নাইকি – জুতার জগতে রাজকীয় যে নাম আজ বিশ্ব সমাদৃত

” জীবন মানেই উন্নতি, হয় আমরা উন্নত হই না হয় আমরা মারা যাই “

— ফিল নাইট, সিইও এন্ড কো ফাউন্ডার, নাইকি।

স্পোর্টস ওয়্যার বা অ্যাথলেটিক ওয়্যার এর জগতে নাইকি খুব পরিচিত একটি নাম। এর আইকনিক ঢেউ খেলানো লোগো, এবং সুপরিচিত ট্যাগলাইন “জাস্ট ডু ইট” এর মাঝেই আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি পাওয়া যায়। ১৯৬৪ সালে ট্র‍্যাকিং কোচ বিল বোয়ারম্যান এবং তার ছাত্র ফিল নাইটের হাত ধরে নাইকির পথচলা শুরু। প্রথমে শুধুমাত্র জাপান থেকে আমদানি করা জুতা বিক্রি করা থেকে ব্যবসা জগতের গ্লোবাল জায়ান্টে পরিণত হওয়া নাইকি তাদের ইনোভেটিভ অ্যাথলেটিক গিয়ার, স্মার্ট মার্কেটিং ক্যাম্পেইন এবং মাইকেল জর্ডান এবং সেরেনা উইলিয়ামস এর মতো বড় বড় অ্যাথলেটদের সাথে কোলাবরেশন করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে নাইকির ইউনিক স্টাইল, পারফরম্যান্স এবং জনপ্রিয়তা একে বিশ্বের অন্যতম সফল একটি ব্র্যান্ডে পরিণত করেছে।

যেভাবে নাইকির শুরু

নাইকির প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ফিল নাইটস ইউনিভার্সিটি অফ ওরেগন থেকে তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ বিজনেসে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে পড়ার এক কাজে তিনি জুতার মার্কেট নিয়ে গবেষণা করেন এবং বুঝতে পারেন বর্তমানে মার্কেটে যেসব জুতা বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর তুলনায় জাপান থেকে আরো ভালো মানের জুতা আমদানি করে আরো কম দামে বিক্রি করা সম্ভব, এতে লাভও থাকবে। তখন আমেরিকান মার্কেটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অ্যাডিডাস ও পুমার মতো বড় বড় জার্মান কোম্পানি। আইডিয়াটা পড়াশোনার একটা প্রজেক্টে ব্যবহার করলেও এটা তার মাথায় থেকে যায় এবং তিনি এটা নিয়ে এগোনো শুরু করেন। এ কাজে তিনি সাথে পেয়েছিলেন ইউনিভার্সিটির কোচ বিল বোয়ারম্যানকে। ব্যবসার এই চিন্তাকে মাথায় রেখে নাইট জাপানে যান এবং জাপানের ওনিৎসুকা টাইগার ব্র্যান্ডের সাথে জুতা আমদানির চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী স্যাম্পল হাতে পেতে তার লেগে গিয়েছিলো প্রায় এক বছর!

প্রথম যখন তিনি জুতার স্যাম্পল হাতে পান, সাথে সাথেই তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার কোচকে। যিনি জুতোর কোয়ালিটিতে ইমপ্রেসড হয়ে তা শুধু কিনেই নেননি, সাথে সাথেই তার ব্যবসায় পার্টনার হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

নাইকি'র প্রতিষ্ঠাতা

জানুয়ারি ২৫, ১৯৬৪ সালে নাইট ও বোয়ারম্যানের হাত ধরে ব্লু রিবন স্পোর্টসের সূচনা হয়, যেখানে নাইট সেল ও ডিস্ট্রিবিউশনের দিকটা দেখতেন আর বোয়ারম্যান নতুন নতুন ডিজাইন আনার দিকে ফোকাসড ছিলেন। প্রথমদিকে ব্লু রিবন স্পোর্টস এর বিক্রি চলতো নাইটের গাড়ির ট্রাংক থেকে। তিনি প্যাসিফিক নর্থ ওয়েস্ট এর রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রির কাজ চালাতেন। অন্যদিকে বোয়ারম্যান ছিলেন একজন দক্ষ ট্র্যাক ও ফিল্ড কোচ, তিনি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ডিজাইন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছিলেন, যে কোন ধরনের ডিজাইন এথলেটের পারফরমেন্সের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে। ১৯৬৬ সালে ব্লু রিবন এবং স্পোর্টস ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা মনিকায় তারা প্রথম রিটেল ষ্টোর খোলেন।

বিখ্যাত ওয়াফল আয়রনের গল্প

নাইকির ইতিহাসে এটি শুধুমাত্র একটি মজার গল্প নয় বরং যুগান্তকারী এক ডিজাইন ও অধ্যায়ের সূচনা। ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে বিল বোয়ারম্যান নতুন একটা জুতার ডিজাইন নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছিলেন। তার ডিজাইন করা জুতাগুলোতে যথেষ্ট গ্রিপ আর ট্রাকশন ছিল না। কী করলে জুতাগুলোকে আরো ভালো করা যায় তাই নিয়ে চিন্তা করছিলেন। এরমধ্যে একদিন সকালবেলা নাস্তা করতে এসে তিনি দেখেন তার স্ত্রী ওয়াফল বানিয়েছেন। ওয়াফলের চারকোনা খাঁজকাটা গ্রিড ডিজাইন দেখে তার মাথায় হঠাৎ করে একটা চিন্তা আসে। সে চিন্তা কাজে লাগাতে আগে পিছে না ভেবেই বাসার ওয়াফল আয়রনে ঢেলে দেন তরল রাবার। খাঁজকাটা গ্রিড ডিজাইন তাকে হতাশ করেনি। সেই গ্রিড কাটা রাবার দিয়ে জুতা বানিয়ে বিল টেস্ট করে দেখেন এবং সফল হন। নতুন সেই ডিজাইনের ছিল আরো ভালো ট্রাকশন এবং কুশনিং, যার ফলে অন্যান্য কম্পিটেটরদের জুতার থেকে সুবিধায় ছিল আরো এগিয়ে। সকালের নাস্তা খাওয়া হোক বা না হোক, সেই ওয়াফল আয়রন থেকে জন্ম হয় নাইকির আইকনিক “ওয়াফল ট্রেনার” এর, যা এখনো সমানভাবে বাজার মাতিয়ে রেখেছে। শুরুটা মজার এক গল্প দিয়ে হলেও এর ফলাফল প্রমাণ করে কোনো আইডিয়াই হাস্যকর বা ফেলনা নয়, যতক্ষণ না তা কাজে লাগানো হচ্ছে।

রিব্র‍্যান্ডিং

১৯৭১ এর শুরুর দিকে ব্লু রিবন স্পোর্টস থেকে নাইকি হওয়ার ইতিহাস শুরু হয়। এর পিছনে ছিল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ এবং এই রিব্র‍্যান্ড নাইকির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর একটি ছিল। রিব্রান্ডের একটা প্রধান কারণ ছিল নাইকির নিজস্ব পরিচয় তৈরি। ব্লু রিবন স্পোর্টস ছিল শুধুমাত্র একটি আমদানিকারক কোম্পানি, যারা জাপান থেকে এনে জুতা বিক্রি করতো। নিজস্ব আইডিয়া ও ডিজাইনের সাথে সাথে নাইকির একটা নিজস্ব পরিচয় দরকার ছিল, তাই নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে যুক্ত করা হয় শক্তিশালী একটি লোগো। গ্রিক মিথলজির দেবী নাইকি হচ্ছেন বিজয়ের দেবী। তিনি যুদ্ধ, খেলাধুলা ও শিল্পে জয় লাভের জন্য বিখ্যাত। নাইকির ভিশনের সাথে মিলে যাওয়ায় এই দেবীর নামেই ব্র্যান্ডের নাম রাখা হয় নাইকি। একই সাথে যোগ করা হয় আইকনিক ঢেউ খেলানো একটি লোগো। লোগোটি ডিজাইন করেছিলেন পোর্টল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির গ্রাফিক ডিজাইন স্টুডেন্ট ক্যারোলিন ডেভিডসন। হালকা ঢেউ খেলানোর লোগো গতি, দ্রুততা এবং বিজয়ের প্রতীক যা নাইকের মূল উদ্দেশ্যের সাথে মিলে যায়। নায়কের প্রথম নিজস্ব ডিজাইন ওয়াফল ট্রেনার শু দিয়েই তাদের রিব্র‍্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়। একই সাথে নাইকি শুধু জুতা ছাড়াও বাস্কেটবল ও সকারের মত অন্যান্য খেলাকে ফোকাস করেও প্রোডাক্ট ডিজাইন শুরু করে, যার ফলে স্পোর্টস এর মার্কেটে নাইকির সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাওয়া শুরু হয়।

নাইকি

নাইকি এয়ার কুশন – আরেক যুগান্তকারী আইডিয়ার গল্প

নাইকির বিখ্যাত এয়ার কুশন টেকনোলজি আবিষ্কারের পিছনেও রয়েছে ভিন্নধারার চিন্তা। এম ফ্র্যাঙ্ক রুডি ছিলেন একজন অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, যার অবসর সময়ের প্রিয় কাজ ছিল দৌড়ানো। তিনি একদিন জুতার সোলে এয়ার পকেট রাখার আইডিয়া নিয়ে ফিল নাইট এর কাছে যান। তার ভাবনা ছিল এরোপ্লেনে থাকা এয়ার পকেটের মতই জুতার এয়ার পকেটও ধাক্কা সয়ে নেবে এবং কমফোর্ট বাড়াবে, মূলত জুতার সোলের ফোম এর জায়গায় থাকবে এয়ার পকেট। আইডিয়াটা একটু অপ্রচলিত আর মূল ধারার বাইরের চিন্তা হলেও, ফিল এর মধ্যকার সম্ভাবনা দেখতে পান এবং রুডিকে প্রটোটাইপ তৈরি করতে উৎসাহ দেন। তখন রুডি, বিল বোয়ারম্যান ও তার দলকে নিয়ে এয়ার কুশনিং টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেন। বিভিন্ন ধরনের প্রোটোটাইপ এবং ম্যাটেরিয়াল নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকেন। লক্ষ্য ছিল ওজনে কম এবং ভালো রেসপন্স করবে এমন একটি কুশন সিস্টেম যা অ্যাথলেটদের কমফোর্ট এবং পারফরম্যান্স দুটোই বাড়াবে।

বিভিন্ন রকমের টেস্টে পাস হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে নাইকি এয়ার কুশন টেকনোলজি ব্যবহৃত প্রথম জুতা বাজারে আনে যার নাম ছিল ‘দি নাইকি এয়ার টেলউইন্ড’। এই জুতায় সোল এর মধ্যে ছিল এয়ার পকেট, যার কারণে দৌড়বিদদের জন্য কুশনিং ও কমফোর্টের ব্যবস্থা হয়। এ ডিজাইনটাতে এয়ার কুশন দেখা না গেলেও অন্যান্য ট্র্যাডিশনাল রানিং শু এর চাইতে এটি ছিল বেশি উন্নতমানের।

১৯৮৭ সালে নাইকি তাদের নতুন “ভিজিবল এয়ার” টেকনোলজি বাজারে নিয়ে আসে। এটি প্রথম দেখা যায় নাইকির “এয়ার ম্যাক্স ১” এ। প্রথমবারের মতো উইন্ডোর সাহায্যে কাস্টমাররা নাইকির এয়ার কুশনিং দেখতে পান। এটি শুধুমাত্র কুশনিং উন্নত করেছিল তাই নয় বরং এর ইউনিক স্টাইল খুব দ্রুতই কাস্টমারদের কাছে জায়গা করে নেয়।

শুধুমাত্র মিড সোলই নয়, এক্সপেরিমেন্ট ও টেস্টের মাধ্যমে নাইকি বিভিন্ন ধরনের এয়ার সোল বাজারে আনা শুরু করে। রানিং শু, বাস্কেটবল শু ইত্যাদি খেলার জন্য আলাদাভাবে মিড সোল থেকে শুরু করে ফুল এয়ারসোল কুশনিংও বাজারে আসে।

এয়ার জর্ডান : বিশ্বব্যাপী পরিচিতি

দিন দিন নাইকির জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছিল। তবে নিজের এলাকায় আর সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছিলেন না ফিল ও বিল। আন্তর্জাতিক বাজারে জায়গা করে নিতে এবার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া হয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল বাস্কেটবল লিজেন্ড মাইকেল জর্ডানের সাথে কোলাবরেশন।

মাইকেল জর্ডান প্রথম খেলা শুরু করেন শিকাগো বুলস থেকে। তার খেলার তাক লাগানো স্টাইল, কারিশমা এবং মেধা খুব দ্রুতই সারা বিশ্বে ভক্তদের নজর কেড়ে নেয়। তার এই জনপ্রিয়তা ধরতে পেরে ১৯৮৪ সালে নাইকি তার সাথে কোলাবোরেশনে যাওয়ার অফার করে। মাইকেল জর্ডান নাইকির সাথে মিলে বাজারে আনেন তার নিজস্ব লাইন এয়ার জর্ডান, যা অ্যাথলেটিক ফুটওয়ার ইন্ডাস্ট্রিকে সারা জীবনের জন্য বদলে দিয়েছিল।

পিটার মুরের ডিজাইন করা এয়ার জর্ডান তার বোল্ড কালার, হাই টপ সিলোয়েট এবং নাইকির আইকনিক উইংস এর সাথে বাস্কেটবল লোগো দিয়ে ভক্তদের মন কেড়ে নেয়। নায়িকার সিগনেচার এয়ার কুশন টেকনোলজি তো ছিলই।

নাইকির অত্যাধুনিক টেকনোলজিতে করা এয়ার জর্ডান পায়ে মাইকেল জর্ডানের পারফরম্যান্স সারা বিশ্বে বাস্কেটবল ফ্যানদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। এয়ার জর্ডানের ইউনিক ডিজাইন, মাইকেল জর্ডানের স্টারডম এবং নাইকির সিগনেচার এয়ার কুশন এই নতুন জুতাকে দিয়েছিল অনন্য মাত্রা। সারা বিশ্বে এয়ার জর্ডান শুধুমাত্র জুতা নয় বরং স্টাইলে পরিণত হয়। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি, আর্ট ইন্ডাস্ট্রি সব জায়গাতেই সাড়া পড়ে যায়। সেলিব্রেটি, ফ্যান, কালেক্টর, সাধারণ মানুষ সবাই সমানভাবে এই জুতার প্রেমে পড়ে। বর্তমানে সবমিলিয়ে ৩৫টি এডিশনের এয়ার জর্ডান নাইকি রিলিজ করেছে।নাইকি'র সাথে জর্ডানের চুক্তি

সিগনেচার স্লোগান : জাস্ট ডু ইট

১৯৮৭ সাল, মার্কেটিং এ স্লোগান তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফাস্টফুড কোম্পানি থেকে শুরু করে ফেডেক্সের মতো কোম্পানিও ব্যবহার করছে ক্যাচি স্লোগান। নাইকির কাছে ব্র্যান্ড ভ্যালু ও ক্যাচি লোগো থাকলেও নেই কোনো স্লোগান। তখন উইডেন কেনেডি অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির সহ প্রতিষ্ঠাতা ড্যান উইডেন দায়িত্ব পেয়েছিলেন নাইকির জন্য একটা স্ট্রং স্লোগান তৈরি করার। তাদের দরকার ছিল এমন একটা ট্যাগ লাইন, যা নাইকি ব্র্যান্ডের মোরালের সাথে ভালোভাবে যাবে। বাধা ভেঙে ফেলার, সর্বোচ্চ দেয়ার এবং জয়লাভ করার।

ড্যানি এই স্লোগানের আইডিয়া পান অদ্ভুত একটা সোর্স থেকে। মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা একজন খুনীর বলে যাওয়া শেষ কিছু শব্দ তার মাথায় বাজে। খুনের দায় অভিযুক্ত গ্যারি গিলমোর ফায়ারিং স্কোয়াডে মারা যাওয়ার আগে শেষ বলেছিলেন “লেটস ডু ইট।”

এই লেটস ডু ইট কে সামান্য পরিবর্তন করে নাইকির স্লোগান করা হয় জাস্ট ডু ইট। সরাসরি লেটস ডু ইট ব্যবহারে কপিরাইটের ঝামেলা হতে পারতো, এছাড়াও সেটা সরাসরি নাইকি এর ভাব ধারার সাথে যায়নি। সিম্পল অথচ শক্তিশালী “জাস্ট ডু ইট” ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো টেলিভিশন কমার্শিয়ালে প্রচারিত হয়, যার প্রভাব ছিল দেখার মতো।

তিন শব্দের এই ছোট্ট স্লোগান দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। মানুষ ফিটনেস ও সেলফ ইমপ্রুভমেন্টের দিকে আগ্রহী হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে জিনিসটা আর জুতা বিক্রয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা ছিল একটা লাইফ স্টাইল তৈরি, একটা ফ্যাশন তৈরি ও নিজের লক্ষ্য ও স্বপ্নকে পূরণ করার পিছনে হাল না ছাড়ার এক বাণী। সারা বিশ্বে সব স্থানে এই স্লোগান ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মানুষকে লক্ষ্য অর্জনে অন্তত প্রথম পদক্ষেপ নিতে এই স্লোগান উৎসাহিত করে। সব ধরনের বাধা বিপত্তি পেরিয়ে নিজের লক্ষ্য অর্জনের মন্ত্রই ছিল যেন “জাস্ট ডু ইট”।

জাস্ট ডু ইট

বিশ্ববাজারে স্থান করে নেয়া

শুধু এয়ার জর্ডানেই থেমে ছিল না নাইকির সাফল্য। ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে যাওয়ার জন্য কোলাবরেশন ছাড়াও আরো বিভিন্ন রকমের পদক্ষেপ নেয় নাইকি। যেমন- ইউরোপে ফুটবল খেলার জনপ্রিয়তা নাইকির নজর কেড়েছিল। তাই ইউরোপীয় মার্কেটে ঢুকতে তাদের কালচার অনুযায়ী ফুটবলে ইনভেস্ট শুরু করে নাইকি। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, রিচার্লিসন, সার্জিও আগুয়েরো, রবার্তো কার্লোস, কিলিয়ান এমবাপ্পের মত প্লেয়ারদের স্পন্সর করে নাইকি। এছাড়াও ২০১৪ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের কিট স্পন্সর হয়েছে নাইকি।

এশিয়ার দিকে মার্কেট বড় করতে ভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয় নাইকি। ব্যবসার প্রথমদিকে জাপানের অনিৎসুকা টাইগার কোম্পানি থেকেই নাইকির প্রোডাক্ট আসতো, সে অভিজ্ঞতা থেকে এশিয়ার মার্কেট সম্পর্কে তারা কিছুটা ধারণা পায়। এশিয়ার মার্কেট ইউরোপের মত নয়, এখানে পপুলেশনের মধ্যে মিডল ক্লাস ক্রেতাদের সংখ্যাই বেশি।

১৯৮০ এর শুরুর দিকে নাইকি টোকিও তে রিজিওনাল অফিস খোলে, যার পরে আস্তে আস্তে বিভিন্ন দিকে ছড়াতে থাকে। লোকাল মার্কেটে প্রোডাক্ট ছড়ানোর জন্য নাইকি ওই এলাকার মানুষদের হায়ার করে, এতে কালচারাল শক এড়ানো যায়। এশিয়ার মানুষেরা জাতিগতভাবে ইউরোপিয়ানদের মতো গঠনের নয়, এছাড়া দুই এলাকার আবহাওয়াও এক নয়, তাই নাইকি এলাকা অনুযায়ী ভিন্ন ডিজাইনের ও সাইজের প্রোডাক্ট তৈরি করে, যা এশিয়ার লোকেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ঠিক ছিল। বিভিন্ন লোকাল ও রিজিওনাল সেলিব্রেটি ও ইনফ্লুয়েন্সারদের সাথে পার্টনারশিপের মাধ্যমে নাইকি এই এলাকায় অবস্থান শক্ত করে। এছাড়াও বিভিন্ন লোকাল স্পোর্টস টিম, ইভেন্ট ও টুর্নামেন্ট নাইকি স্পন্সর করে, যার কারণে এশিয়ার মধ্যেও নাইকির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এশিয়ার বিভিন্ন শহর যেমন টোকিও, বেইজিং, সাংহাই, সিওল এসব জায়গায় ফ্লাগশিপ স্টোর খোলার পাশাপাশি লোকাল বিক্রেতা তাদের সাথেও কোলাবরেশন নাইকিকে লোকাল মার্কেটে শক্ত অবস্থান ও পরিচয় তৈরি করে দেয়।

এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিক ও অন্যান্য বড় বড় ইভেন্টে চাইনিজ অলিম্পিক টিমকে স্পন্সর করায় চায়নাতে নাইকির ব্র‍্যান্ড ইমেজ ছড়িয়ে পড়ে এবং চায়নাতে তাদের আলাদা কাস্টমার বেইস তৈরি হয়ে যায়।

অলিম্পিকে নাইকি

সমালোচনা ও তার জবাব

সাফল্যের রাস্তা ধরে হাঁটলেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে যেতে পারেনি নাইকি। ২০০০ সাল চলার দিকে বেশ কিছু সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পড়ে বিখ্যাত এই ব্র‍্যান্ড। খারাপ কাজের পরিবেশ ও ফ্যাক্টরিগুলোর অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারদিকে। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং চীনের ফ্যাক্টরিগুলোতে শিশুশ্রম ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও শোনা যায়। এ অভিযোগ বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেয় এবং বিভিন্ন এনজিও, মিডিয়া এবং শ্রম অধিকারের সাথে সংযুক্ত অর্গানাইজেশনগুলো মাথা ঘামানো শুরু করে।

এ বিষয়ে অভিযোগগুলো ছিল খারাপ কাজের পরিবেশ, শিশুশ্রম এবং শ্রমিকদের ঠিকমতো অধিকার না দেয়া। যেসব ফ্যাক্টরির উপর নাইকির প্রোডাক্ট বানানোর দায়িত্ব ছিল তাদের ওপর পরিবেশ খারাপ রাখা, অতিরিক্ত কর্ম ঘন্টা, ঠিকমতো বেতন না দেওয়া এবং ক্ষতিকর পরিবেশের শ্রমিকদের কাজ করানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়াও কম বেতনে কাজ করানোর জন্য সুবিধা বঞ্চিত শিশুদেরকে এনে ফ্যাক্টরিরর শ্রমিক বানানোর অভিযোগও পাওয়া যায়। বেতন কম দেবার পাশাপাশি শ্রমিকরা যাতে নিজেদের কোনো সংগঠনও তৈরি করতে না পারে, এ ব্যাপারেও কারখানা থেকে ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা।

এসব খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে নাইকির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। বিভিন্ন কাস্টমার একটিভিস্ট গ্রুপ একসাথে হয়ে নাইকির প্রোডাক্ট বয়কটের আন্দোলন চালানোর চেষ্টা করে এবং জনগণকে অন্য ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট কিনতে প্রভাবিত করতে থাকে। নিউজ পেপার ও মিডিয়ায় এ খবর বেশ বড় করে ছড়ানো হয়, যার মূল বক্তব্য ছিল নাইকির পজিটিভ মার্কেটিং এবং তার পিছনের সত্যতা। ব্র্যান্ডের ইমেজের উপর এভাবে আঘাত আসায় নাইকির ইনভেস্টররাও পিছিয়ে যেতে থাকেন এবং ব্র্যান্ড আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

নাইকি সরাসরি এসব ফ্যাক্টরি না চালালেও, অভিযোগের তীর তাদের দিকেই এসে পড়ে। যেহেতু এ ব্যাপারে দেখা তাদের দায়িত্ব, তাই নাইকি খুব দ্রুতই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে। সাপ্লায়ারদের জন্য খুব দ্রুতই নাইকি একটি কোড অফ কন্ডাক্ট তৈরি করে, যেখানে কাজের একটি স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দেওয়া হয়। যার মধ্যে উপযুক্ত বেতন, ঠিকঠাক কর্ম ঘন্টা এবং সেক্টরের নিরাপদ কন্ডিশনের কথা উল্লেখ করা ছিল। সাপ্লায়ারদের সবাইকে কড়াভাবে এই কোড অফ কন্ডাক্ট মেনে চলতে বলা হয়। তাছাড়াও তারা এই কোড অফ কন্ডাক্ট মেনে চলছে কিনা তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত ফ্যাক্টরি ভিজিটেশন ও অডিট এর ব্যবস্থা চালু করে নাইকি। একই সাথে একে আরও স্বচ্ছ করতে নাইকি তাদের সব সাপ্লায়ারদের একটা লিস্ট এবং নিয়মিত ভিজিটেশনের পর বর্তমান ওয়ার্কিং কন্ডিশন সম্পর্কে ডিটেইল রিপোর্ট পাবলিশ করে। বলা যায় সমালোচনা বন্ধ করতে যেসব শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল নাইকি তার প্রায় সবগুলোই নিতে পেরেছে।

নাইকি সম্পর্কে আরেকটা অভিযোগ ছিল যে তারা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রোডাক্ট বাজারজাত করছে। পরিবেশ সচেতনতা বাড়ার সাথে সাথে শিল্পায়ন ও কর্পোরেট ফ্যাক্টরিগুলোর দিকে আঙ্গুল তোলা হয়। এ থেকে বাদ পড়েনি নাইকি। তাদের প্রোডাক্ট পরিবেশের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস থেকে শুরু করে কোন ধরনের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার এবং ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কীভাবে হচ্ছে সবই সমালোচনার মুখে পড়ে।

নাইকিকে যেসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়

এই সমালোচনাকে রুখতে নাইকি বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল ব্র্যান্ডকে সাসটেইনেবল করে তোলা। নাইকি প্লাস্টিক ও সিন্থেটিক ম্যাটেরিয়াল এর জায়গায় রিসাইকেল পলিয়েস্টার এবং অর্গানিক কটন ধরনের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা শুরু করে। এছাড়াও কিছু এনভায়রনমেন্টাল প্রোগ্রাম লঞ্চ করে যেমন- নাইকি গ্রাইন্ড, “রিইউজ আ শু” ইত্যাদি। নাইকি গ্রাইন্ড এর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং ওয়েস্টকে ব্যবহার করে নতুন প্রোডাক্ট বানানো, আর “রি ইউজ আ শু” এর লক্ষ্য ছিল পুরাতন স্নিকার্সকে রিসাইকেল করে নতুন কিছু বানানো। এ ছাড়াও নাইকি তাদের কার্বন ফুট প্রিন্ট কমাতে সাসটেইনেবল এনার্জি ব্যবহার শুরু করে।

এছাড়াও নাইকির মার্কেটিং ও অ্যাডভার্টাইজমেন্ট নিয়েও ছিল বিতর্ক। কালচারাল ইনসেনসিটিভিটি, জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন এবং স্ক্যান্ডাল অথবা বিতর্কে জড়ানো সেলিব্রেটিদের সাথে কাজ করে যাওয়ায় সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে নাইকি। ঠিক সময়ে পলিসি পরিবর্তন করে সমালোচনাও বন্ধ করেছে তারা। সমাজে পজিটিভ মেসেজ দিয়ে, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং ইনক্লুসিভ বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করে, ভিন্ন ভিন্ন এলাকার জন্য তাদের ট্র্যাডিশন ও কালচার অনুযায়ী মার্কেটিং ডিজাইন করে নাইকি সফলতার ধারা অব্যাহত রেখেছে।

এতকিছুর মধ্যেও নতুন নতুন আইডিয়া ও ইনোভেশন নিয়ে ডিজাইন করা নাইকি থামায়নি। ক্রমাগত বিভিন্ন ডিজাইন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট এর মাধ্যমে সেরা সেরা কালেকশন নাইকি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে।

বর্তমানে নাইকি

সাফল্যের ধারা ক্রমাগত বয়ে চলতে থাকলেও নাইকির গতি কমে যায়নি, নতুন নতুন টেকনোলজির মাধ্যমে প্রোডাক্টের মান বাড়িয়েই চলেছে তারা। একই সাথে মার্কেটিং প্র্যাকটিস এবং ডিজিটাল ইনোভেশনেও কাজ করছে নাইকি। ২০১২ সালে বাজারে আনা নাইকির ফ্লাইনিট টেকনোলজি বাজারে প্রচলিত কেটে সেলাই করা মেথড থেকে প্রায় ৬০% ম্যাটেরিয়াল অপচয় কমায়। এছাড়াও ২০১৭ সালে বাজারে নিয়ে আসা নাইকি রিঅ্যাক্ট ফোম এবং এয়ারভ্যাপোরম্যাক্স আরো কার্যকরী নতুন দুইটি ধরনে নাইকির প্রচলিত কুশনিংকে নতুন মাত্রা দেয়।

সাস্টেইনেবল ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ শুরু করার লক্ষ্য থেকে ২০২০ সালে নাইকি তাদের “স্পেস হিপি লাইন” লঞ্চ করে। এ লাইনের প্রোডাক্টগুলো রিসাইকেল করা মেটেরিয়াল থেকে বানানো হয়। এর ফলে অপচয় কম হয়, এবং কার্বন ফুড প্রিন্ট ও কমে।

বর্তমানে নাইকির যে সাস্টেইনেবিলিটি ক্যাম্পেইন চলছে, তার নাম হচ্ছে “মুভ টু জিরো”। সম্পূর্ণভাবে রিসাইকেল করা পলিয়েস্টার, পচনশীল ম্যাটারিয়াল এবং প্রকৃতিবান্ধব রং ব্যবহার করার মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি কমানোই এ ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও পিছিয়ে নেই নাইকি। ২০১৯ সালের লঞ্চ করা নাইকি ফিট কম্পিউটারের সাহায্যে কাস্টমারের পা স্ক্যান করে কাস্টমারের জন্য সঠিক ফিটের জুতো রেকমেন্ড করতে পারে। এর ফলে ফিটিং ঠিকঠাক হয় এবং রিটার্ন কম আসে। এছাড়াও কাস্টমারদের পার্সোনাল গোলের জন্য নাইকি ট্রেনিং ক্লাব এবং নাইকি রান ক্লাব নামে অ্যাপস রয়েছে যেগুলোর সাহায্যে কাস্টমার তার নিজস্ব ট্রেনিং প্রোগ্রাম এবং ওয়ার্কআউট প্রোগ্রাম নিয়ে নিজের পার্সোনাল গোল ফুলফিল করতে পারেন।

এছাড়াও তাদের নিজস্ব অ্যাপের মাধ্যমে তাদের এক্সক্লুসিভ প্রোডাক্ট, লেটেস্ট নিউজ পাওয়ার সাথে সাথে সরাসরি ব্র্যান্ড পার্সোনালদের সাথে ইন্টারেক্ট করা যায়। নিজস্ব অ্যাপ ছাড়াও বড় বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সাথে কোলাবোরেশনের কারণে সেসব প্লাটফর্ম থেকেও অরিজিনাল নাইকির প্রোডাক্ট কিনতে পারা যায়। অন্য সব আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের মতো এলাকাভিত্তিক ল্যাঙ্গুয়েজ রেফারেন্স এবং পেমেন্ট মেথডও রয়েছে নাইকির।

মুভ টু জিরো

দুইজন সাধারণ উদ্যোক্তার নতুন কিছু করার উদ্যম ও ঝুঁকি নিতে পারার সাহসে ভর করে গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে বিক্রি হওয়া শুরু হয়েছিল নাইকি। সেই নাইকি আজ নিজের দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে শুধু ছড়িয়ে পড়েনি, রাজত্ব করে চলেছে পুরো দমে। আমদানিকারক থেকে নিজস্ব ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়ার যে গল্প, তা শুধুমাত্র একটি কাহিনী নয়, বরং পৃথিবীর চোখে নিজেদের পরিচয় স্পষ্ট করে দেওয়ার এক ইতিহাস। যার সাফল্যের উজ্জ্বলতা এখনো নিভে আসেনি বরং পুরোদমেই জ্বলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *