বর্তমান পৃথিবীতে অনেক কিছুই উন্নত হয়েছে, সাথে সাথে দূরত্বের বাধাও অনেকটাই কেটে গিয়েছে। প্রযুক্তির বদৌলতে মুহূর্তের মধ্যেই পৃথিবীর ওইপাশের খবর আমরা পেয়ে যাচ্ছি। একদেশের উৎপাদিত পণ্য, সেবা, প্রযুক্তি অন্য দেশে বসেও আমরা উপভোগ করতে পারছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে যে কফির কাপে আমরা চুমুক দিচ্ছি, সেই কফি অন্য দেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত হয়ে আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। এমনকি আমাদের দেশে সযত্নে উৎপাদিত চা হয়তো সুদূর ব্রিটেনে কোন রেস্টুরেন্টে শোভা পাচ্ছে। এর প্রায় সবকিছুই গ্লোবালাইজেশনের ফলাফল। শুধুমাত্র পণ্য আমদানি রপ্তানি নয়, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে গ্লোবালাইজেশন।
গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন বলতে আমরা আসলে কি বুঝি? গ্লোবালাইজেশন হচ্ছে এমন একটি ধারণা, যাতে পুরো পৃথিবীকে একটি অভিন্ন এলাকা বা গ্লোবাল ভিলেজ হিসেবে দেখা হয়। এটি সারা বিশ্বের মধ্যে সংস্কৃতি, মনোভাব ও ও প্রযুক্তি বিস্তার ও বিকাশের এক অনন্য উপায়। এর ফলে সমগ্র বিশ্ব প্রায় হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। তবে এর যেমন সুবিধার দিক আছে, তেমন অসুবিধাও আছে। যদিও সব ক্ষেত্রে বেশ ভালোভাবেই প্রভাব ফেলে চলেছে বিশ্বায়ন, আমরা আজকে মূলত এর ব্যবসায়িক এবং অর্থনৈতিক দিকটা নিয়েই আলোচনা করব, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে।
গ্লোবালাইজেশন কি আমাদের জন্য অভিশাপ, না আশীর্বাদ?
গ্লোবালাইজেশনকে আসলে আমরা একপাক্ষিকভাবে ভালো বা মন্দের খাতায় ফেলে দিতে পারি না। এটি তেমন কোনো প্রক্রিয়াও নয় যেটাকে আমরা মোটা দাগে কোনো এক দিকে ফেলে দিতে পারব। গ্লোবালাইজেশন যখন হয়, তখন সেটা প্রায় সবকিছুর উপরেই প্রভাব ফেলে। প্রত্যেক দেশেরই কিছু নিজস্ব আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, ব্যবহার প্রচলন ইত্যাদি থাকে। আর গ্লোবালাইজেশন এসব কিছুর উপরে বেশ প্রভাব ফেলে। তবে এর ফলে যে বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায় তাকেও অস্বীকার করা যায় না। গ্লোবালাইজেশন এর মাধ্যমে যেমন আমরা অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হচ্ছি, তেমন অন্যান্য দেশের অন্যান্য সংস্কৃতির মানুষেরাও আমাদের সংস্কৃতির সম্পর্কে জানতে পারছে। আমরা যেমন বাইরের দেশের তৈরি প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, তারাও হয়তো আমাদের দেশে উৎপন্ন পাটজাত দ্রব্য, চা ও জামদানি শাড়ির প্রশংসায় মুখর হচ্ছে।
সর্বোপরি, গ্লোবালাইজেশনকে আমরা একটি টু ওয়ে স্ট্রিট হিসেবেই দেখতে পারি। এর সুফল কুফল দুটোকেই আসলে মেনে নিতে হবে, এবং একে কাজে লাগিয়ে কীভাবে দেশের আরও উন্নতি করা যায়, আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই সুবিধাকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সে সম্পর্কেই আমরা মূলত আলোচনা করব।
অর্থনৈতিক দিক ও এসএমই ( ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) এর ক্ষেত্রে গ্লোবালাইজেশন কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন বেশ বড় প্রভাব ফেলেছে। গ্লোবালাইজেশনের মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে গিয়েছে। বিশাল বড় একটা মার্কেট এখন খুলে গিয়েছে, যার সুযোগ উদ্যোক্তারা বেশ ভালোভাবেই নিতে পারেন। এছাড়াও ইন্টারনেট ও অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তিও হাতের মুঠোয় চলে আসায় যোগাযোগও খুব সহজ হয়ে গেছে, যে কারণে প্রচারণা ও বিজ্ঞাপনও খুব সহজ হয়ে গেছে। এছাড়াও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো থাকায় ব্যবসার আরো নতুন নতুন অনেক দিক প্রসারিত হয়েছে। তবে এর ফলে প্রতিযোগিতাও বিভিন্নভাবে বেড়ে গিয়েছে, তাই এসব দিকেও লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের।
গ্লোবালাইজেশনের পজিটিভ দিক
১. মার্কেট ও ইকোনোমি বড় হওয়া
গ্লোবালাইজেশন এর সবচেয়ে বড় সুবিধা আমরা যেটা বলতে পারি সেটা হচ্ছে মার্কেট এবং কাস্টমার বেড়ে যাওয়া। যেহেতু দেশের সীমান্তের মধ্যে আর কিছুই সীমাবদ্ধ থাকে না, তাই উদ্যোক্তারা নিজেদের পরিচিত গণ্ডির বাইরে ও বেশ বড় একটা সম্ভাবনাময় কাস্টমার বেশ পেয়ে যেতে পারেন। তারা যদি ঠিকভাবে অ্যাডভার্টাইজিং করতে পারেন, এবং ঠিকঠাকভাবে সাপ্লাই দিতে পারেন, তাহলে এমন সম্ভাবনা রয়েছে যে সারা বিশ্বেই তাদের প্রোডাক্টের ক্রেতা বেড়ে যেতে পারে। এমনকি এই সুযোগ রয়েছে বিশ্বসেরা ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়ারও। অ্যাপল, নাইকি, নেসলে, রোলেক্স, ম্যাকডোনাল্ডস সহ আরো অনেক ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডের চাহিদা ও সাফল্যই তা প্রমাণ করে। যেমন, বাংলাদেশও তৈরি পোশাক শিল্পে খ্যাতি অর্জন করেছে, এবং অনেক বড় বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকেই তাদের প্রাইমারি প্রোডাক্ট সোর্সিং করে থাকে।
এছাড়াও গ্লোবালাইজেশন এর সাথে এমন একটি সুযোগ এসেছে যা একেবারেই নতুন এবং সম্পূর্ণভাবে প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত। সেটি হল ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম। অ্যামাজন, ইবে, আলিবাবা, ইটসি এসব প্লাটফর্মের নাম আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। এসব প্ল্যাটফর্মে শুধু বড় বড় ব্র্যান্ড নয়, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তারাও নিজেদের পণ্যের প্রচার করতে পারেন, আমতা বিশ্বব্যাপী বিক্রিও করতে পারেন। এতে ক্রেতারও সুবিধা হয়, একই প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন রকমের বিভিন্ন দেশের প্রোডাক্ট পেয়ে যান ঘরে বসেই। এর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশেরও উন্নয়ন হয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানি হলে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে, যার ফলে দেশীয় আয় বৃদ্ধি পায়, এবং উন্নতির সম্ভাবনা থাকে।
২. প্রযুক্তি ও তথ্যের সহজলভ্যতা
এ কথা আমাদের মেনে নিতেই হবে যে গ্লোবালাইজেশনের একটা অন্যতম প্রভাব হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির খুব দ্রুত উন্নতি। আজ থেকে ৫-১০ বছর আগেও যেসব জিনিস চিন্তা করা যেত না, সেসব আজ আমরা ঘরে বসেই করে ফেলতে পারছি। এর ফলে উদ্যোক্তারাও বেশ উপকৃত হয়েছেন। বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি ও মেশিনারির আবিষ্কার উৎপাদনকে সহজ করেছে, একই সাথে, পরিশ্রমের জায়গাগুলো কমিয়ে এনেছে। যেসব পরিশ্রমের ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো আগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনো মানুষকে করতে হতো, সেসব জায়গায় এখন মেশিন ও রোবটের ব্যবহার করে ঝুঁকি কমিয়ে আনার সাথে সাথে কাজও সহজ হয়েছে। একই সাথে প্রোডাকশন কস্টও কমে গিয়েছে। ফলে উদ্যোক্তাদের কাজ আরও সহজ হয়েছে।
প্রযুক্তির আরেকটি উপহার হচ্ছে ডিজিটালাইজেশন। এর ফলে আমাদের সকল ক্ষেত্রেই চলে এসেছে আধুনিকতা, মার্কেটিং এর ক্ষেত্রেও এটি ভুল নয়। ডিজিটাল মার্কেটিং কথাটা সম্ভবত আমরা সবাই শুনেছি। এটি বর্তমানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল মার্কেট এর ব্যবহারে আপনি আগের চেয়ে সহজে আপনার টার্গেট কাস্টমারের কাছে পৌঁছে যেতে পারবেন, এছাড়াও বিভিন্ন ডেটা অ্যানালাইসিস করে কাস্টমারের চাহিদা, ইচ্ছা, পছন্দকে বুঝতে এবং সে অনুযায়ী প্রোডাক্ট বা সার্ভিস ডেলিভারি করতে পারবেন। আগে যা করতে অনেক লোকবলের দরকার ও টাকা খরচ হতো, কয়েকটা ক্লিকের মাধ্যমেই এখন সেসব আপনার হাতের মুঠোয় এসে পড়ছে, এবং আপনি যেকোনো জায়গা থেকেই উপভোগ করতে পারছেন সেসব সুবিধা।
৩. নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি
বেকার সমস্যা অনেক আগে থেকেই বেশ বড় একটি সমস্যা, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং জনবহুল একটি দেশের জন্য। তবে গ্লোবালাইজেশন এর সাহায্যে এই সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান রয়েছে। ছোট ছোট কোম্পানি বড় হওয়ার মাধ্যমে যেমন স্থানীয়ভাবে চাকরির সুযোগ বাড়ছে, তেমনি বর্তমানে রিমোট ওয়ার্ক এবং ওয়ার্ক ফ্রম হোম জনপ্রিয় হওয়ায় চাকরির ক্ষেত্রে দূরত্ব বা সীমান্ত এখন আর কোনো বাধা নয়। তাই দেশে বসেই অন্য দেশের চাকরিও করা যাচ্ছে সহজেই। এর ফলে স্থানীয় এবং জাতীয় দুই ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, একই সাথে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও সক্ষম জনশক্তিকে কাজে লাগানোর একটা উপায় পাওয়া গিয়েছে। বেকারত্ব সমস্যা কমে যাবার সাথে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসারও একটা সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
৪. বিদেশি ইনভেস্টরদের দৃষ্টি আকর্ষণ
বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলোর জন্য বিদেশি ইনভেস্টরদের আকর্ষণ করা বেশ লাভজনকই বটে। দেশের সম্পদ সীমিত হলেও বিদেশি বিনিয়োগ যখন আসে তখন সম্ভাবনার খাত বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা তাদের পুঁজির অভাবে আটকে থাকা উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে পারেন বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে। এ ছাড়াও নতুন নতুন উদ্যোগও বেশ সফলভাবে গড়ে উঠতে পারে। যেমন- বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর, অথবা ইউনিলিভার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, গ্রামীণফোন এর মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি।
গ্লোবালাইজেশনের নেগেটিভ দিক
গ্লোবালাইজেশন এর পজিটিভ দিকগুলো আমরা উপরে আলোচনা করেছি, তবে এগুলোই কিন্তু সব নয়। বিপুল পরিমাণ সুযোগ সুবিধা এনে দেওয়ার সাথে সাথে লোকাল বিজনেসের বেশ কিছু ক্ষতির কারণও হয় গ্লোবালাইজেশন। সেগুলো সম্পর্কে এখন আমরা আলোচনা করব।
১. প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার লড়াই
গ্লোবালাইজেশনের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি যে ঝুঁকির মুখোমুখি হয় তা হচ্ছে বড় এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা। বড় বড় কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ব্র্যান্ড পরিচিতি থাকে, এবং লোকবলও বেশি থাকে। তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে প্রায় ছোট ছোট উদ্যোগগুলো পিছিয়ে পড়ে। অনেক সময় মানুষ আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর জিনিসকেই লোকাল জিনিস এর থেকে বেশি ভালো মনে করে, ব্র্যান্ড ব্যালুতে বিশ্বাস করে কেনার সময় সেই জিনিসগুলোকেই প্রাধান্য দেয় যেগুলো বড় ব্র্যান্ড বা কোম্পানির তৈরি, এবং এতে সেই কোম্পানির পরিচিতি বৃদ্ধি পায়।
২. মূল্য ধরা ও লাভ
অনেক সময় নিজস্ব এলাকার লোকাল বিজনেসগুলো বড় কোম্পানিগুলোর সাথে লাভ ঠিক রেখে মূল্যের সামঞ্জস্য করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায়। কারণ আমরা সবাই জানি যে, বেশি পরিমাণে উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎপাদনের খরচ বেশ অনেকটাই কমে আসে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা পুঁজি স্বল্পতার কারণে অনেক বড় স্কেলে প্রোডাক্ট আনাতে পারেন না, কিন্তু বড় বড় কোম্পানিগুলো একসাথে অনেক উৎপাদন করায় ঠিকঠাক লাভ রেখেও মূল্য কম ধরতে পারে। এক্ষেত্রে দামের অসম প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পিছিয়ে যায়। কখনো কখনো তারা কম খরচে উৎপাদন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে পণ্যের মানের সাথে আপোষ করতে বাধ্য হয়, যার ফলে নেগেটিভ মার্কেটিং হয়। কখনো কখনো আবার এই প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয়, অথবা বড় কোম্পানির কাছে নিজের ব্যবসা বিক্রি করে দিতে হয়। এজন্য একইরকম জিনিস নিয়ে অনেকেই কাজ করলেও লম্বা দৌড়ে অল্প কয়েকজনই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।
৩. টেকনোলজির উপর নির্ভরশীলতা এবং তার ফলে সৃষ্ট বৈষম্য
টেকনোলজি ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে সবকিছু কতটা সহজ করেছে এবং এগিয়ে দিয়েছে, এ সম্পর্কে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। তবে এই টেকনোলজি কি সবাই সমানভাবে ব্যবহার করতে পারছে? উত্তরটি হচ্ছে, না। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানিগুলো প্রযুক্তির এই অগ্রগতিকে কাজে লাগাতে পারলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে পড়েছেন। বড় বড় কারখানা ও মেশিনারির কাজে যে পরিমাণ খরচ হয়, সেটা প্রায়ই ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো করতে পারে না। এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলো সেই সুবিধা ও নিতে পারে না। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশের ছোট মাঝারি ব্যবসাগুলো উন্নত দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে, এবং অসম প্রতিযোগিতার শিকার হয়। এমনকি একই দেশের মধ্যে বড় কোম্পানি ও ছোট উদ্যোগগুলোর মধ্যেও এই অসম প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এর ফলে মান ভালো হলেও বড় পরিসরে উৎপাদন করতে না পারায় ছোট কোম্পানি ও উদ্যোগগুলো পিছিয়ে পড়ে।
৪. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং এর ফলে নিজস্বতা ও স্বকীয়তার উপর আঘাত
আমরা সবাই জানি, গ্লোবালাইজেশন এর অন্যতম বড় একটা অংশ হচ্ছে সংস্কৃতির মেলবন্ধন ও পরিবর্তন। কখনো কখনো এই সংস্কৃতির প্রভাব এত বেশি পড়ে যে নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে থাকে। এর সাথে তাল মিলিয়ে বিদেশি সংস্কৃতি ও পণ্যের প্রতি গ্রাহকদের আকর্ষণ বাড়ে যার ফলে স্থানীয় পণ্যের চাহিদা কমে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উন্নত দেশের তৈরি চাকচিক্যময় ও ঝকঝকে আকর্ষণীয় পণ্যের সামনে স্থানীয় কারুশিল্প প্রায়ই টিকতে পারে না।এছাড়াও মেশিনে তৈরি ফ্যাক্টরিতে পাইকারি দরে বানানো জিনিসপত্র আমদানির ফলে ক্ষুদ্র ও হস্তশিল্প, বিভিন্ন কারু শিল্প, ও লোকজ শিল্প তাদের মূল্য হারায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্লাস্টিক পণ্যের সর্বত্র ব্যবহার ও জনপ্রিয়তার কারণে মাটি, বাঁশ, বেত বা কাঁচের তৈরি পণ্যের প্রচলন এখন অনেক কমে গিয়েছে, এমনকি পাট বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল হওয়া সত্ত্বেও বাজারে আমরা পাটের ব্যাগ এর চাইতে প্লাস্টিকের ব্যাগেরই বেশি আনাগোনা দেখি।
বাংলাদেশে কীভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উপর গ্লোবালাইজেশন প্রভাব ফেলছে?
আমরা জানি আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে খুব ছোট একটি দেশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের নাম আন্তর্জাতিকভাবে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। এরমধ্যে গ্লোবালাইজেশনের বেশ প্রকট ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। অনেক বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে নিজস্ব কোম্পানির তৈরি পোশাক বানিয়ে নেয়। এটা সম্ভব হয়েছে গ্লোবালাইজেশন এর কারণেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাহিদা ও মার্কেট তৈরি হওয়াটা উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য খুবই উপকারী।
এছাড়াও বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশী উদ্যোগ তারা নিজেদের পণ্য তুলে ধরতে, প্রচার ও বিক্রি করতেও পারছেন। ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর সুবিধা নিয়েও তারা নিজেদের কাজে বেশ এগিয়ে গেছেন। পণ্যের ছবি তোলা, অ্যাড ক্যাম্পেইন করা, এনগেজিং কন্টেন্ট লিখে কাস্টমারের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করা এসবেও এগিয়ে গিয়েছেন তারা।
এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার গ্লোবালাইজেশনকে যাতে দেশের কল্যাণে ব্যবহার করা যায় সেজন্য বিভিন্ন রপ্তানি প্রণোদনা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে বিশেষ ঋণ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির সাথে পার্টনারশিপ সহজ করা সহ আরো বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে, এগুলো ঠিকঠাক ব্যবহার করে একজন উদ্যোক্তা নিজের ব্যবসায় বেশ উন্নতি করতে পারেন।
গ্লোবালাইজেশনকে কীভাবে সর্বোচ্চ সম্ভাবনাময় উপায়ে কাজে লাগানো যায়?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ছোট দেশে গ্লোবালাইজেশন খুলে দিতে পারে অনেক সম্ভাবনা। কিন্তু সেগুলোকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে এবং নিজেদের অনন্যা অবস্থান তৈরি করতেও জানতে হবে। এর জন্য বেশ কিছু প্রস্তাবনা হাতে নেয়া যেতে পারে।
১. নতুন নতুন প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা
আমরা ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছি প্রযুক্তি এই সেক্টরের কতটা দখল করে আছে। তাই এখানে টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সরকার থেকে ইতিমধ্যেই উপজেলা ও স্থানীয় পর্যায়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি করে দেয়া আছে, তবে এর ব্যাপ্তি এখনো অতটা ছড়ানো নয়। একে আরো বিস্তৃত করা এবং নতুন প্রযুক্তি, সফটওয়্যার, ডিজিটালাইজেশন সম্পর্কে যথাযথ ট্রেনিং ও ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করা এই বিষয়ে একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। বিশেষত গ্রামাঞ্চল এবং প্রান্তিক এলাকাগুলোয় এটার ছড়িয়ে পড়াটা বেশি জরুরী।
২. আর্থিক সীমাবদ্ধতা দূর করতে ঋণ ও ফান্ডের ব্যবস্থা
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের পুঁজির সীমাবদ্ধতা। গ্লোবালাইজেশন এর সুবিধা যাতে তারা টাকার অভাবে নিতে না পারেন এতে রোধ করতে বিভিন্ন ঋণ ও স্কিম চালু করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ নেওয়ার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলোকে আরও শিথিল করা, সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের ব্যাংকগুলোকেই এসএমই খাতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য স্টার্টআপ ফান্ড গঠন করা, বিভিন্ন বড় বড় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মার্চেন্ট বা উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা চালু রাখা, এসবের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের সাহায্য করা যায় এবং এই সম্ভাবনাময় খাতে আরো এগিয়ে যাওয়া যায়।
৩. ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং সম্পর্কিত ওয়ার্কশপ এবং কর্মকাণ্ড
লক্ষ্য যখন আন্তর্জাতিক মার্কেট, সেখানে প্রতিযোগিতা ও হবে অনেক বেশি। তার মধ্যে নিজের দেশের পণ্যকে এগিয়ে নিতে দরকার ঠিকঠাক মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং। অবশ্যই দেশীয় প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এক রকমের হবে না। দেশের বিশেষত্ব, নিজস্ব শিল্প ও সম্পদের ব্র্যান্ডিং এমনভাবে করতে হবে যাতে করে পণ্যের পরিচিতি ও নিজস্বতা প্রকাশ পায়। গল্প বলার কৌশলে পণ্যের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরে কাস্টমারদের আকৃষ্ট করা যায়।
৪. নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্কিং করা ও একে অন্যকে সাহায্য করা
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা অনেক সময়ই নিজেদের ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়ে বড় কোনো প্রকল্পে যোগ দিতে পারেন না, অথবা বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেন না। এর সমাধান হতে পারে যদি উদ্যোক্তারা একত্রে কাজ করেন এবং একে অপরের সহযোগিতা করেন। এক্ষেত্রে সরকার একটা বেশ বড় ভূমিকা পালন করতে পারে,তা হলো নিয়মিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা আয়োজন। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিচিতির পাশাপাশি নিজ দেশের বিভিন্ন রকমের পণ্য একই ছাদের নিচে পাওয়া যায়, যার ফলে সবারই পরিচিতি বাড়ে এবং উপকৃত হয়।
এছাড়াও বড় কোনো প্রকল্প হাতে নেয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা নিজেদের মধ্যে গ্রুপ বা পার্টনারশিপ করে সহজেই এগিয়ে যেতে পারেন। যেমন- বড় কোনো স্পেস ভাড়া করে সবাই মিলে মেলা আয়োজন করা, একই স্টল কয়েকজন মিলে নেয়া, কোনো প্রজেক্ট ট্রেনিং এ টিম হিসেবে কাজ করা ইত্যাদি।
৫. স্থানীয় পণ্যের পরিচিতি আন্তর্জাতিক করার উদ্যোগ নেওয়া
প্রত্যেক দেশেরই নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি ও পণ্য থাকে, যার সাথে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে থাকে। এই ধরনের পণ্যগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করার উদ্যোগ নিতে হবে, যার ফলে দেশের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়বে। বহির্বিশ্বে কোনো দেশের নিজস্ব পণ্যের পরিচিতি মানে হচ্ছে জি আই ট্যাগ। জি আই এর অর্থ হলো জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন। এর দ্বারা একটি পণ্যের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে, এবং এর সত্য কোন দেশ বহন করছে তা বোঝা যায়। ২০২৪ সালের এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩১ টি জি আই পণ্য রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জামদানি শাড়ি, রাজশাহী সিল্ক ও টাঙ্গাইল শাড়ি, কালিজিরা ও কাটারিভোগ চাল, জাতীয় মাছ ইলিশ, রাজশাহীর বিখ্যাত ফজলি আম, নকশি কাঁথা, ঢাকাই মসলিন, নাটোরের কাঁচা গোল্লা, খুলনার বাগদা চিংড়ি ইত্যাদি। এছাড়াও আরো বেশ কিছু পণ্য জি আই তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রসেসে রয়েছে।
৬. টেকসই উন্নয়ন ও উৎপাদনের দিকে নজর দেয়া
প্লাস্টিক এবং অন্যান্য অপচনশীল পণ্য সাময়িকভাবে খুব সুবিধাজনক হলেও ধীরে ধীরে পৃথিবীর উপর এর খারাপ প্রভাব বাড়ছে। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে সাসটেইনেবল বা টেকসই জিনিসপত্র তাই প্রাধান্য পাবে। এই ক্ষেত্রে কলকারখানা ওয়ালা বড় বড় কোম্পানির চাইতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে বাঁশ, কাঠ, বেত, মাটি, কাঁচ এসব জিনিস আমরা ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করে এসেছি, এবং অনেক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এগুলো নিয়ে এখনো কাজ করছে। পণ্যের পরিবেশবান্ধবতার দিকে ফোকাস করলে ভবিষ্যতে এগুলো আবারো প্লাস্টিকের জায়গা নিয়ে নিতে পারবে। এছাড়াও প্লাস্টিকের বদলে কাপড় বা পাটের ব্যাগ ব্যবহার, ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার না করা, কার্বন নিঃসরণের দিকে খেয়াল রাখা এসব পদক্ষেপ পরিবেশের জন্য যেমন ভাল হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভালো ইমপ্রেশন নিয়ে আসবে।
এসএমই খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। গ্লোবালাইজেশনকে কাজে লাগিয়ে এ খাতের উন্নতি করতে হলে সবদিকেই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের এই খাত যদি সঠিক পরিকল্পনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে এদেশের অর্থনীতিতে এটি বেশ বড় ভূমিকা রাখতে পারে, এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস হয়ে উঠতে পারে। তাই গ্লোবালাইজেশনের চ্যালেঞ্জগুলোকে পাশ কাটিয়ে এর সুবিধা গুলোকে কাজে লাগানো এবং এই খাতের উন্নতি করাই হোক মূল অর্থনৈতিক লক্ষ্য।