মার্কেটিং ক্যাম্পেইন সেক্টরটি বর্তমানে অনেক বিস্তৃত। কোম্পানি তাদের নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ক্যাম্পেইন বাছাই করে। কয়েকটি ক্যাম্পেইন নিয়ে আমরা গত পর্বে আলোচনা করেছিলাম। আজকে রইলো দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
ক্যাম্পেইনের কিছু উদাহরণ
৬) ইমেইল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন
মার্কেটারস টুলবক্সে ইমেইল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন অন্যতম জনপ্রিয় ও ইফেক্টিভ একটি টুল। এখানে কাস্টমারকে সব সময় ইনবক্সে পাওয়া যায়। ইমেইল ক্যাম্পেইন আপনাকে দ্রুত বর্তমান ও পোটেনশিয়াল কাস্টমারদের সাথে কানেক্ট করিয়ে দিবে। এই ক্যাম্পেইনের সুবিধা হচ্ছে এটির খরচ একদম কম এবং টুলসও লাগে একদম কম। আর এ কারণেই এটি হয়ে উঠেছে ব্যবসা পরিচালনার অন্যতম এক হাতিয়ার।
ইমেইল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন লঞ্চ করা মানে হচ্ছে কাস্টমারের সাথে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলা, আপনার লেটেস্ট প্রোডাক্ট সম্পর্কে তাদেরকে জানানো, অথবা কোনো ইভেন্ট সম্পর্কে তাদেরকে আপডেট জানানো।
charity: water নামে একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা নিয়মিত তাদের দাতাদের সাথে ইমেইলে যোগাযোগ করে। প্রোগ্রেস রিপোর্ট প্রোভাইড করে। এই ইমেইলে কীভাবে চ্যারিটি থেকে ডোনেশন দেয়া হয়, কোন প্রজেক্টগুলোর প্রোগ্রেস হচ্ছে এবং এগুলোর বিপরীতে কী কী ফিডব্যাক এসেছে সেগুলোও ইনভলভ করা থাকে।
৭) পাব্লিক রিলেশন ক্যাম্পেইন
পাব্লিক রিলেশন ক্যাম্পেইন কোনো একটি ইভেন্টে বা প্রোডাক্ট লঞ্চের সময় একটি শব্দ দ্বারা কোম্পানিকে পরিচিত করে তুলতে পারে। এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বেশ বড় একটি অডিয়েন্সের কাছে ম্যাসেজ পৌঁছে যায়, এরপর ধীরে ধীরে অন্যদের মাঝেও তা ছড়িয়ে পড়ে। এই ধরনের ক্যাম্পেইনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মিডিয়া। সঠিকভাবে ক্যাম্পেইন করতে পারলে এবং মিডিয়া যদি স্টরি বিল্ড করতে পারে তাহলে বাজ ক্রিয়েট হয় অল্প সময়েই।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৯৭ সালে অ্যাপল কোম্পানিতে স্টিভ জবস এর সিইও হিসেবে ফিরে এসে ‘Think Different’ মার্কেটিং ক্যাম্পেইন করা। এই ক্যাম্পেইন এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল যেখানে অ্যাপলের ইনোভেশন ও ক্রিয়েটিভিটিতে নতুন করে ফোকাস করা হয়েছিল এবং কম্পিউটার ও টেকনোলজি ইন্ড্রাস্ট্রিতে তারাই ছিল সেরা কোম্পানি।
এই ক্যাম্পেইনে পাওয়ারফুল ও ইন্সপিরেশনাল টিভি কমার্শিয়াল এর সিরিজ ফিচার করা হয় এবং ইনোভেশন ও ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে প্রচুর প্রিন্ট অ্যাডও তৈরি করা হয়। কমার্শিয়ালটি তৈরি করা হয় ইতিহাস বদলে দেয়া জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নিয়ে। এদের মধ্যে আছেন আলবার্ট আইনস্টাইন, মার্টিন লুথার কিং, জন লেনন এবং আরও অনেকে। এদের প্রত্যেকের সাথে একটি কথাই শুধু যুক্ত ছিল ‘Think Different’। প্রিন্টেড অ্যাডগুলো লাগানো ছিল বিলবোর্ড, বাস, রাস্তার মোড়ের মতো বিভিন্ন জায়গায়। এই অ্যাডটি ক্রিয়েটিভ কম্যুনিটিকে নির্দেশ করে, অ্যাপল প্রোডাক্ট ব্যবহারের যে সুবিধা সেই ম্যাসেজ বেশ পরিষ্কারভাবে দেয়, সেই সাথে আপনিও যে একজন ইনোভেটর ও থিংকার সেটা বোঝায়। এক কথায়, সে সময় এই পাব্লিক রিলেশন ক্যাম্পেইনটি ব্যাপক সারা ফেলে। এক কথায়, জনগণকে প্রোডাক্টের সাথে একাত্ম করে দেয়।
৮) এসইও ক্যাম্পেইন
সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন ক্যাম্পেইন ডিজাইন করা হয় ইন্টেন্ট, কিওয়ার্ড ও কন্টেন্টের মাধ্যমে ওয়েবসাইটে অর্গানিক ট্রাফিক আনার জন্য। আপনার কন্টেন্টকে সার্চ ইঞ্জিনে র্যাংক করানোর জন্য, আপনার ওয়েবসাইট ও ব্লগ পেইজে টাইটেল, মেটা ডাটা, কি অয়ার্ডের মতো এলিমেন্টগুলো অপ্টিমাইজ করতে হবে। সেই সাথে আরও কিছু বিষয় র্যাংকিং এ ইমপ্যাক্ট ফেলে।
অর্গানিক এসইও হচ্ছে মার্কেটার, তাদের কম্পিটিটর ও সার্চ ইঞ্জিনের মধ্যে কখনো শেষ না হওয়া এক ধরনের খেলা। গুগল প্রায়ই অ্যালগরিদম আপডেট রিলিজ করে কিন্তু সেগুলো ব্ল্যাক বক্সে রেখে দেয়। কন্টেন্ট ডেভেলপারসদের টপ ট্রেন্ডে ওঠার জন্য এবং র্যাংক তৈরি করার জন্য তাদের পেইজ আপডেট রাখতে হয়। এই প্রসেসটি বেশ লম্বা, কঠিন হলেও ব্র্যান্ডের সফলতার জন্য এই ক্যাম্পেইন খুব জরুরি।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিউটি ই কমার্স সাজগোজের কথা বলা যায়। তারা তাদের কন্টেন্ট এমনভাবে তৈরি করেছে যে বিউটি রিলেটেড কোনো টপিক সার্চ দিলে তাদের লেখাটাই সামনে চলে আসে। কারণ তারা সঠিকভাবে টাইটেল, ট্যাগ, মেটাডাটা, কী ওয়ার্ডসহ সব কোয়েরি ফুলফিল করে। রেগুলার কন্টিনিউ করার কারণে তাদের সেল বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
৯) ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং ক্যাম্পেইন
ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং ক্যাম্পেইন হলো সেগুলো যেগুলো বিভিন্ন সোশ্যাল চ্যানেল যেমন টিকটক, ইউটিউব ও লিংকড ইন এ প্রমোট করা হয়। কাস্টমারদেরকে তাদের ফ্যামিলি ও ফ্রেন্ডদের মধ্যে প্রোডাক্ট রেফার করার কথা বলার চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার বা ব্লগ রাইটাররা যদি প্রোডাক্ট রিকমেন্ড করে তাহলে কাস্টমাররা বেশি আগ্রহী হয় কেনার জন্য। যদি ক্যাম্পেইন সাকসেসফুল হয়ে যায় তাহলে ব্র্যান্ডটি হাজার হাজার নতুন মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।
বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং এই মুহূর্তে বেশ জনপ্রিয়। ব্যক্তি উদাহরণ যদি দিতে যাই তাহলে হাবিবা আক্তার সুরভী’র কথা বলা যায়। এই মুহূর্তে তিনি ইয়াং জেনারেশনের কাছে বেশ পপুলার। নিজস্ব পোশাক ব্র্যান্ড শরদিন্দু দিয়ে তিনি পরিচিতি তো পেয়েছেনই, বিউটি প্রোডাক্ট নিয়েও কন্টেন্ট তৈরি করেন বলে তাকে অনেকেই ফলো করে। আর এ কারণেই অনেক নামীদামী বিউটি ব্র্যান্ড তার সাথে কোলাবরেশনের কাজ করেছে।
১০) ভিডিও মার্কেটিং ক্যাম্পেইন
প্রতি মাসে অন্তত ২ বিলিয়ন মানুষ ইউটিউবে ভিডিও দেখে। যার কারণে দিন দিন ভিডিও মার্কেটিং হয়ে উঠেছে মার্কেটারদের বেশ বড় ভরসার একটি জায়গা। অন্যান্য ক্যাম্পেইনের মতো ভিডিও মার্কেটিংও বিভিন্ন লক্ষ্য, ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেস তৈরি ও প্রোডাক্ট বিক্রি করে থাকে। এই মার্কেটিং এর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে, কোনো কিছু পড়া বা স্ক্রলিং না করে শুধু ভিডিও দেখেই প্রচুর তথ্য জানা যায়।
১১) গেরিলা মার্কেটিং ক্যাম্পেইন
গেরিলা নামটা শুনে কি আপনার যুদ্ধক্ষেত্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে? আচমকা পেছন থেকে আক্রমণ করে শত্রুদের আস্তানা ছারখার করে দেয়া হয় এই গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ করে। এ তো যুদ্ধক্ষেত্রের কথা, তাহলে মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে এই নামটি কেন ব্যবহার করা হয়? এই মার্কেটিং এ অবশ্য যুদ্ধ নেই, এখানে প্রচলিত বিজ্ঞাপনের বাইরে যেয়ে অপ্রচলিত রীতিতে চমক তৈরি করে গ্রাহকদের মনে দীর্ঘদিন প্রভাব বিস্তার করা হয় অর্থাৎ কাস্টমাররা এই ব্র্যান্ডকে মনে রাখে অনেকদিন। টিভি, রেডিও, পত্রিকা, অনলাইনে জনগণ একই ধারার বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগে বলে বেশিরভাগ সময়েই এগুলো এড়িয়ে চলে। আবার ওয়েবসাইটেও যে বিজ্ঞাপনগুলো দেখা যায় সেগুলোতেও তেমন কেউ নজর দেয় না। আর ঠিক এই জায়গাতেই কাজ করে গেরিলা মার্কেটিং।
ম্যাকডোনাল্ডসের খুব সুন্দর কয়েকটি উদাহরণ আছে এই গেরিলা মার্কেটিং নিয়ে। জেব্রা ক্রসিংকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের আদলে রঙ করে রাস্তা পারাপারে সকলেরই দৃষ্টি কেড়েছে এই ব্র্যান্ড। তাছাড়া পার্কের মধ্যে সিটবিহীন বেঞ্চে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া বা রাস্তার মাঝে থাকা কফির কাপ থেকে ধোঁয়া ওঠা – এসবই গেরিলা মার্কেটিং এর অভিনব উদাহরণ। এই নজর কাড়া যে বিক্রির উদ্দেশ্যে করা তা নয়, বরং কাস্টমারের মনে দীর্ঘ সময়ের জন্য জায়গা করে নেয়াই ব্র্যান্ডের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে।
মার্কেটিং এর দুনিয়া এতই বিস্তৃত যে কখনো কখনো খোদ মার্কেটাররাই বুঝে উঠতে পারেন না কাস্টমারদের কাছে পৌঁছাতে গেলে কোন পদ্ধতিটি তারা অবলম্বন করবেন। আবার এটাও সত্যি যে মার্কেটিং ছাড়া কাস্টমাররা প্রোডাক্ট ও সার্ভিস সম্পর্কে জানতেও পারবে না। তাই মার্কেটিংও লাগবে, সেটার আবার ভিন্ন কোনো ধরনও বেছে নিতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ক্রিয়েটিভ প্রজেক্ট সফল করার জন্য কোন ক্যাম্পেইন কীভাবে কাজ করে? সেটা বোঝার জন্য আমি বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ক্যাম্পেইন সম্পর্কে দুই পর্বে আলোচনা করেছি। এর মধ্যে থেকে আপনি বেছে নিন কোনটি আপনার জন্য স্যুইটেবল। তাহলে আর দেরি কেন? মার্কেটিং ক্যাম্পেইন বাছাই করে কোম্পানিকে সফল করতে এগিয়ে যান আরও এক ধাপ।