বর্তমানে বিশ্বে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা আঁকাশছোয়া। ফেসবুক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম, যার বর্তমানে ৩.০৩ বিলিয়ন ইউজার রয়েছে। তাই, ফেসবুক হতে পারে আপনার বিজনেস এর জন্য চলনসই প্ল্যাটফর্ম এবং খুলে দিতে পারে সম্ভাবনার দুয়ার। ৬৬% ফেসবুক ব্যবহারকারী মানুষ তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও লোকাল বিজনেসের খোঁজ ফেসবুকে নেন সপ্তাহে অন্তত একবার। সুতরাং আপনার যদি কোনো বিজনেস থাকে, এখনই সময় আপনার বিজনেসকে ফেসবুকে নিয়ে আসার। ফেসবুকে চালু করা মার্কেটপ্লেস অপশন আপনাকে এখন পণ্য তালিকাভুক্ত করার সুযোগ দেয়, এছাড়াও বিজনেস পেজ খোলা এবং টার্গেট অডিয়েন্স এর কাছে নির্দিষ্ট বুস্ট এ প্রোডাক্ট পাঠানোর কাজও ফেসবুক করে দেয়। আমাদের এই আর্টিকেলে আমরা ফেসবুক ব্যবহার করে নিজেদের বিজনেস কীভাবে বড় করা যায় সে সম্পর্কে জানাবো।
ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা বড় করার উপায়
ফেসবুক মার্কেটিং
ফেসবুক মার্কেটিং বলতে আমরা বুঝি কোনো বিজনেস বা ব্র্যান্ডের প্রমোশন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুকের ব্যবহার করাকে। ফেসবুক মার্কেটিং একটা বড় সংখ্যাক ক্রেতার কাছে আপনার প্রোডাক্টের প্রমোশন করে, পটেনশিয়াল কাস্টমারদের আকর্ষণ করে। এতে প্রোডাক্টের সেল ও প্রফিট বৃদ্ধি পায়। এমনকি অনেক বিজনেস শুধুমাত্র ফেসবুক কেন্দ্রিক ব্যবসাই শুরু করে সাফল্য পেয়েছে, পরে ওয়েবসাইটও বিজনেসে যুক্ত করেছে। সুতরাং, ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম ফেলে দেয়ার মতো কোনো ব্যাপার নয়। সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে ফেসবুক থেকেই আপনি হয়ে যেতে পারেন সফল ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা।
ফেসবুক প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগানোর টিপস ও ট্রিকস
ফেসবুক শুধুমাত্র একমুখী একটা প্ল্যাটফর্ম নয়, এখানে আপনি বিভিন্নভাবে প্রোডাক্টের প্রমোশন করতে পারেন। পোস্ট, কমেন্ট, ভিডিও কন্টেট, স্টোরি ও রিলস, অ্যাড ম্যানেজমেন্ট, গ্রুপ খোলা, কন্টেস্ট করা বা গিভএওয়ের ব্যবস্থা করা, মেসেঞ্জারে অটো রেসপন্স সেভ করা, ইনফ্লুয়েন্সার ও ভ্লগারদের সাহায্য নেয়া, ফেসবুক শপ ও মার্কেটপ্লেস, লাইভ ভিডিও স্ট্রিম ইত্যাদি অনেক অপশনই আছে যেগুলোর সাহায্যে আপনি আপনার ব্যবসার উন্নতি করতে পারবেন। অনেক অ্যাডভান্সড টেকনিকের পাশাপাশি আছে পেইড সার্ভিসও, যেমন- বুস্ট। এমনকি পরিচিতি বাড়লে আপনি নিজের ব্র্যান্ড পেজ ভেরিফাইডও করে নিতে পারেন। দেখা যাক আমরা আর কী কী করে ফেসবুককে কাজে লাগাতে পারি।
১) কমিউনিটি তৈরি করুন
লোকাল কমিউনিটি বিজনেস এর জন্য একটা খুব বড় রানিং ফ্যাক্টর হতে পারে। এই জিনিসটা অনলাইন অফলাইন দুই ক্ষেত্রেই সত্যি। আপনার নিজ এলাকার আশেপাশে বুস্ট করুন, বন্ধুবান্ধব, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে আপনার পেজ শেয়ার করতে বলুন, যারা আশেপাশে আছে তাদের জন্য ফ্রি ডেলিভারি বা পিক আপ অপশনের ব্যবস্থা রাখতে পারেন। আপনার পরিচিত মানুষদের আপনার বিজনেস কমিউনিটিতে দেখলে বাইরের মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করবে এবং আপনার কাছ থেকে কেনাকাটায় ভরসা পাবে, তাই কমিউনিটি ফর্ম করা জরুরি।
২) স্পেশাল বা লিমিটেড এডিশন কিছু আইটেম রাখুন
খেয়াল করলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ বড় বড় ব্র্যান্ডই ফেসবুকে স্পেশাল কিছু আইটেম দেয়। এ ক্ষেত্রে শোরুম এর চেয়ে অনলাইনে একটা সুবিধা আছে। শোরুমে আপনি এক সাথে নির্দিষ্ট কিছু আইটেমই ডিসপ্লে করতে পারেন, কিন্তু অনলাইনে আপনার সব কালেকশনই আপনি একসাথে ডিসপ্লে করতে পারেন। তাই কিছু আইটেম, যা শোরুমে নেই সেগুলো লঞ্চিং, প্রথম অর্ডারে ছাড়, ফেসবুকে অর্ডারে ছাড় এসব অফার করতে পারেন, এতে মানুষ আপনার পেজ এর সাথে এনগেজ বেশি করবে এবং প্রচারণা হবে।
৩) আনন্দ ও বিনোদনের সুযোগ রাখুন
এখনকার সময়ে মানুষের ধৈর্য কম, শুধুমাত্র সেল পোস্ট বা প্রোডাক্ট এর ছবি দিয়ে মানুষের আগ্রহ ধরে রাখা যায় না। তাই মাঝে মাঝে বিনোদনমূলক, জ্ঞান ও তথ্যমূলক, হাস্যরস পোস্ট করতে পারেন। এছাড়াও বর্তমানে চলতে থাকা ট্রেন্ড, কাস্টমারদের কাছে জিজ্ঞাসা যে পরের প্রোডাক্ট তারা কী চাচ্ছেন, কোন রঙের চাহিদা বেশি ইত্যাদি পোলের মাধ্যমে মতামত নিতে পারেন। নিজের পেজের প্রোডাক্টের সাথে অন্য কোন প্রোডাক্ট মেলে, কিসের সাথে পরলে সুন্দর লাগবে এধরনের পোস্টও করতে পারেন। এতে মানুষের আপনার কথা মনে থাকবে এবং পোস্ট তাদের ফিডে না গেলেও তারা নিজেরাই খুঁজে নেবেন।
৪) ফেসবুকে লাইকের সংখ্যা বাড়ান
ফেসবুক পেজে আপনার যত বেশি লাইক থাকবে তত বেশি প্রমোশন হবে এবং পটেনশিয়াল কাস্টমারদের কাছে আপনার বিজনেস পৌঁছাবে। তাই লাইকের সংখ্যা বাড়ানোয় মনোযোগ দিন। অর্গানিকভাবে লাইকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কন্টেস্ট ও গিভএওয়ে, মেম্বার ইনভাইটিং, কুইজ ইত্যাদির আয়োজন করতে পারেন। এছাড়াও বুস্টিং এর সাহায্যেও লাইকের সংখ্যা বাড়ানো যায়। পেজে লাইক বেশি থাকলে প্রমোশন এর সাথে কাস্টমার রিলায়েবলিটিও বাড়বে এবং আপনার বিজনেস গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
৫) অফলাইন স্টোরে ফেসবুক স্টোরকে প্রমোট করুন
আপনার যদি একটা অফলাইন স্টোর থাকে, সেখানে ফেসবুক স্টোরের কথা জানান। পোস্টার বা ব্যানারে টাঙাতে পারেন। বিজনেস কার্ডে ফেসবুক স্টোরের তথ্য দিন। কাস্টমারদেরকে ফেসবুক স্টোরে চলা বিভিন্ন অফার ও প্রোমো কোডের কথা জানান। এতে আপনার অফলাইন কাস্টমাররাও অনলাইনে আপনাকে সাপোর্ট করতে পারবেন।
৬) নতুন কাস্টমারদের জন্য ছাড় দিন
পুরাতন কাস্টমারদের সাথে সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি নতুন কাস্টমার তৈরি করাটাও জরুরি। এতে আপনার বিজনেস বৃদ্ধি পাবে। এজন্য বেশ কিছু বুদ্ধি খাটানো যায়। নতুন কাস্টমারদের জন্য রাখতে পারেন ফার্স্ট অর্ডার অফার, দিতে পারেন ওয়ান টাইম ইউজ কুপন কোড। পেজ-গ্রুপে জয়েন থাকলে ডিসকাউন্ট, ওয়ান টাইম ফ্রি ডেলিভারি। এধরনের জিনিসগুলো ছড়িয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি, কাস্টমারের সংখ্যা ও আপনার বিজনেসের জনপ্রিয়তা বাড়বে।
৭) ফিডব্যাক এর অপশন রাখুন
ফেসবুক ও এফ কমার্সের সুবিধা হচ্ছে, এখানে আপনি সরাসরি পার্সোনাল আইডি থেকে কাস্টমারের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। কাস্টমারও আপনাকে সরাসরি পান। ফেসবুক পেজে একটা অপশন থাকে, রেটিং বা রেকমেন্ডেশন, যেখানে কাস্টমার আপনার সার্ভিস বা প্রোডাক্ট সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন এবং নিজেদের মতামত, ভালোলাগার জায়গা বা কোথায় ইম্প্রুভ করা যায় এসব পরামর্শ দিতে পারেন। এতে করে পটেনশিয়াল কাস্টমাররা আপনার প্রোডাক্টে ভরসা পাবেন।
৮) ব্যবহার করুন অন্যান্য মিডিয়াও
এফ কমার্স বলে শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে তা নয়, অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকেও কাজে লাগান। টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এগুলোতে পোস্ট করুন, সুন্দর সুন্দর কন্টেন্ট আপলোড করুন, হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করুন। আপনার পেজ এর রিচ বাড়বে, আরো বেশি অডিয়েন্স এর কাছে পৌঁছাবে। এখন ফেসবুকের আন্ডারে থাকা প্রায় সব মিডিয়ার ক্রসওভার করা বা প্রোফাইলে লিংক শেয়ার করা যায়। এভাবে লিংক শেয়ার করে রাখলে মানুষ এক প্ল্যাটফর্ম থেকেই আপনার সবগুলো লিংক পেয়ে যাবে।
৯) হাই ডেফিনিশন ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করুন
ক্লিয়ার ও সুন্দর ছবি আপলোড করুন। প্রোডাক্টের সৌন্দর্য যাতে ছবিতে ফুটে ওঠে তা নিশ্চিত খেয়াল করতে হবে। এখন ভিডিও শেয়ারের বিভিন্ন মাধ্যম হয়েছে, যেমন ফেসবুক রিলস, লাইভ শেয়ারিং। প্রোডাক্টের সুন্দর করে ভিডিও করে পেজে আপলোড করুন। ছবির চাইতে ভিডিওতে অনেক সময় প্রোডাক্টের ডিটেইলস ভালোভাবে বোঝা যায়। তাই, ভালো কোয়ালিটির ছবি ও ভিডিও দিন।
১০) ভ্লগার ও ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং করুন
ভ্লগার ও ইনফ্লুয়েন্সারদের বেশ বড় রকমের ফলোয়ার বেস থাকে। তাদের দিয়ে মার্কেটিং ও পেইড প্রমোশন করালে আপনার বিজনেস বড় সংখ্যাক পটেনশিয়াল কাস্টমারের কাছে চলে যাবে। তাই, নিতে পারেন তাদের সাহায্য। পি আর মার্কেটিং, পেইড প্রমোশন, ফিজিক্যাল লাইভ ইত্যাদি সার্ভিস ইনফ্লুয়েন্সাররা প্রায়ই দিয়ে থাকেন। তাই, এই বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কম সময়ে বেশি ফলোয়ার ও পটেনশিয়াল কাস্টমার পেতে পারেন।
১১) ক্যাচি হেডলাইন ব্যবহার করুন
কাস্টমার ও ফলোয়ারদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য ক্যাচি ও ইন্টারেস্টিং ক্যাপশন ও হেডলাইন ব্যবহার করতে পারেন। শুধুমাত্র প্রোডাক্টের দাম বা ম্যাটেরিয়াল না লিখে প্রোডাক্টটি সম্পর্কে দিতে পারেন মজার কোনো তথ্য বা ঐতিহাসিক গল্প। এমনকি প্রোডাক্টের পিছনের গল্পও। এতে মানুষ প্রোডাক্টটিকে ও আপনাকে মনে থাকবে।
১২) পেজে অ্যাকটিভ থাকুন
আপনার ফেসবুকের শপটিও কিন্তু আপনার ফিজিক্যাল শপের মতই গুরুত্বপূর্ণ। ফিজিক্যাল শপে একদিন দুদিন না গেলে যেমন সেল কমে যাবে, ফেসবুক পেজে এক্টিভ না থাকলেও তাইই হবে। এছাড়া এখন ফেসবুকের নতুন ফিচার অনুযায়ী পেজে এক্টিভিডি না থাকলে সেই পেজের রিচ আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এর ফলে আপনার কথা কম মানুষের কাছে পৌঁছাবে। বিভিন্ন তথ্য, প্রোডাক্টের ছবি, আলোচনা বা পোল, স্পেশাল কালেকশন ইত্যাদি মিলিয়ে চেষ্টা করবেন প্রতিদিন কিছু না কিছু পোস্ট করার। এতে আপনার পেজ এর রিচ বজায় থাকবে এবং কাস্টমাররা ভরসা করতে পারবে।
১৩) লোগো ও ট্যাগলাইন ব্যবহার করুন
ব্যবসার জন্য লোগো ও ট্যাগলাইন এমনিই দরকারি, ফেসবুকের ব্যাপারে স্পেশাল কেন? কারণ ফেসবুকে আপনি ছবির মাধ্যমে প্রমোশন চালাচ্ছেন, সেই ছবি অনেক মানুষের কাছে যাচ্ছে এবং মানুষ তা দেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আপলোড করা ছবি ও ভিডিওতে ব্যবহার করুন আপনার বিজনেসের ট্যাগলাইন ও লোগো। এতে করে মানুষ ছবিটা সেভ করে আপনার পেজ হারিয়ে ফেললেও ছবি থেকে লোগো ও ব্র্যান্ডের নাম দেখে খুঁজে নিতে পারবে। এছাড়া আপনার পরিশ্রম করে তোলা ছবি কেউ নিজের নামে চালাতে পারবে না।
১৪) শপ অপশন ব্যবহার করুন
অনেক এফ কমার্স উদ্যোক্তারাই তাদের পেজ এ ফেসবুক শপ অপশনটা সঠিকভাবে কাজে লাগান না। শপ অপশনে আপনার প্রোডাক্টগুলো লিস্ট করা থাকলে কেউ পেজ এ ঢুকেই প্রোডাক্টের তালিকা পেয়ে যাবেন ও নিজের পছন্দমত পণ্য দেখে নিতে পারবেন। এ কারণে শপ অপশনটি বন্ধ রাখবেন না। আপনার প্রোডাক্ট লিস্ট করে রাখুন ফেসবুক শপে।
যারা নতুন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন বা ইতিমধ্যে শুরু করেছেন কিন্তু তেমন সেল হচ্ছে না, তারা এই টিপস ও ট্রিকস ফলো করে দেখতে পারেন। আশা করি ফেসবুক ব্যবহার করে পেজের সেল অল্প সময়ে বৃদ্ধি পাবে।