দোকানে যেয়ে পছন্দ করে একটার জায়গায় তিনটা ড্রেস কিনলেন। কিন্তু বছরখানেকের বেশি সময় হয়ে গেলেও আলমারি থেকে জামা তিনটির থেকে দুটি একবারও পরলেন না। এক সময় ভুলেই গেলেন সেই জামা দুটোর কথা। পরে থেকে সেগুলোও নষ্ট হলো। আর পরাই হয়ে উঠলো না। এটা কিন্তু এক ধরনের অপচয়। ভেবে দেখুন, সে সময় যদি এই দুটো জামা আপনি না কিনতেন তাহলে আপনার কিছু অর্থও বেঁচে যেত। আবার অন্য কেউ কিনলে তারা হয়ত পরতেও পারতো। মিনিমালিজম বা মিনিমালিস্ট লাইফস্টাইল ঠিক এই অপচয়গুলোকে রোধ করার কথাই বলে। বর্তমানে সচেতন অনেকেই এই লাইফস্টাইলের অনুসারী হচ্ছেন। আজকের আর্টিকেলে আমরা কথা বলবো এই বিষয়টি নিয়েই।
মিনিমালিস্ট লাইফস্টাইল কাকে বলে?
এই লাইফস্টাইলের মূল কথাই হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবহার কমিয়ে আনা। জীবনধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন বুঝে খরচ করা। ঘরে যদি অতিরিক্ত জিনিস থাকে, তাহলে মাইন্ডও রিফ্রেশ থাকে না। তাছাড়া বর্তমানে আমাদের পরিবেশ হুমকির মুখে। অতিরিক্ত জিনিস ব্যবহারে পরিবেশেও এর প্রভাব পড়ছে। যা ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আপনার যে জিনিসের প্রয়োজন নেই সেটি কাউকে দিয়ে দিন। একই পোশাক বারবার পরার অভ্যাস করুন।
কীভাবে মিনিমালিজম শুরু করা যায়?
জীবনকে জটিল না করে সহজ উপায়ে যাপন করার চেষ্টা করতে হবে। মিনিমালিজম শুরুর আগে যা যা করতে হবে-
১) দামি জিনিস নয়, কোয়ালিটিযুক্ত জিনিস কিনুন
আপনাকে মিনিমালিজম হতে বলছি মানে এই নয় যে আপনি শপিং করতে পারবেন না। অবশ্যই পারবেন। তবে ঠিক ততটুকুই যতটুকু আপনার প্রয়োজন। প্রাইস ট্যাগ না দেখে জিনিসটি কতদিন টিকবে সেটা ভাবুন। এর স্থায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করুন। কোন উপাদানের তৈরি জিনিস বেশিদিন টিকে সেটি আগে জেনে নিন। চিন্তা না করে জিনিস কিনলে তা এক সময় ঘরে বাড়তি জিনিস হিসেবেই পড়ে থাকবে। তাই মানসম্পন্ন জিনিস কিনুন।
২) কেনার আগে ভাবুন
দোকানে যাওয়ার আগে চিন্তা করেছেন একটা, আর কিনেছেন আরেকটা। শুধু তাই নয়, দরকার নেই এমন অনেক জিনিস দিয়েই বাস্কেট ভরে থাকে। এই অভ্যাস কন্ট্রোল করতে না পারলে মিনিমালিস্ট হওয়া যাবে না। কেনার আগে লিস্ট করে নিন আপনার কী কী প্রয়োজন। সেই হিসেবে দোকানে যান। যদি দোকানে যেয়ে নতুন কিছু চোখে পড়ে তাহলে ভাবুন সেই জিনিসটি কি আপনার সত্যিই দরকার? কেনার পর ব্যবহার করবেন তো? শুধু শুধু ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকবে না তো? যদি এসবের সহজ উত্তর পান, তাহলে কিনুন, নইলে বাদ দিন।
৩) ডিক্লাটার করুন
মিনিমালিস্ট লাইফস্টাইল লিড করার জন্য আরেকটি বিষয় মেনে চলতে হবে, আর তা হলো ডিক্লাটার করা। আমাদের সবার বাসাতেই এমন অনেক কিছু রয়েছে যেগুলো হয়ত আর কখনো ব্যবহার করা হবে না। সেগুলো কাউকে দিয়ে দিন।
ডিক্লাটার করার সহজ তিনটি ধাপ হচ্ছে-
Keep- যেগুলো নিজের কাছে রাখতে চান সেগুলো রেখে দেয়া
Donate- যে জিনিস ও কাপড় কাউকে দিয়ে দিতে চাচ্ছেন সেগুলো আলাদা করা
Discard– যেগুলো আর ব্যবহারযোগ্য নয়, সেগুলো ফেলে দেয়া
কী কী ডিক্লাটার করা যায়?
কাপড়- কমবেশি সবার বাড়িতেই কিছু বাড়তি কাপড় থাকে। যেমন- কোনটা হয়ত সাইজে ছোট হয়ে গিয়েছে, কোনোটার রঙ জ্বলে গিয়েছে, কিছুতে হয়ত দাগ লাগার কারণে আর পরা হচ্ছে না। এমন কাপড়গুলো ফেলে না রেখে কাউকে দিয়ে দিন। এতে হয়ত একজন মানুষের উপকার হবে।
বই ও কাগজপত্র- শখ করে বই কিনে ঘর ভরিয়ে রেখেছেন, কিন্তু সেগুলো কবে পড়বেন জানেন না। ব্যস্ততার সাথে সাথে বইয়ের নেশাও কমে যাচ্ছে। যদি এই সমস্যার মুখোমুখি আপনিও হয়ে থাকেন তাহলে সেগুলো বিক্রি করে দেয়াই উত্তম। অনেকের কাছে রিসার্চ পেপার, অফিস আদালতের নানা কাগজ জমানো থাকে। অনেকদিন জমা থাকার কারণে সেগুলো তেলাপোকা বা ইঁদুর কেটে ঘর নোংরা করতে পারে। আবার ধুলো পড়ে নষ্টও হয়ে যেতে পারে। তাই এগুলোর ডিজিটাল ভার্সন করে ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে জমা রাখতে পারেন। কাগজ জমে ঘরও নোংরা হবে না, আবার পরিষ্কারও থাকবে।
রান্নাঘরের জিনিসপত্র- রান্নাঘরে আমাদের নিত্যদিনই কাজ করতে হয়। তাই রান্নার কাজে ব্যবহারের জিনিসগুলোও দ্রুত পুরনো হতে থাকে। যদি নতুন জিনিস আনতেই চান, তাহলে অবশ্যই আগে পুরনোগুলো সরিয়ে নিন।
বিউটি প্রোডাক্টস ও ওষুধপত্র- পারসোনাল কেয়ারের জন্য যে বিউটি প্রোডাক্ট কিনছেন সেগুলোর মেয়াদ আছে তো? দেখা যায়, একটি ব্যবহার করতে করতে অন্যটির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এমন হলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কাউকে দিয়ে দিন। খেয়াল করে দেখুন তো। ওষুধের বক্সে যে ওষুধগুলো আছে সেগুলোর মেয়াদ কয়দিন আছে? যদি না থাকে, তাহলে ফেলে দিয়ে জায়গা খালী করে ফেলুন।
৪) রি-ইউজ করতে শিখুন
এক পোশাক অনেকবার পরে ফেলেছেন? ছিঁড়ে গিয়েছে বলে কাউকে দিতেও পারছেন না? এমন হলে সেটি দিয়ে পাপোশ বা টেবিল মোছার রুমাল বানিয়ে ফেলুন। যে পানির বোতলটা আর ব্যবহার করবেন না সেটি কেটে লাগিয়ে ফেলুন গাছ। যে মগ বা গ্লাসটা আর প্রয়োজন নেই, সেটিতেও ফুল বা গাছ রেখে ঘর সাজাতে পারেন।
৫) কম বাসনে রান্না করুন
আমাদের অনেকের ধারণা রান্না করতে গেলে অনেক ধরনের বাসনের দরকার হয়। আসলেই কি তাই? অল্প বাসন ব্যবহারেও কিন্তু রান্নার কাজ মোটামুটি সেরে ফেলা যায়। আর একদিনে অনেক পরিমাণে খাবার রান্না করা থেকে বিরত থাকুন। মানুষের সংখ্যা বুঝে তবেই চুলায় খাবার চাপিয়ে দিন। নইলে সেগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পরে ফেলে দেয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না।
কী কী উপকার পাওয়া যায়?
মিনিমালিস্ট লাইফস্টাইল এর উপকার একেকজনের কাছে একেকরকম হতে পারে। এটা পারসন টু পারসন ভ্যারি করে। তবে বেশিরভাগ মানুষের ধারণা শারীরিক, মানসিক ও ইমোশনাল বেশ খানিকটা স্পেস পাওয়া যায় এই লাইফস্টাইল লিড করলে। অনেকেরই অতিরিক্ত জিনিসের কারণে দুশ্চিন্তা হয়। এই লাইফস্টাইলের কারণে সেটা অনেকখানি কমে যায়। এছাড়া জিনিস কম কেনা হয় বলে টাকাও বেঁচে যায়। সেগুল একাউন্টে জমা থাকলে বেশ ভালোই লাগে। ফিজিক্যাল জিনিসের সাথে অ্যাটাচমেন্ট কম হয় বলে মেন্টাল হেলথ ভালো থাকে, যা আছে তাতে স্যাটিসফেকশন বাড়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা ইকো ফ্রেন্ডলি থাকা যায়।
মিনিমালিজম হলে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে চিন্তা কমে যাওয়া বলে পরিবারের সাথে বেশি সময় কাটানো যায়। সেই সাথে জমানো টাকা দিয়ে কোথাও ঘুরে আসা যায় বা প্ল্যান করা যায় নতুন কিছুর। আর কম জিনিস থাকলে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে ঘর পরিষ্কার থাকে। বাইরের হাওয়া ঘরে ভালোভাবে ঢোকে। প্রকৃতির সাথে সময় কাটানোর সুযোগ বেড়ে যায়।
পছন্দের জিনিস দিয়ে ঘর সাজানো, পছন্দের পোশাক কেনার মধ্যে কোনো দোষ নেই। আপনার ইচ্ছেমতো খরচ আপনি করতেই পারেন। কিন্তু জানেন কি, সবশেষে আপনিও একজন মানুষ। এই পৃথিবীর উপর আপনারও কিছু দায়ভার আছে। আর সেটা মেটাতেই আপনার উচিত মিনিমালিস্ট হওয়া। আপনি যদি একটা পোশাক কম পরেন, তাহলে সেটা বানানোর জন্য উপাদান ও পানি খরচ হয়, সেটা কিছুটা কম হবে। প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করা কমিয়ে দিলে পরিবেশও বাঁচবে। আজ যদি বর্তমান আপনি সুন্দর করতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে আপনার সন্তান কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখেছেন? অন্তত তাদের জন্য হলেও এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রেখে যাওয়ার দায়িত্ব আমার, আপনার, সবার। মিনিমালিস্ট হোন, পৃথিবীকে সুন্দর রাখুন, ভবিষ্যতের জন্য বাসযোগ্য করে তুলুন।