আমরা যখন মার্কেটিং নিয়ে কাজ করি তখন চাই আমাদের ক্যাম্পেইন যেন অবশ্যই বেশি মানুষের চোখে পড়ে, টার্গেট অডিয়েন্সের হার্ট পর্যন্ত পৌঁছায় এবং ROI (Return Of Investment) এর প্রমোশন জেনারেট হয়। বর্তমানে অনেক ধরনের মার্কেটিং ক্যাম্পেইন আছে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনটি আপনাকে বেছে নিতে হবে সেটা বোঝা বেশ কঠিন। এজন্য অবশ্য মার্কেটিং ও অ্যাডভার্টাইজিং এর বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। ক্যাম্পেইন সম্পর্কে জানা থাকলে আপনি বুঝতে পারবেন কোন কোন জায়গা থেকে আপনাকে শুরু করতে হবে। এতে আপনার স্ট্রেসও কমে যাবে। চলুন আজকের আর্টিকেলে জেনে নেয়া যাক মার্কেটিং ক্যাম্পেইন এর সম্পর্কে বিস্তারিত।
মার্কেটিং ক্যাম্পেইন এর কমপোনেন্ট
সাকসেসফুল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন এ কিছু কমপোনেন্ট আছে। যেমন-
১) ক্লিয়ারলি ডিফাইন্ড আউটকাম – সকল ক্যাম্পেইনই শুরু হয় খুব ভালো একটি আউটকাম দিয়ে। আপনি কি কোনো নতুন প্রোডাক্ট বিক্রি করতে চাচ্ছেন? বর্তমান কাস্টমারদের বলতে চাচ্ছেন আপনার সার্ভিস বদলে গিয়েছে? ফেইসবুক বা টিকটকে আরও ফলোয়ার বাড়াতে চাচ্ছেন? মার্কেটিং ক্যাম্পেইনের প্রধান কয়েকটি লক্ষ্য এগুলো।
২) অডিয়েন্স – আপনি কি বর্তমান কাস্টমারদের জন্য অ্যাডভার্টাইজ করছেন? নাকি নতুনদের আকর্ষণ করতে চাচ্ছেন? আপনি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে যে ম্যাসেজ দিতে চাচ্ছেন সেটার জন্য যে টার্গেট অডিয়েন্স ঠিক করবেন তার উপর ক্যাম্পেইন অনেকটাই নির্ভর করবে।
৩) অফার – আপনার ক্রিয়েটিভ কন্টেন্টে অডিয়েন্স কেমন অ্যাকশন নিবে আপনি কী চাচ্ছেন? আপনি কি তাদের কোনো ওয়েবিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন? কোনো প্রোডাক্ট ফ্রিতে ট্রায়াল করিয়েছেন? আপনার অফার বা অ্যাকশনই ঠিক করবে মার্কেটিং ক্যাম্পেইন কীভাবে অডিয়েন্সের উপর প্রভাব ফেলবে এবং কীভাবে ক্রিয়েটিভ কন্টেন্ট তৈরি হবে।
৪) ক্লিয়ার ম্যাসেজ – আপনি কি কোনো প্রোডাক্ট বিক্রি করছেন? ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেস ক্রিয়েট হবে? কিছু ফ্রিতে দিতে চাচ্ছেন? মার্কেটিং ক্যাম্পেইনের সফলতার জন্য ম্যাসেজ ক্লিয়ার থাকা খুব জরুরি।
ক্যাম্পেইনের কিছু উদাহরণ
ক্যাম্পেইনের বেসিক তো জানা হলো, এবার চলুন কিছু উদাহরণ জানা যাক।
মার্কেটিং ক্যাম্পেইন করার সময় আগে ঠিক করতে হবে আপনি কোন ধরনের ক্যাম্পেইন করতে চাচ্ছেন। সঠিক ক্যাম্পেইনই পারে আপনাকে টার্গেট কাস্টমার পর্যন্ত পৌঁছাতে। চলুন জেনে নেই এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত-
১) ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন
এই ক্যাম্পেইনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে লোকে যেন আপনার কোম্পানির ব্র্যান্ডকে চিনে এবং মনে রাখে। সরাসরি ROI মেট্রিকস হয়ত তারা ব্যবহার করে না, কিন্তু তারপরও মার্কেটে বিশ্বাস তৈরি করতে চায়।
যে ব্র্যান্ডের ক্যাম্পেইন করা হবে তার একটি লোগো থাকতে হবে পরিচিতির জন্য। ক্যাম্পেইন এমন হতে হবে যেন সেটি বিজনেসের সাথে রিলেটেড হয় এবং অন্যান্য কম্পিটিটিটরদের থেকে আপনাকে আলাদা করে। অনেক সফল ক্যাম্পেইনে কোম্পানির ভ্যালু নিয়েও হয়ে থাকে। যদি ক্যাম্পেইন সফল হয় তাহলে পরের বার লোকে আপনার ব্র্যান্ডের সাথে নতুন করে পরিচিত হতে আসবে না, জানতে চাইবে আপনি কী নিয়ে কথা বলছেন।
আরও একটু সহজ করে বুঝিয়ে বলি। ধরুন, আপনি আপনার ব্র্যান্ড নিয়ে নিয়মিত অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছেন। যতবেশি লোকের কাছে ব্র্যান্ডের নাম পৌঁছাবে তত সেটি পরিচিতি পাবে। আর পরিচিতি বাড়ার কারণে মানুষ আপনার থেকেই কিনবে। কারণ মানুষ কখনো না কখনো নিজেকে স্পেসিফিক ব্র্যান্ডের কাস্টমার হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। সেই কমিউনিটির একটি অংশ হতে চায়, নিজেকে সেই ব্র্যান্ডের একজন অ্যাম্বাসেডর বা প্রতিনিধি ভাবতে থাকে।
এবার এই ক্যাম্পেইনের একটি উদাহরণ দেয়া যাক।
আপনি দোকানে যখন পানি কিনতে যান তখন সাধারণত কী বলেন? মাম, কিনলে বা ফ্রেশ পানি দিন, তাই তো? এটা কেন বলেন? মার্কেটে তো আরও পানির ব্র্যান্ড আছে। সেগুলোর নাম হয়ত আপনি বলেন না কারণ এদের অ্যাওয়ারনেসে আপনার মনে হয়েছে এই ব্র্যান্ডের পানি ভালো হবে। অথচ সব পানির স্বাদই কিন্তু প্রায় একই রকম। তবু এই যে অনেকগুলো থেকে নির্দিষ্ট কোনো ব্র্যান্ডকে আলাদা করা, এটা তৈরিই হয়েছে ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন থেকে।
২) রিব্র্যান্ডিং ক্যাম্পেইন
কোনো এক্সিস্টিং ব্র্যান্ডকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য এই ক্যাম্পেইন করা হয়। যেমন- অনেক সময় ব্র্যান্ডের নাম, লোগো, স্লোগান বা কালার বদলাতে পারে। তখন নতুন নাম বা ব্র্যান্ড ম্যাটারিয়ালের সাথে পরিচয় করানো হয় এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে। এক সময় যে লোগো বা কালারের সাথে কাস্টমার পরিচিত ছিল, রিব্র্যান্ডিং ক্যাম্পেইনের কারণে তারা ধীরে ধীরে নতুনের সাথে পরিচিত হতে থাকে।
সম্প্রতি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও তাদের নতুন ব্র্যান্ড লোগো উন্মোচন করে। পাঠাও এর স্লোগান এখন ‘পাঠাও ইজ অলঅয়েজ হিয়ার উইথ ইউ’। একে আমরা এই ক্যাম্পেইনের উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি।
৩) সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং ক্যাম্পেইন
ডিজিটাল মার্কেটিং এর অন্যতম একটি শাখা হচ্ছে SEM। এর মাধ্যমে যে কোনো সার্চ ইঞ্জিন এর পেইড অ্যাডভার্টাইজিং অপশন ব্যবহার করে টাকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে কোনো কিওয়ার্ডকে সার্চ ইঞ্জিনের প্রথম পাতায় আনা যায়। এই ক্যাম্পেইন করা থাকলে যে টপিকটা নিয়ে সার্চ করা হবে সেটা স্পন্সরড অ্যাড হিসেবে প্রথমেই আসবে। এটা করা হয় কারণ কোনো কাস্টমার যদি আপনার কোম্পানি রিলেটেড কোনো টপিক সার্চ করে, তাহলে আপনার ওয়েবসাইটটাই সবার আগে আসবে।
উদাহরণ হিসেবে Upwork এর কথা বলা যায়। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য অনেক বড় একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস এটি। এই কোম্পানি সব সময় চেষ্টা করে সার্চ ইঞ্জিনে যেন তাদেরকে সবার শুরুতে দেখা যায় সেই পরিমাণ ট্রাফিক আনতে। পেইড অ্যাডভার্টাইজমেন্টের মাধ্যমে আপওয়ার্ক প্রতি ক্লিকে ফ্রিল্যান্সিং রিলেটেড স্পেসিফিক সার্চ আইটেম টার্গেট করে রাখে। আপনি যদি ‘বেস্ট ফ্রিল্যান্সার’ লিখেও সার্চ করেন, তাহলে আপওয়ার্ককে দেখা যাবে প্রথম বা দ্বিতীয় পজিশনেই।
৪) সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং ক্যাম্পেইন
এই ক্যাম্পেইন ব্যবহার করে আপনি পৌঁছাতে পারবেন ফেইসবুক, টিকটক, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন এর মতো সাইটগুলোতে। মার্কেটিং ক্যাম্পেইন এর জন্য কোন প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিবেন, সেটার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ঠিক করতে হবে আপনি কন্টেন্ট অরগ্যানিকভাবে পাবলিশ করবেন নাকি পেইড অ্যাড দিবেন নাকি দুটোই চাচ্ছেন। এই মার্কেটিং আপনার বিভিন্ন পারপাজ সার্ভ করবে। এর মাধ্যমে ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেস বাড়বে, ভিজিটর রিটার্গেট করবে যারা ওয়েবসাইট আবার ভিজিট করবে বা কার্টে ট্র্যানজেকশন করবে।
আমেরিকার জনপ্রিয় একটি জিম প্রতিষ্ঠানের নাম Planet Fitness। কোভিড-১৯ প্যান্ডামিকের সময় এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ ভালো একটি মার্কেটিং এর উদাহরণ তৈরি করে। মহামারীতে যখন সবাই ঘরবন্দী, তখন তারা ব্যবসা নিয়ে ভিন্ন আঙ্গিক থেকে চিন্তা করে। ফেইসবুক লাইভস্ট্রিমে তারা প্রতিদিন ক্লাস নেয়া শুরু করে যেন তাদের কাস্টমাররা মোটিভেটেড থাকে এবং নতুন নতুন মানুষ জিমে যুক্ত হয়। সে সময় ক্যাম্পেইনটি বেশ হিট করে। প্রতিটি ভিডিও হাজারেরও বেশি ভিউ হতে থাকে এবং ফলোয়াররা রিমোট ক্লাস নিয়ে তাদের রিভিউ দিতে থাকে। এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে শুধু তাদের জিমই খোলেনি, বরং কাস্টমারদের জন্য নতুন একটি অধ্যায়ও চালু হয়েছিল।
৫) ইউজার জেনারেটেড কন্টেন্ট (UGC) মার্কেটিং ক্যাম্পেইন
এই মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে সরাসরি অডিয়েন্সকে আমন্ত্রণ জানানো হয় যেন তারা কন্টেন্ট তৈরি করেন। এর মূল কারণ হচ্ছে – অডিয়েন্স কখনো কখনো ভাবতে পারে আপনি শুধু তাদের কাছে পণ্য বিক্রিই করতে চাচ্ছেন। এর বদলে যদি এমন হয় যে কারও বন্ধু বা কলিগ কোনো কিছু নিয়ে কথা বলছে, সে নিজেও তখন সেই কন্টেন্টের অংশ হতে চাইলো। এই ধরনের ক্যাম্পেইনে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।
২০১৪ সালে আমেরিকান নন প্রফিট অর্গানাইজেশন ALS Association চ্যারিটির জন্য একটি ইউজিসি মার্কেটিং ক্যাম্পেইন শুরু করে। ক্যাম্পেইন নিয়ে কথা বলার আগে একটু জানিয়ে রাখি এটি আসলে কী। এর পুরো নাম হচ্ছে Amyotrophic lateral sclerosis। এটি প্রোগ্রেসিভ নিউরোডিজেনারেটিভ একটি ডিজিজ যা কিনা ব্রেইন ও স্পাইনাল কর্ডের নার্ভ সেলকে এফেক্ট করে। যার কারণে ব্যক্তি প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারেন। এই রোগে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ফান্ড কালেকশনের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ক্যাম্পেইন করে। ক্যাম্পেইনটির নাম ছিল Ice Bucket Challenge। এই চ্যালেঞ্জে ব্যক্তিকে বালতি ভর্তি বরফ ঠান্ডা পানি শরীরে ঢালতে হয়। চ্যালেঞ্জটি সোশ্যাল মিডিয়াতে ওয়াইল্ডফায়ারের মতো ছড়িয়ে যায়। অপরাহ উইনফ্রে, বিল গেটস, জর্জ বুশ এর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা সহ কয়েক লাখ সাধারণ নাগরিক এই চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়ে এই ক্যাম্পেইনকে সফল করে তোলেন। এর জনপ্রিয়তার পেছনে মূল কারণ কি জানেন? কারণ এর পেছনে কোনো ব্র্যান্ড কাজ করেনি, করেছে জনগণ।
মার্কেটিং ক্যাম্পেইন আসলে এখানেই শেষ নয়। আরও নানা ধরনের ক্যাম্পেইন রয়েছে। আজ প্রথম পর্বে আলোচনা করলাম ৫টি ক্যাম্পেইন নিয়ে। বাকি পর্বগুলোতে বিস্তারিত আরও আলোচনা থাকবে।