ইন্টারভিউ দিতে গেলে কমবেশি আমাদের সবাইকে একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। সেটা হচ্ছে ‘আপনাকে কেন নিয়োগ দিব?’ প্রশ্নটি শুনে বেশ সিম্পল মনে হতে পারে। কিন্তু এটা আসলে বেশ ট্রিকি একটি প্রশ্ন এবং আপনি যদি নিজেকে এটির উত্তরের জন্য প্রস্তুত না করে থাকেন তাহলে ভয়ও পেয়ে যেতে পারেন। অপরপাশে যে ব্যক্তি বসে আছেন, তাকে ইমপ্রেস করার জন্য এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর আপনাকে বেশ গুছিয়েই দিতে হবে। যিনি আপনার ইন্টারভিউ নিবেন তিনি আপনাকে এই প্রশ্নটি কয়েকভাবে করতে পারেন। যেমন-
- আপনাকে কেন নিয়োগ দিব?
- এই জবের জন্য কেন আপনার নিজেকে ফিট মনে হচ্ছে? আপনার এক্সপেরিয়েন্স ও ব্যাকগ্রাউন্ড যে এই জবের জন্য পারফেক্ট হবে কেন আপনি সেটা মনে করছেন?
- এই চাকরির জন্য আপনিই কেন বেস্ট?
- এই পজিশনের জন্য আপনি আগ্রহী কেন?
প্রশ্নগুলো শুনে ভড়কে যান অনেকেই। কেন এমন প্রশ্ন আপনাকে করা হয়, কীভাবে এর উত্তর গুছিয়ে দিবেন এসব নিয়েই আজ বিস্তারিত আলোচনা করবো আপনাদের সাথে।
‘আপনাকে কেন নিয়োগ দিব?’ – নিয়োগকারী এটা কেন জিজ্ঞেস করে?
এই প্রশ্নটি আপনাকে করা হয় কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী আপনার যোগ্যতা ও দক্ষতা আছে কিনা সেটা বোঝার জন্য। এর মাধ্যমে চাকরিদাতারা বুঝতে পারেন একজন প্রার্থী জব রিকয়ারমেন্ট কত ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে এবং প্রতিষ্ঠানের সফলতার জন্য সে কীভাবে অবদান রাখতে পারবে।
এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময়, অবশ্যই আপনি আপনার যোগ্যতা, স্কিল, বাড়তি কোনো যোগ্যতা, কোনো বিষয়ে স্ট্রেন্থ ভালো থাকলে সব তথ্য জানাতে হবে। তিন থেকে চারটি নির্দিষ্ট কারণ তাদের জানান কেন আপনি এই জবের জন্য নিজেকে কোয়ালিফাই মনে করছেন এবং কিছু দক্ষতার কথা জানান যেগুলো অন্য প্রার্থীদের থেকে আপনাকে আলাদা করবে। সেই সাথে এই পজিশনের জন্য আরও এক্সেপশনাল কোনো কোয়ালিটি আর স্ট্রেন্থ যদি থাকে তাহলে সেটাও জানাবেন।
কীভাবে উত্তর দিবেন?
‘আপনাকে কেন নিয়োগ দিব?’ এই প্রশ্নের উত্তর দেয়টা আসলে সহজ নয়। কারণ আপনি কেন এই পজিশনের জন্য বেস্ট সেটা অল্প কথায় বোঝানো বেশ কঠিনই বোটে। এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার আগে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবেন চলুন জেনে নেয়া যাকঃ
জব রিকয়ারমেন্ট ভালো করে বুঝুন- জব ডেসক্রিপশন ভালো করে বুঝতে হবে। সেই সাথে একজন প্রার্থীর মাঝে কী কী স্কিল, কোয়ালিফিকেশন ও কোয়ালিটি ইমপ্লয়ার খুঁজছে সেটাও খুঁজে বের করতে হবে।
স্ট্রেন্থ চিহ্নিত করুন- আপনার কাজের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও অর্জনের উপর নির্ভর করে জব রিকয়ারমেন্ট অনুযায়ী আপনার স্ট্রেন্থ কতটুকু। তাই হার্ড স্কিল (টেকনিক্যাল এক্সপার্টাইজ) এবং সফট স্কিল (কমিউনিকেশন, লিডারশীপ, প্রব্লেম-সলভিং) এমন বিভিন্ন কোয়ালিফিকেশন জেনে রাখুন।
জবের সাথে কোয়ালিফিকেশন কানেক্ট করুন- আপনার যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কীভাবে আপনাকে এই পজিশনের জন্য করে তুলেছে সেটা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করুন। আপনার অ্যাবিলিটি ও অ্যাকোমপ্লিশমেন্ট সম্পর্কে সম্ভব হলে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলুন।
আপনার ইউনিক সেলিং পয়েন্ট হাইলাইট করুন- কেন আপনি অন্যদের চেয়ে আলাদা সেই বিষয়গুলোতে জোর দিন। এটা হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি স্কিলের কম্বিনেশন, কোনো সার্টিফিকেট, ইন্ড্রাস্টি নিয়ে কোনো তথ্য অথবা কোনো বিষয়ে সফলতা।
উৎসাহ দেখান- প্রতিষ্ঠান ও তার কাজের প্রতি যে আপনার আগ্রহ আছে সেটা বোঝান। প্রতিষ্ঠানের সফলতার জন্য আপনি কী কী করতে পারেন, ইচ্ছাশক্তি কতটুকু এবং কতটা প্যাশনের সাথে আপনি কাজ করতে পারেন এসব কিছু ভালোভাবে ব্যাখ্যা করুন।
অল্প কথায় বুঝিয়ে বলুন- যতটুকু প্রশ্ন করা হয় ততটুকুই অল্প কথায় জবাব দিন। জড়তা নিয়ে কথা বলা বা অযৌক্তিক বর্ণনা দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কেন চাকরিদাতা আপনাকে নিয়োগ দিবে শুধু সে প্রশ্নের উত্তরেই যুক্ত থাকুন।
প্র্যাকটিস করুন এবং প্রস্তুত থাকুন- যে উত্তরটি আপনি বলবেন সেটি যেন কনফিডেন্তের সাথে দিতে পারেন সেজন্য বারবার প্র্যাকটিস করুন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে কথা বলতে পারেন, কথা রেকর্ড করে শুনতে পারেন অথবা কোনো বন্ধুর সাথে প্র্যাকটিস করে ফিডব্যাক চাইতে পারেন। এই কাজগুলো করলে আপনার মনোবল বাড়বে।
যেভাবে স্টেপ বাই স্টেপ উত্তর দিবেন
পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিলে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া আপনার কাছে মোটেই কঠিন লাগবে না। চলুন জেনে নেই কীভাবে স্টেপ বাই স্টেপ উত্তর দিবেন।
১) আপনি যে রিসার্চ করেছেন সেটা তাদেরকে বোঝান
চাকরিদাতা কেমন প্রার্থী খুঁজছেন সেটা সাধারণত জব পোস্টেই লিখে দেয়া থাকে। কাজেই সেটি আগে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন। তারা যে দক্ষতা খুঁজছে সেগুলো ভালোভাবে বুঝুন, তাদের বিভিন্ন রিকয়ারমেন্ট, এডুকেশন ও এক্সপেরিয়েন্স সেকশন দেখুন। এতে আপনি বুঝতে পারবেন এই পজিশনের জন্য কোন কোন কোয়ালিফিকেশন আপনার দরকার। এতে কিন্তু জব ডেসক্রিপশন শেষ হয়ে যায় না। এরপর কিছুটা সময় কোম্পানি নিয়ে জানুন। তাদের মিশন, প্রজেক্ট ও গোল সম্পর্কে জানলে আপনি বুঝতে পারবেন তারা কেমন প্রার্থী চাচ্ছেন। এই তথ্যগুলো আপনাকে আপনার উত্তর খুঁজে পেতেও সাহায্য করবে।
২) এই পজিশনের জন্য আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড ও এক্সপেরিয়েন্সের গুরুত্ব বোঝান
যখন উত্তর দিতে যাবেন, তখন আপনার অভিজ্ঞতা ও বর্তমান কোম্পানির পজিশনের সাথে একটি কানেকশন তৈরি করুন। সহজ ভাষায়, এই জবের জন্য আপনার কোয়ালিফিকেশনের কারণে কেন আপনি যোগ্য প্রার্থী সেটা বুঝিয়ে বলুন। আপনার ক্যারিয়ারে যদি এমন কোনো কাজ থেকে থাকে যেটা এই পোস্টের সাথে রিলেট করে তাহলে অবশ্যই সেটা সম্পর্কে জানান।
৩) কাজ সম্পর্কে যে উৎসাহী সেটা বোঝান
আপনাকে যখন ইন্টারভিউতে ডাকা হইয়েছে তার মানে চাকরিদাতা বুঝতে পেরেছেন আপনার মধ্যে সেই যোগ্যতা আছে। তাই, আপনার নিজের ভ্যালু সম্পর্কে হাইলাইট করার সাথে সাথে কাজের প্রতি যে আপনি প্যাশনেট এবং কাজ করতে উৎসাহী সেটা বুঝিয়ে বলতে ভুলবেন না। সত্যি বলতে, সব চাকরিদাতাই চান তাদের কর্মীরা কাজের প্রতি আগ্রহী হবে, কাজ করতে মজা পাবে এবং কাজের প্রতি পজিটিভ থাকবে। তবে এজন্য অনেক কথা বলার দরকার নেই। মুখে হাসি এবং অল্প কিছু কথাতেই এটি সম্পর্কে আপনি বুঝিয়ে বলতে পারবেন।
যে ভুলগুলো করা যাবে না
‘আপনাকে কেন নিয়োগ দিব?’ ইন্টারভিউতে যখন এর উত্তর খুঁজছেন, তখন মনে রাখবেন কিছু ভুল আপনার করা যাবে না। যেমন-
অপ্রয়োজনীয় কথা বলা- অনেকেই ইন্টারভিউ দেয়ার সময় এমন অনেক তথ্য দিয়ে বসেন যার কারণে মনে হয় সামনে যিনি বসে আছেন তিনি হয়ত খুব কাছের কেউ। এই ভুল একদমই করা যাবে না। এতে তিনি ভাবতে পারেন আপনি কাজ করতে বেশি আগ্রহী হন এবং কোম্পানির জন্য ফিট নন। এর বদলে নিজের কোয়ালিফিকেশন, স্কিল ও এক্সপেরিয়েন্সের উপর জোর দিন।
কনফিডেন্স কম থাকা- আত্মবিশ্বাসের সাথে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। যদি আপনার নিজের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থাকে বা কথা বলার সময় সেটা বোঝা যায় তাহলে চাকরিদাতা আপনাকে সুযোগ দিতে চাইবেন না। তাই নিজের বিশ্বাস ও দক্ষতার উপর অবশ্যই বিশ্বাস রাখুন।
জব সম্পর্কে কোনো তথ্য না দিতে পারা- যে কোম্পানি নিয়ে আপনি ইন্টারভিউ দিতে চাচ্ছেন সেটা সম্পর্কে এবং যে কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করেছেন সেটা নিয়ে বিস্তারিত না জানা বেশ বড় একটি ভুল। সময় নিয়ে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে রিসার্চ করুন, তাদের মূল্যবোধ ও লক্ষ্য সম্পর্কে জানুন, তারা প্রার্থীর মাঝে কী চাচ্ছে সেটার উত্তর খুঁজুন।
কোম্পানির চাহিদার কথা ভুলে যাওয়া- মনে রাখবেন, প্রশ্ন কিন্তু শুধু আপনাকে নিয়েই নয়, আপনাকে দিয়ে কীভাবে কোম্পানির চাহিদা পূরণ করা যাবে এটাও এর সাথে জড়িত। তাই শুধু নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুরণের কথা ভুলে যান। এর বদলে আপনার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কীভাবে কোম্পানির সফলতায় যুক্ত হতে পারে এবং নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে পারেন সেদিকে জোর দিন।
এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলতে পারলে ‘আপনাকে কেন নিয়োগ দিব?’ এর উত্তর আপনার কাছে অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। সেই সাথে আপনার নিজের প্রতি কনফিডেন্স বাড়বে। তাহলে এবার নতুন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার সময় আর ভয় পাবেন না তো?