পজিটিভ সেলফ টক | নিজেকে ভালো রাখার অন্যতম উপায়

সহজ সাধারণ বাংলায় নিজের সাথে ইতিবাচক কথা বলাকেই পজিটিভ সেলফ টক বলে। জীবনে চলার পথে আমাদের যে জিনিস সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো পজিটিভিটি। যে কোনো ব্যাপার বা ঘটনাকে যদি পজিটিভ বা ইতিবাচকভাবে দেখতে আমরা ব্যর্থ হই, এর খারাপটাই আমাদের উপর বেশি প্রভাব বিস্তার করবে। সবসময় আমরা অন্যের সাথে পজিটিভ থাকার আলাপ শুনি। এর মানে হচ্ছে মানুষের কথাবার্তাকে ইতিবাচকভাবে নেয়া, তাদের সাথে ভালো আচরণ করা, ভালোভাবে সবকিছু সামলে নিতে পারা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো নিজের জীবনকে বা মন মানসিকতাকে যে ইতিবাচক দিকে নিতে হবে এই কথা খুব কম লোকই আমাদের জোর দিয়ে জানান। ব্যক্তি যদি নিজেই কোনোকিছু সহজভাবে না নিতে পারেন তাহলে বাকিদের ক্ষেত্রে কীভাবে তা করে দেখাবেন? তাই সবার প্রথমে আমাদের নিজেদের নিয়ে ইতিবাচকভাবে ভাবতে হবে। আমরা নিজেরা ইতিবাচক মনোভাব ধারণ করলে তবেই বাকিদের ব্যাপারে আরো ইতিবাচক হতে পারবো। এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে নিজের সাথে কথা বলা, সময় কাটানো। নিজের সাথে কথা বলা মানে অযাচিতভাবে শুধুমাত্র বকে যাওয়াই না, বরং মিনিংফুল ওয়েতে নিজেকে নিয়ে ভাবা, নিজের ভাবনাকে নিয়ে ভাবা, চিন্তার গভীরতা বাড়ানো। এর আরেকটি সুন্দর নাম ও দেয়া যায়, তা হলো আত্মসমালোচনা। আপনি যত নিজের কাজ, নিজের চিন্তা নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন, ততই আপনি এর প্রশস্ততা বা প্রসারতা নিয়ে উপলব্ধি করতে পারবেন যে আসলেই আপনি ইতিবাচকভাবে নিজেকে কতটুকু উপস্থাপন করতে পারেন, আপনার কথা এবং কাজে আপনার আশেপাশের মানুষ কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারছে। অবশ্যই এটি অত্যন্ত ভালো এবং গঠনমূলক অভ্যাস। এতে করে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নিজের ইতিবাচক চিন্তার প্রভাব তার উপর ফুটিয়ে তোলা যায়। যার ফলে একতরফাভাবেই কোনোকিছু নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার বা ভুল করার প্রবণতা কমে যায়।

পজিটিভ সেলফ টক

সেলফ টক যে সবসময় পজিটিভই হবে এমনটা নাও হতে পারে। দুই ধরনের সেলফ টক রয়েছে। পজিটিভ ও নেগেটিভ। প্রায়ই আমরা নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলি এবং বিরক্ত হয়ে ভাবি এটা কীভাবে আমার দ্বারা হয়ে গেলো। যার ফলে একধরনের গতি নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে নিজের সাথে পজিটিভ কথা বলার, এমনকি ভুল কিছু হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেয়ার মতো আশ্বাস নিজেকে দিতে হবে এবং পরবর্তীতে যাতে এমন ভুল না হয় এ ব্যাপারে নিজেকে তৈরি করতে হবে, অনুপ্রাণিত করতে হবে। নিজের সঙ্গে কথা বলার কিছু উপায় বা পদ্ধতিও আমাদের জানা উচিত।

পজিটিভ সেলফ টক এর জন্য যা যা করতে হবে 

১) কোন ভাষায় নিজের সঙ্গে কথা বলছেন সেটা খেয়াল করুন

আমরা অনেক সময়ই নিজেরা নিজেদের সঙ্গে কথা বলার সময় রুঢ় ভাষায় কথা বলে থাকি। খারাপ ভাষা ব্যবহার করে থাকি। খারাপ কথা মাথায় ঘোরে, যে এটা আমি পারব না। এটা আমার দ্বারা হবে না ইত্যাদি। এটার বদলে বরং ভাবুন কী করে সেটা থেকে বের হবেন, আপনি সেটা পারবেন, পারতে হবে ইত্যাদি।

২) নিজেকে তৃতীয় ব্যক্তি ভাবা

নিজেকে একজন তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে ভেবে নাম ধরে কথা বলুন। আমি, আমার, ইত্যাদি এসব না বলে, বরং একটা দূরত্ব রেখে নাম ধরে কথা বলুন।

৩) ভাবনা চিন্তা করুন

নিজের সঙ্গে কথা বলার সময় ভাবনা চিন্তা করে কথা বলুন। কারণ জানবেন, নিজের সঙ্গে নিজের কথা কিন্তু আমাদের উপর সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলে।

৪) লেখার অভ্যাস করুন

নিজের সঙ্গে যা কথা বলছেন, যে জরুরি পয়েন্ট আছে তার মধ্যে সেগুলো কোথাও লিখে রাখুন। প্রয়োজনে কোনও থেরাপিস্টের সাহায্য নিন।

পজিটিভ সেলফ টক

কী কী উপকার হয় এতে?

পজিটিভ সেলফ টক আমাদের জীবনে বেশ কিছু উপকার করতে পারে। চলুন জেনে নেয়া যাক পজিটিভ সেলফ টকের উপকারিতা সম্পর্কে-

১) জীবনশক্তি বাড়িয়ে তোলে

ধরুন আপনি নিজেকে নিয়ে খুব হতাশ। কোনোভাবেই জীবনের ক্যালকুলেশন মিলিয়ে উঠতে পারছেন না। নিজেকে অনুপ্রেরণা জোগানোর মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। নিজের দুর্বল অসহায় সময়ে নিজের শেল্টার হতে পারছেন না। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আপনাকে উজ্জীবিত করতে পারবে পজিটিভ সেলফ টক। আপনি যত নিজেকে বোঝাতে এবং জানাতে পারবেন যে, জীবন খুব সুন্দর, আমাকে শেষটা দেখতেই হবে, সার্ভাইভ করতে পারতেই হবে, আমি পারবো, আমার মধ্যে সেই সাহসী স্বত্তা রয়েছে-  ততই জীবনের কঠিন সময়ে লড়াই করা সহজ হবে। আপনার বেঁচে থাকার আশা জোগাবে। আপনার জীবনশক্তি বাড়বে। আপনি আরো অনেকদিন সুন্দর পৃথিবী দেখার ব্যাপারে আশাবাদী হবেন।

২) জীবনে সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায় 

আপনি যখন নিজের কাজ নিয়ে নিজেকে জানবেন যে আপনি কী করছেন, কেন করছেন, সবকিছুর মানে যখন আপনার কাছে স্পষ্ট থাকবে তখন আপনি সহজ জীবন খুঁজে পাবেন। আপনার জীবন নিয়ে হতাশা কমে যাবে। জীবনধারণ সুখকর হবে। আপনি আপনার সবকিছুকে সত্য এবং অতিবাস্তব হিসেবে মেনে নিতে শুরু করবেন। জীবনের সাথে ভালো কিছু ঘটলে সাদরে গ্রহণ করবেন, খারাপ কিছু ঘটলে তা নিয়ে হতাশ হওয়ার থেকে সামনে ভালো কিছু হওয়ার আশা রাখবেন। সবকিছু মিলিয়ে জীবনের মানে আপনার কাছে অনেক সহজ হবে। জীবন নিইয়ে আপনার সন্তুষ্টির মাত্রাও বেড়ে যাবে।

জীবনে সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়

৩) ইমিউন ফাংশন ভালো হয়

এই ইমিউন সিস্টেম একটি নিরাপত্তা সিস্টেম স্বরূপ। এই সিস্টেম আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং রাসায়নিক উপাদান প্রবেশ এবং রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে দূরে রাখে। ইমিউনিটি দেহ প্রতিরক্ষার জন্য একটি প্রাকৃতিক উপায়। একটি শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি কমিয়ে দেয় এমনকি রোগ নিরাময় ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। বেশকিছু খাবার দাবারের উপর যেমন শরীরের ইমিউন সিস্টেম বাড়ে তেমনই মানসিক এবং চিন্তাগত দিক থেকে নিজেকে পজিটিভভাবে মোটিভেট করলেও আমাদের ইমিউন সিস্টেম বৃদ্ধি পায়।

৪) মানসিক স্বস্তি পাওয়া যায় 

আপনার জীবনের সবকিছু যখন আপনার জানা থাকবে, আপনি যখন জীবনের সত্যতা মেনে নিতে শিখবেন এবং সে অনুযায়ী নিজেকে এগিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা করবেন ঠিক তখনই মানসিকভাবে আপনি আরো স্ট্যাবল হতে পারবেন। আপনার মনে ওই ভেবে অস্থিরতা তৈরি হবে না যে আপনি নিজেকে বুঝতে চাননি, নিজেকে নিয়ে ভাবেননি, নিজেকে গুরুত্ব দেননি। সেলফ ভ্যালু বাড়বে নিজের সাথে ইতিবাচক কথার মাধ্যমেই, নিজেকে জানার মাধ্যমেই। তাই যখন পজিটিভ সেলফ টক আমাদের মধ্যে পজিটিভ এনার্জি আনবে, তখন মানসিক শান্তিও বাড়বে।

৫) শারীরিক সুস্থতা বজায় থাকে 

পজিটিভভাবে নিজেকে বোঝাতে পারা, নিজের মধ্যে পজিটিভ ভাবনা লালন করতে পারা কষ্ট এবং ব্যথা কমায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। উন্নত মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা দান করে। ভালো স্বাস্থ্য কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং স্ট্রোক থেকে সেইফ রাখে।

শারীরিক সুস্থতা বজায় থাকে

৬) মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস পায়

শারীরিক ও মানসিকভাবে যখন কোনো ব্যক্তি ভালো ও সুস্থ অনুভব করবে তখন তার মধ্যে মৃত্যু নিয়ে চিন্তা এমনিতেই কমে যাবে। হতাশ মানুষই সবচেয়ে বেশি এ ধরনের চিন্তা করেন। যে মানুষ জীবন নিয়ে সুখী, জীবনের বোঝাপড়া যার জানা, নিজের সম্পর্কে যার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস রয়েছে, নিজের মন সম্পর্কে যে সম্পূর্ণটাই অবগত। সে ব্যক্তি কখনোই মৃত্যুকে সহজে আমন্ত্রণ জানাতে আগ্রহী থাকবেন না। তাই এই ব্যাপারগুলো যখন একজনের মধ্যে বিরাজমান থাকে তখন তার মৃত্যুঝুঁকি কমে আসে।

পজিটিভ সেলফ টক কতটা প্রভাবক হিসেব কাজ করে সে আলোচনা করতে গেলে আমরা একটি গবেষণা নিয়ে কথা বলতে পারি। একটু ইরানি গবেষণা জানিয়েছে, ২০২০ সালে কোভিডের সময় তারাই সবচেয়ে বেশি তাদের উদ্বেগের সাথে মোকাবিলা করতে পেরেছিলো যারা নিজেদের সাথে পজিটিভ সেলফ টকিং এ অংশ নিয়েছে এবং এই দুঃসময় কেটে যাবে বলে নিজেকে আশা দেখিয়েছে। সার্ভেতে আরও দেখা গেছে যে, যারা ইতিবাচক স্ব-কথোপকথনে জড়িত তারা তাদের আবেগ এবং মানসিক চাপ মোকাবেলা করার জন্য কার্যকর কৌশল তৈরি করতে পারছে। ২০১৯ সালের একটি সার্ভেতে দেখা গেছে যে, যখন শিক্ষার্থীরা একটি বক্তৃতা বা উপস্থাপনা দেওয়ার আগে একটি নিজেদের চিন্তাচেতনা দ্বারা পরিচালিত বিবৃতি দেয়, তখন তারা নিষেধ করা শিক্ষার্থীদের তুলনায় কম উদ্বেগ অনুভব করে।

সত্যি বলতে মূল কথা হচ্ছে, আপনাকে আপনার পরিবার, প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব, কাছের মানুষ যতই মোটিভেট করার চেষ্টা করুক, যতই আপনার মধ্যে পজিটিভিটি বুস্ট করার চেষ্টা করুক, আপনি নিজে থেকে যদি এমনটা না করতে পারেন, নিজে যদি নিজেকে ইতিবাচক ইঙ্গিত না দিতে পারেন তাহলে কারো কথা বা কাজের প্রভাব আপনার মধ্যে দেখা দিবে না। তাই প্রথমে নিজের পজিটিভ মনোভাব তৈরি করে নিজেকে নিজের সাথে আলোচনায় এনে ইতিবাচক দিকে টেনে নিয়ে যেতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *