প্রযুক্তির এই যুগে এসে সরাসরি কোনো পণ্য কেনাকাটার চেয়ে অনলাইনে ঘরে বসে কেনাকাটা করা ইদানীং বেশি স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে। পৃথিবী জুড়ে বেশ কয়েকটি এমন বিখ্যাত ই-কমার্স রয়েছে যেখানে কি না একটি শপিং মলের মতো সবই পাওয়া যায়। শপিফাই নামক কানাডিয়ান এই প্রতিষ্ঠানটি ঠিক এমনটি একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। কীভাবে এত মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে সফলতার পথে প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে গেলো সে গল্পই জানাবো আজ।
শপিফাই কী?
Shopify মূলত একটি Canadian Ecommerce Company যারা বিভিন্ন অনলাইন স্টোরগুলোর জন্য ওয়েব সফটওয়্যার ডেভেলপ করে। তাদের তৈরি শপিফাই সফটওয়্যারটি মূলত একটি অনলাইন ভিত্তিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, যা দ্বারা অনলাইনে প্রায় যেকোনো ধরনের পণ্য খুব সহজেই বিক্রয় করা সম্ভব। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন বা ছোট আকারে নিজের পণ্য বা সেবা সেল করেন তাদের কেনাবেচার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হলো এটি।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, শপিফাই প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আপনাকে অবাক করে দেবে। আজকে যারা বা যতগুলো কোম্পানি শপিফাই ব্যবহার করছেন, তারা কেউ কেউ হয়তো জানেনই না শুরুর দিকে এটি একটি স্নোবোর্ডিং কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে। স্নোবোর্ডিং হচ্ছে একটি বিনোদনমূলক খেলা বা কার্যকলাপ, যাতে একটি কাঠ বা বোর্ড নির্মিত মসৃণ তক্তা বা স্নোবোর্ড চালকের পায়ে যুক্ত করে তা দ্বারা বরফ বা তুষারের ঢালের উপর পিছলিয়ে চলা হয়। কীভাবে একটি কোম্পানি এমন একটি অ্যাক্টিভিটি ছেড়ে ই-কমার্সের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাই জানার বিষয়।
প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের বয়স এখন প্রায় ১৭ বছর হলেও এর শুরুর ইতিহাস ছিলো আরো পেছনের। ২০০৪ সালে তিন বন্ধু টোবিয়াস লুটকে, ড্যানিয়েল ওয়েইনান্ড এবং স্কট লেক স্নোডেভিল নামে একটি স্টোর খোলার মাধ্যমে স্নোবোর্ডিং সরঞ্জাম বিক্রি শুরু করার জন্য ইন্টারনেটেও তাদের স্টোরের প্রকাশ ঘটান। অনলাইন স্টোরের জন্য বিদ্যমান ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলি তখন ততটা সন্তোষজনক ছিল না, তাই বন্ধু লুটকে, যেহেতু একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার ছিলেন, তিনি নিজেই একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার জন্য এই দায়িত্ব নিজের উপর নিয়েছিলেন। প্লাটফর্মটি বানিয়ে শুরু করার দুই মাস পরে, স্নোডেভিল চালু হয়েছিল যেটি কি না স্নোবোর্ডিং ইভেন্ট হোস্ট করতো এবং সে সংক্রান্ত জিনিসপত্রও বিক্রি করতো। দুই বছর পরে ২০০৬ সালে, স্নোডেভিল হোস্টিং প্ল্যাটফর্মটি Shopify হিসাবে চালু করা হয়েছিল। অবশেষে তারা যেমন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম চেয়েছিলেন যেখানে সব ধরনের পণ্যই আসলে থাকবে- সেভাবে পরিচালনা করা শুরু করে। এটি একটি কানাডিয়ান কোম্পানি। সিজনের সময় বরফ ঢাকা দেশ হওয়ায় তাদের কাজ খুব সহজেই প্রসারতা পায় এবং পরবর্তীতে সেটি প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্নের ই-কমার্স রূপেই আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
শপিফাই এর বর্তমান মালিক
তিন বন্ধু মিলে যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন, এর মধ্যে টোবিয়াস লুটকে, বর্তমানে কোম্পানিটির CEO হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি দেখাশুনা করছেন। তবে এপ্রিল ২০১৫তে, কোম্পানিটি একটি সার্বজনীন লেনদেনে অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ এখানে অনেক শেয়ারহোল্ডারস যোগ হয়। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ এবং টরন্টো স্টক এক্সচেঞ্জ উভয়েই প্রাথমিকভাবে পাবলিক অফারের জন্য এখানে আবেদন করেছিল। তার মানে কোম্পানিটি এখন পুরোপুরিভাবে শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানাধীন এবং পরিচালনা করার জন্য নির্ধারিত কাউন্সিল দ্বারা পরিচালিত হয়। বাকি দুই বন্ধু তাদের শেয়ার ছেড়ে দিয়ে শপিফাই থেকে বিরতি নেন।
কাজের প্রসারতা যেভাবে বৃদ্ধি পায়
শুধুমাত্র স্নোবার্ড সরঞ্জাম বিক্রির বাইরে যেয়ে ই-কমার্সে Shopify-এর সম্পৃক্ততা এটিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে বা প্রসারতা পেতে সাহায্য করেছে। ২০০৯ সালে, তারা তাদের অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (API) তৈরি করেছিল, যা শপিফাই-এর জন্য নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশনগুলিকে তাদের অ্যাপ স্টোরে বিক্রি করার অনুমতি দেয়। ২০১০ সালে, এটি মোবাইলে Shopify এনে অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে একটি Shopify অ্যাপ যোগ করে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে, ব্যবসার মালিকরা তাদের প্রিয় ডিভাইসগুলিতে তাদের Shopify স্টোরগুলি দেখতে, যুক্ত এবং পরিচালনা করতে পেরেছিল।
POS সম্পৃক্ততার মাধ্যমে ‘Shopify’ এর সাফল্যের গল্প
Shopify এর সবচেয়ে বড় প্রভাবকগুলির মধ্যে একটি হলো ই-কমার্সের জন্য পয়েন্ট অফ সেল (POS) বিষয়টি নতুনভাবে তৈরি করা বা সংজ্ঞায়িত করে ধারণা দেয়া। ২০১৩ সালে, কোম্পানিটির পরিচালকেরা Shopify এর অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। এই নতুন সংযোজন তৃতীয় পক্ষের পেমেন্ট গেটওয়ের প্রয়োজনীয়তাকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে দিয়েছে, যাতে করে ব্যবসায়ীরা তাদের বাইপাস করতে পারে। ২০১৭ সালে, একটি পয়েন্ট অফ সেল সিস্টেমের সাথে iPads তৈরি করে যা সরাসরি ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের অর্থপ্রদান গ্রহণ করে। এই আইপ্যাড পিওএস এখনও প্রতিদিন ফিজিক্যাল শপ বা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে যারা বড় আকারের পিওএস সিস্টেম ছাড়াই ছোট কাজে লাগান তারা।
একইভাবে, ই-কমার্স স্পেসে Shopify-এর উপস্থিতি একটি ব্যবসা চালানোর ক্ষমতাকে অনেকের হাতে তুলে দেয়, কীভাবে? শেয়ালহোল্ডিং সিস্টেমের মাধ্যমে। পুরাতন মার্চেন্ট বা বণিক প্রথা প্রক্রিয়াগুলোকে আধুনিকভাবে নতুন আঙ্গিকে নিয়ে আসে। ২০১৫ সালে যখন Amazon-এর ওয়েবস্টোর, যা মার্চেন্ট সার্ভিস সিস্টেম হোস্ট করে, পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন তারা Shopify-কে তাদের ‘পছন্দের মাইগ্রেশন প্রদানকারী’ হিসেবে গ্রহণে আগ্রহ দেখিয়েছিল, যার ফলে Shopify-এর শেয়ারগুলি এক লাফেই বেড়ে যায়। অতি সম্প্রতি, শপিফাই ২০১৭ সালে সরাসরি অ্যামাজন ইন্টিগ্রেশন ক্ষমতা ঘোষণা করেছে।
ব্যবসায়ীক প্রসারের উদ্দেশ্যে যেসব কোম্পানিগুলো শপিফাই ব্যবহার করেন
‘শপিফাই’ এর সর্বশেষ প্রেস রিলিজ অনুযায়ী, Shopify-এ ১.৭ মিলিয়নেরও বেশি কোম্পানি রয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, Shopify প্রমাণ করেছে যে, কীভাবে সত্যিকার অর্থে চাইলেই বা কাজ করলেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা একটি প্ল্যাটফর্মে নিজেদের পরিণত করা যায়, বর্তমানে তারা প্রায় বিশ্বের ১৭৫টি দেশে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
শপিফাই এর সুবিধা
শপিফাই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনেকগুলো সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। জেনে নেওয়া যাক শপিফাই এর সুবিধাগুলো সম্পর্কে। যেমন-
- উন্নতমানের কাস্টমার সাপোর্ট পাওয়া সম্ভব
- সহজেই সাইট পরিচালনা করা যায়
- বিশ্বাসযোগ্য হোস্টিং সার্ভিস ব্যবহার করা সহজ
- শপিফাই এর অ্যাপ স্টোর ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করা যায়
২০২৩ এর রিপোর্ট অনুসারে, শপিফাই এর স্টোর সংখ্যা
কিছু বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন যে, এটি ২ মিলিয়ন স্টোর সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারে কারণ মহামারী চলাকালীন সময়ে ই-কমার্সের প্রতি আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। এই মুহূর্তে, শপিফাইতে ১.৭ মিলিয়নেরও বেশি ব্যবসা হোস্ট করা হয়েছে এবং এটি স্পষ্ট যে কোম্পানিটি বিশ্বব্যাপী একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলেছে।
যে যে স্টোর তৈরি করা যাবে
Shopify এখন সকল প্রকার ব্যবসার জন্য তৈরি করা জনপ্রিয় এবং শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম। আপনি আপনার পণ্য বিক্রি থেকে শুরু করে, ক্লায়েন্টের পণ্য বিক্রি, ড্রপশিপিং, অ্যাফিলিয়েট পণ্য খুব সহজে বিক্রি করতে পারেন এবং পণ্যের প্রসার ঘটাতে পারেন।
Shopify দিয়ে যে ধরনের পণ্য বিক্রয় করা যাবে
প্রায় যেকোনো ধরনের ফিজিক্যাল এবং গ্রাফিক্যাল প্রোডাক্ট বিক্রয় করা সম্ভব shopify এর মাধ্যমে। ফিজিক্যাল প্রোডাক্ট যেমন- ক্লথিং, ইলেকট্রিক্যাল প্রোডাক্ট, বই, আসবাবপত্র ইত্যাদি পণ্য প্রমোট করে বিক্রয় করা সম্ভব। আর গ্রাফিক্যাল প্রোডাক্ট যেমন- ই-বুক, ওয়েব টেম্পলেট, অ্যানিমেশন, ভিডিও ইত্যাদি পণ্য বিক্রয় করা সম্ভব। পৃথিবীতে যত ধরনের ই-কমার্স প্রোডাক্ট প্রচলিত রয়েছে তার সবই শপিফাইতে প্রমোট ও বিক্রয় করা সম্ভব। এমনকি চাইলে আপনি নিজেও নতুন কোনো ই-কমার্স প্রোডাক্ট নিয়ে আসতে পারেন। শুধুমাত্র প্রয়োজন আপনার একটি সুন্দর পরিকল্পনার! যার মাধ্যমে যে কেউ চাইলেই ঘরে বসে অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে টাকা উপার্জন করতে পারে।
শপিফাই ব্যবহার করে যেভাবে সফল হবেন
একদম নিজস্ব একক একটি প্ল্যাটফর্মে শক্তিশালীভাবে, আপনার ব্যবসাকে Shopify-এ নিয়ে আসা হয়তো সহজ, কিন্তু সেটিকে দাঁড় করানো কঠিন হতে পারে। এক মিলিয়নেরও বেশি অন্যান্য মার্চেন্টদের থেকে আপনার ব্যবসাকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে সাহায্য করার জন্য আপনার প্রয়োজন, Shopify প্ল্যাটফর্মের আদ্যোপান্ত সবই জানে এমন কিছু এক্সপার্ট এর সহায়তা। এছাড়াও নিজের ব্যবসাকে ইউনিকভাবে ফুটিয়ে তোলা, পর্যাপ্ত ও প্রপার ব্র্যান্ডিং, মার্কেটিং, চেষ্টার মাধ্যমে আপনি চাইলে শপিফাই কেন যেকোনো প্ল্যাটফর্মেই আপনার ব্যবসাকে সফলতার শিখরে নিয়ে যেতে পারবেন। শপিফাই এর সঠিক প্রিসেট স্টোরফ্রন্ট রেডি করা থেকে শুরু করে, স্টোরটিকে সঠিক উপায়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করা সহ আপনার ব্যবসা উপযোগী এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তই পারবে আপনার প্রতিষ্ঠান বা স্টোরটির প্রসারতা তৈরি করতে।
যেকোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্য নিয়ে ব্যবসা করাই যেখানে অনেক চ্যালেঞ্জের বিষয় হিসেবে দাড়ায়, সেখানে ই-কমার্স যখন একসাথে এত প্রতিষ্ঠান এবং এতরকমের সার্ভিস নিয়ে কাজ করে নিশ্চয়ই সেটি পরিচালনা করা এবং সবকিছু গুছিয়ে রেখে টিকে থাকা খুবই কঠিন। সেক্ষেত্রে শপিফাই এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো বলতে গেলে মোটেই সহজ ছিল না। অল্প অল্প করে শুরু করে, প্রত্যেকটা সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমেই এতবড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটিকে তৈরি করা এবং এখনো পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে।