ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডন যাওয়ার ট্রেন যখন চার ঘন্টা দেরি করে ফেলে, সেই ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত জোয়ান রাউলিং (জে কে রাউলিং) নামের একজন মধ্যবয়সী নারী বুনে ফেলেন একটি গল্পের জাল। তিনি তখনো জানতেন না এই গল্প একদিন বিশ্বের ছোট থেকে বড়, কিশোর কিশোরী থেকে বৃদ্ধ সবাইকে মুগ্ধ করবে, তৈরি হবে আলাদা ফ্যানডম। বলছি হ্যারি পটারের কথা। ১২ জন প্রকাশক থেকে ফেরত যেয়ে অবশেষে হ্যারি পটারের পান্ডুলিপি ব্লুমসবেরী নামক একটি ছোট্ট প্রকাশনার চেয়ারম্যান নিগেল নিউটনের হাতে পড়ে। যেই পান্ডুলিপিটি পড়ে তার ১১ বছরের মেয়ে বইটি প্রকাশ করার জন্য তার বাবার কাছে অনুরোধ করে। প্রথমে শিশুতোষ বই হিসেবে প্রকাশ করলেও এটি সব বয়সের সকল বইপ্রেমীদের কাছে হয়ে ওঠে অত্যন্ত প্রিয়। হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়ায় ভেসে থাকে বিশ্বব্যাপী সবাই। আর এরই ধারাবাহিকতায় একে একে প্রকাশিত হয় হ্যারি পটার সিরিজের ৭টি বই। এত দারুণ গল্পকে বড় পর্দায় আনেন বিশ্বখ্যাত ওয়ার্নার ব্রাদার্স, যা তৈরি করে হ্যারি পটারের আলাদা একটি জগৎ। মূলত এর পর থেকেই হ্যারি পটারের ভক্তদের জন্য এসকল সিনেমা শুটিং এর স্থান, বইয়ে উল্লেখিত স্থানগুলো হয়ে ওঠে বিখ্যাত। আজকে জেনে নিবো “মাগল” বিশ্বে থাকা সেই জাদুর দুনিয়ার সেইসকল স্থানসমূহ, যা একজন হ্যারি পটার ফ্যান বা পটারহেডকে অল্প সময়ের জন্য হলেও হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়া তে নিয়ে যাবে।
হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়া
৪ প্রিভেট ড্রাইভ, লিটল হুইংগিং, পিকেট পোস্ট ক্লোজ, বার্কশায়ার, ইংল্যান্ড
প্রথমেই দেখে নিবো জাদুকর হ্যারি মানুষ বা মাগলদের দুনিয়ায় কোথায় থাকে? অনেকের মনে হতে পারে এটি হয়তো নিছক গল্পে লেখার ছলে অথবা পর্দায় সেট তৈরি করে দেয়া। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই ঠিকানাটি ইংল্যান্ডের বার্কশায়ারে সত্যিই আছে এবং এটি একটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তি। ওয়ার্নার ব্রাদার্স এখানে “হ্যারি পটার এন্ড দ্যা ফিলোসফার্স স্টোন” এর জন্য শ্যুটিং করে।
প্ল্যাটফর্ম 9¾, কিংস ক্রস স্টেশন, লন্ডন
এবার ঢুকে পড়া যাক হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়ার দুয়ারে। হগওয়ার্টস স্কুল অফ উইচক্রাফট এন্ড উইজার্ডিতে পৌঁছাতে হলে যেতে হবে ট্রেনে, আর সেই ট্রেনের জন্য ঢুকতে হবে “নাইন এন্ড থ্রি কোয়ার্টার” এ – যা প্লাটফর্ম তিন এবং প্ল্যাটফর্ম চার এর মাঝামাঝি জায়গায়। সিনেমার শ্যুটিং হয় লন্ডনের কিংস ক্রস স্টেশন এ, তারপর থেকেই ভক্তদের সেখানে আনাগোনা। ভক্তরা অনেকবার নিশ্চয়ই দুই দেয়ালের মাঝ থেকে ঢুকে যেতে চেষ্টাও করেছেন! তবে এখন গেলে আপনি হ্যারি পটারের সেই বই ভরা ট্রলি দেখতে পাবেন, যা দেয়ালের অর্ধেক ভেতরে আছে। তাই প্রিয় হগওয়ার্টস হাউজের পোশাক পরে সেই জাদুর দুনিয়ার একটু ছোঁয়া পেতে চলে যেতে পারেন লন্ডনের কিংস ক্রস স্টেশনে।
গথল্যান্ড রেলওয়ে স্টেশন, নর্থ ইয়র্কশায়ার, ইংল্যান্ড
ইংল্যান্ডের এই রেলওয়ে স্টেশনটি হ্যারি পটার সিনেমায় দেখা যায় “হগসমেড স্টেশন” হিসেবে। ১৮৬৫ সালে নির্মিত এই প্রাচীন রেলওয়ে স্টেশনটি হ্যারি পটার ফ্যানদের জন্য একটি অন্যরকম আবেগের জায়গা। তাই ইংল্যান্ড এর রেলওয়ে স্টেশনটি হ্যারি পটার ফ্যানদের দর্শনীয় স্থানের তালিকায় থাকতেই পারে।
আলেনউইক ক্যাসেল, আলেনউইক, ইংল্যান্ড
মনে আছে হ্যারি পটার এন্ড দ্যা ফিলোসফারস স্টোন এর সেই দৃশ্যটি যেখানে ব্রুমস্টিক বা ঝাড়ুর উপর চড়ে উড়ে বেড়ানো শিখে হ্যারি পটার আর তার বন্ধুরা? সেই দৃশ্যে যে ক্যাসেল বা প্রাসাদটি দেখা যায় তা আলেনউইক ক্যাসেল নামে পরিচিত। ১১ শতকের দিকে নির্মিত এই প্রাচীন প্রাসাদটির মাঠেই আমরা দেখতে পাই হ্যারি কুইডিচ খেলাও শিখে। ব্রুমস্টিকে উড়তে না পারলেও সেই অনুভূতির কিছুটা স্বাদ নেয়ার জন্য হলেও দেখতে যেতে পারেন প্রাচীন এ প্রাসাদটি।
উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড অফ হ্যারি পটার, থিম পার্ক, ক্যালিফোর্নিয়া (ইউনিভার্সাল স্টুডিও), ফ্লোরিডা এবং জাপান (হলিউড, বেইজিং)
এতক্ষণ তো গেলো শ্যুটিং স্পটের কথা, এখন যদি সত্যি সত্যি হ্যারি পটারের জাদুর রাজ্যে ঢুকে পড়া যায় তাহলে কেমন হয়? বিশ্বব্যাপী হ্যারি পটার ফ্যানদের এই আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে ইউনিভার্সাল স্টুডিও ও ওয়ার্নার ব্রাদার্স মিলে তৈরি করেছে থিম পার্ক “উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড অফ হ্যারি পটার”। কী নেই এই থিম পার্কগুলোতে! হোগমেড থেকে শুরু করে ডায়াগন এলি, কিংবা থ্রিডি ম্যাজিকাল রাইড থেকে লাইভ শো- সবই আছে এখানে।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ফ্লোরিডা এবং জাপানের বেইজিং শহরের হলিউডে অবস্থিত এই থিম পার্কগুলো পটারহেডদের জন্য সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্থান। এই থিম পার্কগুলোতে আছে ডায়াগন এলি যেখানে “ওলিভিয়েন্ডারস ওয়ান্ড শপ” বা ওলিভিয়েন্ডারের জাদুর কাঠির দোকান, “উইজলিস উইজার্ড উইজেস” কিংবা লিকি কাল্ড্রন এর মতো নামকরা দোকানগুলো। ওয়ান্ড শপ এ জাদুর কাঠি পছন্দ করার জাদু দেখতে পারবেন। সেই সাথে কিনতেও পারবেন জাদুকাঠি, যা দিয়ে পুরো পার্কেই নানারকম স্পেল বা মন্ত্রের সাহায্যে নানারকম আকর্ষণীয় জাদু দেখানো হয়। এই পার্কে পাবেন হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস, সেই ধোঁয়া ওঠা জাদুর ট্রেন। এই ট্রেনে করে পৌঁছে যেতে পারবেন হগওয়ার্টস এ। আর এই রাইডের মাঝে দেখা পাবেন নানা পরিচিত ক্যারেক্টার, প্রাণী কিংবা উইজার্ড ও উইচদের। এখানে আছে হগসমেড গ্রাম, আছে বাটারবিয়ার খাওয়ার জন্য শপ। এমন কি পুরো পার্কেই হ্যারি পটার দুনিয়ার নানারকম প্রাণী আর চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। এছাড়াও আছে রোলার কোস্টার রাইড “ফ্লাইট অফ হিপ্পোগ্রিফ”, আছে “হ্যাগরিডস ম্যাজিক্যাল ক্রিয়েচার মোটর বাইক রাইড” যা ফরবিডেন ফরেস্ট এর মধ্য দিয়ে এক অবিস্মরণীয় যাত্রায় নিয়ে যায়। এছাড়াও নানারকম খাবার, স্যুভেনিওর, লাইভ শো ইত্যাদি তো রয়েছেই৷ প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৭০ ডলারের বিনিময়ে আপনি ঘুরে আসতে পারবেন এই থিম পার্কগুলোতে। তাই আপনি যদি হন পটারহেড, তবে আপনার পরবর্তী ভ্রমণের তালিকায় জায়গা করে নিতেই পারে এই পার্কগুলোর যেকোনো একটি।
ওয়ার্নার ব্রাদার্স স্টুডিও ট্যুর, লন্ডন, ইংল্যান্ড
ওয়ার্নার ব্রাদার্স স্টুডিও নানারকম বিখ্যাত সব সিনেমার সেট ও প্রপ্স দিয়ে পরবর্তীতে দর্শনার্থীদের জন্য এক্সিবিশন ও ট্যুর আয়োজন করে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় বাদ যায়নি তুমুল জনপ্রিয় হ্যারি পটার সিরিজও। হ্যারি পটার সিরিজের নানারকম মিনিয়েচার সেট, সত্যিকারের প্রপ্স (আলাদাভাবে বানানো নানারকম সাজ সরঞ্জাম যা সিনেমা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়) এবং অন্যান্য সকল জিনিসের এক্সিবিশন দেখতে পারবেন এই স্টুডিওতে। এটি ইংল্যান্ডের হার্ডফোর্ডশায়ার এর লিভসডেন এ অবস্থিত। স্টুডিও এই ট্যুর আপনাকে হেঁটেই দেখতে হবে। নানারকম ভাগে বিভক্ত এই স্টুডিও ট্যুরে আপনি দেখতে পারবেন এই জাদুময় সিনেমার পেছনের যাদু। কীভাবে অসম্ভব এই জাদুময় দুনিয়া আমরা পর্দায় দেখেছি তার সবটাই দেখতে পারবেন এই স্টুডিও ট্যুরে। প্রতিদিন প্রায় ৬০০০ এর বেশি পর্যটক এই স্টুডিও ট্যুরে আসে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। ওয়ার্নার ব্রাদার্স এর ওয়েবসাইট থেকেই এই ট্যুরের জন্য টিকেট বুক করা যায়। টিকিটের জন্য আছে নানা রকম প্যাকেজও। তাই ব্যাটে বলে মিলে গেলে একবার ঘুরে আসতেই পারেন জাদুর এই দুনিয়ায়।
হ্যারি পটার থিমড ক্যাফে
পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হ্যারি পটার এবং এর আশেপাশের দুনিয়া নিয়ে তৈরি নানারকম ক্যাফে। এসকল ক্যাফেতে গেলে নানারকম মুখরোচক খাবারের পাশাপাশি হ্যারি পটারের জাদুময় পরিবেশের ছোঁয়া পাবেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম সুন্দর ও ব্যস্ততম শহর সিউলের হোংডেতে পাবেন ৭ তলা বিশিষ্ট “৯৪৩ কিংস ক্রস” ক্যাফে৷ এই ক্যাফেটি আপনাকে হ্যারি পটারের দুনিয়ায় সফর করিয়ে আনবে। সাত তলা বিল্ডিং এর পুরোটাই হ্যারি পটার দুনিয়ার নানা জিনিসের আদলে তৈরি। এখানের সাজসজ্জা এত সমৃদ্ধ যে তা ওয়ার্নার ব্রাদার্স এর স্টুডিও ট্যুরের ছোট ভার্সন বলে চালিয়েই দেয়া যায়। এখানে দেখতে পাবেন ডায়াগন এলির প্রতিকৃতি, দেখতে পাবেন “মিরর অফ এরিসেড”, আছে হ্যারি পটার থিম ব্যাংকুয়েট হল কিংবা অলিভিয়েন্ডারের জাদুর ছড়ির দোকানের আদলে তৈরি ঘরও। পাবেন উইজার্ড ক্যাফে ও উইজার্ড ডর্মিটরি। তাই সিউল ভ্রমণের সময়, হ্যারি পটারের ফ্যান হলে অবশ্যই ঘুরতে ভুলবেন না এই অসাধারণ ক্যাফেটিতে।
আর যদি কখনো ঘুরতে যান সিঙ্গাপুর, সেরাঙ্গুন রোড এ পেয়ে যাবেন “প্ল্যাটফর্ম ১০৯৪”। এই ক্যাফেটি শুধু যে তাদের খাবার দিয়েই মুগ্ধ করবে আপনাকে তাই নয়, বরং হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়ায় হারিয়ে যেতেও আপনাকে সাহায্য করবে।
হ্যারি পটারের জাদুময় দুনিয়াতে ঘুরে আসতে পারবেন “দ্যা উইচেস ব্রিউ ডাইনার্স”, ফিলিপাইনে। হ্যাঁ, ফিলিপাইনের এই ক্যাফেটি পুরোটাই যেন হ্যারি পটারের স্বপ্নের জগৎ কে আপনার চোখের সামনে এনে দিবে। এই ক্যাফেটিও নানা দেশের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
মং কক, হংকং এও পাবেন হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়ায় ঘুরতে ঘুরতে মুখরোচক খাবারের স্বাদ নেয়ার সুযোগ। ক্যাফেটির নাম ৯ ৩/৪ ক্যাফে (9 ¾ cafe)। ক্যাফেটি হংকং এ পটারহেডদের কাছে কিন্তু বেশ জনপ্রিয়।
ইন্ডিয়ার চেন্নাই আমাদের খুব একটা অপরিচিত জায়গা। এই পরিচিত শহরেই শাস্ত্রীনগর এ “অ্যালোহোমোরা” নামের ক্যাফেটি শুধু সাজসজ্জা নয় বরং খাবারের ক্ষেত্রেও আপনাকে দিবে হ্যারি পটারের জাদুর ছোঁয়া। খাবারগুলো হ্যারি পটার সিরিজের পরিচিত সব খাবার বা জিনিসের নামে ও আকৃতিতে তৈরি। তাই চেন্নাই ঘুরতে ঘুরতে এক বিকেলে ঘুরে আসতেই পারেন জাদুর এই ক্যাফেটিতে।
বিশ্বের প্রায় সব নাম করা শহরগুলোতে এখন হয়তো খুঁজলেই পাওয়া যাবে এমন নানারকম ক্যাফে বা ছোট ছোট জাদুময় স্থান, যা শুধুমাত্র একজন উইচ বা উইজার্ডরাই খুঁজে পাবে। তাই নিজেকে হ্যারি পটারের দুনিয়ায় সামিল করতে পৃথিবীর নানা প্রান্তে খুঁজতে যেতেই পারেন এ সকল জাদুর স্থানগুলো। নিজেকে আবিষ্কার করতে পারেন স্বপ্নের এই জাদুর দুনিয়ায়।
ছবি – সংগৃহীত