নিজের একটি ব্যবসা চালানো অনেক বড় একটি দায়িত্ব, তবে নিজের পরিবারকে সময় দেয়াও ফুল টাইম একটি জব। যারা পরিবার থেকে দূরে বসে কাজ করেন তাদের জন্য এটা অবশ্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। আবার বাড়িতে বসে কাজ করলেও মনে হয় না যে সব সময় কাজের মধ্যেই থাকা হচ্ছে? তাহলে আসলে পরিবারকে সময় দেয়া হচ্ছে কখন? ব্যবসায়ীরা যখন কাজের দুনিয়ায় ডুবে থাকেন তখন পরিবারকে সময় দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে যান। চাকরী জীবনে হয়ত এটা একটু সহজ হয়। কিন্তু ব্যবসায়িক জীবনে পরিবারের জন্য সময় বের করা বেশ কঠিন। কিন্তু আপনি কাজ কাদের জন্য করছেন? পরিবারের জন্যই তো? তাহলে তাদেরকেই যদি সময় না দিতে পারেন তাহলে এই কাজের মূল্য কী থাকবে? তাই ব্যবসায়িক ও পারিবারিক জীবন একসাথে ব্যালান্স করতে পারা জরুরি। কিন্তু কীভাবে? তা নিয়েই আজ কিছু পরামর্শ জানাবো।
ব্যবসায়িক ও পারিবারিক জীবন একসাথে ব্যালান্স করবেন যেভাবে
কথায় বলে, সময়ই অর্থ। তবে এখানে কিছু পার্থক্য আছে। অর্থ আয় করার জন্য সুযোগ সবসময়ই থাকবে, কিন্তু সময় একবার চলে গেলে সেটা আর ফিরে আসে না। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও যেমন এটা মনে রাখা জরুরি, তেমনই পারিবারিক ক্ষেত্রেও। এতকিছুর পরও ব্যবসায়িক ও পারিবারিক জীবন ব্যালান্স করার উপায় আমাদেরই বের করতে হবে।
১) অন্যকে কাজ ভাগ করে দেয়া
টানা কাজ করতে থাকলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি কীসের হবে জানেন? নিজের শরীরের। আর এতে নিজেও ভালো থাকবেন না, পরিবারও দুশ্চিন্তায় থাকবে। তাই সব কাজ একা না করে কাজ ভাগ করে দিন। একটা ব্যবসায় অনেক ধরনের কাজ থাকে। অপারশন, সেলস, মার্কেটিং, কাস্টমার সার্ভিস, অ্যাকাউন্টিং ইত্যাদি। প্রতিটি কাজই ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর এগুলো সব একসাথে করতে গেলে আপনি এতটাই ব্যস্ত হয়ে যাবেন যে পরিবারের জন্য সময় বের করতে পারবেন না। তাই কাজ ভাগ করে দিন টিমের মধ্যে। যদি বেশি মানুষও না থাকে, এরপরও এমন একজনকে নিয়োগ দিন, যার কাজই হবে আপনার কাজগুলো সামলানো।
২) প্রতিটি দায়িত্ব পালনের জন্য রুটিন করে নিন
ব্যবসায়িক ও পারিবারিক জীবন ব্যালান্স করার জন্য পরিকল্পনা করা খুব জরুরি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কী কী কাজ করবেন সেটার একটা রুটিন সেট করে নিন। কিছু কাজ আপনাকে করতেই হবে এটা নির্ধারণ করে নিন। যেমন- বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনা, রাতের খাবার সবার সাথে খাওয়া, বাচ্চাকে হোমওয়ার্ক করানো এগুলোর জন্য একটা শিডিউল করে নিন। যদি এগুলো একটা রুটিনের মতো হয়ে যায়, তাহলে ব্যবসায়িক ও পারিবারিক জীবন ব্যালান্স করা কঠিন মনে হবে না।
৩) সবাই ঘুমালে কাজ করুন
ব্যবসায়িক কাজ সব সময় বাড়িতে করা ঠিক নয়, এটাও যেমন ঠিক, তেমনই কিছু কাজের ডেডলাইন থাকে যেগুলোর জন্য হয়তো বাড়তি কাজ ঘরে থেকেই করতে হয়। সব সময় না হলেও মাঝে মাঝে এই কাজগুলো সবাই ঘুমিয়ে গেলে করতে পারেন। এতে যেমন পরিবারের সাথে সময় কাটানোর সুযোগও পাওয়া যাবে, তেমনই ওয়ার্ক রিলেটেড স্টাফগুলোও কমপ্লিট করা যায়।
৪) কিছু কাজ সবার সামনেই করতে পারেন
অফিসের সব কাজের প্রেশার বাড়িতে বয়ে নিয়ে আসতে হবে এটা জরুরি নয়। বাড়িতে বসে যখন কাজ করছেন তখন যদি কোনো রিসিভ করা বা মেইলের রিপ্লাই দিতেই পারেন। এর মানে হচ্ছে পরিবারের সাথে থাকাকালীন এমন কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করা যেতেই পারে। তাছাড়া কাজ করতে যেয়ে কী কী চ্যালেঞ্জ ফেইস করছেন, কী কী আইডিয়া পেলেন, কোন কাজগুলো করতে যেয়ে ঝামেলায় পরেছেন এগুলো পরিবারের সাথে শেয়ার করতে পারেন। এতে পারিবারিক বন্ধন শক্ত হবে। আপনার পরিবারও বুঝবে আপনি কী কী কাজ করেন, তারাও আপনার কাজকে অ্যাপ্রিশিয়েট করবে।
৫) ওয়ার্ক লিমিট সেট করুন
সর্বপ্রথম আপনাকে ঠিক করতে হবে কত ঘন্টা আপনি কাজ করতে চান। আপনি যদি কোনো উদ্যোক্তাকে জিজ্ঞেস করেন কেন সে নিজের ব্যবসা শুরু করেছে, তাহলে শুরুতেই সে বলবে কাজের স্বাধীনতা ও ফ্লেক্সিবিলিটি পেতে, নিজেই নিজের কাজের বস হতে সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যখন ইচ্ছা কাজ করা, যতক্ষণ ইচ্ছা কাজ করা এসব নিজের ব্যবসাতে করাই যায়, কিন্তু সেটা যদি দিনের পর দিন হতে থাকে তখনই সমস্যার শুরু হয়। কাজের কোনো সময়সীমা থাকে না বলেই দিন রাত, সকাল সন্ধ্যা এক করে কাজ করেই যাওয়া হয়। এতে পরিবারের সদস্যরাও বুঝতে পারে না আপনাকে কখন কাছে পাবে, কীভাবে আপনার সাথে সময় কাটাবে। তাই কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করা খুবই জরুরি।
৬) গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আগে করুন
কাজের জন্য সময় নির্ধারণ করার সাথে সাথে এটাও বোঝা জরুরি যে কোন কাজগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে টাইম কনজিউমিং কাজগুলো প্রতিষ্ঠানে খুব একটা ভ্যালু অ্যাড করছে না, সেগুলো করা কিছুটা কমিয়ে দিয়ে সেই সময়টুকু পরিবারকে দিন। ৯০ শতাংশ কাজ এমন হওয়া উচিত যেগুলো আপনার ব্যবসাকে গ্রো করতে সাহায্য করবে এবং লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। কাজের কোয়ানটিটির চেয়ে কোয়ালিটি নিয়ে ভাবুন এবং এর রেজাল্ট আপনি দ্রুত পাবেন। তাই বিজনেস ওনার হিসেবে যে কাজটিকে কম গুরুত্বের মনে হচ্ছে সেটা করা বাদ দিয়ে দিন।
৭) বাউন্ডারি সেট করুন
ব্যবসায়িক ও পারিবারিক জীবন ব্যালান্স করার আরও একটি উপায় হচ্ছে বাউন্ডারি সেট করে নেয়া। আর এজন্য জীবনে ‘না’ বলতে পারাটা খুব জরুরি। অথচ এটা আমাদের অনেকের কাছেই খুব কঠিন একটি বিষয়। সব সময় সব কাজে হ্যাঁ বলতে থাকা দুই লাইফেই ঝামেলার সৃষ্টি করে। কোনো বাড়তি কাজ করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন যে সেটি আপনি করতে পারবেন কিনা। যদি কাজগুলো আপনার সময়ের বাইরে যেয়ে করতে হয় বা নিজের ইচ্ছার বাইরে হয়ে যায় তাহলে কাজের ঝামেলায় এতটাই বাউন্ড হয়ে যাবেন যে পরিবারকে সময়ই দিতে পারবেন না। আর এটা দিনশেষে মানসিক যন্ত্রণাই বাড়াবে।
বাউন্ডারি সেট করে দেয়া মানে হচ্ছে এক্সপেকটেশন ও কনফ্লিক্টের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় সেটা কমিয়ে আনে। সেটা অফিস হোক বা বাসা। আপনার যারা বিজনেস পার্টনার আছে তাদেরকে জানিয়ে রাখুন যে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আপনি কোনো ফোন কল রিসিভ করবেন না। আবার পরিবারকেও জানিয়ে রাখুন যদি কোনো কাজ থাকে, তখন যেন তারা আপনাকে ইমার্জেন্সি ছাড়া না ডাকে। এইসব কমিউনিকেশনগুলো ক্লিয়ার করে নিলে দুই পক্ষকেই খুশি রাখা সম্ভব।
আর্টিকেলে আমি কয়েকটি পয়েন্ট বললাম যেগুলো মেনে চললে ব্যবসায়িক ও পারিবারিক জীবন ব্যালেন্স করা সম্ভব। কিন্তু এটাও সত্যি, বর্তমানের এই অস্থির ও প্রতিযোগিতার যুগে হেলদি ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স করা খুবই কঠিন। আমরা যদি নিজেরা সচেতন না হই, তাহলে আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন নষ্ট করে ফেলবো, ব্যক্তিগত সম্পর্ক এড়িয়ে চলব, আনন্দদায়ক মুহূর্ত তৈরি করতে পারবো না, বুঝতেই পারবো না জীবন কতটা সুন্দর। আবার এটাও ঠিক যে বাসা ও অফিস দুটোই একসাথে ব্যালেন্স করা সম্ভব, আপনি এটা যতটা কঠিন ভাবছেন ততটা কঠিন নয়। এটা শুধু কিছু পরিকল্পনা ও প্র্যাক্টিসের বিষয়। প্রতিদিনের জীবনে কিছু ছোট ছোট পরিবর্তন এনে, রেগুলার রুটিনে কিছু টিপস অ্যাড করে, নিজের ও পরিবারের ছোট ছোট খুশির দিকে খেয়াল রেখে এই কাজগুলো আমরা করতে পারি। যদি আপনি নিজেকে সুখী দেখতে চান তাহলে কর্মজীবনে কতটুকু কাজ করলে পারিবারিক জীবনে ক্ষতি হবে না সেটাও আগে বুঝে নিতে হবে।