পার্সোনালাইজড মার্কেটিং বর্তমানে কাস্টমার আকর্ষণে কোম্পানিগুলোর ব্যবহার করা একটি প্রায় অব্যর্থ টেকনিক। আপনি একটু খেয়াল করলেই দেখতে পারবেন আপনার চারদিক ঘিরে রয়েছে পার্সোনালাইজড মার্কেটিং। কীভাবে? কখনো কি খেয়াল করেছেন, আপনি যে ধরনের জিনিস খুঁজছেন, বা পছন্দ করেন, কিনতে আগ্রহী, মার্কেটপ্লেসে সার্চ দিয়ে দেখেছেন সেই জিনিসগুলোই আপনার হোমপেজে বা নোটিফিকেশনে আসছে, আপনাকে সাজেশন হিসেবে শো করছে? এটা আসলে পার্সোনালাইজড মার্কেটিং, যা ক্রেতা বিক্রেতা দুইজনের জন্যই সমান উপযোগী। আজ আমরা মার্কেটিং এর এই সেক্টরটি সম্পর্কে জানবো।
পার্সোনালাইজড মার্কেটিং কী?
পার্সোনালাইজড মার্কেটিং হচ্ছে কাস্টমার এর গতিবিধি বা অ্যাক্টিভিটির উপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র তার জন্য নির্দিষ্ট মার্কেটিং পদ্ধতি সাজানো। এর জন্য কাস্টমারের কিছু তথ্য সংগ্রহ ও অ্যাক্টিভিটি মনিটরিং এর অনুমতি প্রয়োজন হয়।
পার্সোনালাইজড মার্কেটিং হচ্ছে ডাটা বেইজড ওয়ান অন ওয়ান মার্কেটিং। ডাটা এর মূল শক্তি। কাস্টমারের এলাকা, পছন্দ অপছন্দ, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী নির্দিষ্ট প্রোডাক্ট কাস্টমারকে দেখানো পার্সোনালাইজড মার্কেটিং এর উদ্দেশ্য। এখনকার দিনে কাস্টমাররা তাদের পছন্দের কোম্পানির কাছ থেকে এপ্রিশিয়েটেড হতে পছন্দ করেন, তারা একঘেয়ে ইমেইল নোটিফিকেশনের বদলে শুধু তাদের জন্য নির্দিষ্ট অফার বা ছাড় পেলে খুব খুশি হন। কিছু নামীদামী বিখ্যাত ব্র্যান্ড যেমন- সেফোরা, এদের একটা পলিসি আছে, কাস্টমারের তথ্য তাদের কাছে থাকলে, জন্মদিনে কাস্টমার একটা ছোট গিফট পান। এরকম অনেক কোম্পানিই আছে যারা কাস্টমারকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেন এবং কাস্টমারও তাদের এই ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে রিপিট কাস্টমারে পরিণত হন। সুতরাং বলা যায়, কাস্টমারকে রিপিট কাস্টমারে পরিণত করারও একটা কার্যকর উপায় পার্সোনালাইজড মার্কেটিং।
এই মার্কেটিং এর সুবিধাগুলো কী কী?
যেহেতু পারসোনালাইজড, তার মানে কাস্টমার ধরে রাখার অবশ্যই কিছু সুবিধা আছে। যেমন-
১) কাস্টমারের কাছে আরো কার্যকরভাবে পৌঁছাতে পারা
পার্সোনালাইজড মার্কেটিং এর সাহায্যে আপনি কাস্টমারের কাছে আরো ভালোভাবে তথ্য পৌঁছাতে পারবেন। কাস্টমারের পছন্দের সাথে মিলিয়ে প্রাসঙ্গিক কন্টেন্ট দেখানোর মাধ্যমে কাস্টমারকে আকৃষ্ট করতে পারবেন। এটা সাধারণ মার্কেটিং আর অ্যাড ক্যাম্পেইন থেকে আলাদা। যেমন- একজন কাস্টমারের যদি একটা নির্দিষ্ট ফ্লেভার পছন্দ থাকে, আপনি সেই ফ্লেভারের সাবান শ্যাম্পু কসমেটিকস তার কাছে বিক্রি করতে পারলেও অন্য ফ্লেভারের একই জিনিস তিনি নাও কিনতে পারেন। এভাবে কাস্টমারকে তার পছন্দ অনুযায়ী জিনিস দেখিয়ে আপনি একইসাথে বিক্রি বাড়াতে পারেন এবং কাস্টমার আপনার শপ মনে রেখে পুনরায় কেনাকাটা করার সম্ভাবনা বাড়ে।
২) কাস্টমার তৈরি
পার্সোনালাইজড মার্কেটিং পুরাতন ক্রেতাদের প্রাধান্য দেয়ার সাথে সাথে নতুন ক্রেতা তৈরিতেও সাহায্য করবে। আপনি যখন কোনো একজনের পছন্দ অনুযায়ী বিশেষভাবে সাজানো মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ফলো করবেন, তার সামনে তার পছন্দমত প্রোডাক্টই আসবে, এতে করে তার সেই পণ্য কিনে নেয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। এভাবেই নতুন ক্রেতার সৃষ্টি হয়।
৩) ক্রেতার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়
পার্সোনালাইজড মার্কেটিং টেকনিক এ আপনার ক্রেতার মন বুঝতে হবে। ক্রেতা কী ধরনের প্রোডাক্ট পেলে খুশি হবেন এবং সেলস বাড়বে সে অনুযায়ী প্রোডাক্ট তার সামনে যেতে হবে। এর ফলে আপনার ক্রেতার প্রতি একটা মনোযোগ তৈরি হয় এবং সেই ক্রেতা আপনার আলাদা অ্যাটেনশন পায়। ক্রেতারা এটা পছন্দ করেন। তাদের পছন্দের ব্র্যান্ড যে তাদের কথা মনে রাখছে বা তাদের পছন্দ অনুযায়ী কিছু করছে এটা তাদের মনে থাকে এবং তারা অন্যদের রেকমেন্ড করেন, এর ফলে সেল বৃদ্ধির একটা সুযোগ তৈরি হয়।
৪) ক্রেতার জন্য সুবিধাজনক হয়
পার্সোনাল মার্কেটিং ক্রেতার সুবিধার কথা চিন্তা করে সে অনুযায়ী প্রচার করে, প্রত্যেক ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী প্রোডাক্ট দেখানোর ফলে ক্রেতাদের প্রায়ই পছন্দের জিনিস খুঁজতে কম কষ্ট করতে হয়। অনেক জিনিসের মাঝে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজতে গিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তবোধ করেন বা সঠিক জিনিস খুঁজে পান না। পার্সোনালাইজড মার্কেটিং এই ক্ষেত্রে খুব সাহায্য করে এবং ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী চলায় ক্রেতা তার দরকারি জিনিস পেয়ে যান ঝামেলা ছাড়াই।
৫) কাস্টমার লয়ালিটি বাড়ে
কাস্টমার লয়ালিটি মানে হচ্ছে ক্রেতা যখন একটি কোম্পানির সুযোগ সুবিধায় অভ্যস্ত হয়ে তাদের নিয়মিত ক্রেতায় পরিণত হন এবং অন্য কোম্পানির চেয়ে পছন্দের কোম্পানিকে প্রাধান্য দেন। পার্সোনালাইজড মার্কেটিং ক্রেতাকে গুরুত্ব দেয় এবং ক্রেতাকে স্পেশাল ফিল করায়, যার ফলে ক্রেতার উপর ভালো প্রভাব পড়ে এবং তার লয়ালিটি বাড়ে।
৬) কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স এর উন্নতি
ক্রেতারা প্রায়ই শুধু শুধু ব্যক্তিগত তথ্য দিতে চান না, এর বিনিময়ে কিছু পেলে ব্যক্তিগত তথ্য দিতে তারা নিজের ইচ্ছাতেই তথ্য দিতে রাজি থাকেন। যেমন, তারা বিশেষ কোনো কুপন বা ডিসকাউন্ট এর বিনিময়ে সার্ভে বা প্রশ্নপত্র পূরণ করেন। এই তথ্যের মাঝে থাকে তাদের সাম্প্রতিক কেনাকাটা বা পণ্য ব্যবহারের তথ্য, পণ্য ব্যবহার করে তাদের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। এছাড়াও এই তথ্য ব্যবহার ও সুরক্ষিত রাখার মাধ্যমে কাস্টমারের সাথে কোম্পানির বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়।
৭) অল্প ই-মেইলে ক্রেতা বিরক্ত হন না
একটা সময় কোম্পানিগুলোর মাঝে প্রতিযোগিতা হত কে কত বেশি ইমেইল পাঠাতে পারে, এটাকে একটা নাম্বার গেইম হিসেবেই ধরা হত। বাস্তব ক্ষেত্রে এত এত ইমেইলের ভিড়ে দরকারি ইমেইলগুলো হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এতে আমরা বিরক্তও হই। পার্সোনালাইজড মার্কেটিং এর ফলে এই প্রতিযোগিতা কমে এসেছে। এখন অতিরিক্ত ইমেইল পাঠানো কোম্পানিগুলোকে ক্রেতারা এড়িয়ে চলেন। বিশেষ ডিসকাউন্ট, গুরুত্বপূর্ণ নোটিশ বা ক্রেতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কুপন ছাড়া অন্য প্রমোশনাল মেইল না পাঠালেই ক্রেতারা খুশি হন। এর ফলে অল্প মেইল পাঠিয়েই সাফল্য অর্জন করা যায়।
পার্সোনালাইজড মার্কেটিং এর কিছু উদাহরণ
১) নির্দিষ্ট ও টার্গেটেড ইমেইল
টার্গেটেড ইমেইল ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট ক্রেতা বা কোম্পানিকে বিশেষ চাহিদা বা প্রায়োরিটি অনুযায়ী টার্গেটেড ইমেইল পাঠানো যায়। সাধারণত ব্যবসায় কাস্টমাররা ইমেইল চান কি চান না সে ব্যাপারে অনুমতি প্রয়োজন হয়, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এজন্য ইমেইলের পাশে নিউজলেটার বা নোটিফিকেশন পাঠানোর অনুমতি চাওয়া হয়। কাস্টমার অনুমতি দেয়ার পর আপনি তার সম্পর্কে থাকা ডাটা অনুযায়ী স্পেশালাইজড অফার, ডিসকাউন্ট বা রিলেটেড প্রোডাক্ট এর ইমেইল পাঠাতে পারেন।
২) অনলাইন শপিং ফিল্টার
আমরা দারাজ, আমাজন বা বিভিন্ন ওয়েবসাইট অথবা এপ এ শপিং করতে গেলে প্রায়ই একটা ছোট অপশন থাকে একপাশে, যেটার নাম ফিল্টার। ফিল্টার দিয়ে আমরা নিজেদের পছন্দমত আইটেম আলাদা করতে পারি। পার্সোনালাইজড মার্কেটিং এ ফিল্টার এর আলাদা স্থান আছে। ফিল্টার দিয়ে পণ্যের মূল্য, ধরন ইত্যাদি আলাদা করে নিজেদের মতো পণ্য দেখা যায় এবং এতে প্রয়োজনীয় জিনিস হাজার হাজার পণ্যের মাঝে খুঁজতে হয় না বলে সময় বাঁচে। এতে কেনার সম্ভাবনাও বাড়ে। এ কাজে নির্দিষ্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করা যায়।
৩) ফ্রি ট্রায়াল বা স্যাম্পল অফার
সার্ভে বা প্রশ্নোত্তরের বিনিময়ে অফার করা যায় ফ্রি ট্রায়াল বা স্যাম্পল। প্রায়ই ফ্রি অফার করা পণ্য ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে এবং ক্রেতা নিজের সম্পর্কে তথ্য দিতে রাজি হন। এই তথ্য থেকে ভবিষ্যতে ক্রেতার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী পণ্য তাকে দেখানো যায়। বিভিন্ন বড় বড় ব্র্যান্ড তাদের প্রোডাক্ট যেমন- প্রসাধনী, খাবার ইত্যাদি স্যাম্পল বা টেস্টার সাইজ তৈরি করে এবং সেগুলো ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে, যাতে ক্রেতা সেগুলো ব্যবহার করে কোনটা তার পছন্দ বা কোনটা তার সাথে মিলছে তা বুঝতে পারে এবং পরবর্তীতে কেনার সময় সেটা মনে রাখতে পারে।
৪) পণ্যকে বিশেষ করে তোলা
মাঝে মাঝে কিছু কোম্পানিকে দেখা যায় কোনো ক্যাম্পেইন বা বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী পণ্যের কাস্টমাইজেশন করেন বা বিশেষ করে তোলেন। যেমন- ক্রেতার নামে পণ্য বানানো, বিশেষ প্যাকেজিং, বা ক্রেতার পছন্দে পণ্য সাজাতে দেয়া। বিখ্যাত লিপস্টিক কোম্পানি লিপ ল্যাব এর একটি প্রোগ্রাম আছে, যেখানে আপনি তাদের স্টোরে গিয়ে নিজের পছন্দমত রঙ মিশিয়ে লিপস্টিক বানাতে পারবেন এবং সেটাকে নিজের পছন্দমত নাম দিতে পারবেন। এধরণের ইউনিক প্রোগ্রামে ক্রেতা স্পেশাল ফিল করেন এবং কোম্পানির প্রতি ক্রেতার আগ্রহ বাড়ে।
৫) কুপন অফার করা
পছন্দের পণ্যে কুপন বা ডিসকাউন্ট কে না পছন্দ করে! অনেক সময় কাস্টমার ফ্রিতে অপ্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়ার চাইতে নিজের দরকারি ও পছন্দের পণ্যে ডিসকাউন্ট বেশি পছন্দ করেন। কাস্টমারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে কাস্টমারকে বিশেষ কুপন কোড বা ডিসকাউন্ট দিলে কাস্টমার খুশি হন এবং অন্যদের রেকমেন্ড করে থাকেন।
৬) ডিজিটাল টুল ব্যবহার
পার্সোনালাইজড মার্কেটিং এ ডিজিটাল প্লাটফর্ম আর তার টুলগুলো খুব কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়। যেমন- বিভিন্ন প্লাটফর্মে প্রোডাক্ট এর হ্যাশট্যাগ, ভিডিও মেসেজ তৈরি ইত্যাদি। উদাহরণ হিসেবে গুগলকেই ধরা যায়, প্রতিটি বিশেষ দিনে গুগল তার লোগো চেঞ্জ করে সেই দিনের থিম অনুযায়ী। বা কিছুদিন আগে সবার খুব পছন্দের বারবি মুভির কথাই ধরা যাক। মুভি রিলিজ উপলক্ষ্যে বারবি থিমে একটি ফটোফ্রেম করা হয়েছিল, যেটা মুহূর্তের মধ্যেই সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ খুব আগ্রহী হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে থাকে ক্রমাগত। এর ফলে মুভির প্রচারণা যেমন বেড়েছে, তেমনি মানুষের মনে অন্যান্য মুভির চেয়ে একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে এই মুভি। এভাবে ডিজিটাল টুলসের মাধ্যমে মানুষের কাছাকাছি যাওয়া যায়।
৭) এক জাতীয় পণ্যের প্রচারণা
সাধারণত আমরা কিছু কেনাকাটা করতে গিয়ে সেটা না পেলে একইরকম বা একই কাজে ব্যবহার করা যাবে এমন বিকল্প খুঁজতে থাকি, এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্লাটফর্মে মূল পণ্যের লিংকে সমজাতীয় বা অন্য ব্র্যান্ডের একই পণ্য দেখানো হয়। এতে ক্রেতার ঝামেলা কমে, তার দরকারি জিনিসটা না পেলেও তার বিকল্প খুঁজতে বেশি ঝামেলা করতে হয় না। যেমন, এক বিশেষ ব্র্যান্ডের সাবান শ্যাম্পুর নিচে যদি অন্য ব্র্যান্ডের একইধরণের সাবান-শ্যাম্পু দেখানো হয়, সম্ভাবনা রয়েছে যে ক্রেতা সেটি কিনে নেবেন। এতে বিক্রি বাড়ে এবং ক্রেতার ঝামেলা কমে।
বর্তমান সময়ে পার্সোনালাইজড মার্কেটিং ব্যবসার উন্নতিতে ভালো প্রভাব ফেলে। ক্রেতারা স্পেশাল ফিল করেন, খুশি হন ও কোম্পানির লাভ বাড়ে। পার্সোনালাইজড মার্কেটিং আরো বিভিন্নভাবে করা যায়, তবে এগুলো একেবারে বেসিক কিছু ধারণা। এটা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্যই লাভজনক।