স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা কি আদৌ সম্ভব! কীভাবে প্রস্তুতি নেয়া যায় তাহলে?

অনেক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেকগুলো জিজ্ঞাসু চোখ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনি কী বলবেন, কীভাবে বলবেন তা শোনার জন্য তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আপনিও বেশ ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন কথা বলার জন্য। কথা শুরু করার সময় হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন বেশ কয়েকটি স্ক্রিপ্ট অথবা স্লাইডে লেখা থাকলো যা যা বলবেন তার সবই। মুহূর্তেই দর্শক সারিতে গুঞ্জন উঠলো ‘এই বক্তব্য শুনে কী হবে? সবই তো স্লাইডে দেয়া!’ আপনি বেশ নার্ভাস হয়ে গেলেন। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনি ভেবেছিলেন স্লাইডে লেখা তো থাকলোই। হাতে স্ক্রিপ্টও থাকলো। দেখে দেখে শুধু বলে গেলেই হবে। বেশ প্রশংসাই কুড়াবেন, কারণ আপনি বলতে পারেন ভালো। মোট কথা ঘটনা পুরোটাই উলটে গেলো। এটি কেন হলো বলতে পারেন? কারণ স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা দর্শকে মনযোগ ধরে রাখার অন্যতম একটি উপায়। কিন্তু সেই উপায়টিই যখন আর থাকছে না, তখন তারা কীভাবে আগ্রহ পাবে? এমন সমস্যার মুখোমুখি কমবেশি আমরা সবাই হই। কিন্তু এর সমাধান নিয়ে তেমন একটা ভাবি না। ভাবি, স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা কি আদৌ সম্ভব! তাই সবকিছু যেমন যাচ্ছে, তেমনই যাক না! চলুন তাহলে আনস্ক্রিপ্টেড টক এর প্রস্তুতি সম্পর্কে আজ জানা যাক।

স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা কি সম্ভব?

স্ক্রিপ্ট দেখে কথা বলা আর স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা – এই দুইয়ের মধ্যে প্রধান পার্থক্য কি বলুন তো? দুটোর জন্যই প্রস্তুতি নিতে হয়। তবে আনস্ক্রিপটেড হলে তখন কী কী লেখা ছিল সেগুলো বার বার মনে করার চেষ্টা করতে হয় না। এর বদলে আপনি মূল বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন এবং প্রতি মুহূর্তে কী কী নতুন শব্দ দিয়ে সবাইকে বিমোহিত করবেন তা নিয়ে ভাবতে থাকতে থাকেন। এখানে সর্বোচ্চ আপনার হাতে কিছু নোটস থাকতে পারে, যেখানে শুধু কিছু পয়েন্টস লেখা থাকবে।

স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা

আনস্ক্রিপটেড স্পীচ হলে সেখানে বলার মতো অনেক কথা থাকে। এই কথাগুলো শুনতে বেশ তরতাজা ও নতুন লাগে। বোঝাই যায় আপনি চিন্তা চেতনায় কতটুকু উঁচুতে আছেন। যদি এভাবেই কথা বলতে আপনার ভালো লাগে, আপনি যা যা বলতে চাচ্ছেন সবই সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারছেন, তাহলে বুঝে নিন এটা আপনার জন্য বেস্ট চয়েস।

আনস্ক্রিপ্টেড আর আনপ্রিপেয়ার্ড এর মধ্যে পার্থক্য কী?

আনস্ক্রিপ্টেড কথা আপনি বলতে পারেন, কিন্তু আনপ্রিপেয়ার্ড? একদমই নয়! এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য বোঝা খুবই জরুরি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথার ক্ষেত্রে, পরবর্তীতে কোনো বাহানা দেয়াই যুক্তিযুক্ত নয়। বেশিরভাগ আনস্ক্রিপ্টেড কথাতেই, অর্ধেক পর্যন্ত এসে আর বক্তব্য আগায় না, কোনো সিক্যুয়েন্স থাকে না, মূল পয়েন্টগুলো বাদ রয়ে যায়, বারবার একই কথা বলে যেতে হয়।

কীভাবে প্রস্তুতি নেয়া যায়?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে তাহলে স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা যায়? এটির প্রায় ৮০ শতাংশই নির্ভর করে আপনি দর্শকের সামনে কী কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তার উপর। যে কোনো বক্তব্য যদি গল্পের আকারে বলা হয় তাহলে বেশি সহজ হয়। আর যদি শুরুই করা হয় বেশ জটিল ব্যাখ্যা আর কঠিন কঠিন যুক্তি দিয়ে তাহলে সেই কথা শোনার কোনো আগ্রহই থাকবে না। এজন্য অবশ্যই আপনাকে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। আর এই প্রস্তুতির জন্য ফলো করতে হবে করতে হবে কয়েকটি স্ট্র্যাটেজি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-

১) কনসেপ্ট বোঝানোর জন্য শব্দ খুঁজে বের করুন

হতে পারে যে কথা বলতে বলতে আপনি মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। সামনে কী বলবেন বুঝে পাচ্ছেন না। অথচ আপনার সামনে যারা বসে আছে তারা অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছে শোনার জন্য। ঠিক এই মুহূর্তে আপনি কী করবেন? যে কনসেপ্ট নিয়ে আপনি কথা বলছেন সেটি বোঝানোর জন্য উপযুক্ত কোনো একটি শব্দ জাস্ট খুঁজে বের করে ফেলুন। তবে হ্যাঁ, এটি কিন্তু প্রথমবারেই হবে না। এজন্য আপনার নিজের বেশ কয়েকবার প্রস্তুতি নিতে হবে। বারবার নিজেই নিজের সাথে কথা বলতে হবে, হুটহাট কী কী উদাহরণ দেয়া যায়, সেটা মাথায় গেঁথে ফেলতে হবে। এতে আপনি নিজে বেশ কনফিডেন্ট হবেন এবং প্রতিটি পয়েন্ট নিয়ে নিজেই নিজের কাছে ক্লিয়ার থাকবেন।

২) নোট রাখুন

স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা

কথা বলতে বলতে আপনি হয়ত এমন কোনো পয়েন্ট বলেছেন সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি একের পর এক প্রতিটি স্টেপ ধরে ধরে কথা বলা এগিয়ে নিতে পারেন তাহলে খুব একটা সমস্যা হবে না। কিন্তু যদি এক টপিক থেকে আরেক টপিকে যেতে হয় এবং আবারও ফিরতে হয় পুরনো টপিকে, তাহলে কী বলতে চাচ্ছিলেন সেটা ছোট্ট একটা নোটে টুকে রাখুন। বিস্তারিত কথা নয়, এতে বক্তব্য স্ক্রিপ্তেড হয়ে যাবে। নোটটা সামনে থাকলে পরবর্তীতে কী চাচ্ছিলেন সেটা মনে পড়ে যাবে।

৩) খেয়াল রাখুন সময়ের দিকে

আপনার বক্তব্যের জন্য যারা আয়োজন করেছেন, তারা কথা বলার জন্য কতটুকু সময় নির্ধারণ করেছেন সেটা অবশ্যই জেনে রাখুন। কথা শেষ করুন সেই সময়ের মধ্যেই। কারণ আপনার মতো বাকিদেরও সময় নির্ধারণ করা। যদি সময়ের মধ্যে আপনি কথা শেষ না করেন তাহলে বাকিরাও তাদের বক্তব্য বলে শেষ করতে পারবে না। আর এটা একজন বক্তা হিসেবে বেশ বিব্রতকর। আর এতে দর্শকরাও বেশ বিরক্ত হন। এটা কখনোই করবেন না। এজন্য আপনি যা করতে পারেন-

  • আগে নিজে নিজে কথা বলে প্র্যাকটিস করে নিন যে সময়ের মধ্যে তা শেষ হচ্ছে কিনা। যদি তা না হয়, তাহলে কিছু কিছু পয়েন্ট বাদ দিয়ে দিন।
  • সময়ের ব্যাপারে সচেতন থাকার জন্য কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ি দেখুন। কতটুকু সময় আছে এবং সেই অনুযায়ী কী কী কথা বলতে হবে গুছিয়ে নিন।
  • বক্তব্য এমনভাবে সাজান যেন সময়ের মধ্যেই ৯০ শতাংশ কথা বলা হয়ে যায়।

স্লাইড দেখে কথা বললে কী হয়?

বেশিরভাগ স্পীকারই কথা বলার সময় বার বার স্লাইডের দিকে তাকান। এই স্লাইডকেই তারা গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন। এমনভাবে স্লাইড সাজান যেখানে টেক্সট ও বুলেট একদম বিস্তারিতভাবে দেয়া থাকে। আপনি কী বলতে চাচ্ছেন সেটা আগে থেকেই দর্শকশ্রোতা জানে। এতে স্লাইডে থাকা তথ্যগুলো নতুন করে আর কোনো আগ্রহ জাগায় না। এটা শেষ পর্যন্ত আসলে আর বলার মতো কোনো কথাই থাকে না। স্লাইড যদি স্ট্রাকচারালি সাজানো থাকে তাহলে আপনার কনফিডেন্স যেমন বুস্ট হয়, তেমনই কথা বলাও সুন্দর হয়।

স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা

ধরা যাক, আপনার কথার সাথে সাথে একটি করে ইমেজ চেঞ্জ হচ্ছে স্লাইডে। আপনি যদি কোথাও আটকে যান, তখন নেক্সট স্লাইডে চলে যান এবং আবারও আগের স্লাইডে ফিরে আসুন। এতে আপনি আবারও ট্র্যাকে ফিরতে পারবেন। তবে এটা যে সব সময় একইভাবে কাজ করবে তা নয়। কথার সাথে সাথে স্লাইড বদলানো বেশ বড় একটি ইমপ্যাক্ট ফেলে। আপনি পরবর্তীতে কী বলতে চাচ্ছেন সেটা আগেই বলে ফেললে আগ্রহ খানিকটা কমে যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে অবশ্য বেশ কাজে আসে পুরনো দিনের হাতে লেখা পাঞ্চি নোটস। ছোট ছোট নোটে আপনি লিখে রাখুন কী কী পয়েন্ট নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন। একটি দুটি শব্দ বা পয়েন্ট চোখের পলকে দেখে নিলে কথা বলার সময় ভুলে যাবেন না।

আপনি যখন দর্শকশ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কথা বলবেন, তখন যদি একটু থামেন তাহলে কিন্তু তারা বিরক্ত হবে না। বরং আপনি নিজের জন্য এটুকু সময় নিতে পারেন। এতে হয়ত আপনি বিব্রত হতে পারেন, কিন্তু তারা হবে না। এতে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কথা বলার সময় তাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসুন, একটু পানি পান করুন, একটু হাঁটুন। এতে যা বলতে চাচ্ছিলেন তা মনেও পড়ে যাবে, আবার ফিরতে পারবেন কথার দুনিয়ায়।

স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা আমাদের অনেকের কাছেই বেশ কঠিন মনে হয়। কিন্তু একবার যদি প্র্যাক্টিসের মাধ্যমে ব্যাপারটি রপ্ত করে ফেলতে পারেন, তাহলে আর এত জটিল লাগবে না। আপনার কথায় আপনি বাজিমাত করে ফেলতে পারবেন সহজেই। তাই ভয় না পেয়ে, স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা শিখুন, রপ্ত করুন দারুণ একটি অভ্যাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *