ছোট বেলায় ইন্ডিয়ান টিভি চ্যানেলগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে, একটা এড আমরা প্রায় সবাই দেখেছি। আমুল- দ্য টেস্ট অফ ইন্ডিয়া। খুব কিউট একটা মেয়ে ব্রেড এ বাটার লাগিয়ে খাচ্ছে, এই মাস্কটটা আমাদের প্রায় সবারই পরিচিত। নিজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আমুল রপ্তানি শুরু করেছে বিশ্বের অনেক দেশেই, এমনকি বাংলাদেশে বসেও আমরা এখন পেয়ে যাচ্ছি আমুল এর বাটার, ঘি, কোল্ডকফি, ফ্লেভারড মিল্ক ইত্যাদি প্রোডাক্ট। কিন্তু আমুল এর এই যাত্রার শুরুটা কীভাবে? প্রায় ৭৭ বছর ধরে ব্যবসায় টিকে থাকা এবং মার্কেটে মনোপলি জাহির করা, মোটেও সোজা কাজ নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে এক বিশাল ইতিহাস, যাকে বলা হয় ইন্ডিয়ার হোয়াইট রেভোলিউশিন। এভাবে একতার মাধ্যমে জন্ম হওয়া এবং একাধিপত্য নিয়ে নেয়া, কীভাবে সফলতার সাথে আমুল সেটি করে আসছে, আমরা আজ সেই কাহিনীই জানবো।
যাত্রা শুরুর গল্প
এই গল্পের শুরু ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালের দিকে, যখন ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য চলছে। তখনকার বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) শহরে ব্রিটিশ বড় বড় পদধারীদের বসবাস। তাদের প্রয়োজন মেটাতে ব্রিটিশ সরকার মুম্বাই শহরে দুধের সরবরাহ বাড়ানোর উপায় খুঁজতে থাকে। বম্বে থেকে ৩৩০ কিলোমিটার উত্তরের গুজরাটের খেড়া জেলায় সন্ধান পাওয়া যায় বড় ভলিউমের দুধের সরবরাহের। সেই প্রায় ১৯০০ সাল থেকেই খেড়া দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। ১৯২৬ সালে সেই দুধ উৎপাদনকে পুঁজি করে ব্যবসা শুরু করেন একজন পার্সি ব্যবসায়ী। পেস্তোনজি এডুলজি নামের সেই ব্যবসায়ী নিজের কোম্পানির জন্য একটি মাখন তৈরির ফ্যাক্টরি খোলেন এবং কোম্পানির নাম দেন পোলসন। বিপুল পরিমাণে সরবরাহ পাওয়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পোলসন কোম্পানি। ঘরে ঘরে তখন পোলসন কোম্পানির প্রোডাক্ট পাওয়া যেত।
বোম্বের সরকার পোলসন কোম্পানির কাছে বড় আকারে দুধ সরবরাহের অফার করে বেশ ভালো দামের বিনিময়ে, পোলসনও সে অফার লুফে নেয়, এর মধ্যে দিয়েই লম্বা দূরত্বে তরল দুধ পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ কাজ পরিচালনার জন্য বোম্বের মিউনিসিপাল কর্পোরেশন একটি প্রকল্প নেয় যার নাম ছিল বোম্বে মিল্ক স্কিম। কিন্তু এর মাধ্যমে বোম্বে সরকার এবং পোলসন কোম্পানি দুই দলই লাভবান হলেও, ক্ষতিতে পড়ছিল দুধ উৎপাদনকারী কৃষকরা। কারণ বড় লাভের মুখ দেখলেও তার বেশিরভাগটা নিজের পকেটেই ভরে নিচ্ছিল পোলসন কোম্পানি। তাদের এই ঠকানোর কাহিনী তারা প্রকাশ করেন সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল এর কাছে, যিনি ছিলেন ভারতের প্রথম উপ প্রধানমন্ত্রী, এবং সেই এলাকারই লোক। তিনি কৃষকদেরকে একত্র হতে বলেন এবং সমবায় সংঘ গঠন করলে তাদের নিজেদের একটা শক্তি থাকবে এই উপদেশ দেন। সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি তার ডেপুটি মোরারজি দেশাইকে নির্দেশ দেন। যিনি পরে এই সমবায়ের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য খেড়া জেলার কংগ্রেস কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ত্রি ভুবন দাস প্যাটেলকে দায়িত্ব দেন। এই ত্রিভুবনদাস প্যাটেলই হলেন আমুল এর প্রথম স্রষ্টা।
এত কিছুর পরেও পোলসনকে টলানো যাচ্ছিল না, বিভিন্ন অজুহাত খুঁজে তারা কৃষককে তাদের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করছিল। দুধে যথেষ্ট মাখন নেই, বা পানি মেশানো, মাছি পড়েছে এসব অজুহাতে কৃষককে কম টাকা দিয়ে গা বাঁচাতে চাইছিল পোলসন। তখন সিদ্ধান্ত হয়, পোলসনকে একেবারে সরিয়ে দিতে হবে। সরাসরি কৃষকরা বোম্বে মিল্ক স্কিম এর কাছে দুধ সরবরাহ করবে। কিন্তু বোম্বে মিল্ক স্কিম এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৬ সালের কৃষকরা এক হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে খেড়া জেলার প্রতিটি গ্রামে একটি করে সমিতি গড়ে তোলা হবে এবং কেউ পোলসন কোম্পানির কাছে কোনো দুধ বিক্রি করবে না। আনন্দ জেলা থেকেই তাদের হেডকোয়ার্টার গড়ে উঠবে এবং দুধ বিক্রির মার্কেট গড়ে তোলা হবে। তাদের ভাষ্য ছিল, পোলসনের কাছে এক ফোঁটা দুধও বিক্রির আগে সেই দুধ রাস্তায় ঢেলে দেওয়া হবে। কৃষকদের ১৫ দিনের বিক্ষোভে পোলসনের সরবরাহে ভাটা পড়ে, সরবরাহ না পেয়ে বোম্বে মিল্ক স্কিম প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হয়। বাধ্য হয়ে কৃষকদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া হয়।
১৯৪৬ সালে ত্রিভুবনদাস প্যাটেল গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সমিতি গড়তে উৎসাহ দেন। ডিসেম্বরের দিকে খেড়া জেলার সমবায় দুধ উৎপাদন সমিতি লিমিটেড (KDCMPUL) এর জন্ম হয়, যা থেকে পরে জন্ম নেয় আমুল। ১৯৪৯ সালে ত্রিভুবনদাস প্যাটেল এর সাথে দেখা হয় ডাক্তার ভার্গেস কুরিয়েনের। ডাক্তার ভার্গেস কুরিয়েন ছিলেন কেরালায় জন্ম নেওয়া একজন ইঞ্জিনিয়ার, যিনি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তার ডিগ্রি পেয়েছিলেন। আনন্দতে গভর্নমেন্ট ইন্ডিয়া ক্রিমারির অধীনে রিসার্চার হিসেবে চাকরি করেছিলেন কুরিয়েন। কিন্তু নিজের চাকরি পছন্দ ছিল না তার। অফিসের পাশেই খেড়া সমবায়ের প্লান্ট হওয়ায় অবসর সময়ে তিনি প্রায়ই তাদের পুরনো মেশিনপত্র ঠিক করে দিতেন। এর মাঝেই একদিন ত্রিভুবন দাশকে কুরিয়েন বুদ্ধি দেন, এই পুরনো জং ধরা প্লান্ট ভেঙে ফেলে নতুন করে প্লান্ট তৈরি করতে। প্রায় ৪০০০০ টাকা জোগাড় করে কুরিয়েনের হাতেই নতুন প্লান্ট তৈরির দায়িত্ব দেন ত্রি ভুবন দাস। প্লান্ট তৈরি হতে হতে কুরিয়েন সরকারি চাকরি থেকে রেজিগনেশন দিয়ে দেন, এবং ত্রিভুবন দাস তাকে সমবায় দুধ উৎপাদন সমিতির জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে চাকরিতে নিয়ে নেন। বাকিটা ইতিহাস!
১৯৫২ সাল হতে হতে সব ধরনের বাধা পেরিয়ে সমবায় দুধ উৎপাদন সমিতি প্রায় ২০ হাজার লিটার দুধ সরবরাহ করে, যা ১৯৪৮-এর তুলনায় ছিল দশ গুণ বেশি। কিন্তু বেশি উৎপাদনের সাথে দেখা যায় এক নতুন সমস্যা। মহিষ শীতকালে যে পরিমাণ দুধ দেয়, তা গরম কালের দুধের প্রায় আড়াই গুণ বেশি। এই অতিরিক্ত দুধ নিয়ে কী হবে, তা নিয়ে চিন্তা শুরু হয়। না সেগুলো বিক্রি করা যাচ্ছিল আর না সেগুলো কোনোভাবে সংরক্ষণের বুদ্ধি পাওয়া যাচ্ছিল।
একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান ভাবা হচ্ছিল যে, যদি কোনোভাবে এই অতিরিক্ত দুধকে অন্য কাজে লাগানো যায়। যেমন মাখন এবং গুড়া দুধে রূপান্তর করে লম্বা সময়ের জন্য রেখে দেয়া যেত। কিন্তু এর জন্য দরকার প্রসেসিং প্ল্যান্ট। এছাড়াও গরুর দুধ খেয়ে গুড়া দুধে রূপান্তর করার টেকনোলজি জানা থাকলেও মহিষের দুধে সেটা কাজ করবে না, তাহলে উপায়? বিপদ থেকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন কুরিয়েন এর বন্ধু ডেইরি টেকনোলজিস্ট হরিচাঁদ দালায়া। মহিষের দুধকে স্প্রে করে গুঁড়ো দুধ বানানোর টেকনোলজি তিনিই আবিষ্কার করেন। যার হাত ধরে তৈরি হয় ভারতের প্রথম গুড়া দুধ ও মাখন এর প্ল্যান্ট। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই প্ল্যান্টের উদ্বোধন করেন।
আমুল নাম কীভাবে এলো?
১৯৫৬ সালের দিকে কুরিয়েন বুঝতে পারেন যে শুধুমাত্র বোম্বের মিল্ক মার্কেট দিয়ে এই বিপুল পরিমাণে দুধ বাজারজাত করা সম্ভব নয়, আরো বড় মার্কেট লাগবে, যে জন্য একে ব্র্যান্ডে পরিণত হতে হবে। সমবায়ের একজন কেমিস্ট “আমুল” নামটি প্রস্তাব করেন। এই নামের দুইটি দিক ছিল, প্রথমটি হল, আমুল শব্দটা সংস্কৃত আমুল্যা থেকে অনুপ্রাণিত, বাংলায় যার অর্থ হয় অমূল্য। নিজেদের উৎপাদিত পণ্যে নিজেদের গর্বের কথা প্রচার করতেই এ নামটি নেয়া। এছাড়াও আনন্দ মিল্ক ইউনিয়ন লিমিটেড এর সবগুলো নামের প্রথম অক্ষর গুলো নিয়েও “AMUL” ই হয়। নামটা ছোট, মনে রাখার মত এবং এর পিছনে রয়েছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ১৯৫৭ সালে খেড়া সমবায় আমুল ব্র্যান্ডের নাম পাকাপাকিভাবে রেজিস্ট্রি করে নেয়, যা এখন ভারতের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডগুলোর একটি।
হোয়াইট রেভ্যুলেশন
আমুল এর যাত্রাপথের একটা বেশ বড় মাইল ফলক হলো ইন্ডিয়ার বিখ্যাত হোয়াইট রেভ্যুলেশন। এর মাধ্যমে সারা ভারতে দুধের সরবরাহ নিশ্চিত হয় এবং প্রান্তিক কৃষকরা তাদের উৎপন্ন দুধের যথাযথ মূল্য পায়। এর শুরু হয় ১৯৬৪ সালের যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সরদার প্যাটেল এর জন্মদিনে আনন্দ ভিজিট করতে আসেন। তিনি কুরিয়েনের মডেল দেখে চমৎকৃত হন এবং পুরো ভারতে কুরিয়েনকে সেটা ছড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কথা থাকা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ১৯৬৫ সালে সরকারি তহবিল ছাড়াই ন্যাশনাল ডেইরি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন করা হয়।
১৯৭০ সালের জুলাইয়ে ন্যাশনাল ডেইরি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড অফিসিয়ালি লঞ্চ করে “আ বিলিয়ন লিটার ড্রিম” যাকে হোয়াইট রেভ্যুলেশন, অপারেশন ফ্লাড ইত্যাদিও বলা হয়। লক্ষ্য ছিল ভারতের ডেইলি ইন্ডাস্ট্রিকে বিন্দু থেকে বন্যায় নিয়ে যাওয়া। ১৯৭৩ সালে গুজরাট কোঅপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন লিমিটেড করা হয় এবং খেড়া ইউনিয়ন আমুল ব্র্যান্ডের দায়িত্ব জিসিএমএমএফ এর হাতে দিয়ে দেয়।
তিনটি ধাপে এই অপারেশন ফ্লাড পরিচালিত হয়।
প্রথম ধাপ চলেছিল ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। তখন পর্যন্ত ভারত দুধ উৎপাদনে মোটামুটি নিচের দেশগুলোর কাতারেই পড়ে আছে। এই ধাপে মূলত দুধের উৎপাদন বাড়ানোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অপারেশনের সাথে জড়িতরা বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে হেঁটে কৃষকদেরকে এক হওয়ার উৎসাহ দিতেন। এর ফান্ডিং মূলত ছিল ইউরোপিয়ান ইকনোমিক কমিটি থেকে। এই ধাপে অতিরিক্ত দুধ সংরক্ষণেও জোর দেওয়া হয়েছিল। একদম গ্রাম লেভেল থেকে দুধ সংগ্রহ করে তা সরবরাহের কাজ করা হতো। জেলা লেভেলের ডেইরি ফার্মগুলো জেলা লেভেল এর সমবায়ের হাতে ছিল। এতটুকু নিশ্চিত করার দরকার ছিল যে, কৃষকদের হাতেই যাতে মূল্য থাকে।
দ্বিতীয় ধাপ চলে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত। এভাবে মূল টার্গেট ছিল প্রোডাকশন আরো বড় করা। এই প্রোগ্রামে ভারতের ২৯০ টি জেলায় ১৩০ টি দুধ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এবং গ্রাম ও শহরের মাঝে ক্রেতাও বিক্রেতার মধ্যে সংযোগ গড়ে উঠে তৈরি হয়েছিল একটি সফল ন্যাশনাল মিল্ক গ্রিড। একই সাথে দুধ সংরক্ষণ ও দুগ্ধ জাত অন্যান্য পণ্য বানানোর ক্ষেত্রেও জোর দেওয়া হয়, দূরের পথে দুধ আনা নেওয়ার ক্ষেত্রেও নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়। এই ধাপের শেষের দিকে ৪৩ হাজার গ্রাম সমিতি থেকে প্রায় সোয়া চার মিলিয়ন দুধ উৎপাদনকারী কৃষক স্বাবলম্বী হন। গুড়া দুধ উৎপাদনের হার ২২ হাজার টন থেকে বেড়ে গিয়ে ১ লক্ষ ৪০ হাজার টনে পরিণত হয়।
তৃতীয় ধাপে ছিল তাদের অবস্থান শক্ত করা এবং দুধ উৎপাদনে নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করে তোলা। এই ধাপে আগেই থাকা ৪২ হাজার গ্রাম সমিতির সাথে আরো ৩০০০০ নতুন সমিতির যোগ হয়। এই ধাপ চলে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত। এর ফলেই ভারত হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদনকারী রাষ্ট্র। এই ধাপে টেকনোলজিক্যাল উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষকদেরকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রেও জোর দেওয়া হয়। দুধ উৎপাদন বাজারজাতকরণ সংক্রান্ত, গবাদি পশু পালন এবং যত্ন, সমবায় চালানো এবং একতা গড়ে তোলা এসব ব্যাপারে কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রোগ্রাম শুরু করা হয়।
হোয়াইট রেভ্যুলেশন সফল হওয়ার পক্ষে যেসব ফ্যাক্টর কাজ করে
১) গ্রাম সমিতিগুলো ছিল হোয়াইট রেভোলিউশনের প্রাণ। কৃষকের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে ঠিকঠাক বাজারের প্রচার ও বিক্রি করতো। এগুলো না থাকলে হোয়াইট রেগুলেশন দাঁড়াতেই পারত না।
২) কৃষকের হাতের ক্ষমতা দেওয়ার কারণে কৃষক নিজেরটা নিজে ভালো বুঝে নেয়, এবং উৎসাহিত হয়।
৩) গরুর থেকে বেশি ও উন্নতমানের দুধ উৎপাদনে ক্রস ব্রিডিং ও আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। এতে বিদেশি উন্নত মানের জাতের সাথে দেশি জাতের ক্রস ব্রিড করে সংকর জাত তৈরি করা হয় যেগুলো উন্নত মানের ও ভালো পরিমাণে দুধ দিত।
৪) ক্রেতার সন্তুষ্টির জন্য প্রতি ব্যাচের দুধ পরীক্ষা করা এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হতো।
৫) সারাদেশে দুধ উৎপাদন ও সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করার উপযোগী সেন্টার তৈরি করা হয় এবং নতুন নতুন কোল্ড স্টোরেজ ও দূরের পথে দুধ পাঠানোর জন্য বিশেষ ধরনের ফ্যাসিলিটিতে ইনভেস্ট করার কারণে দুধের মান ছিল অক্ষুন্ন।
৬) সঠিক ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি বেছে নেয়ার কারণে আমুলের নাম ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে এবং কাস্টমাররাও সন্তুষ্টির কারণে প্রথমেই আমুলকে বেছে নেয়।
৭) মূল প্রোডাক্ট দুধ হলেও বিভিন্ন রকমের ডেইরি প্রোডাক্ট যেমন মাখন ঘি গুঁড়ো দুধ চিজ ইত্যাদিও বাজারজাত করায় দুগ্ধজাত পণ্যের একটা বেশ বড় মার্কেট তৈরি হয়।
হোয়াইট রেভ্যুলেশনকে সফল করে ১৯৯৮ সালে ভারত আমেরিকাকে সরিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুধ উৎপাদনকারী দেশ হয়ে ওঠে। বিশ্ব ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার লোন এর বিপরীতে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতি প্রতিবছরে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গিয়েছে। এত দ্রুত উন্নতির গল্প সাধারণত দেখা যায় না।
আমুলের গঠন
আমুলের গঠন মডেলটাকে আনন্দ ডিজাইন বলেই প্রচার করা হয়। কী রকম এই মডেল, জানা যাক।
তিনটি লেভেলে এই মডেল কাজ করে, এলাকাভিত্তিক, অঞ্চল ভিত্তিক এবং প্রদেশভিত্তিক। এদের কারো মধ্যেই আর্থিক কোনো সংযোগ বা দায়বদ্ধতা থাকে না। আমুল মূলত কোনো একক মালিকানা ভিত্তিক কোম্পানি নয় বরং সারা ভারতের ৩০ লক্ষ কৃষকের কোম্পানি আমুল। সাহায্য, সহযোগিতা ও উপদেশের মাধ্যমে আরো কৃষকদেরকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসছে আমুল। গ্রাম এলাকার সমিতিগুলো মূলত উৎপাদনকারী কৃষকদের জন্য কমিউনিটি। তাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তাদের প্রতি নিজেরা জেলা সমিতি গঠন করেন। এবং প্রদেশভিত্তিক ফেডারেশন মূলত তাদের উৎপন্ন প্রোডাক্ট ডিস্ট্রিবিউশন ও মার্কেটে বিক্রির দায়িত্ব নেয়।
বাটার গার্লের গল্প
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে আমুল যখন নিজেদের ব্র্যান্ড নেইম পেয়ে গেছে, তখন দরকার ছিল একটা স্টং মাসকটের। পোলসন তখনো প্রতিযোগী হিসেবে রয়ে গেছে। টেক্কা দিতে বেশ নজর কাড়া কিছু একটা দরকার। এই চিন্তা মাথায় রেখে আমুলের ক্যাম্পেইন তৈরির দায়িত্ব পাওয়া সিলভেস্টার ডাকুনহা তার ক্রিয়েটিভ হেড ইউস্টেস ফার্নান্দেজ এর সাহায্যে তৈরি করেন হাসিখুশি, নীল চুলওয়ালা, পোলকা ডটের ফ্রক পরা মিষ্টি এক কার্টুন শিশুকে। যার হাতে বাটার টোস্ট এবং চোখে দুষ্টুমি। আমুল বাটার কারণ বলেই পরিচিতি হয় আমুলের সেই মাস্কটের। ১৯৬৬ সালে আমুলের মাস্কট গার্ল প্রথম সবার সামনে আসে। “আটারলি বাটারলি ডেলিশিয়াস”, সিম্পল অফ ক্যাচি এই ট্যাগ লাইনে। হাসিখুশি বাটার গার্ল শুরুতেই মানুষের মন কেড়ে নেয় এবং পরবর্তীতে বড় ভবিষ্যতের জন্য খুটি গেঁড়ে ফেলে। তবে এই হাসি খুশি ইনোসেন্ট চরিত্রটি বাটার গার্লের একমাত্র রূপ নয়। আমুলের সাথে অন্যান্য কোম্পানির তফাৎ হলো, ভারতের যেকোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমুল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে অ্যাডভার্টাইজিং ও বাটার গার্লের মাধ্যমে। ক্রিকেট থেকে শুরু করে রাজনীতি অথবা বলিউড স্ক্যান্ডাল, সবকিছুই নিজেদের অ্যাডভার্টাইজিং এ ব্যবহার করেছে আমুল।
আমুল বাটার গার্ল সবসময়ই ছিল ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। জাতীয় সংস্কৃতি এবং আবেগকে সুন্দরভাবে বিভিন্ন অ্যাডের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে আমুল গার্ল। সব স্তরের সব বয়সের মানুষকে যেমন একসাথে এনেছে, তেমনি মুখ খুলে আলোচনার সুযোগও করে দিয়েছে। যেসব বিষয়ে মানুষ কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে, নির্দ্বিধায় সেগুলোকে এড এর মাধ্যমে সমালোচনা করেছে আমুল গার্ল। বুদ্ধিদীপ্ত শব্দচয়ন এবং শ্লেষাত্মক ব্যঙ্গ ব্যবহার করে আলোচনায় থাকতেও জুড়ি ছিল না বাটার গার্লের। রাজনৈতিক ব্যাপারের পাশাপাশি মি টু মুভমেন্ট, এলজিবিটিকিউ রাইটস, বলিউড এবং পপ কালচার, আইপিএল এর স্পট ফিক্সিং এবং ডোপিং এর স্ক্যান্ডাল ইত্যাদি বিষয়ে আমলের মতামত স্পষ্টই ছিল। এ সম্পর্কে একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করা যায়। ভারতের একজন হীরার বিজনেসম্যান নিরব মোদী ভারতের সবচেয়ে বড় পাবলিক সেক্টর ব্যাংকগুলোর একটা, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের হাইপ্রোফাইল ব্রডক্যাশে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৮ সালে জানা যায় যে নিরব মোদী ও তার অ্যাসোসিয়েটরা জাল কাগজের মাধ্যমে প্রায় দুই বিলিয়ন রুপির ফ্রড করে। এ ঘটনায় আমুল একটা নতুন অ্যাডভার্টাইজমেন্ট লঞ্চ করে, এখানে বাটারকে একটা নেকলেস এর সাথে দেখা যায় এবং ক্যাপশনে ছিল “চোর ইয়েস”, যাতে মজার ছলে নিরব মোদি ও তার ফ্রড করার ঘটনাকেই তুলে ধরা হয়। এটি দেখে নিরব মোদি ক্ষুদ্ধ হন এবং আমুলকে হুমকি দেন এই বলে, যে এই অ্যাডভার্টাইজমেন্ট নামিয়ে না নেয়া পর্যন্ত সে এবং তার কোম্পানির কেউ আমুল বাটার খাবেন না। তবে এর ফলে আমুলের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি বরং বেড়েছে।
বর্তমান বাজারে আমুলের অবস্থান
আমুল বিশ্ববাজারে একটু পিছিয়ে গেলেও ভারতের সবচেয়ে বড় দুধ উৎপাদনকারী সমিতি হিসেবে নিজের স্থান টিকিয়ে রেখেছে। গুণগত মান ঠিক রেখে সামর্থের মধ্যে দাম রাখায় বাজারে আমুলের জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মত।
বর্তমানে মার্কেটে টিকে থাকা শুধুমাত্র দুধ ও দুধের ট্র্যাডিশনাল প্রোডাক্টগুলো দিয়ে সম্ভব নয়। তাই আমুল এই দিকে এনেছে বৈচিত্র্য। বিভিন্ন ফ্লেভারের আইসক্রিম ভারতের বাজারে আমুল বেশ ছড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়াও মিল্ক বেসড বেভারেজগুলো, যেমন কোল্ড কফি, ফ্লেভারড মিল্ক, লাচ্ছি ইত্যাদি প্রোডাক্ট বেশ বড়সড়ভাবেই বাজারজাত করেছে আমুল। এছাড়াও চকলেট, বিস্কিট, বিভিন্ন ইনস্ট্যান্ট ফুড ইত্যাদি প্রোডাক্ট তো বাজারজাত করে বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট এর সাথে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আমুল। এর মাধ্যমে মার্কেটে আমুলের একাধিপত্য গড়ে উঠেছে।
টেকনোলজির দিক থেকেও বেশ এগিয়েছে আমুল। শুধুমাত্র দুধের সাপ্লাই চেন, এবং কোয়ালিটি চেক করতে আধুনিকতার ব্যবহার করেই আমুল থেমে নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় এনগেজ হয়ে মার্কেটিং এর সাথে সাথে ভোক্তাদের সাথে যোগাযোগ করা, কানেকশন তৈরি করা, মতামত নেওয়া ইত্যাদি মডার্ন মার্কেটিং টুলগুলোও বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করে যাচ্ছে আমুল। এর ফলে আগের প্রজন্মের সাথে সাথে নতুন প্রজন্মের মনও আমুল জয় করে নিচ্ছে।
সবশেষে….
আমুলের আজকের এই সাফল্য একদিনের অর্জন নয়। ১৯৪৬ সাল থেকে একদম তৃণমূল অঞ্চল থেকে শুরু করা ছোট্ট একটি প্রোটেস্ট থেকে আজ ভারতের সবচেয়ে বড় দুগ্ধজাত প্রোডাক্ট সাপ্লাই দেয়া কোম্পানি আমুল। উপর মহলের তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং ভেবেচিন্তে নেওয়ার ডিসিশনের কারণেই এটা আজ সম্ভব হয়েছে। ভার্গেস কুরিয়েনকে বলা হয় “ভারতের মিল্ক ম্যান”। যে ঐতিহ্য সংস্কৃতি তিনি শুরু করেছেন, তার উপর ভিত্তি করে আমুল আজ এত বড় হয়েছে, জিতেছে পুরস্কারও। শুধুমাত্র দুধের উপর ভরসা না করে ক্রমাগত এক্সপেরিমেন্ট ও ইনোভেট করেই গিয়েছে। শুধুমাত্র প্রোডাক্ট এর ক্ষেত্রে নয়, ব্যবহৃত টেকনোলজির ক্ষেত্রেও। মূল কথা, গ্রামের যে কৃষক উৎপাদিত দুধের ন্যায্য মূল্য পেতেন না, আর হাতে আঙুল তুলে দিয়েছে ক্ষমতা এবং ন্যায্য পাওনা দুটোই। একতার শক্তি যে কত বেশি, তা আমুলের এই গল্প থেকেই আবারো প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি মার্কেটিং এর মধ্যে দিয়েও মানুষের মন ছুঁয়েছে আমুল।
“আমুল দুধ পিতা হ্যায় ইন্ডিয়া” এর মতো গানই হোক, অথবা কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ব্যঙ্গাত্মক মতামতই হোক, আমুলের বিজ্ঞাপন যে ক্রেতা সাধারণের মন জিতে নিতে পেরেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। একই সাথে অন্যের গুণগত মান এবং জনসমর্থন ধরে রাখা কোনো সহজ কথা নয় কিন্তু এত বছর ধরে আমুল সেটাই করে এসেছে, এবং ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে কাজ করতে যাচ্ছে। পোলসন কোম্পানিকে হারিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে যার যাত্রা শুরু, দেশের গণ্ডি ছেড়ে সে আজ বিদেশেও পা রেখেছে। আমুলের এই গল্প যেন ছোটবেলায় শেখা “একতাই বল” অথবা “দশের লাঠি একের বোঝা” প্রবাদ বাক্য দুটি সত্য প্রমাণ করে দেয়। একটি বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলী পদক্ষেপ কীভাবে অনেকের জীবন বদলে দিতে পারে, আমুল তারই উদাহরণ।