মার্কেটিং ফিল্ডে আপনার জন্য রয়েছে দারুন সব কাজের সুযোগ। আজকের বাজারে যেখানে একটা সাধারণ মানের চাকরি পাওয়াও কঠিন, সেখানে মার্কেটিং প্রতিদিন নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করছে।
LinkedIn-এর এক তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ সালে শুধু মার্কেটিং পেশাতেই ৩,৮১,০০০ টি নতুন চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে! বর্তমানে সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও হাজার হাজার শিক্ষার্থী মার্কেটিং বিষয়ে পড়ছেন। এমনকি এই বিষয়ে পড়তে আগ্রহীদের সংখ্যা যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
আচ্ছা, কখনো ভেবে দেখেছেন এই জনপ্রিয়তার কারণ আসলে কী? মার্কেটিং ফিল্ডে চাকরির সম্ভাবনাই বা কেমন?
একটি পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে তা ক্রেতার নিকট পৌঁছানোর মধ্যেই কিন্তু মার্কেটিংয়ের কাজ সীমাবদ্ধ নয়। কোন কোম্পানির পণ্য, সেবা অথবা আইডিয়াকে তার প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা এবং স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাও মার্কেটিংয়ের অন্যতম প্রধান কাজ। এই ফিল্ডটি মুলত প্রচন্ড গতিশীল ও বহুমুখী এবং এই ক্ষেত্রে সফলভাবে কাজ করার জন্যে আপনার ‘Hard skills’ যেমন প্রয়োজন হবে, তেমনি ‘Soft Skills’ এরও প্রয়োজন হবে।
এখানে আপনি ‘প্রোডাক্ট মার্কেটার’ হিসেবে কাজ করতে পারবেন যারা কিনা নতুন ‘প্রোডাক্ট’ অথবা ‘প্রোডাক্ট লাইন’ বাজারে ক্রেতাদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। এছাড়াও ‘ব্র্যান্ড ম্যানেজার’ হিসেবে কোন নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের প্রতি ক্রেতাদের আকর্ষন বৃদ্ধি এবং ব্র্যান্ডকে ক্রেতাদের নিকট তুলে ধরার দায়িত্বেও কাজ করতে পারবেন। মার্কেট রিসার্চ অ্যানালিস্ট, গ্লোবাল মার্কেটিং অ্যানালিস্ট, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যানালিস্ট এসব পজিশন আজকের তরুণদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এসব পজিশনে আপনি কাজ করতে পারেন ‘রিসার্চার’ (Marketing Researcher) হিসেবে, যার কাজ মূলত ক্রেতার চাহিদা ও কোম্পানির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গবেষণা করা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করা। ‘Sales and Advertising’ এর আওতায় কোন পণ্য বা সেবার বিক্রয় বৃদ্ধির জন্য আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন তৈরি ও ক্যাম্পেইন পরিচালনার কাজও করতে পারেন।
মার্কেটিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন কিন্তু ‘ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের’ কথা না বললেই নয়!
এই যে আপনি স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রতিদিন এত ‘কন্টেন্ট’ দেখেন, হোক সেটা ভিডিও, মিম্, ছবি, গান-বাজনা অথবা কোন কোম্পানির প্রোডাক্টস এর বিবরণ, তাদের বিশেষ ক্যাম্পেইন, সমাজের উন্নয়নে তাদের ভুমিকা ইত্যাদি.. এগুলো ঠিক কারা পোস্ট করে আপনার ‘ফিড’ পর্যন্ত পৌঁছায় জানেন? এগুলোর দায়িত্ব কিন্তু একজন ডিজিটাল মার্কেটারের উপরই থাকে!
‘Social Media Marketing (SMM)’ এর কাজ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কোন ব্যক্তি অথবা কোম্পানির সঙ্গে তাদের ফলোয়ারদের এনগেজমেন্ট বৃদ্ধি করা, একটি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত কাস্টমার ‘Base’ তৈরি করা, কোম্পানির ‘Vision & Mission‘ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা ইত্যাদি। SMM এর আওতায় আবার ‘Communications’ এবং ‘Public Relations’ এর কাজও আপনি করতে পারেন। অন্যদিকে, Search Engine Optimization (SEO) -এ কাজ করতে চাইলে আপনাকে জানতে হবে সর্বোচ্চ ‘ট্র্যাফিক’ পাওয়ার জন্যে কিভাবে কোম্পানির ওয়েবসাইট তৈরি করতে হয়, ডিজাইন করতে হয়, কিভাবে কি-ওয়ার্ডস্ লিখতে হয়।
পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে এখন ক্রেতাকে দোকানে যেয়ে ঘুরে ঘুরে আর দেখতে হয়না। অনলাইনে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ওয়েবসাইটে যেয়ে ঘরে বসেই পণ্য নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রাহক ফেসবুক, টুইটার, ইন্সট্রাগ্রাম, গুগল, হ্যাংআউট এর মত প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সেবাদাতার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছে।
কিন্তু বাস্তবতা হল এতকিছুর ভিড়ে কোন পণ্যটি কাস্টমার কিনবে? সেটাই নিবে যেটার প্রতি তার মনে একটা সফট কর্নার রয়েছে। চাইবে সে সেরা প্রাডাক্টটাই কিনতে, কিন্তু কিনবে যেটা সে ভাল মত বুঝে। মনে রাখতে হবে কাস্টমার কখনো সেরা প্রোডাক্ট কিনে না। সে কিনে এমন প্রোডাক্ট যেটা সে ভালো বুঝতে পারে।
আর মানুষ গল্পের মাধ্যমে সহজে সবকিছু বুঝতে পারে। ঠিক তেমনই, একটি কোম্পানি যত দ্রুত কাস্টমারকে বোঝাতে পারবে কেনো তার সেই কোম্পানীর পণ্য বা সেবা গ্রহণ করা উচিত কিংবা সে ঐ পণ্য বা সেবা গ্রহণ না করলে তার কি ক্ষতি হবে, ততই সেই বিক্রি বেড়ে যাবে।
এই বিষয়ে ডোনাল্ড মিলার তার লিখা বই Building a StoryBrand (বিল্ডিং এ স্টোরি ব্র্যান্ড)-এ খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন। ডোনাল্ড মিলার একজন আমেরিকান লেখক, পাবলিক স্পিকার এবং একজন ব্যবসায়ী। তিনি “storybrand ” নামক মার্কেটিং কোম্পানির সিইও। মার্কেটিংয়ের উপর তার লেখা একটি অন্যতম বই “Building a StoryBrand”. আপনি যদি একজন উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ি বা মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রির একজন হয়ে থাকেন অথবা আপনি যদি আপনার প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ভ্যাল্যু এবং সেলস বাড়াতে চান, তাহলে এই বইটি আপনার জন্য আশির্বাদ স্বরূপ। যারাই সেলস, মার্কেটিং বা ব্র্যান্ডিং-এ আগ্রহী তাদের জন্য এই বইটি পড়া অতিব জরুরী। যারা বইটির নাম আগে কখনো শোনেননি বা শুনেছেন কিন্তু পড়েননি তাদের অনুরোধ করব দ্রুত এই বইটি সংগ্রহ করে পড়ে ফেলার জন্য।
মার্কেটিং মেসেজ লিখার জন্য ডোনাল্ড মিলার এর মজাদার একটি সমাধান আছে। তিনি বলেছেন, যেকোনো সময় কোনো প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য আমাদের যখন মার্কেটিং ক্যাম্পেইন সাজাতে হয়, এই পয়েন্টটি আপনাদের মধ্যে যারা বিভিন্ন কোম্পানির জন্য মার্কেটিং ক্যাম্পেইন সাজান তাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ, একটা মার্কেটিং ক্যাম্পেইন সাজানোর জন্য আপনাকে মূলত তিনটা প্রশ্ন করতে হবে।
প্রশ্নগুলি হলো
- What does the ‘Hero’ want?
স্টোরি ব্র্যান্ড সিরিজের আগের লেখাগুলি যারা পড়েছেন নিশ্চয়ই জানেন গল্পের হিরো কে। জ্বি, হ্যাঁ আপনার কাস্টমারই এখানে হিরো। যদি লেখাগুলো পড়ে না থাকেন তবে অনুরোধ করব একটু কষ্ট করে পড়ে আসতে তাহলে আপনারই বুঝতে সুবিধা হবে। কাস্টমার আসলে চায় কি? এটাই আমাদের সবার আগে প্রশ্ন করতে হবে। - What is opposing the ‘Hero’ from getting what he wants?
আপনার কাস্টমার যা চাচ্ছে, সেটি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধা গুলো আসলে কি? অর্থাৎ তিনি কেন তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে পৌঁছতে পারছেন না? - What will happen if he does or does not get what he wants?
আপনার কাস্টমার যা চাচ্ছেন সেটি যদি তিনি পেয়ে যান, তাহলে তার কেমন লাগবে? ভালো বা খারাপ যাই লাগুক সেই এক্সপ্রেশন এর বহিঃপ্রকাশ কেমন হবে, সেই ধারণা আপনার কল্পনায় পূর্বেই করতে পারতে হবে।
লেখকের মতে, এই তিনটি প্রশ্নের উওর যদি আপনি সুন্দর করে সাজাতে পারেন, তাহলে পৃথিবীর যেকোনো মার্কেটিং ক্যাম্পেইন আপনি তৈরি করতে পারবেন এবং সেটির সফলতার মুখ দেখতে পাওয়ার প্রবণতা অনেকগুণ বেড়ে যাবে।
বিষয় তিনটি বোঝার জন্য আমরা যদি বাস্তব কোনো উদাহরণ নিয়ে কথা বলি তাহলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে।
প্রথমেই একটা প্রোডাক্ট বা সার্ভিস প্রয়োজন বিক্রি করার জন্য। ধরুন, “পডকাস্ট মাইক্রোফোন” এখানে মূল প্রোডাক্ট। এখন পডকাস্ট মাইক্রোফোনের কোনো কোম্পানি আপনাকে তাদের প্রোডাক্টের মার্কেটং ক্যাম্পেইন সাজাতে বললো। তার মানে ধরে নেন আপনিই বর্তমানে কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন, যার প্রধান কাজ মাইক্রোফোন বিক্রির ক্যাম্পেইন চালানো।
প্রথম প্রশ্নটি হলো ক্যাম্পেইন সাজানোর প্রথমেই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, What does the hero want? হিরো কি চায়? অর্থাৎ কাস্টমারের প্রয়োজনীয়তা কি? কাস্টমার কি মাইক চান?
এই জায়গাটা একটু ভালো করে খেয়াল করবেন। আপনার কাস্টমার কিন্তু মাইক চান না, যেটা আপাতদৃষ্টিতে আমরা ভুল করে থাকি বোঝার ক্ষেত্রে। আপনার কাস্টমার চান, তিনি যখন পডকাস্ট বা ভিডিও রেকর্ড করতে বসবেন তখন যেন অডিও কোয়ালিটি বেশ ভালো হয়। কাস্টমারের অডিয়েন্স যেন বক্তার কথা ভালোভাবে শুনতে পারেন, এটাই কাস্টমারের মুখ্য চাওয়া।
আমাদের আশেপাশের এরকম অনেক মার্কেটিং ম্যানেজারকেই বলতে শুনবেন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ভাষ্য, “কাস্টমার তো মাইক চান।” মিলার বলেছেন, সাধারণ চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে, সমস্যার গভীরে যেয়ে চিন্তা করার সক্ষমতা আপনার থাকতে হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, What is opposing the hero from getting what he wants? তো কাস্টমার যে মাইক্রোফোনটা চান, তিনি যে চান তার অডিয়েন্স সুন্দর করে কথা শুনতে পারুক, এই বিষয়টার সাথে কাস্টমারের প্রোডাক্ট কিনতে না চাওয়ার বাঁধাটা আসলে কোথায়? চিন্তা করুন তো?
Price একটা বাঁধা হতে পারে, আপনার প্রোডাক্ট যে ভালো, কাস্টমারের কাছে সেটার ভালো ব্যাখ্যা আপনি দাঁড় করাতে পারেননি অথবা মার্কেটে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ একই প্রোডাক্ট খুব ভালো ব্যাখ্যা করে বিক্রি করছে, এরকম আরও বাধার একটা চেকলিস্ট বানিয়ে প্রতিটা বাঁধার জন্য একটা করে বিজ্ঞাপন বানাবেন।
কখনো কখনো অনেকগুলো সমস্যার সমাধান একটা বিজ্ঞাপনেই দেয়া সম্ভব। আপনার ব্যবসার সুবিধার্থে যেকোনো একটা পন্থা অবলম্বন করে মার্কেটিং ম্যানেজার সমাধান দিবে। তবে অবশ্যই প্রতিটি বাঁধা আপনার জানা থাকতে হবে।
এবং শেষ প্রশ্নটি হলো, What will happen if he does or does not get what he wants? আপনি যদি কাস্টমারকে এই অসাধারণ মাইকটি দিতে পারেন, তাহলে কাস্টমার কোন দিক থেকে লাভবান হতে পারবেন এটার উওর আপনার মার্কেটিং ক্যাম্পেইন দিয়ে তাকে বোঝাতে হবে।
যারা Aspirational Marketing এর সাথে পরিচিত, তারা আশা করি বিষয়টি এর আগেই বুঝে থাকতে পারেন। ধরুন, আপনারা টেলিভিশনে রিয়েলস্টেট কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে থাকবেন, একজনের জীবনে একটা সময়ে বাড়ি ছিলো না। তারপর তিনি বাড়ি পেলেন, নিজেদের একটা ছোট্ট আঙিনা পেলেন, বাচ্চার জন্য শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ পেলেন, এভাবে বিজ্ঞাপনের নানা পসরা সাজিয়ে থাকেন ডেভেলপাররা।
Aspirational Marketing:
এই যে একটা সময় কিছু না থাকতে থাকতে যখন কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় এই ব্যাপারগুলো আসলে Aspirational। আমাদের দেশীয় টেলিকম কোম্পানিগুলো ঈদের সময় বাড়ি ফেরা নিয়ে এ ধরনের নানা মার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালিয়ে থাকে।
তো কাস্টমার যখন আপনার সার্ভিস ব্যবহার করবেন, তিনি যেসব সুবিধাগুলো পাবেন অথবা আপনার সার্ভিস না নিলে যেই সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হবেন, পজিটিভ এবং নেগেটিভ যেকোনো ভাবেই Aspirational Marketing ক্যাম্পেইন সাজাতে পারেন।
এই মার্কেটিং ক্যাম্পেইন আপনার ইচ্ছামত যেকোনোভাবেই হতে পারে। তবে যেভাবেই হোক না কেন, মূল বার্তা যাতে কাস্টমারের সরাসরি দৃষ্টিগোচর হয়। আপনার কোম্পানির যত ধরনের মার্কেটিং মেসেজ থাকবে, সবগুলোকেই প্রতিনিয়ত এই তিনটি প্রশ্নের উওর দিয়ে যেতে হবে।
পরিশেষে যদি আপনি এই কাজগুলি করে যেতে পারেন তাহলে মার্কেটিং এর দিক থেকে অন্যান্য যেকোনো বিজনেস থেকে আপনার বিজনেস সব সময় এগিয়ে থাকবে বলে ডোনাল্ড মিলার তার লিখা Building a StoryBrand (বিল্ডিং এ স্টোরি ব্র্যান্ড) বইয়ে বলেছেন।
আশা করি যারা মার্কেটিং নিয়ে আগ্রহ রাখেন তাদের ভালো লাগবে। তবে সত্যি বলতে মূল বইটি পড়ে এর চেয়ে আরও বেশি জানতে পারবেন। আমি আশা করবো আপনারা বইটি সংগ্রহ করে পড়বেন।
আজ এ পর্যন্তই। পরবর্তী ব্লগে এই বই থেকে আরও দারুন কিছু কৌশল নিয়ে আপনাদের সাথে আলোচনা করবো। ততোদিন সবাই ভালো থাকুন। আমাদের আজকের এই আলোচনাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই একটি কমেন্ট করে জানাবেন এবং আরও অনেকের উপকারের স্বার্থে শেয়ার করবেন।