সফট স্কিল কীভাবে পারসোনালি ও প্রফেশনালি আমাদেরকে বেনিফিট দেয়?

কর্মক্ষেত্রে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে ভালোভাবে জানা এবং কাজ নিয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা অবশ্যই জরুরি। নইলে কোনো কাজ কীভাবে করতে হবে সেটা সময়মত বোঝা যাবে না। আবার এটাও সত্যি, কাজ তো সবাই করে। কিন্তু যারা আসলে হাই পারফর্মার হতে চায় তাদের কিছু কোয়ালিটি আলাদাভাবে থাকতেই হবে। যেমন- সবার সাথে কীভাবে কমিউনিকেট করতে হয় সেটা বোঝা, অন্যদের সাথে সুন্দরভাবে কাজ করা, সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। আর এগুলোকেই বলা হয় সফট স্কিল। এই স্কিলগুলো আপনাকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ করে তুলবে, সেই সাথে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানা যাবে এবং প্রফেশনাল এনভায়রনমেন্টও বুঝতে সাহায্য করবে।

সফট স্কিল কোনগুলো এবং এগুলো কীভাবে আয়ত্ত করা যায়?

১) ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সকে সংক্ষেপে বলা হয় EQ। নিজের ইমোশনকে চিনে, বুঝে এবং ইফেক্টিভলি ম্যানেজ করতে পারলে স্ট্রেস অনেকটাই কমে আসে। আত্মসচেতনতা অর্থাৎ নিজেকে চেনা ও বোঝা, সামাজিক দক্ষতা অর্থাৎ সমাজে থাকা অন্য ব্যক্তিদের বোঝা, সেলফ ম্যানেজমেন্ট- এর সবই সফট স্কিলের উদাহরণ। আপনি ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সে কতটুকু দক্ষ সেটা বোঝার জন্য অনলাইনে টেস্ট করতে পারেন।

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স সফট স্কিল এর একটি অংশ

২) এমপ্যাথি বা সহমর্মিতা

আপনার মাঝে এমপ্যাথি যত বেশি থাকবে, তত আপনি ব্যক্তিগতভাবে অন্যদের সাথে কানেক্ট হতে পারবেন। বস, কলিগ বা অন্য যাদের সাথেই কাজ করতে হয়, যদি তাদের অনুভূতি সম্পর্কে বোঝা যায়, তাহলে টিমওয়ার্ক আরও ভালো হয় এবং কনফ্লিক্ট হওয়ার চান্স কমে। যেমন- একজন ম্যানেজার যদি তার অধনীস্থে যারা কাজ করছেন তাদের সমস্যাগুলো শোনেন এবং সেই জায়গায় নিজেদের রেখে বিবেচনা করেন, তাহলে তারা সেই সমস্যাটি ভালোভাবে বুঝতে পারবেন এবং সহমর্মিতাও দেখাতে পারবেন।

৩) কমিউনিকেশন

কলিগ, ক্লায়েন্ট বা স্টেকহোল্ডার- যে কারো সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য ইফেক্টিভ কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ ভালো হওয়া খুবই জরুরি। এতে যে শুধু কথাবার্তাই ক্লিয়ার হবে তা না, বরং অন্যরা কী চাচ্ছে সেটাও যেমন বোঝা যাবে, তেমনই ফিডব্যাকও পাওয়া যাবে। নিয়োগকর্তারা আসলে এমন ব্যক্তিদের চান যারা সহকর্মীদের সাথে প্রফেশনাল রিলেশনশীপ তৈরি করতে পারবেন, বিশেষ করে যখন টিমের সাথে কথা বলা হবে তখন।

কমিউনিকেশন স্কিলের কয়েকটি উদাহরণ হলো-

  • অ্যাকটিভ লিসেনিং
  • ভারবাল কমিউনিকেশন
  • নন ভারবাল কমিউনিকেশন
  • রিটেন কমিউনিকেশন
  • প্রেজেন্টেশন স্কিল
  • পাবলিক স্পিকিং
  • নেগোসিয়েশন
  • কনফিডেন্স

সফট স্কিল এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কমিউনিকেশন স্কিল থাকা

৪) লিডারশীপ

একজন ভালো লিডার সব সময় তার টিমকে আরও ভালো কাজ করতে উৎসাহ দেয়। ভিশন ক্লিয়ার করতে, ইফেক্টিভলি কমিউনিকেট করতে এবং চমৎকার একটি কালচার তৈরি করতে তারা বেশ পারদর্শী হয়ে থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তারা করে সেটি হচ্ছে, তারা টিম মেম্বারদের উৎসাহ দেয় এবং যে কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সর্বাত্মক সহায়তা করে।

লিডারশীপ স্কিলগুলোর মধ্যে আছে-

  • প্রবলেম সলভিং
  • কোচিং ও মেন্টরিং
  • ম্যানেজমেন্ট
  • স্ট্র্যাটেজিক থিংকিং
  • ডিসিশন মেকিং
  • টিম বিল্ডিং

৫) টিম ওয়ার্ক

সফট স্কিল এর মধ্যে আরও একটি ইম্পরট্যান্ট স্কিল হচ্ছে টিম ওয়ার্ক। সবাই মিলে একসাথে কাজ করলে লক্ষ্য অর্জন করাও সহজ হয়। এই স্কিলের মধ্যে আছে কমিউনিকেশন, কোলাবরেশন এবং গ্রুপে সবার সাথে একসাথে কাজ করার জন্য কমিটমেন্ট। যারা সবার সাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারেন তারা প্রফেশনাল গোল অ্যাচিভ করতে এবং অর্গানাইজেশনের সাকসেসে বেশি কন্ট্রিবিউট করতে পারেন।

টিম ওয়ার্ক স্কিলের ভেতর যে বিষয়গুলো অবশ্যই থাকতে হবে-

  • সমস্যা সমাধানের দক্ষতা
  • মেডিটেশন
  • অ্যাকাউন্টেবিলিটি
  • কোলাবরেশন
  • রেসপেক্টফুলনেস

সফট স্কিল

৬) ক্রিয়েটিভিটি

ক্রিয়েটিভিটি থাকলে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু চিন্তা করা যায়। এছাড়া চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে কীভাবে সেগুলোর সমাধান করা যায় তারও বেশ কিছু আইডিয়া পাওয়া যায়। এক কথায়, কাজ করার আগ্রহ, ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা এবং অনিশ্চয়তাকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে ক্রিয়েটিভ মানুষরা বেশ দক্ষ। এই সফট স্কিলটি থাকা মানে যে কেউ একটি সমস্যাকে ভিন্ন ভিন্ন এংগেল থেকে দেখতে পারে এবং সেগুলোর সমাধানও দিতে পারে নতুন নতুন উপায়ে।

ক্রিয়েটিভ স্কিলের কিছু উদাহরণ-

  • ব্রেইনস্টরমিং
  • ইমাজিনেশন
  • আগ্রহ থাকা
  • এক্সপেরিমেন্ট করা

৭) টাইম ম্যানেজমেন্ট

টাইম ম্যানেজমেন্ট মানে হচ্ছে কোনো কাজকে গুরুত্ব দেয়া, সেটা সম্পন্ন করার জন্য সকল প্রস্তুতি নেয়া এবং বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটিজের মাধ্যমে সেটা শেষ পর্যন্ত সফল করা। নিয়ম মেনে কাজ করতে হয় বলে কাজেও ফোকাসড থাকা যায়। সাধারণত, টাইম ম্যানেজমেন্ট স্কিল ভালো হলে ডেডলাইন নিয়ে হতাশা ও দুশ্চিন্তা কমে। ওয়ার্কপ্লেসে এই স্কিল থাকলে অন্যদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে থাকা যায়।

টাইম ম্যানেজমেন্ট স্কিলের কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে-

  • প্ল্যানিং
  • গোল সেটিং
  • ডেলিগেশন বা প্রতিনিধিত্ব করা
  • টাইম ব্লকিং

৮) অ্যাডাপট্যাবিলিটি

বর্তমান যুগ ব্যবসার হলেও ক্রমাগত এখানে পরিবর্তন হচ্ছে। এই সফট স্কিল আপনাকে সাহায্য করবে পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে। ওয়ার্কপ্লেসে যদি নতুন কিছু শিখতে হয় বা নতুন কোনো টেকনোলজির সাথে অ্যাডজাস্ট হতে হয়, তখন এই স্কিল বেশ কাজে আসে। আপনি জানেন না কখন আপনাকে কোন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। তাই সব সময় সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকা জরুরি।

কয়েকটি অ্যাডাপট্যাবিলিটি স্কিল হচ্ছে-

  • ফ্লেক্সিবিলিটি
  • সহনশীলতা
  • গ্রোথ মাইন্ডসেট
  • অ্যানালাইসিস

৯) প্রবলেম সলভিং

প্রবলেম সলভিং স্কিল

প্রবলেম সলভিং এমন একটি দক্ষতা যেটি যে কোনো সমস্যার সমাধান সহজেই করে দিতে পারে। যে কোনো কমপ্লেক্স চ্যালেঞ্জ সহজেই চিহ্নিত করতে পারা এবং সুযোগ বুঝে সেগুলোর সমাধান করা হয় এই দক্ষতার মাধ্যমে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতেও এই দক্ষতা কাজ করে। কয়েকটি প্রবলেম সলভিং স্কিলের মধ্যে আছে-

  • ক্রিটিক্যাল থিংকিং
  • অ্যানালাইসিস
  • স্ট্র্যাটেজিক থিংকিং
  • উদ্যোগ
  • কমিউনিকেশন
  • ক্রিয়েটিভ থিংকিং
  • ইনোভেশন

১০) কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট

সব সহকর্মী যে সব সময় সব কলিগদের সাথে থাকতে পারে এমন নয়। টিমে কোনো সমস্যা হলে সেটা সমাধানের জন্য সব পক্ষ থেকেই কনফ্লিক্ট হতে পারে। এ ধরনের কনফ্লিক্ট বা মতভেদকে ভালোভাবে ম্যানেজ করার প্রসেসকেই বলা হয় কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট। এই দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন কমিউনিকেশন স্কিল, অ্যাকটিভ লিসেনিং, নেগোসিয়েশন স্কিল এবং কোলাবোরেট করার দক্ষতা।

কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট স্কিলের মধ্যে আছে-

  • এমপ্যাথি
  • নেগোসিয়েশন
  • মেডিটেশন
  • কনফ্লিক্ট রিজোলিউশন

সফট স্কিল থাকা জরুরি কেন?

এটি জরুরি, কারণ এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সফল কর্মী এবং হেল্পফুল টিম মেম্বার হয়ে ওঠেন। এমন ব্যক্তিরা যে কোনো জবের ক্ষেত্রেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হয়ে ওঠেন। নিয়োগকর্তারা সব সময় সফট স্কিল আছে এমন ব্যক্তি খোঁজেন, কারণ তারা এর মাধ্যমে বুঝতে চান সেই ব্যক্তি কতটুকু সফলতার সাথে প্রতিষ্ঠানকে দিতে পারবেন। গবেষণা অনুযায়ী, ৮৯ শতাংশ নতুন নিয়োগের ফলাফল খারাপ আসে শুধুমাত্র সফট স্কিল ভালো না হওয়ার কারণে, এর পেছনে মূল কারণ টেকনিক্যাল কাজ না পারা নয়। বিশেষ করে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স ও মোটিভেশন না থাকার কারণে তারা বেশি পিছিয়ে পড়েন। এটি বেশি ঘটে এন্ট্রি লেভেলে নিয়োগের ক্ষেত্রে। কারণ তাদের টেকনিক্যাল স্কিল খুব ভালো না হলেও, প্রতিযোগিতায় তারা অনেকটাই পিছিয়ে থাকেন এই সফট স্কিল না থাকার কারণে।

সফট স্কিল

কীভাবে এই স্কিল ইমপ্রুভ করা যায়?

সফট স্কিল কীভাবে পারসোনালি ও প্রফেশনালি আমাদের বেনিফিট দেয় সেটা তো আমরা জানলাম। কিন্তু এই স্কিল ইমপ্রুভ করা যায় কীভাবে? এর জন্য যা যা করতে হবে-

অন্যদের সাথে ডিসকাশন করতে হবে

এমন গ্রুপ খুঁজে বের করতে হবে যারা বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে। সেটা হোক শিক্ষার্থী জীবনে বা কর্মজীবনে। যদি কোন প্রজেক্ট সম্পর্কে বুঝতে আপনার কিছুটা সময়ও লেগে যায়, তবু আপনি বুঝবেন কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, সবার সহযোগিতা পেতে হয়, যোগাযোগ করতে হয় এবং ফিডব্যাক পেতে হয়।

প্র্যাকটিস করুন

সফট স্কিল মানে এমন নয় যে, জাস্ট শুধু কাজ করে গেলাম আর হয়ে গেলো। এর মানে হচ্ছে আপনি যেমন কাজ করবেন, তেমন রেসপন্সও পাবেন। তাই অন্যদের সাথে কমিউনিকেট করা শুরু করুন। শুধু অন্যকে বলা নয়, তারা কী বলছে সেটাও আপনাকে শুনতে হবে এবং কীভাবে তাদের আপনি বললে তারা বুঝবে সেই দক্ষতাও আপনার মাঝেই থাকতে হবে।

সেলফ রেসপেক্ট

আপনার উন্নতিতে কীভাবে সফট স্কিল রিফ্লেক্ট করছে সেটা বুঝতে হবে আপনাকেই। হার্ড স্কিলের মতো এটা গোণা সম্ভব নয়। আপনি যখন কোনো প্রজেক্টে কাজ করছেন, ইন্টার্নশীপ করছেন, ভলান্টিয়ার অপরচুনিটি পেয়েছেন, পার্ট টাইম কাজ করছেন, এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের সাথে যুক্ত আছেন অথবা কোনো ইন্টারভিউতেই নিজের কথা বলছেন- তখনই আসলে বোঝা যায় আপনি কতটুকু এই দক্ষতায় সফল হয়েছেন। এর প্রতিফলন আপনার নিজেকেই খুঁজতে হবে। বুঝতে হবে, কোথায় কোথায় গ্যাপ রয়ে যাচ্ছে, কীভাবে আরও ইফেক্টিভ কমিউনিকেটর হতে পারবেন, পরবর্তীতে আরও কী কী করা যায়।

সফট স্কিল কী, কেন প্রয়োজন আর কীভাবে এটি ইমপ্রুভ করবেন সে সম্পর্কে তো জানা হলো। এবার এই দক্ষতাগুলো কাজে লাগিয়ে ফেলুন পারসোনালি ও প্রফেশনালি। দেখবেন জয় আপনারই হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *