এডিডাস | ১০০ বছর ধরে টিকে থাকা এক অদম্য ব্র্যান্ড

আপনি যদি খেলাধুলার সাথে যুক্ত থাকেন অথবা নাও থাকেন তবুও এডিডাস এর নাম শুনেই থাকবেন। বর্তমান বিশ্বে যত দারুণ ও উন্নতমানের স্পোর্টসওয়্যার তৈরী হয় তার মধ্যে এডিডাস অন্যতম। কারণ গত ১০০ বছর ধরে এই কোম্পানিটি বিভিন্ন চড়াই উতরাই পেরিয়েও ধরে রেখেছে তাদের স্বকীয়তা। আজকে আমরা বিশ্বের অন্যতম পুরোনো এই ব্র্যান্ডটির আদ্যোপান্ত জানবো।

সাধারণ এক শুরু

জার্মানীর ছোট্ট এক শহর বাভারিয়াতে ১৯০০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এডলফ ড্যাসলার। স্কুল শেষ করার পরে তিনি বেকিং এর কোর্স করেন তবে ক্যারিয়ার হিসেবে তিনি এটি বেছে নেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সেখানে যুদ্ধের সময় তিনি জুতা তৈরিতে দক্ষতা অর্জন করেন এবং বাসার পিছনে জুতা মেরামতের একটি দোকান দেন। ১৯২৪ সালে এডলফ ড্যাসলার তার বড় ভাই রুডলফের সাথে মায়ের বাড়িতেই শুরু করেন “ড্যাসলার ব্রাদার্স শু ফ্যাক্টরী”। তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো অ্যাথলেটদের জন্য আরো উন্নতমানের জুতা তৈরি করা। তারা এ সময় টেনিস থেকে শুরু করে ফুটবল সহ সবরকম খেলার জন্য জুতা তৈরী করতে থাকেন। ড্যাসলার ব্রাদার্স এ সময়ে অনেক অ্যাথলেটিক অনুষ্ঠানের জন্য উন্নতমানের স্পাইকড রানিং শু (কাঁটা বা স্পাইকসহ জুতা) তৈরী করেন। এই স্পাইকড অ্যাথলেটিক ফুটওয়্যার এর গুণমান বাড়ানোর হেভি মেটাল স্পাইকের বদলে রাবার এবং ক্যানভাসের স্পাইক ব্যবহার করেন।

এডিডাস এর প্রতিষ্ঠাতা

১৯৩৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে তৎকালীন আমেরিকান স্প্রিন্টার জেসি ওয়েন্সকে তারা তাদের হাতে তৈরী স্পাইক জুতা ব্যবহার করতে রাজি করান। জেসি যখন চারটি সোনা জেতেন এই জুতা ব্যবহারের পর তখন থেকেই মূলত ক্রীড়াবিদরা ড্যাসলার বাদার্স এর এই জুতার প্রতি আগ্রহী হন। এটি এত জনপ্রিয় হয়েছিলো যে ড্যাসলার ভাইয়েরা বছরে প্রায় দুই লাখ জোড়া জুতা বিক্রি করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ড্যাসলার ভাইদের মাঝে মতবিরোধ তৈরী হয় এবং এই মতবিরোধের জন্য দুই ভাই আলাদা হয়ে যান। রুডলফ আলাদা আরেকটি প্রসিদ্ধ কোম্পানি তৈরি করেন যার নাম দেন “পুমা”। এডলফ তাই নিজের নামে প্রথম অংশ এডলফ থেকে “এডি” (ADI) এবং পরের অংশ ড্যাসলার থেকে (DAS) যুক্ত করে “এডিডাস” গঠন করেন, যেটি ১৯৪৯ সালে তিনি অফিসিয়ালি রেজিস্ট্রেশন করেন। ১৯৫২ সালে এডলফ এডিডাস কোম্পানির বিখ্যাত এই তিনটি বার (যেটি তাদের সব পণ্যে ব্যবহৃত হয়) সেটি ফিনল্যান্ডের কোম্পানি “কারহু স্পোর্টস” থেকে ১৬০০ ইউরো ও দুই বোতল হুইস্কির বিনিময়ে কিনে নেন। এটি এতই জনপ্রিয় হয় যে এডিডাস “থ্রি স্ট্রাইপড কোম্পানী” নামেও পরিচিতি পায়।

দুই ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দিতা

স্পোর্টস জগতে “পুমা”র নাম ডাকও একবারে যে কম তা নয়। আলাদা হয়ে যাবার পর শুরু হয় দুই ভাইয়ের মাঝে প্রতিদ্বন্দিতা। এমন কি “হেরজোগেনআওহা” নামের এই শহর দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি দল ছিলো পুমার পক্ষে, অন্যটি এডিডাসের। শহরের দুটি ফুটবল ক্লাবও দুটি কোম্পানিকে আলাদা আলাদা সাপোর্ট করে। শহরটি সে সময় “বাঁকানো ঘাড়ের শহর” হিসেবেও পরিচিতি পায়, কারণ রাস্তায় প্রত্যেকে প্রত্যেকের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতো কে কোন কোম্পানীর জুতা পরে আছে। কথিত আছে রুডলফের বাসায় কেউ এডিডাসের জুতো পরে গেলে তিনি তাকে পুমার এক জোড়া জুতো ফ্রি গিফট করতেন এবং সেটি পরে দেখার জন্য অনুরোধ করতেন। এই প্রতিদ্বন্দিতার আগুনে ঘি ঢালে “পেলে চুক্তি” যেখানে ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের জন্য বিশ্বসেরা এই ফুটবলারের সাথে চুক্তিবদ্ধ না হতে সম্মত হয়। কারণ তাদের দুজনেরই মনে হয়েছিলো যে এত বিখ্যাত একজন খেলোয়াড়ের বিডিং মূল্য অনেক বেশি হবে। তবে রুডলফ এই চুক্তি ভঙ্গ করেন এবং পেলেকে পুমার সাথে স্পন্সারশিপ এ স্বাক্ষরিত করেন। ফলে দুই ভাইয়ের মাঝের সম্পর্ক একরকম ভেঙেই যায়।

এডিডাস ও পুমা

তুমুল সাফল্যের পথে এডিডাস

এডলফের নেতৃত্বে এডিডাস বেশ উন্নতি লাভ করে এবং একটি নাম করা স্পোর্টস ব্র্যান্ডে পরিণত হতে থাকে। এডিডাসের মূল লক্ষ্য ছিলো উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক  ডিজাইনের সাথে উন্নতমানের অ্যাথলেটিক জুতা তৈরী করা। এজন্য এডিডাসের নাম ক্রীড়াবিশ্বে দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে এডিডাস একটি অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করে যখন জার্মানীর জাতীয় ফুটবল টিম এডিডাসের নতুন ধরনের বুট পরে খেলে ফিফা বিশ্বকাপ জেতে। বিশেষ ধরনের এই বুটগুলোর স্পাইকগুলো খোলা যেত, ফলে আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে প্রয়োজনমত এই বুটটি ব্যবহার করা যেত। এই সুবিধার কারণেই ভেজা ও কাদাযুক্ত মাঠেও জার্মান ফুটবল টিম দুটি গোলের একটি ম্যাচ জেতে যা ছিলো অভাবনীয়। এছাড়া এই বুটগুলো বাজারে প্রচলিত বুটগুলোর চেয়ে ওজনে প্রায় অর্ধেকেরও কম ছিল। এই আকস্মিক বিজয় এডিডাসকে বিশ্বব্যাপী পরিচয় এনে দেয় এবং একটি শীর্ষস্থানীয় স্পোর্টস ব্র্যান্ড হিসেবে অবস্থান তৈরী হয়।

এডলফের নেতৃত্বে এডিডাস দারুণভাবে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৬৭ সালে এডিডাস আরো একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়, তারা এবার শুধুই জুতা নয় বরং স্পোর্টসের জন্য উপযুক্ত ও আরামদায়ক পোশাক তৈরির চিন্তাভাবনা করে। এই চিন্তাভাবনা থেকে তারা “ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার” ট্র্যাকস্যুট বাজারে নিয়ে আসে। ফ্রাঞ্জ বাকানবাওয়ার ছিলেন একজন বিশ্ববিখ্যাত জার্মান ফুটবলার। সেসময় ট্র্যাকস্যুটের ধারণাটা ছিলো একবারে নতুন। এডিডাসের এই ট্রাকস্যুটটি ছিল হালকা ওজনের সিনথেটিক ফাইবার দিয়ে তৈরী। এছাড়া তিনটি স্ট্রাইপের দারুণ ফ্যাশনেবল ডিজাইন এটিকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। তবে আসলে এটি জনপ্রিয় হওয়ার জন্য দারুণ একটি আইডিয়া ছিলো ফুটবলার ফ্রাঞ্জ বাকানবাওয়ারের নামে আনা, ফলে এটি পরিচিতি পেয়ে যায় দ্রুত। ফ্যাশানেবল স্পোর্টিং পোশাকের প্রবর্তন এডিডাসের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ১৯৭০ এর দশকে যখন সেখানের সাধারণের মাঝে জগিং এর অভ্যাস গড়ে উঠছিল। যেহেতু ট্র্যাকস্যুটটি ছিল দৌড় ঝাঁপ অথবা যেকোনো স্পোর্টসের জন্য আরামদায়ক, তাই সাধারণ মানুষের মাঝেও জগিং এর সময় এটি পরার প্রবণতা দেখা যায় এবং শুধুই ক্রীড়াবিদ নয় বরং জনসাধারণের মাঝে এটি বহুল ব্যবহৃত হতে থাকে।

৭০ এর দশকে এডিডাস তাদের ক্ষেত্র আরো বড় করতে থাকে। তাদের জুতা বা পোশাক শুধু স্পোর্টস এর জন্য নয় বরং পর্বতারোহণ, ব্যায়াম, জিমন্যাস্টিকস এ ধরনের সকল ক্ষেত্রে যেন ব্যবহার করা যায় সেদিকেই ফোকাস করে তারা। ফলে উত্তোরত্তর জনপ্রিয় হতে থাকে এডিডাসের সকল পণ্য। তাছাড়া ফ্যাশনের চেয়েও এডিডাস চেষ্টা করেছে যেন তাদের পণ্যগুলো হয় আরামদায়ক এবং কাজের। এর মাঝে ১৯৭০ সালে এডিডাস তাদের প্রথম অফিসিয়াল ফুটবল “টেলস্টার” ফিফা ফুটবল ওয়ার্ল্ড এর জন্য নিয়ে আসে। নামটি যেমন টেলস্টার ঠিক তেমনই। এই বলটি বানানোর পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো যেন এটি সাদা কালো টেলিভিশনে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এটি ছিলো এডিডাসের আরো একটি বড় সাফল্য। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ এর অফিসিয়াল ফুটবল স্পন্সর এডিডাস। এছাড়াও এ সময়েই এডিডাস তাদের আইকনিক জুতা “এডিডাস স্ট্যান স্মিথ” এবং “এডিডাস সুপারস্টার” নিয়ে আসে, যা এটিকে সাফল্যমন্ডিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৯৭২ সালের মিউনিখের অলিম্পিকে পুরো বিশ্ব যেন তাকিয়ে ছিলো এডিডাসের দিকে। ঠিক এ সময়েই একটি জার্মান ক্রিয়েটিভ এজেন্সির সাথে ছোট কোলাবোরেটিভ ডিজাইনার টিমের মাধ্যমে এডিডাসের বিখ্যাত ‘ট্রিফয়েল” (একরকম গুল্ম জাতীয় গাছ) লোগো তৈরী করে যার পাতার মাঝে এডিডাসের বিখ্যাত তিনটি স্ট্রাইপ ছিলো। এই লোগোটি এডিডাসের পণ্যগুলোতে ব্যবহার করায় আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এগুলো। ১৯৭২ এর অলিম্পিকে জার্মান অ্যাথলেটসহ বিভিন্ন দেশের অ্যাথলেটরা এডিডাসের স্পর্টসওয়ার এবং জুতা ব্যবহার করেন। হাই জাম্পে তরুণ অ্যাথলেট উলরিক মেফার্থের স্বর্ণ জেতা এবং রাশিয়ার ভ্যালেরি বোর্জভ যখন এডিডাসের জুতা পরেই বিশ্বের দ্রুততম মানব হিসেবে পরিচিতি পান তখনই এডিডাস তার জাত যেন পুরো বিশ্বকে আরো একবার চিনিয়ে দেয়। এরপর রেট্রো যুগের ডিস্কোতেও ছড়িয়ে পড়ল এডিডাসের ট্র্যাকস্যুট। ডান্সফ্লোরে এডিডাস এর বিভিন্ন ট্র্যাকস্যুট এর দেখা পাওয়া ছিলো অতি সাধারণ ঘটনা। এই ৭০ এর দশকে এডিডাস বেশ প্রতিযোগীতার মাঝে ছিলো, বিশেষ করে উদীয়মান ব্র্যান্ডগুলো যেমন নাইকির মতো কোম্পানীগুলোর সাথে।

এডিডাস ট্র্যাকস্যুট

জাদুর জুতো তৈরীর এক কারিগরের বিদায়

এডিডাসের যখন সাফল্য এমন তুঙ্গে ঠিক সেসময় ৭৮ তম জন্মদিনের কিছুদিন আগেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান এডলফ ডেসলার, যিনি প্রায় একাই নেতৃত্ব দিয়ে এডিডাসকে টেনে তুলেছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। যেই মানুষটি পুরো  বিশ্বের কাছে স্পোর্টসওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির ধারণাই বদলে দিয়েছিলেন। এডলফ ড্যাসলারের এই সোনালী যুগ শেষ হয়, শুরু হয় আরেক যুগ। এডলফ ড্যাসলারের পর এডিডাস কোম্পানীর সিইও হিসেবে কর্তৃত্বে আসেন তার স্ত্রী ক্যাথি এবং তার ছেলে হোর্স্ট ড্যাসলার।

নতুন নেতৃত্বে এডিডাস

হোর্স্ট ড্যাসলার কোম্পানির নেতৃত্বে যাওয়ার পর মূলত ফোকাস করেন পোশাকের দিকে। তাছাড়া ৮০ এর দশকে মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে, ফলে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা ও ব্যায়াম শুধুই ক্রীড়াবিদ নয় বরং সাধারণের মাঝেও বেশ প্রচলিত হতে থাকে। তাই ফ্যাশনেবল, হালকা ও আরামদায়ক স্পোর্টসওয়্যার, ট্র্যাকস্যুট এগুলোর চাহিদা বাড়তে থাকে। এ সময় এডিডাসের জুতার সাথে স্পোর্টসওয়্যার এরও জনপ্রিয়তা ও চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৪ সালে এডিডাস মাইক্রোপেসার সম্বলিত স্পোর্টস জুতা এনে সবাইকে চমকে দেয় কারণ তখন কম্পিউটার বা এ জাতীয় জিনিস এত সহজলভ্য ছিল না। এই যন্ত্র পারফরমেন্স এর স্ট্যাটিস্টিক্স দেখাতো। শুধু তাই নয় হিপহপ, স্ট্রিট কিংবা ফ্রি স্টাইল নৃত্যশিল্পী ও গায়কেরাও এডিডাসের ট্র্যাকস্যুট বা বিভিন্ন পোশাক পরে বিখ্যাত করে তোলেন এটিকে। মূলত পরতে হালকা, যার ফলে নাচতে সুবিধা হত, গাঢ় রঙ এবং বোল্ড ডিজাইনের এই পোশাকগুলো তাদের স্টাইলের জন্য ছিল একদম মানানসই। এমন কি আমেরিকান হিপ হপ গ্রুপ “রান ডিএমসি”, “মাই এডিডাস” নামের একটি গানও রিলিজ করে একটি কনসার্টে যেখানে ৪০,০০০ দর্শকের সামনে তারা এডিডাসের জুতা তুলে ধরে। এডিডাসকে স্ট্রিট স্টাইল ও অনুমোদন দেয়, যেটি ছিলো স্পোর্টসওয়্যার কোম্পানি হিসেবে প্রথম নন-অ্যাথলেটিক স্পন্সরশীপ।

মালিকানা পরিবর্তন এবং ধসের কবলে এডিডাস

যদিও এডিডাস ততদিনে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছিল তবুও ১৯৮৭ সালে হোর্স্ট ড্যাসলারের মৃত্যুর পর কোম্পানিটি যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। এরও তিন বছর আগে মারা যান ক্যাথি ড্যাসলার, ফলে এডিডাস হারায় যোগ্য নেতৃত্ব। ১৯৮৯ সালে ড্যাসলার পরিবারের একক মালিকানা হস্তান্তর হয়ে এডিডাস একটি স্টক কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৯০ সালে এডলফ ডেসল্যারের মেয়েরা তাদের শেয়ার সব বিক্রি করে দেন। তারা বের হয়ে যাবার পর ফ্রেঞ্চ ব্যবসায়ী বার্নার্ড ট্যাপি কোম্পানীটি কিনে নেন। তবে ট্যাপি এর সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্ব সঠিক ছিল না। ফলে ১৯৯২ সালে কোম্পানিটি এত রেকর্ড পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয় যে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায়। ব্যাংকের ঋণ সময়মতো শোধ করতে না পারায় ট্যাপি ক্রেডিট লিওনাইস ব্যাংকে কোম্পানিটি নিলামে তুলতে বাধ্য হয়। যদিও ব্যাংকটি সর্বাত্মক চেষ্টা করে ট্যাপির কাছে এডিডাসকে ফিরিয়ে দেয়ার, কারণ ট্যাপি সে সময় ফরাসি সরকারের নগর বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ব্যক্তিগত দেউলিয়া, ম্যাচ ফিক্সিং সহ নানারকম মামলায় ট্যাপি জড়িয়ে পড়েন ও জেলে যান। ১৯৯৪ সাল থেকে ট্যাপির বন্ধু রবার্ট লুই-ড্রেফাস এডিডাসের নতুন সিইও হলে, ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্রেডিট লিওনাইস ব্যাংক এটি ২.৮৫ বিলিয়ন ফ্রাঙ্কের বিনিময়ে তাকে পূর্ণ মালিকানা দেয়, যা ছিল ট্যাপির পাওনা ৪.৪৪৮৫ বিলিয়ন ফ্রাঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি।

বার্নার্ড ট্যাপি

হারানো জৌলুস ফিরে পাওয়া

রবার্ট লুই-ড্রেফাসের নেতৃত্বে এডিডাস আবার তার হারানো জৌলুস ফিরে পেতে শুরু করে। এডিডাসের সবচেয়ে ক্লাসিক জুতোগুলোর মধ্যে কয়েকটি সে সময়ে আবারও উৎপাদন করা শুরু হয়। এগুলো ব্রিটপপ তারকা, হিপ হপ স্টারদের মাঝে আবারও তুমুল সাড়া ফেলতে থাকে। কারণ লুইসের পার্টনার ক্রিশ্চিয়ান টরেস অনুধাবন করেন যে এডিডাসের নতুনত্ব দরকার নেই বরং যেটি ইতিমধ্যে বিখ্যাত আছে সেটিকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। ১৯৯৫ সালে কর্পোরেশন হওয়ার ছয় বছর পর পাবলিক কোম্পানি হয়। এসময় এডিডাসের আরো একটি ভালো সিদ্ধান্ত ছিল ছোট ছোট স্পোর্টস কোম্পানি কিনে মার্কেট দখল করা। এর মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিল সলোমন ক্রয় করা। এই কোম্পানিটি কেনার ফলে সলোমন, টেইলরমেড, ম্যাভিক এবং বনফায়ারের মত ব্র্যান্ড এডিডাসের আওতায় চলে আসে। এগুলো ছিল স্কাই ডাইভিং এর সরঞ্জাম, গলফ এর সরঞ্জাম ও পোশাক তৈরীর কোম্পানী। এই কোম্পানীর গ্রুপটির নাম হয় সলোমন-এজি। সলোমন এজি অনেক দ্রুত স্টক মার্কেট দখল করতে সফল হয় এবং এডিডাসকে আবার তার আগের জায়গায় ফিরে আসতে সাহায্য করে। লুইস অত্যন্ত সক্ষমতার সাথে এডিডাসের লভ্যাংশ প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি করেন ১৯৯৩ সাল ত্থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। ২০০০ সালে অসুস্থতার জন্য লুইস রিজাইনের ঘোষণা দেন। তার জায়গায় সিইও হিসেবে আসেন হার্বার্ট হেইনার।  ২০০৪ সালে ইংলিশ ফ্যাশান ডিজাইনার স্টেলা ম্যাকাথি এডিডাসের সাথে কোলাবোরেট করে একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার লাইন যেখানে মেয়েদের জন্য স্পেশাল স্পোর্টসওয়্যার ডিজাইন করা হয়। ২০০৬ সালে সলোমন এজি বিক্রি করে এডিডাস এবং সে সময়ের জনপ্রিয় আরেকটি স্পোর্টসওয়্যার কোম্পানি রিবক কিনে নেয়। এই বছরেই “এডিডাস ১” নামের বিশ্বের প্রথম ইন্টেলিজেন্ট জুতা নিয়ে আসে এডিডাস, যেটিতে ছিলো একটি মাইক্রোপ্রসেসর, যা প্রতি সেকেন্ডে ৫ মিলিয়ন ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে জুতোকে আবহাওয়া অনুযায়ী ব্যবহারযোগ্য করে তুলতো। এটি একটি রিপ্লেসেবল ব্যাটারির সাহায্যে চলত, যা ১০০ ঘন্টা দৌড়ানো পর্যন্ত কাজ করতো। ২০০৬ সালে এডিডাস ১১ বছরের চুক্তি করে এনবিএ এর সাথে তাদের অফিসিয়াল পোশাক সাপ্লায়ার হিসেবে। সেই সাথে এটি এনবিএ,এনবিডিএল এবং ডাব্লিউএনবিএ এর অফিসিয়াল জার্সি তৈরী করে থাকে।

বর্তমানে এডিডাস

বর্তমানে এডিডাসের গ্লোবাল কর্পোরেট হেডকোয়ার্টার আছে হেরজোগেনআওহা, জার্মানীতে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত জায়গা যেমন লন্ডন, পোর্টল্যান্ড, টরোন্টো, টোকিও, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, স্পেনের মত জায়গাতেও আছে বিজনেস কোয়ার্টার। হার্বার্ট হেইনার প্রায় ১৫ বছর এই কোম্পানিটিকে আগলে রাখার পর মারা যান। এরপর ২০১৬ সালে সিইও হিসেবে আসেন ক্যাসপার রোরস্টেড যিনি এই কোম্পানিটিকে নিয়ে যান ডিজিটাল যুগে। ২০২২ সালে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড গুচি এর সাথে কোলাবোরেট করে এডিডাস। এছাড়া বিশ্বের প্রথম স্পোর্টসওয়্যার অ্যাপসও লঞ্চ করে এডিডাস। ২০২৩ সালে এডিডাসের নতুন সিইও হয়ে আসেন বিয়ন গুল্ডেন। বর্তমানে কোম্পানিটির মূল্য ৪৫.১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে কোম্পানীটি ৪২০ মিলিয়ন জোড়া জুতা বিক্রি করেছে এক বছরে।

এডিডাস

এডিডাসের বর্তমান ট্যাগলাইন হলো ‘Impossible is nothing” এবং এই সত্যটি এডিডাস কোম্পানি বারবারই প্রমাণ করেছে। ভাইয়ের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা থেকে শুরু করে হালের বড় কোম্পানি নাইকি- সবার সাথেই বার বার প্রতিযোগীতা করেছে এডিডাস এবং জিতেছে। প্রায় ১০০ বছর ধরে নানা চড়াই উতরাই পেরিয়েও ধরে রেখেছে নিজের অবস্থান। বিভিন্ন সময়ের বিখ্যাত সব ক্রীড়াবিদ ছাড়াও নায়ক, নায়িকা গায়ক, গায়িকা সকলের মন জয় করেছে এই ব্র্যান্ডের নানা জিনিস। স্ট্রিট ফ্যাশন থেকে স্পোর্টসওয়্যার- সবখানেই জয় করেছে এডিডাস। এডলফ ড্যাসলার কখনো একটি বিজয়ে থেমে যাননি বরং আরো উন্নত করার জন্য সবসময় কাজ করেছেন। তিনি বলতেন,- “কৃতিত্ব নিয়ে কখনো সন্তুষ্ট হবেন না, সবসময় শিখতে থাকুন।” তার এই চিন্তাধারার জন্যই তিনি কখনো থেমে থাকেননি। তাই আজও ১০০ বছর পরও তারই দেখানো পথেই নিরন্তর এগিয়ে চলেছে তার স্বপ্নের ‘এডিডাস”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *