বাজে অভ্যাস পরিত্যাগ করে ভালো অভ্যাস তৈরি করবেন কীভাবে?

মানুষ অভ্যাসের দাস নাকি অভ্যাস মানুষের দাস, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মানুষ যে তার তীব্র ইচ্ছাশক্তি আর একান্ত চেষ্টার ফলে যেকোনো কিছুই সম্ভব করতে পারে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একজন মানুষের স্বভাবগুলো সাধারণত পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ, পড়াশোনার ক্ষেত্র, কার্যক্ষেত্র, বন্ধুবান্ধব ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তৈরি হয়। দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেক সময় না চাইতেও আমাদের কোনো কোনো খারাপ অভ্যাস হয়ে যায়। যেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর জানা স্বত্ত্বেও আমরা ছাড়তে পারি না। এসকল অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য তীব্র ইচ্ছাশক্তির পাশাপাশি কিছু স্টেপ অনুসরণ করে এসব ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চলুন আজকে জেনে নিই কীভাবে কোনো খারাপ বা বাজে অভ্যাস থেকে নিজেকে মুক্ত করবেন।

বাজে অভ্যাস কীভাবে পরিত্যাগ করবেন 

১। কারণ খুঁজে বের করুন

কোনো সমস্যা কেন হচ্ছে সেটি বের করতে পারলেই অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়। খারাপ অভ্যাসের কারণ খুঁজে বের করতে পারলে এটি থেকে মুক্ত হতেও সময় বেশি লাগবে না। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের অভ্যাস হলো আমাদের এমন স্বভাব বা চিন্তাধারা যা আমরা বার বার, প্রতিনিয়ত করি। যার ফলে এটি একা একাই আমাদের মধ্যে চলে আসে। মানুষ সাধারণত অভ্যাস তৈরি করে, যেন তাদের ব্রেইন একই কাজে বার বার অনেক সময় ও ফোকাস না দেয়, বরং যে সকল জটিল কাজে সময় ও ফোকাস বেশি লাগে সেগুলোতে মনোযোগ দিতে পারে।

সাধারণত দেখা যায় যেকোনো খারাপ অভ্যাস তৈরি হয় স্ট্রেস, একঘেয়েমি, ডিপ্রেশন অথবা নেগেটিভ কোনো ঘটনা ইত্যাদি থেকে। ছোট ছোট খারাপ অভ্যাস যেমন- দাঁত দিয়ে নখ কাটা থেকে শুরু করে অতিরিক্ত কেনাকাটা করা কিংবা ইন্টারনেটে অনেক সময় ব্যয় করা- সবই হতে পারে ডিপ্রেশন, স্ট্রেস অথবা একঘেয়েমির জন্য। তাই প্রথমে নিজে সচেতন হোন কেন আপনার মধ্যে এ ধরনের অভ্যাস তৈরি হচ্ছে তা বোঝার জন্য।

বাজে অভ্যাস এর কারণ খুঁজে বের করুন

২। খারাপকে প্রতিস্থাপন করুন ভালো দিয়ে

আপনার জীবনে এখন যত অভ্যাস আছে, ভালো অথবা খারাপ তার সবই কোনো না কোনো কারণে হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো কোনো খারাপ অভ্যাসও কোনো এক দিক থেকে আপনার জন্য কোনো বেনিফিট এনেছে। তাই হুট করেই যেকোনো অভ্যাস ত্যাগ করা বেশ কঠিন হয়ে যেতে পারে।

এক্ষেত্রে একটি সহজ আর কার্যকর উপায় হলো, খারাপ অভ্যাসের বদলে একটি ভালো অভ্যাস তৈরি করা। যেমন ধরুন, আপনি প্রচুর পরিমাণে ধূমপান করেন যেটি আপনার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন হুট করেই ধূমপান ছেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এটি ছাড়তে বেশ কঠিন হয়ে যাবে। তার বদলে আপনাকে চিন্তা করতে হবে যে, নতুন কোন পজেটিভ পদ্ধতিতে আপনি এই স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তার সাথে মোকাবেলা করতে পারেন। আস্তে আস্তে সিগারেটের বদলে সেই অভ্যাসটি তৈরি করে ফেলতে হবে।

এক কথায়, খারাপ অভ্যাসগুলো আপনার নির্দিষ্ট কিছু চাহিদা পূরণ করে। তাই আপনার খারাপ অভ্যাসগুলোকে একটি স্বাস্থ্যকর অভ্যাসে প্রতিস্থাপন করতে হবে, যা এই চাহিদাগুলোকেও মিটাবে। আর আপনি যদি ভেবে থাকেন যে, একবারে খারাপ অভ্যাসগুলোই শুধু বাদ দিবেন তবে আপনার এই নির্দিষ্ট কিছু চাহিদা অপূর্ণই রয়ে যাবে। ফলে দৈনন্দিন জীবনে অনেক বেশি স্ট্রাগল করতে হবে। তাই চেষ্টা করুন একটি খারাপ অভ্যাস বদলে একটি ভালো অভ্যাস করার।

৩। খারাপ অভ্যাসের বিকল্প খুঁজুন এবং সঠিক পরিকল্পনা করুন

যেকোনো খারাপ অভ্যাসের একটি বিকল্প ভালো অভ্যাস খুঁজুন। খারাপ থেকে ভালো অভ্যাসে পরিণত করার জন্য নিজের গোল সেট করুন। নিজে নিজে চিন্তা করুন ও প্ল্যান তৈরি করুন। সময় বেঁধে দিন নিজেকে যে খারাপ অভ্যাস থেকে ভালো অভ্যাসে যেতে কতটা সময় নিবেন। ফোকাস করুন পজেটিভ দিকগুলোতে। ভেবে বের করুন যে, এই অভ্যাসের যে কারণ, সেই কারণকে আবার মোকাবেলা করতে হলে আপনি পরবর্তীতে কী করবেন?

যেমন ধরুন- আপনি ধূমপান ছাড়তে চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে একদিনেই হুট করে ছেড়ে দেয়া সম্ভব না। প্রথমে নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করুন যে আপনাকে এই অভ্যাসটি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তবে স্ট্রেস বা একঘেয়েমি বোধ করলে সিগারেট ধরানোর বদলে অন্য কী করলে এটাকে সামলাতে পারবেন সেটি খুঁজে বের করুন। গোল সেট করুন যে আজকে গতকালের চেয়ে একটি সিগারেট কম খাবেন। এভাবে ধীরে ধীরে অভ্যাসটি ত্যাগ করতে হবে।

পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কিছুই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। তাই যে অভ্যাসই হোক না কেন, আপনি আগে পরিকল্পনা করুন কীভাবে এটি থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসতে পারবেন।

বাজে অভ্যাস বদলে নতুন অভ্যাস তৈরি করুন

৪। খারাপ অভ্যাসগুলোকে উৎসাহ দেয় এমন কারণগুলো চিহ্নিত করে বাদ দিন

খারাপ অভ্যাসের প্রায়ই ট্রিগার থাকে যা আপনার আচরণকে প্ররোচিত করে। এই ট্রিগারগুলি মানসিক, পরিবেশগত বা পরিস্থিতিগত হতে পারে। আপনার অভ্যাসগুলোকে কিসে ট্রিগার করে তার দিকে মনোযোগ দিন এবং খুঁজে বের করুন। ধরুন, আপনার টিভি দেখার অভ্যাসটি অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে চলে গিয়েছে, এটি থেকে বের হতে সর্বপ্রথম আপনি টিভির রিমোট লুকিয়ে ফেলুন। তারপর টিভি দেখার এসময়ে অন্য কোনো কিছু করুন যাতে আপনি আনন্দ পান। বই পড়ুন, গান শুনুন, নিজেকে নিয়ে ভাবুন, ছবি আঁকান, কিছু তৈরি করুন, রান্না করুন, ঘর গোছান ইত্যাদি অন্য অনেক কাজের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বদলে ফেলুন অতিরিক্ত টিভি দেখার অভ্যাসটি। আবার ধরুন- আপনি মিষ্টি বেশি খান, যা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে। মিষ্টিজাতীয় খাবার কেনা কমিয়ে দিন। দিনে যেখানে আপনি ৫টি চকলেট খান, মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে আস্তে আস্তে চকলেট খাওয়া কমান। সম্ভব হলে চকলেট কেনা বন্ধ করে দিন। যেসকল কারণে কোনো খারাপ অভ্যাস হচ্ছে আপনার মাঝে, সেসকল কারণকে এড়িয়ে চলুন। এতে খারাপ অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে আপনার জন্য অনেক সহজ হবে।

৫। সাপোর্টিং পরিবেশ ও সঙ্গ তৈরি করুন

যেহেতু আমাদের অভ্যাস পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও আমাদের আশেপাশের পরিবেশের মাধ্যমে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে, তাই খারাপ অভ্যাস পরিত্যাগের ক্ষেত্রে এগুলো সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবে। আপনার আশেপাশের পরিবেশ, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের মানুষেরা যদি আপনাকে এই অভ্যাস পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাপোর্ট করে তাহলে আপনার জন্য এটি হবে সবচেয়ে সহজ। তাই এমন বন্ধুসঙ্গ যারা ভালো অভ্যাসে উৎসাহ দেয় তাদের সাথে বেশি সময় কাটান।

৬। সফলতার চিন্তা করুন

প্রচলিত আছে, মানুষ যা মন দিয়ে ভাবে মানুষ তা অবশ্যই করতে পারে। তাই যখন আপনি নিজের পরিবর্তন করতে চান ভালোর দিকে, তখন চিন্তা করুন যে এই ভালো অভ্যাসগুলো রপ্ত করতে পারলে আপনার জীবনটা আরো কত সুন্দর হবে। ভাবুন যে, এই ভালো অভ্যাসের মাধ্যমে আপনি কীভাবে সবার কাছে সমাদৃত হবেন। এধরনের চিন্তাগুলো আপনার মনোবল বাড়াবে আর খারাপ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করে ভালো অভ্যাস তৈরির জন্য আরো বেশি উৎসাহ দিবে।

৭। আপনার কাজ ও আচরণের উপর নিবিড় লক্ষ্য রাখুন

গবেষণায় দেখা যায় যে, খারাপ অভ্যাস পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আপনার নিজের আচরণ লক্ষ্য করা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে জার্নালিং একটি দারুণ উপায়। ধরুন আপনি একটি খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন। প্রতিদিন একটু একটু করে নোট করুন, কতটুকু অগ্রগতি হচ্ছে সেটি লিখে রাখুন। এতে যেমন উৎসাহ পাবেন, তেমন অভ্যাস পরিবর্তনের অগ্রগতিও ট্র‍্যাক করতে পারবেন।

৮। নিজেকে পুরস্কৃত করুন

খারাপ অভ্যাস ভেঙে ভালো অভ্যাস তৈরি করার এই যাত্রায় নিজেকে ছোট ছোট অগ্রগতির জন্য পুরস্কৃত করুন। ছোট ছোট গোল সেট করুন এবং সেই গোল পূরণ করতে পারলে নিজেকে পুরষ্কৃত করুন। নিজের পছন্দের রেস্টুরেন্টে খেতে যান, প্রিয় কোনো বই কিনুন বা ঘুরতে যান অথবা এমন কিছু করুন যা করে আপনি সত্যি সত্যি অনেক আনন্দ পাবেন। এই পুরস্কারগুলো আপনার ইতিবাচক আচরণগুলোকেও প্রভাবিত করবে এবং উৎসাহও বাড়বে। এভাবে খারাপ অভ্যাস ছাড়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপও সৃষ্টি হবে না।

নিজেই নিজেকে পুরস্কার দেয়া

খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করে ভালো অভ্যাস তৈরি করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই এক্ষেত্রে প্রচুর ধৈর্য ধারণ করতে হবে। একটু একটু করে এগিয়ে যেতে হবে। আর নিজের মধ্যে থাকতে হবে প্রচুর ইচ্ছাশক্তি আর সুগঠিত পরিকল্পনা। তাই আত্মবিশ্বাস আনুন নিজের মাঝে এবং লেগে পড়ুন একটি ভালো অভ্যাস তৈরি করতে।

ছবিঃ সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *