একটা সময়ে ডাকযোগের বেশ প্রচলন ছিলো। মানুষ এক শহর বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে এইসকল পদ্ধতি অবলম্বন করে আর্থিক লেনদেন বা যেকোনো ধরনের লেনদেনই করতো। বর্তমানে ইন্টারনেট, প্রযুক্তি, ডিজিটালাইজেশন সবকিছু সহজ হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক লেনদেনটাকেও এতটাই সহজ করে দিয়েছে যে, আমরা চাইলে এখন বাসায় বসেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে লেনদেন করতে পারি খুব সহজেই। ঠিক এমনই একটি অর্থ লেনদেনকারী সহায়ক প্রতিষ্ঠান হলো- পে প্যাল। আমেরিকান এই কোম্পানি বর্তমানে পুরো বিশ্বব্যাপী আর্থিক লেনদেনে শীর্ষে অবস্থানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। আমাদের ডিজিটাল লেনদেনে কতটা সুবিধার দ্বার খুলে দিয়েছে এই পে প্যাল, তা নিয়েই আমরা আজকে জানবো।
ধরা যাক, হাসপাতালে রোগী ভর্তি করানোর আগে রোগীর নাম, ঠিকানা, বয়স ইত্যাদি তথ্য দিতে হয়। জরুরি মুহূর্তে এসব তথ্য দেওয়ার ঝামেলা কারোরই পোহাতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু রোগীর যদি আগেই রেজিস্ট্রেশন করা থাকত, তাহলে খুব সহজে হাসপাতাল নম্বর বা পেশেন্ট আইডি দিলে সব তথ্য চলে আসত, বারবার সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে এই পদ্ধতি ইতিমধ্যে চলমান। কিন্তু এর চেয়েও ভালো হতো একটি হাসপাতাল আইডি দিয়ে যদি দেশের সব কয়েকটি হাসপাতালে দ্রুততার সঙ্গে ভর্তি করিয়ে নেওয়া যেত।
এখন এ প্রক্রিয়া অনলাইনে অর্থ লেনদেন করার ক্ষেত্রে, কেনাকাটা করতে গেলে অথবা কাউকে টাকা পাঠাতে গেলে বারবার অ্যাকাউন্টের নাম, নম্বর, রাউটিং নম্বর, ক্রেডিট কার্ড হলে কার্ড নম্বর, কার্ডের মেয়াদ ইত্যাদি তথ্য প্রদান শুধু ঝামেলাদায়কই নয়, গুরুত্বপূর্ণ এই আর্থিক ডেটা যেখানে সেখানে সরবরাহ করা অনিরাপদও বটে। ঠিক এ জায়গায় এসেই আর্থিক খাতে বিশ্বব্যাপী নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছে পে প্যালের মতো সেবাগুলো।
পে প্যাল কী?
পে প্যাল (PayPal) হলো, পুরো বিশ্বে অর্থ লেনদেনকারী একটি অনলাইন মাধ্যম, যার মাধ্যমে যে কেউ অর্থ আদানপ্রদান করতে পারে, কেনাবেচা করার সময় পেমেন্ট করতে পারে ঘরে বসেই। মূলত নিজের ব্যাংক একাউন্ট এর সাথে পে প্যাল লিংক করিয়ে নেয়া যায়। তাহলে লেনদেনকৃত অর্থ ওই একাউন্টে এসে জমা হয়। আবার যে কেউ এখানে তার নিজস্ব অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করে সেখানেও অর্থ রাখতে পারেন সরাসরি।
যাত্রা শুরু যেভাবে
তিনজন উদ্যোক্তা- ম্যাক্স লেভচিন, পিটার থিয়েল এবং লুক নোসেক এর হাত ধরেই ‘ফিল্ডলিংক’ নামে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যদিও পরে নাম পরিবর্তন করে কনফিনিটি। এমন একটি কোম্পানি যা হাতে-হোল্ড ডিভাইস অর্থাৎ মুঠোফোনের মতো ডিভাইসের জন্য সিকিউরিটি সফটওয়্যার তৈরি করেছিল। সিকিউরিটি সফটওয়্যার তৈরির কাজের সঙ্গে লেনদেন বা ডিজিটাল ওয়ালেট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও, ধীরে ধীরে এটি একটি ডিজিটাল ওয়ালেটে তার ফোকাস পরিবর্তন করেছে। পে প্যাল ইলেকট্রনিক পেমেন্ট বা ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের প্রথমভাগ এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে।
এরপর ২০০০ সালের মার্চ মাসে, কনফিনিটি অন্য একটি কোম্পানি x.com – এর সাথে একসাথে হয়ে একটি অনলাইন আর্থিক সেবা সংস্থা চালু করে, যা ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে এলন মাস্ক, হ্যারিস ফ্রিকার, ক্রিস্টোফার পেইন এবং এড হো দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অর্থ স্থানান্তর ব্যবসার সীমাবদ্ধতা থাকা স্বত্তেও তারা ভবিষ্যত সাফল্য সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন। মাস্ক ও বিল হ্যারিস, X.com-এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও সিইও, অর্থ স্থানান্তর ব্যবসার সম্ভাব্য ভবিষ্যত সাফল্য নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন এবং হ্যারিস ২০০০ সালের মে মাসে কোম্পানি ছেড়ে চলে যান। সেই বছরের অক্টোবরে, মাস্ক সিদ্ধান্ত নেন X.com তার অন্যান্য ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং কার্যক্রম বন্ধ করে দিবে এবং অর্থপ্রদানের উপর মনোযোগ দেবে। একই মাসে, ইলন মাস্ক X.com-এর সিইও হিসেবে পিটার থিয়েলের স্থলাভিষিক্ত অর্থাৎ দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, যা ২০০১ সালের জুন মাসে সালে পে প্যাল নামকরণ করা হয় এবং ২০০২ সালে সর্বজনীন বা সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। পে প্যালের আইপিও পিওয়াইপিএল টিকারের অধীনে শেয়ার প্রতি $১৩ এ তালিকাভুক্ত এবং $৬১ মিলিয়নেরও বেশি তৈরি করেছে।
যেভাবে কাজ করে
পে প্যাল ব্যবহারে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আপনি লেনদেন করতে পারেন ন্যুনতম কোনো ফি ছাড়াই। তবে এর জন্য দুই পাশের ব্যবহারকারীরই অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। আপনি মোবাইল, ওয়েব ব্রাউজার, ট্যাব যেকোনো কিছু দিয়েই পে প্যাল ব্যবহার করতে পারবেন। পেপ্যালে দুই ধরনের লেনদেন প্রক্রিয়া রয়েছে।
- ব্যক্তিগত
- ব্যবসায়িক
আপনি আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী এই দুই ধরনের অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করতে পারবেন।
পে প্যাল ক্রেডিট সিস্টেম
পে প্যাল ক্রেডিট হলো ভার্চুয়াল ক্রেডিট লাইন, অর্থাৎ ব্যাংকিং সেবায় যেরকম হাতে হাতে বা ফিজিক্যাল ক্রেডিট কার্ড় ব্যবহার করা যায়, তেমনি পে প্যাল ইউজাররা ভার্চুয়াল ক্রেডিট কার্ড এর মাধ্যমে লেনদেন করতে পারেন। তবে এটি শুধুমাত্র পেপ্যাল ব্যবহার করা যায় এমন অনলাইন ওয়েবসাইটগুলোতেই অর্থ প্রদান করতে ব্যবহার করা যাবে।
পেপ্যাল পে ইন ফর ম্যাথড
ধরুন এটি পেপ্যাল না, বিকাশের মতো অন্য কোনো মোবাইল ব্যাংকিং। বিকাশের মাধ্যমে কোনো বিপনি বিতান থেকে বা শপিং সেন্টার থেকে কিছু কিনলেন। আপনি কীভাবে পেমেন্ট করবেন? নিশ্চয়ই একবারে পুরো টাকাটা পাঠিয়ে দিবেন। এখানেই পেপ্যাল ডায়নামিক তৈরি করেছে, পেপ্যালের মাধ্যমে আপনি আপনার পেমেন্টটা নির্দিষ্ট একটি সময়ের ভিতর চার ধাপে শেষ করতে পারবেন। অর্থাৎ ধরেন এক মাসের মধ্যে আপনি যে ১০০ টাকার কেনাকাটা করেছেন এই ১০০ টাকাকে চারভাবে ভাগ করে পে করতে পারবেন। এই পেমেন্ট এমাউন্ট হতে হবে $৩০ এবং $১৫০০ এর মধ্যে।
বাংলাদেশে পেপ্যাল আনার প্রতিবন্ধকতা
বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশে পেপ্যালের সার্ভিস চালু আছে এবং লেনদেন হয় ২৫টির বেশি মুদ্রায়। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সচল পেপ্যাল অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৩ কোটি। প্রতিদিন পেপ্যালের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় ৪ কোটির বেশিসংখ্যক লেনদেন। অনলাইন লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ বাজারের ৪৩ দশমিক ৮৫ ভাগ রয়েছে পেপ্যালের দখলে। বিশ্বের ১ কোটি ৬৮ লাখের বেশি ওয়েবসাইট পেপ্যালের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করে। ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৭১ ভাগ ই-কমার্স সাইট পেপ্যালের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের সুযোগ রেখেছে।
বাংলাদেশে এখন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন দেশের অর্থনীতিতে। এই ফ্রিল্যান্সাররা বহুদিন ধরে আকুতি জানিয়ে আসছেন লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে পেপ্যাল যেন চালু হয়। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার আশ্বস্ত করা হলেও দুই শতাধিক দেশে চলমান এই সেবা হতাশাজনকভাবে এখনো চালু হয়নি বাংলাদেশে। দেশের বহুল প্রচারিত ‘ঘরে বসে আয়’ নামক স্লোগান আমরা প্রচার করা শুরু করে দিলেও অন্যতম স্বীকৃত মাধ্যমে সেই আয় আনার ব্যবস্থা আমরা করতে পারছি না। দায়িত্বশীল কোনো জায়গা থেকে চালু না হওয়ার কারণও স্পষ্ট করা হয়নি।
এ কথা ঠিক যে পেপ্যালের এ দেশে আসা শুধু আমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না। পেপ্যালের ব্যবসায়িক কৌশল, বাজারের আকার, তাদের লাভ-ক্ষতির হিসাব, ঝুঁকির আশঙ্কা ইত্যাদির ওপরও নির্ভর করে। সঙ্গে সঙ্গে নির্ভর করে আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মুদ্রানীতির ওপরও। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইসিটি ডিভিশন, বিভিন্ন অংশীজনসহ সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় কি না, সেই প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে। নীতিগত কোনো বাধা থাকলে বিশ্বের সিংহভাগ দেশে যে পদ্ধতিতে এটি পরিচালিত হয়, আমরা কেন সেভাবে সমন্বয় করতে পারব না? উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে উপাত্ত বা অবকাঠামো দেশের সীমানায় রাখার বাধ্যবাধকতা দেওয়ায় তুরস্কে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল পেপ্যাল (সূত্র: টেকক্রাঞ্চ)।
আমাদের মুঠোফোন গ্রাহক, ইন্টারনেট গ্রাহক, ই–কমার্সের প্রসার ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ পেপ্যালের জন্য যে বড় ধরনের এক বাজার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পেপ্যাল ছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই—ব্যাপারটি তা নয়, সব ক্ষেত্রে পেপ্যালই যে সেরা সমাধান, সেটিও নয়। কিন্তু যে সেবা বিশ্বের এতগুলো দেশে বিদ্যমান, তুলনামূলকভাবে যে সেবা সহজ, দ্রুত ও নিরাপদ, যে সেবা বিশ্বজুড়ে গ্রাহকদের কাছে গ্রহণযোগ্য, সেটি স্মার্ট বাংলাদেশ বা ক্যাশলেস সোসাইটির পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকা একটি দেশে থাকবে না, সেটি কেমন যেন বেমানান, কেমন যেন অগ্রহণযোগ্য।
শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বহু পদক্ষেপ ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি। একবার তো ‘জুম’ দিয়ে পেপ্যালের কাজ চালানোর আওয়াজও উঠল। পেপ্যাল যেখানে অনলাইন পেমেন্ট পরিষেবা, বলা চলে জুম সেখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তরের পরিষেবা মাত্র। দুধের স্বাদ ঘোল দিয়ে যেমন মেটানো যাবে না, পেপ্যালের কাজও তেমনি জুম দিয়ে করা যাবে না। আমাদের প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে বাইরের একজন ক্রেতাকে পেপ্যাল বাদ দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বলা, ই–মেইল বাদ দিয়ে ডাকযোগে চিঠি পাঠাতে বলার মতোই অস্বস্তিকর।
সঠিকভাবে পুরো পৃথিবীতে যদি পে প্যাল নিশ্চিত করা যায়, এটি হতে পারে সবকিছুর সহজ সমাধান বা সহায়ক প্রতিষ্ঠান। মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাপন হয়ে উঠতে পারে আরো গোছানো এবং সাবলীল। তাই ইন্টারনেটের এ যুগে এসে পেপ্যালকে সাধুবাদ জানিয়ে গ্রহণ করাই নিজেদের জন্য কল্যাণকর ভূমিকা রাখবে।