লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি: শিল্পের জগতে রহস্যময় একটি নাম

“যেভাবে একটি ভালোভাবে কাটানো দিনের শেষে শান্তির ঘুম আসে,সেভাবেই একটি আনন্দময় জীবনের শেষে সুখের মৃত্যু আসে” – লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি।

শিল্পী লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি, পূর্ণ নাম লিওনার্দ্যো দ্যি স্যের পিয়েরো দ্য ভিঞ্চি, শিল্পজগতে এক আদর্শ নাম। রেঁনেসায় যেসব শিল্পী তাদের বিখ্যাত ও প্রতিভাময় শিল্পকর্মের মাধ্যমে আলোচিত হয়েছিলেন, ভিঞ্চি তাদের মধ্যে অন্যতম। তার “দ্য লাস্ট সাপার” কিংবা “মোনালিসা” এখনো বিখ্যাত এবং তার নোটবুকের লেখাগুলোর মতই রহস্যময়। তিনি ছিলেন একাধারে একজন শিল্পী, ভাস্কর, স্থপতি, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী। এমনকি মানবদেহ নিয়েও তার জ্ঞান ছিল অবাক করার মতো। তাকে একজন বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী মানুষও বলা যায়। বহুমুখী প্রতিভার এই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেই আজ আমরা জানবো।

লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি এর জীবনী

কেমন ছিল ভিঞ্চির ছোটবেলা?

ফ্লোরেন্সের ভিন্সি নামক শহরের নিকটবর্তী আন আচিনো গ্রামে ১৪৫২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ এপ্রিল ভিঞ্চির জন্ম। তার বাবা পিয়েরো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন সমাজের একজন প্রভাবশালী উঁচু ঘরের লোক, তার মা ক্যাটরিনা (মতান্তরে ক্যাতলীনা) ছিলেন সাধারণ ঘরের মেয়ে। গবেষকরা কেউ কেউ এটাও মনে করেন তিনি ছিলেন একজন মধ্যপ্রাচ্য হতে আগত দাসী। পিয়েরো ও ক্যাটরিনার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু তারা বিবাহ করেননি। এর মধ্যে ভিঞ্চির জন্ম হয়। পিয়েরোর বাবা এই প্রেম মেনে নেননি, ফলে পিয়েরো ও ক্যাটরিনার বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং তারা আলাদা আলাদা মানুষের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি

লিওনার্দ্যোর ছেলেবেলা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে খুব সামান্য যা জানা যায়, জন্মের পাঁচবছর পর্যন্ত লিওনার্দ্যো মার কাছেই ছিলেন। এরপর তার বাবা তাকে মার কাছ থেকে তাকে একরকম কিনে নিয়েই নিজের কাছে নিয়ে আসেন। লিওর সৎমা আলবিয়েরা আমাদোরি ছিলেন একজন স্নেহময়ী নরম মনের মানুষ। তার কাছে আদর যত্নেই বেড়ে উঠছিলেন লিও। কিন্তু ১৪৬৪ সালে লিওর অল্পবয়সেই তার এই মা মৃত্যুবরণ করেন।

বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি জীবনে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তার যখন বয়স ১৪ বছর, তার বাবা তাকে তখনকার বিখ্যাত শিল্পী “আন্দ্রে দাই সায়ন ভ্যারিচ্চিও” এর কাছে হাতে কলমে শিক্ষা নিতে পাঠান। ভ্যারিচ্চিওর কাছে তখন নামীদামী শিল্পীদের আনাগোনা, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গিরল্যান্ডিও, পেরুগন, লরেঞ্জো দাই ক্রিডি।

এহেন নামিদামী শিল্পীদের মাঝে কাজ করে লিওনার্দ্যোর প্রতিভা প্রকাশ পেতে থাকে। এখানে তিনি হাতে কলমে শেখেন কারুকাজ, রসায়নবিদ্যা, চামড়ার কাজ, প্লাস্টার দিয়ে কাস্টিং, ভাস্কর্য তৈরি ও মডেলিং, কাঠের কাজ ইত্যাদি। কিশোর লিও’র কাজ এতটাই চমৎকার ছিল যে ভ্যারিচ্চিও এর সাথে তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম “ব্যাপ্টিজম অফ ক্রাইস্ট” ছবিটিতে তিনি কাজ করেন এবং তার কাজে ভ্যারিচ্চিও অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়াও তার বেশ কয়েকটি ছবিতে লিওনার্দ্যো মডেল হিসেবেও কাজ করেছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম “দি বার্জেলো” এবং “টোবিয়াস এন্ড দি এঞ্জেল”।

১৪৭২ সালে লিওনার্দ্যো চিকিৎসক ও চিত্রকরদের সংঘ “গিল্ড অফ সেন্ট লুক” এর পরিচালক হবার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন, কিন্তু তার বাবা তাকে নিজেদের ওয়ার্কশপে কাজে দেন। এসময় লিও ভ্যারিচ্চিওর সাথেও কর্মরত ছিলেন। কারখানায় মূলত তিনি ক্রেতাদের ফরমায়েশ মত ছবি এঁকে দেয়ার কাজ করতেন।

লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি'র আঁকা ছবি ভ্যাপ্টিজম অব ক্রাইস্ট

কীভাবে কাটিয়েছেন পেশাগত জীবন?

লিওনার্দ্যোর পেশাগত জীবনও অনেকটাই ধোঁয়াশাময়। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো ছাড়া তার সম্পর্কে খুব কমই জানা গিয়েছে। তবে ধারণা করা হয়, ১৪৭৮ থেকে ১৪৮১ সাল পর্যন্ত তিনি পারিবারিক ওয়ার্কশপেই ফরমায়েশি চিত্রের কাজ করে গেছেন। ১৪৭৮ সালে তিনি “চ্যাপেল অফ সেন্ট বার্নার্ড” এর মত বড় কাজ করেন। এছাড়া সঙ্গীতেও লিওনার্দ্যো ছিলেন পারদর্শী, তিনি ১৪৮২ সালে “লরেঞ্জো দ্য মেদিসি” এর জন্য ঘোড়ার মুখের আকৃতির একটি বীণা তৈরি করেন, যে বীণাটি তার হাত দিয়েই মিলানের ডিউকের কাছে শান্তিচুক্তির আহ্বান হিসেবে পাঠানো হয়।

১৪৮২ থেকে ১৪৯৯ সালের মধ্যবর্তী সময় লিওনার্দ্যো মিলানে ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এখানে তিনি আঁকেন “ভার্জিন অব দ্য রকস এবং তার বিখ্যাত “দ্য লাস্ট সাপার”। এ সময়ে তার অধীনস্তদের মধ্যে একজন নারী মারা যান যার নাম কাকতালীয়ভাবে “ক্যাটরিনা” এবং তার শেষকৃত্য করা হয় জাঁকজমকপূর্ণভাবে। কোথাও নথিবদ্ধ বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই ক্যাটরিনা প্রকৃতপক্ষে লিওনার্দ্যোর মা ক্যাটরিনা।

বিখ্যাত সব চিত্রকর্ম

মিলান ফ্রেঞ্চদের দখলে যাবার কারণে লিওনার্দ্যো ভেনিস ও মানতুয়া হয়ে ফ্লোরেন্সে ফেরত আসেন। তার খ্যাতি ও উদ্ভাবনী শক্তির কারণে তার পুরোনো বন্ধু এবং নতুন প্রজন্মের চিত্রশিল্পীরা ছিলেন তার গুণমুগ্ধ। তার জীবনের এই শেষদিকে তিনি পূর্বের তূলনায় অনেক বেশি কাজ করেন। তিনি তার “ভার্জিন এন্ড দ্য চাইল্ড উইথ সেইন্ট অ্যান” এর কাজ প্রাথমিকভাবে শুরু করেন, কিন্তু পরে তিনি আবার দশ বছরের জন্য অসমাপ্ত করে রেখেছিলেন। এর দুবছর পরেই তিনি তার বিখ্যাত “মোনালিসা” আঁকেন।

এছাড়াও লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি পালাজ্জো ভেসিও এর হল অফ ৫০০ তে একটি ম্যুরাল ওয়ার্ক করার কমিশন নিয়েছিলেন, যা অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিল। তার উল্টোদিকের দেয়ালে আরেকটি ম্যুরাল করার জন্য কমিশন পেয়েছিলেন আরেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মাইকেল এঞ্জেলো, কিন্তু তার কাজটিও অসমাপ্ত রয়ে যায়। পরবর্তীতে মেডিসি পালাজ্জো ভেসিওকে নিজের বাড়ি বানানোর পর জর্জিও ভাসারিকে নতুন করে সংস্কার করার দায়িত্ব দেন, এই সংস্কার করতে লিওনার্দ্যো ও মাইকেল এঞ্জেলো, দুজনের অসমাপ্ত কাজ দুটিই নষ্ট করে ফেলা হয়।

ভার্জিন অন দ্য রকস

লিওনার্দ্যো তার নিজের আঁকা ছবিও অনুকরণ করতেন ভিন্ন স্টাইলে বা রঙে। তার বিখ্যাত “ভার্জিন অন দ্য রকস” এর একটি অনুকরণ করেন তিনি আলাদা রঙ, আলো ও অন্যান্য সূক্ষ্ম পরিবর্তন করে। ১৫০৬ সালে তিনি মিলান ফিরে এসেছিলেন এবং একটি ভাস্কর্যের কাজ করেছিলেন। এছাড়াও তার বিভিন্ন নথিতে বিভিন্ন মেশিনের অংশ, কীভাবে কাজ করে, ওড়ার মত যন্ত্র এসবের নকশা পাওয়া যায়, যা থেকে বোঝা যায় যন্ত্রবিদ্যায়ও লিও ছিলেন পারদর্শী।

রহস্যময় জীবন

লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি’র জীবনের পরতে পরতে ছিল রহস্যে মোড়ানো। তা হোক তার রহস্যে ভরা নোটবুক বা তার কালজয়ী চিত্রকর্ম মোনালিসা। তার ব্যক্তিগত জীবনে কোনো নারীর উপস্থিতি তেমন পাওয়া যায় না, তার মা এবং সৎমা বাদে। তিনি কারো সাথে প্রেমে জড়াননি, বিয়ে অথবা সংসারও করেননি। তবে কি তিনি সমকামী ছিলেন? ১৪৬৭ সালে একবার লিওনার্দ্যোসহ তিনজন যুবককে সমকামীতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, যদিও পরে কী হয় তা জানা যায়নি।

কিছু কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন লিওনার্দ্যোর প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার ছাত্র “গিয়াকমো ক্যাপরোত্তি” বা ডাকনামে “সালাই” এর সাথে। সালাই প্রায় দুই দশকের মতো লিওনার্দ্যোর সাথে সাথে ছিলেন এবং তার বেশ কিছু চিত্রকর্মের মডেলও হয়েছেন। যদিও সমকামীর বিষয়ে কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এমনই রহস্যে ভরা তার নোটবুক। লিও তার আইডিয়া যেন কেউ চুরি করে নিতে না পারে, তাই মিরর ইমেজ এর মতো করে তিনি তার নোটবুকে লিখতেন, ব্যবহার করতেন দুর্বোধ্য সাংকেতিক ভাষা ও বিভিন্ন ধাঁধা।

মোনালিসার অজানা রহস্য

মোনালিসা লিওনার্দ্যোর একটি কমিশন ওয়ার্ক হলেও তিনি এর পরতে পরতে যোগ করেছেন রহস্য। ১৫০৩-১৫০৪ সালের মাঝে কোনো এক সময় লিওনার্দ্যো ফ্লোরেন্টাইন ব্যবসায়ী ফ্রান্সেসকো দেল গিওকন্ডো এর অনুরোধে কাজটি শুরু করেন। চিত্রকর্মটি তার নতুন বাড়ির জন্য করার কথা ছিল এবং মডেল ছিলেন তার স্ত্রী লিসা দেল গেরাদিনি। লিওনার্দ্যো দশ বছরেরো বেশি সময় নিয়ে পেইন্টিংটি করেন, এমনকি তার মারা যাবার সময়ও পেইন্টিংটি ছিল অসমাপ্ত। তিনি এই ছবিতে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করেন, যার বেশিরভাগই ছিল তখনকার শিল্পীদের কাছে একদম অপরিচিত। আলোছায়ার খেলায় তিনি ব্যবহার করেন রঙ ও দূরত্ব, যেখানে বেশিরভাগ শিল্পীরাও ব্যবহার করতেন রেখা। তিনি বিভিন্ন অনুপাতে রঙের ভিন্ন ভিন্ন ঘনত্বকে কাজে লাগিয়েও অনেকটা কাজ করেছেন। এছাড়াও আরেকটি রহস্যময় ব্যাপার হচ্ছে মোনালিসার হাসি। তার হাসি কি আসলেই হাসি, নাকি তার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে চাপা দুঃখ? ভিন্ন ভিন্ন আলোতে এই হাসি ভিন্ন ভিন্নরকম হয়ে দর্শকের চোখে ধরা দেয়, কখনো কখনো মিলিয়ে যেতেও দেখা যায় মোনালিসার রহস্যময়ী হাসি!

মোনালিসা

এছাড়াও প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয় লিসাই ছিলেন মোনালিসার মডেল, কিন্তু এ বিষয়েরও কোথাও কোনো সঠিক তথ্য নেই। অনেকেই মনে করেন মোনালিসা আসলে লিসা নয়, অন্য কোনো নারীকে মডেল হিসেবে কল্পনা করে বানানো। কেউ কেউ মনে করেন মোনালিসার মডেল আসলে দুইজন, লিসা এবং তার ছাত্র সালাই! তবে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো মতামত কারো কাছেই নেই! মোনালিসাও রহস্য হয়েই মানুষের মনে রয়ে গেছে।

জীবনের শেষ মুহূর্ত ও মৃত্যু

সেপ্টেম্বর ১৫১৩ থেকে ১৫১৬ পর্যন্ত লিওনার্দ্যো রোমে কাটিয়েছিলেন। ১৫১৬ সালের অক্টোবরে রাজা ১ম ফ্রান্সিস মিলান পুনরুদ্ধার করেন এবং লিওনার্দ্যোকে স্থপতি, শিল্পী এবং রাজার উপাধি দেন। ১৪১৬ সাল থেকে তিনি ফ্রান্সিসের অধীনে কাজ করেন এবং তার বাসভবনের পাশে “ক্লস লুইস” ভবনে বসবাস করতে থাকেন। এরপর লিওনার্দ্যো বেশিদিন বাঁচেননি। ১৫১৯ সালের ২ মে ৬৭ বছর বয়সে ক্লস লুইসেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বিভিন্ন রঙের জীবন কাটানো লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি তার জীবনে শিল্পকলার সাথে রেখে গেছেন অনেক রহস্যও। তার কাজগুলো যেমন কালজয়ী, একইসাথে কিছুটা দুর্বোধ্যও, যা আসলে তার প্রতিভাকেই ফুটিয়ে তোলে। ব্যক্তিগত জীবনে লিওনার্দ্যো ছিলেন একজন পারফেকশনিস্ট, তিনি বিভিন্ন চিত্রকর্ম পারফেক্ট না হওয়ায় অসম্পূর্ণ ফেলে রেখেছেন, যে কারণে তার মৃত্যুর পরে অনেক অসমাপ্ত কাজের খোঁজ পাওয়া যায়। একজন আদর্শ শিল্পীর জীবনের মতই, লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি’র জীবন ছিল বিভিন্ন রঙে চিত্রিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *