নামে পরিচিত হয়। ১৮৭২ সালে তিনি তুলো উৎপাদন বাড়িয়ে তোলেন এবং নাগপুর, বোম্বে ও কুর্লাতে মিল প্রতিষ্ঠা করেন। তার মিল ও কোম্পানী দক্ষতা, উন্নত শ্রমিক সুরক্ষা পলিসি এবং উন্নতমানের ফাইবার তৈরীর জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ১৯০১ সালে ইন্ডিয়ার প্রথম স্টিল ফ্যাক্টরীর কন্সট্রাকশন শুরু করেন যা বর্তমানে টাটা স্টিল নামে পরিচিত। তার দুই পুত্র স্যার দোরাবজি জামশেদজী টাটা এবং স্যার রতনজি টাটা এর পরিচালনায় টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি ভারতের বৃহত্তম প্রাইভেট স্টীল প্রস্তুতকারক হয়ে ওঠে এবং কেবল টেক্সটাইল, আয়রন ও জলবিদ্যুৎই নয় বরং রাসায়নিক, কৃষি সরঞ্জাম, ট্রাক, লোকোমোটিভ এবং সিমেন্টও উৎপাদনকারী একাধিক কোম্পানির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। 

১৯০৩ সালে তিনি ইন্ডিয়ার প্রথম ফাইভ স্টার হোটেল তৈরী করেন যেটায় ইলেক্ট্রিসিটি ছিল। যা আজও বিশ্বে সবার কাছে সমাদৃত “হোটেল তাজ মহল” নামে। ১৯০৪ সালে জামশেদজি টাটা মৃত্যুবরণ করেন। রেখে যান এক দারুণ নীতিগত লেগ্যাসি। যেখানে অন্যান্য সব ব্যবসা, কল কারখানা শ্রমিকদের সুবিধার কথাই ভাবতো না, সেখানে জামশেদজি টাটা ভারতে প্রথম প্রভিডেন্ট ফান্ড, মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্স, পে উইথ লিভ চালু করেন। শুধু তাই-ই নয় ফ্যামিলি ডে, স্পোর্টস ডে চালু করেন যা সেই শ্রমিক শোষণের আমলে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

জামশেদজি টাটার পর তার কোম্পানীর হাল ধরেন তারই দুই ছেলে। পরিবারের ব্যবসায়ীক দারুণ জ্ঞান ও দক্ষতায় তারাও টাটা কোম্পানীকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। জামশেদজী এর জীবদ্দশায় তিনটি ইচ্ছে ছিলো- একটি ফাইভ স্টার হোটেল খোলা যেখানে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ যেতে পারে, একটি হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরী এবং একটি স্টিলের ফ্যাক্টরী তৈরী করা। তিনি বেঁচে থাকতে শুধুমাত্র হোটেলটিই করে যেতে পেরেছিলেন তবে বাকি প্রোজেক্টগুলোর কাজও শুরু হয়েছিলো। দোরাবজি টাটা তার বাবার স্বপ্ন পূরণে শক্ত হাতে নেমে পড়েন। স্টীল ফ্যাক্টরী যখন পুরোদমে চালু হলো, ১৯০১ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটিশদের যুদ্ধের জন্য প্রচুর পরিমাণে স্টিলের প্রয়োজন হলো। টাটার স্টিল ফ্যাক্টরী এসময় স্টীলের সবচেয়ে বড় সাপ্লায়ার হয়ে পড়লো। তাদের স্টিল দিয়ে বানানো হলো ট্যাংক, অস্ত্র, রেলওয়ে ট্র্যাকস। একটি বিখ্যাত উক্তি আছে তাদের স্টিল নিয়ে, যা একজন ব্রিটিশ পলিটিশিয়ান বলেছিলেন- “টাটা স্টীল আমাদেরকে বাঁচিয়েছে। তাদের স্টিলের কোয়ালিটি এত ভালো ছিল যে তা দিয়ে বানানো ট্যাংক বোমার আঘাতেও কিছু হয়নি।”  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর টাটা স্টিল গ্রেট ব্রিটেনে বেশ রেপুটেশন পেয়ে যায়। এবং ১৯১৪ সালে আসতে আসতে টাটা গ্রুপ এত বিশাল হয়ে ওঠে যে এর অধীনে ১৪ টি আলাদা আলাদা কোম্পানি ছিলো। দোরাবজি টাটা কোম্পানি সামলান ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত। এরপরই এই কোম্পানির দায়িত্ব নেন তাদের দূর সম্পর্কের কাজিন জাহাঙ্গীর রতন টাটা সংক্ষেপে যিনি জে আর ডি টাটা নামে পরিচিত। তিনিও ছিলেন অনেক প্যাসোনেট এবং তার স্বপ্নও ছিলো বিশাল। মূলত জে আর ডি টাটার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ছিলো ফ্রান্সে, পেশায় ছিলেন পাইলট। তিনি ভারতের সর্বপ্রথম এয়ারলাইন্স, টাটা এয়ারলাইন্স চালু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর জওহরলাল নেহেরু সিদ্ধান্ত নেন ইন্ডিয়ার যত বড় বড় কোম্পানী আছে সবই সরকারীকরণ করা হবে। সেই সুবাদে জে আর ডি টাটার এই এয়ারলাইন্স ও সরকারী তদারকিতে চলে আসে এবং নাম দেয়া হয় “এয়ার ইন্ডিয়া”। এটি ছিলো জে আর ডি টাটার জন্য বেশ হৃদয়বিদারক। তবে তিনি মেনে নিয়েছিলেন কারণ টাটা পরিবার মনে করতেন ব্যবসা শুধু লাভের জন্য নয়, বরং দেশ গঠনের জন্যও। তাই ন্যাশনালাইজ করার পরও যখন জে আর ডি টাটা কে এয়ার ইন্ডিয়া লিড করার প্রস্তাব করা হয়, তিনি তাতে আনন্দের সাথেই রাজি হন। সত্তর এবং আশির দশকে এয়ার ইন্ডিয়াকে দুনিয়ার অন্যতম প্রেস্টিজিয়াস এয়ারলাইন বলা হতো। এর বাইরে জে আর ডি টাটা নানান সেক্টরে নিজেদের ব্যবসাকে প্রসারিত করতে থাকেন। ১৯৪৫ সালে টাটা মোটরস এর প্রথম প্রোডাক্ট লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তৈরী হয়। ১৯৬৮ সালে টাটা কনসাল্টেন্সী সার্ভিস বা টিসিএস তৈরী হয় যা ইলেক্ট্রনিক ডাটা প্রসেসিং সার্ভিস প্রোভাইড করতো। বর্তমানে ইন্ডিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এমপ্লোয়িং কোম্পানি হলো এই টিসিএস। এছাড়াও ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টার, লবণের কোম্পানী, ইলেক্ট্রনিক্স ম্যানুফ্যাকচারিং সহ আরো অনেক দিকে ব্যবসা বড় করে তোলেন। জে আর ডি টাটা ৫২ বছর ধরে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন এবং এই সময়ে ৯৫ টি কোম্পানী ছিলো টাটা কোম্পানীর অধীনে। কিন্তু সময়ের অধীনে ও সরকারী কিছু রুলসের কারণে টাটা গ্রুপের কিছু কোম্পানী লস প্রজেক্টে পড়ে যায়। এর মাঝে ছিল ইলেক্ট্রনিক ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী যা নেলকো নামে পরিচিত। এর মার্কেট শেয়ার সেসময় ২০% থেকে ২% এ এসে দাঁড়ায়। এই নেলকো থেকেই শুরু হয় রতন টাটার সফলতার গল্প।

রতন টাটা কে ছিলেন?

নিজেদের কোনো সন্তান ছিল না তাই নাভাল নামের এক ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন রতনজি টাটা এবং তার স্ত্রী নাওয়াজবাই টাটা। এই নাভাল টাটা ছিলেন রতন টাটার বাবা। নিজের পালক পিতার নাম অনুসরণেই নিজের ছেলের নাম রেখেছিলেন রতন টাটা। রতন টাটার জন্ম ১৯৩৭ সালে ২৮ ডিসেম্বর, তৎকালীন মুম্বাইতে, ব্রিটিশ শাসনামলে। মাত্র ১০ বছর বয়সেই রতন টাটার বাবা নাভাল টাটা এবং মা সোনু টাটার মাঝে ডিভোর্স হয়ে যায়। এতটুকু বয়সের বাবা মায়ের ছায়া হারিয়ে ফেলা রতন টাটাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন তার দাদী নাওয়াজবাই টাটা।

নওয়াজবাই টাটা রতন এবং তার ভাই জিমি টাটার দায়িত্ব নেন। দাদির কাছে কখনোই আদর বা যত্নের অভাব হয়নি রতন টাটার। নিজের সন্তানদের মতই রতনদেরকে আদরে যত্নে এবং শিক্ষায় বড় করে তোলেন নওয়াজবাই টাটা। মুম্বাইতে পড়াশোনা শুরু করলেও হাই স্কুলের জন্য আমেরিকায় চলে যান রতন টাটা। সেখানে রিভারডেল কান্ট্রি স্কুল থেকে হাই স্কুল কমপ্লিট করে কর্ণেল ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচারে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট  প্রোগ্রামে ভর্তি হন।  এরপর আমেরিকান একটি  আর্কিটেকচারাল ফার্মে চাকরি শুরু করেন। টাটা কোম্পানির এত বড় সম্রাজ্যে আসার কোনো লোভ রতন টাটার মাঝে ছিল না। কিন্তু এমন সময় তার দাদী অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ইন্ডিয়া ফিরে আসেন। 

টাটা কোম্পানীতে টাটা রাজপুত্র

দেশে ফেরার পর স্বনামধন্য আইবিএম কোম্পানিতে চাকরির জন্য ডাক পড়ে। রতন টাটা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিলেন যে তিনি আইবিএম এই জয়েন করবেন ,কিন্তু জে আর ডি টাটা তখনো বেঁচে ছিলেন। তিনি রতন টাটাকে নিজেদের কোম্পানি থাকতে অন্য কোম্পানিতে চাকরি করতে কীভাবে দিবেন? তাই রতন টাটা ১৯৬২ সালে টাটা মোটরস এ কিছুদিন ট্রেনিং এ থেকে তারপর টাটা স্টিলে সাধারণ একজন কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেন। রতন টাটা এখানে শ্রমিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতেন এমন কি মাঝে মাঝে নিজেও গনগনে আগুনের সামনে থেকে বেলচা দিয়ে চুনাপাথর তুলতেন। কাজেই যাদের মনে হয় যে রতন টাটা উত্তরাধিকার সূত্রেই সব পেয়েছেন- তারা যে কতটা ভুল তা এখান থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তার বিচক্ষণতা, দক্ষতা ও ডেডিকেশনের যে অভাব ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন মাত্র তিন বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের মাঝেই তিনি টাটা স্টিল কোম্পানীর টেকনিক্যাল অফিসার হয়ে ওঠেন। 

এর মাঝে নেলকো (ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি) কোম্পানির চলছিল দুর্দিন। এদিকে রতন টাটার দক্ষতা ততদিনে কোম্পানির সবাই বুঝতে শুরু করেছে। তা নেলকোর ডিরেক্টর ইনচার্জ হিসেবে তাকে ১৯৭১ সালে দায়িত্ব দেয়া হলো। নেলকো মূলত রেডিও বানাতো। রতন টাটা দায়িত্ব নিয়েই বললেন যে নেলকো বাঁচাতে হলে আমাদেরকে প্রোডাক্ট আপগ্রেড করতে হবে, আরো অ্যাডভান্স টেকনোলজিতে ইনভেস্ট করতে হবে। কাজেই রেডিও বানানো বাদ দিয়ে নেলকো তখন স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স এর দিকে ঝুঁকলো। তিন বছরের মাঝে নেলকো আগের অবস্থায় ফিরে গেলো, ২% মার্কেট শেয়ার থেকে ২০% মার্কেট শেয়ারে উঠল। যদিও পরবর্তীতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হওয়ায় নেলকো পুরোপুরি শাট ডাউন হয়ে যায়। তবে এর মাধ্যমে টাটা গ্রুপের উচ্চপদস্থ সবাই রতন টাটার দক্ষতার পরিচয় ভালোভাবেই পেয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে তাই তাকে টাটা গ্রুপের উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং রতন টাটাকে টাটা গ্রুপের চেয়ারপারসন হিসেবে জে আর ডি টাটা ঘোষণা দেন। যদিও চেয়ারপারসন হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন মোট চারজন কিন্তু তার মাঝে রতন টাটার নামই ছিল না। ফলে মিডিয়া এবং কোম্পানি সহ সব জায়গায় বেশ তোলপাড় শুরু হয়, কোম্পানির অনেকেই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তবে রতন টাটার দক্ষতাই ছিলো তাদের জন্য মোক্ষম জবাব। এরপর থেকেই শুরু হলো টাটা গ্রুপের সফলতার আরেক অধ্যায়।

টাটা কোম্পানীর সোনালী দিন

সরকার থেকে যখন ঘোষণা আসে ইন্ডিয়া সোশ্যালিস্ট ইকোনমিক্যাল মদেল থেকে ক্যাপিটালিজম এর দিকে যাবে, রতন টাটা সেসময় বিচক্ষণতার সাথে দারুণ এক পদক্ষেপ নেন। তিনি যত সাবসিডিয়ারী গ্রুপ ছিল তার অধীনে ছোট ছোট কোম্পানীগুলোর ওনারশীপ বাড়াতে থাকেন, ফলে টাটা কোম্পানী একটি বড় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। এর ফলে কোনো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানী এসে টাটা কোম্পানী কিনতে পারে না। এই সিদ্ধান্তটি এত সাক্সেস্ফুল ছিল যে সে সময়ে টাটা কোম্পানি শুধু সারভাইভ করেনি বরং বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোও কিনতে শুরু করে। ইংল্যান্ডের চা কোম্পানী টেটলি টি, ইউরোপের একটি স্টিল জায়ান্ট কোম্পানী কোরাস ইত্যাদি কিনে নেয় টাটা গ্রুপ।

ফোর্ডের উপর নেয়া সুইট রিভেঞ্জ

রতন টাটা সম্পর্কে যে ঘটনাগুলো বহুল প্রচলিত তার মাঝে এটি বেশ মজার সেই সাথে ইন্সপায়ারিংও বটে। ১৯৯১ সালে ইন্ডিয়ায় প্রথম বাজারে আসে সম্পূর্ণ দেশীয় পার্টস ও প্রযুক্তিতে তৈরী গাড়ি টাটা ইন্ডিকা। রতন টাটা ভেবেছিলেন দেশে কম বাজেটের মাঝে ভালো মানের গাড়ি পেলে মধ্যবিত্তরাও গাড়ি চালাতে পারবে এবং আগ্রহী হবে কিনতে। কিন্তু জনগণের মাঝে বিদেশী গাড়ি কেনার মনোভাব বেশি থাকায় এই প্রোজেক্টটি লসের মুখে পড়ে। তাই কোম্পানিকে বাঁচাতে বিশ্ববিখ্যাত গাড়ির কোম্পানি ফোর্ডের দ্বারস্থ হন রতন টাটা। তিনি ভেবেছিলেন ফোর্ডের সাথে যুক্ত হতে পারলে হয়ত ইন্ডিকা কেনায় আগ্রহী করে তোলা যাবে জনসাধারণকে। আমেরিকায় মিটিং এ ফোর্ডের সে সময়ের চেয়ারম্যান বিল ফোর্ডের সাথে দেখা করলে তিনি বেশ তালিচ্ছ্য আর অপমান করেন রতন টাটা ও তার টিমকে। 

১৯৯৯ সালের এই মিটিং থেকে বেরিয়ে এসে টানা তিন বছর রতন টাটা এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলেন। যত ইন্ডিকা গাড়ি ছিল বা চলছিলো তার যত সমস্যা হচ্ছিলো তা কোম্পানীর টাকায় কাস্টমারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঠিক করতে লাগলেন। এমনকি এজন্য টাটা মোটরসকে লসের মুখেও পড়তে হলো। সবাই ভাবলো রতন টাটা অপমান মেনে নিতে না পেরে বুঝি পাগলই হয়ে গেছেন। কিন্তু মূলত তিনি টাটা ব্র্যান্ডের উপর জনগণের আস্থা তৈরী করছিলেন এভাবে। এরপর ২০০২ সালে বাজারে আসলো টাটা ইন্ডিকা ভি ২। মাত্র ১৮ মাসে ১ লক্ষ গাড়ি সেল হয়ে হয়ে ভারতের অটোমোবাইল জগতে রীতিমতো তোলপাড় ফেলে দিলো সেটি। সফলতার পারদ তখন উপরে চড়তে শুরু করেছে টাটা কোম্পানিতে। এর মাঝে টাটা কনসাল্টেন্সি সার্ভিসকে আর উন্নত করে তুললেন, টাটা স্কাই এর মত সফল নেটওয়ার্কিং ব্র্যান্ড আনলেন। এদিকে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় ফোর্ড কোম্পানির অবস্থা নাজেহাল। এমন সময়েই টাটা কোম্পানী মেইল করে ফোর্ডকে জানায় তাদের জাগুয়ার এবং ল্যান্ড রোভার কোম্পানির স্বত্ত্ব কিনতে চায় টাটা। পরে ২.৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এ দুটি ব্র্যান্ডের স্বত্ত্ব কিনে নেন রতন টাটা।

 

 

 

তবুও জনদরদী আর বিনয়ী

এমন দারুণ একটি প্রতিশোধের সময় বিল ফোর্ড যখন বললেন “আপনি এগুলো কিনে আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন” তার প্রত্যুত্তরে “থ্যাংকিউ” ছাড়া অন্য কোনো শব্দ ব্যয় করেননি রতন টাটা। এই মানুষটি সারাজীবন দেশ এবং জনগণের জন্য কাজ করে গেছেন। আয়ের ৬৬% যেতো টাটা ট্রাস্ট ফান্ডে তাই আপনি কখনো বিলিওনিয়ার লিস্টে এই মানুষটির নাম দেখেননি। যখন মুকেশ আম্বানি ১৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি বানালেন, রতন টাটা তখন বলেছিলেন “আমাদের দেশে প্রত্যেকদিন ২২-২৩ কোটি মানুষ খালি পেটে ঘুমাতে যায়। সেখানে এত টাকা দিয়ে মুকেশ আম্বানি কেন বাড়ি বানালেন আমি বুঝিনি।” এটি নিয়ে সে সময় তুমুল বিতর্ক শুরু হয় তবে রতন টাটা আজীবনই সাধারণ মানুষের জন্য ভেবেছেন। যদিও শ্রেষ্ঠ দানবীরের নামের লিস্টেও তাকে পাবেন না কারণ টাটা চ্যারিটেবল ফান্ড গঠন করেছিলেন জামশেদজী টাটা। তাই টাটা কোম্পানী থেকে যত টাকা দান হয় তা সবই তার নামে হয়ে থাকে, এজন্য বিশ্বের সবচেয়ে দানবীরের তালিকায় শীর্ষে আছেন জামশেদজী টাটা। তারপরও সাধারণ মানুষের জন্য কম টাকায় ক্যান্সারের চিকিৎসা করার জন্য হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট নির্মাণ এমন কি কুকুরদের জন্যও হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন রতন টাটা।

সাধারণ মানুষের জন্য এমন মায়া থেকেই বাজারে এনেছিলেন টাটা ন্যানো। ঘটনাটি ছিলো এমন- একদিন ঝুম বৃষ্টির মাঝে রতন টাটা গাড়ি রাস্তায় দাড়িয়েছিলো, তিনি খেয়াল করেন ৪ জনের একটি পরিবার একটি মোটরসাইকেলে একদম ঠাসাঠাসি করে বসে আছে এবং বৃষ্টিতে ভিজছে। সেই থেকে তার মাথায় আসে কীভাবে কম বাজেটে গাড়ি এমন সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেয়া যায়। এর ৫ বছর পর বাজারে আসে বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি টাটা ন্যানো। যদিও ভুল মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির কারণে টাটা ন্যানো সেভাবে মার্কেট দখল করতে পারেনি তবে যদি সফল হতো তাহলে হয়ত ইন্ডিয়ার প্রায় সব মধ্যবিত্তের একটি করে গাড়ি থাকতো। তবে টাটা কোম্পানির বিজনেস মোটো কখনোই শুধু লাভ করা ছিলো না, বরং সবসময় সমাজের কল্যাণ করাই ছিলো মূল লক্ষ্য।  

শুধু মানুষ নয়, কুকুরদের প্রতিও ছিলো এই মানুষটির অসীম মায়া। তাজ মহল হোটেলে তাই দেখা যেত কুকুরদের অবাধ বিচরণ। এমন কি প্রিন্স চার্লসের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের পোষা কুকুর অসুস্থ থাকায় তার পাশে থাকার জন্য। আসলে কখনো বিয়ে না করা এই একলা মানুষটি এই কুকুরগুলোকেই পরিবারের সদস্য বানিয়ে নিয়েছিলেন। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিং এও তারা থাকতো তার সঙ্গী হয়ে।

 

এক দরদী নেতৃত্বের শেষ

অসম্ভব বিনয়ী এবং বিচক্ষন এই সাধারণ থাকতে চাওয়া অসাধারণ মানুষটিরও একদিন সময় হয়ে আসে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার। বেশিদিন আগে নয়, ২০২৪ সালের ৯ই অক্টোবর জানা গেলো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে হেরে গিয়েছেন রতন নাভাল টাটা। পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন এমন একজন মানুষ যিনি সারাজীবন মানুষের জন্য ভেবেছেন, যেকোনো কিছুর আগে মানবতাকে ঠাঁই দিয়েছেন সবার আগে।

জীবদ্দশায় এই মানুষটি তার অসাধারণ সব কৃত্তিত্বের নানা সম্মানজনক পদক ও পুরষ্কারে ভূষিত হন। পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, নাইট গ্রান্ড ক্রস সহ ছোট বড় নানা সম্মাননা ছিলো তার ঝুলিতে। এতকিছুর পরও খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন তিনি। মাঝে মাঝে বসে পড়তেন নিজের ড্রাইভারের পাশে, কিংবা ড্রাইভার না থাকলে নিজের গাড়ি নিজেই চালাতেন। সম্মান করতেন সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে, খেয়াল রাখতেন কোম্পানীতে যুক্ত মানুষদের, শ্রমিকদের জন্য নানা সুবিধার ব্যবস্থা করতেন। 

রতন টাটার কিছু কালজয়ী উক্তি

রতন টাটার কিছু উক্তি শুনলেই বোঝা যায় মানুষটি কতটা বিনয়ী এবং বিচক্ষণ ছিলেন-

নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব নেওয়া। নেতৃত্ব মানে তোমার অধীনে যারা আছেন, তাদের সবচেয়ে ভালোভাবে খেয়াল রাখা

তিনি আরো বলেছেন-

তুমি যদি দ্রুত হাঁটতে চাও, তাহলে একা হাঁটো। কিন্তু তুমি যদি অনেকটা দূর হাঁটতে চাও, সবাই মিলে একসঙ্গে হাঁটো”

জীবনে উত্থান–পতন থাকবেই। এভাবেই তুমি এগিয়ে যাবে। কেননা ইসিজি রিপোর্ট ‘সরলরেখায়’ আসার মানে হলো তুমি মৃত!

রতন টাটা তার জীবদ্দশায় টাটা কোম্পানিকে নিয়েছেন এক অন্য মাত্রায়। তিনি চেয়ারপারসন থাকাকালীন টাটা কোম্পানীর রেভিনিউ বেড়েছে ৪০% এবং আয় বেড়েছে ৫০%। রতন টাটা সবসময় তরুণদেরকে সুযোগ দেয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সবসময় চাইতেন তরুণেরা এগিয়ে যাক, নেতৃত্ব দিক, দেশ নিয়ে ভাবুক। তিনি ছিলেন উদ্যমী, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী এবং সাহসী। লাভ লসের হিসাবের বাইরে যে একটি সুন্দর জীবন আছে- তা তিনি খুব  ভালোভাবেই দেখিয়ে দিয়েছেন পুরো বিশ্বকে। তার এত নিষ্ঠা আর বিনয় থাকার থাকার ক্রেডিট ও তিনি দিতেন তার দাদীকে, যিনি তাদেরকে পরম মমতায় বড় করেছিলেন। শুধুমাত্র একজন বড় ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি না হয়ে বরং মানুষের জন্য, সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করার এই দীক্ষা টাটা পরিবারকে নিয়ে গিয়েছে অন্য এক উচ্চতায়। নানা বাধা বিপত্তি, ক্ষয়ক্ষতির মুখেও তাই ভারতের সবচেয়ে পুরনো প্রাইভেট কোম্পানিটি আজও দাঁড়িয়ে আছে স্বগর্বে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *