ফ্রিদা কাহলো | চিত্রকর্মের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া মহীয়সী এক নারী

ফ্রিদা কাহলোকে যদি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের দলে ফেলা হয় তাহলে একটুও ভুল হবে না। তার ব্যতিক্রমী ধরনের চিত্রকর্ম, অনন্য স্টাইল এবং সেলফ পোর্ট্রেট এর ভিন্ন ভিন্ন ধরন তাকে তার সমসাময়িক অন্যান্য চিত্রশিল্পীদের তুলনায় আলাদা করে দিয়েছে। তার চিত্রকর্মগুলো অনেকটা তার জীবনের প্রতিচ্ছবি, তার জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার উপরে তিনি ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। ফ্রিদা তার জীবনে প্রতিকৃতি, চিত্রকর্ম আর রঙিন মিলিয়ে প্রায় ২০০ এর মত কাজ করেছেন, যার মধ্যে ৫৫টি তার আত্মপ্রতিকৃতি। ফ্রিদা নিজেকে এঁকেছেন বিভিন্নভাবে, কখনো উজ্জ্বল রঙের মিশেলে, কখনো সাদাকালোর ছোঁয়ায়। এতে তার জীবনের বিভিন্ন আনন্দঘন মুহূর্ত বা বিষাদময় স্মৃতিই ফুটে ওঠে। বিখ্যাত এই চিত্রশিল্পীর জীবন সম্পর্কেই আজ আমরা জানবো।

ফ্রিদা কাহলো’র জীবনী 

জন্ম ও ছোটবেলা  

ফ্রিদা কাহলো

ফ্রিদা জন্মসূত্রে মেক্সিকান ও জার্মান ছিলেন। তার বাবা উইলহেলম কাহলো ছিলেন জার্মান এবং মা ম্যাটিল্ডা ক্যালেড্রন গনজালেস ছিলেন মেক্সিকান। ১৯০৭ সালের ৬ই জুলাই তার জন্ম। তার চিত্রকর্মে বিভিন্ন অংশেই তার নিজস্ব সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে। তার পূর্ণ নাম ম্যাগডালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ক্যালেড্রন। তার ছেলেবেলার বাড়িটি বর্তমানে “ব্লু হাউজ” নামে বিখ্যাত। ফ্রিদা চার বোনের মধ্যে ছিলেন তৃতীয়। তিনি তার বাবার সমর্থন পেয়েছেন ছোটবেলা থেকেই, যিনি ছিলেন একজন ফটোগ্রাফার।

ফ্রিদা খুব অল্পবয়স থেকেই বিভিন্নভাবে শারিরীক প্রতিবন্ধকতার শিকার হন, কিন্তু তার জন্য তার শিল্পীসত্তা থেমে থাকেনি। মাত্র ছয় বছর বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে তার একটি পা সারাজীবনের জন্য আকারে ছোট থেকে যায়। এই প্রতিবন্ধকতা কাটাতে ফ্রিদা বিশেষভাবে তৈরি জুতা পরতেন, যার ভেতরে হিল এবং সোল উঁচু করে বানানো ছিল।

জীবন বদলে দেয়া দুর্ঘটনা

চিত্রকর্মের প্রতি ফ্রিদার ছোট থেকেই আগ্রহ থাকলেও জীবন বদলে দেয়া একটি ঘটনা থেকে তিনি পুরোপুরি চিত্রকর্মে মনোযোগী হয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফ্রিদা এক ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনার শিকার হন। তার মেরুদন্ড, গলার হাড় ,বুকের পাঁজর ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বলা চলে অল্পের জন্যই তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বেঁচে গেলেও সুস্থ হবার জন্য তার অনেক সময় বিছানায় থাকতে হয় এবং সহ্য করতে হয় অবর্ণনীয় ব্যথা। এর ফলে তার ডাক্তার হবার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও এই লম্বা সময়ের দুর্ভোগ ছিল অসহ্য। এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে ফ্রিদা চিত্রকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার মা তাকে একটি বিশেষ ধরণের ইজেল তৈরি করে দিয়েছিলেন যাতে তিনি শুয়ে শুয়েই ছবি আঁকতে পারেন। বাবা এনে দিয়েছিলেন রংতুলি ও অন্যান্য সামগ্রী। মা আর বাবার সাহায্যে এভাবেই ফ্রিদা এঁকে চলেন তার নিজের জীবনের সেই ভয়াবহ সময়, শারিরীক ও মানসিক বিপন্নতাকে চিত্রকর্মে ফুটিয়ে তোলেন। তার ইজেলের পাশেই রাখা ছিল একটি আয়না, সে আয়নায় ফ্রিদা নিজেকে দেখতেন আর নিজেকেই আঁকতেন।

ফ্রিদা কাহলো ছবি আঁকতেন বিছানায় শুয়ে

প্রেম ও পরিণয়

ফ্রিদার জীবনে পরবর্তী অধ্যায়ে তার পরিচয় হয় তার স্বামী দিয়েগো রিভেরার সাথে। ছোটবোনের সাথে স্কুলে যাবার সময় একদিন তার দিয়েগো রিভেরার সাথে পরিচয় হয়, যিনি ছিলেন তখনকার মেক্সিকোর একজন বিখ্যাত ম্যুরালিস্ট। ফ্রিদা নিজ থেকে তার সাথে কথা বলে নিজের করা কিছু স্কেচ দেখান। রিভেরা তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ছবি আঁকা চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেন। এরপর তাদের প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হয়। চিত্রকলার প্রতি ভালোবাসা আর রাজনীতির প্রতি আগ্রহ থেকে দুজনের পরিচিতি বাড়ে, ধীরে ধীরে পরিচয় প্রণয়ে রূপ নেয়।

১৯২৯ সালে ফ্রিদা আর রিভেরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, যে বিয়েতে ফ্রিদার বাবা মার মত ছিল না। ফ্রিদার বাবা মা এ বিয়েকে “হাতির সাথে ঘুঘুর বিয়ে” বলে মন্তব্য করেছিলেন। কারণ রিভেরা ফ্রিদার চেয়ে বয়সে বিশ বছরের বড় ছিলেন, আকারেও বিশালদেহী। ফ্রিদা আর রিভেরা দুইজনেই কমিউনিস্ট মতবাদে বিশ্বাসী হলেও তার মা বাবার এ ব্যাপারে ভিন্নমত ছিল, তাই তার বিয়ে তারা মেনে নিতে পারেননি।

ফ্রিদার স্বামী

বিবাহিত জীবনের চড়াই উৎরাই

ফ্রিদার বিবাহিত জীবন ছিল বিভিন্ন চড়াই উৎরাইএ ভর্তি। এক্সিডেন্টের ফলে সৃষ্ট ব্যথা তার কখনোই পিছু ছাড়েনি, এর সাথে যুক্ত হয় গর্ভপাতের বেদনা। ফ্রিদা মা হতে চেয়েছিলেন, বেশ কয়েকবার সন্তানধারণ করার চেষ্টা করার পরেও প্রতিবারই তার সন্তান গর্ভেই মারা যায়। ধারণা করা হয় তার পূর্বের বাস এক্সিডেন্টের আঘাতগুলো এর জন্য দায়ী হতে পারে। ফ্রিদা বিভিন্ন চিত্রকর্মে তার এই মাতৃত্বের অক্ষমতা ও হাহাকার প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন ইঙ্গিতের মাধ্যমে। যেমন “হেনরি ফোর্ড হসপিটাল” ছবিতে তিনি অনুর্বর শুষ্ক প্রাণহীন জমির সাথে নিজেকে তুলনা করেন।

রিভেরার সাথে বিয়ের পর ফ্রিদার চিত্রকর্মগুলোয় ধীরে ধীরে মেক্সিকোর রঙিন ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। তিনি নিজেকে আঁকেন মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী রঙিন পোশাকে, মাথায় রঙবেরঙের ফুল দিয়ে।

পরকীয়া ও বিবাহ বিচ্ছেদ

বিয়ের সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রিভেরা ছিলেন মেক্সিকান রেভ্যুলশনারি পার্টির একজন প্রভাবশালী সদস্য। বিয়ের পর ফ্রিদা ও রিভেরা দুজনেই একইসাথে সক্রিয় হতে থাকেন রাজনীতিতে। এভাবেই ফ্রিদার সাথে পরিচয় হয় তখনকার সোভিয়েত থেকে বিতাড়িত লিওন ট্রটস্কির সাথে। ট্রটস্কি ও তার স্ত্রী পালিয়ে এসে ফ্রিদা ও রিভেরার বাড়িতে আশ্রয় নেন। ফ্রিদা আর রিভেরা তাদের স্বাগত জানান। তারা সবাই ছিলেন একই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। ধীরে ধীরে ট্রটস্কির সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন ফ্রিদা। তিনি তাদের একসাথে থাকার সময়ে ট্রটস্কিকে তার প্রতিকৃতি এঁকে উপহার দিয়েছিলেন, যার নাম ছিল “সেল্ফ পোর্ট্রেইট ডেডিকেটেড টু লিওন ট্রটস্কি”, ছবিটিতে ফ্রিদা ট্রটস্কিকে এঁকেছিলেন কপালে একটি অতিরিক্ত চোখ দিয়ে, যার দ্বারা তার বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা নির্দেশ করেন। ফ্রিদা ট্রটস্কির একজন অনুরাগী ছিলেন। ট্রটস্কি ছাড়াও আরো অনেকের সাথেই ফ্রিদা জড়িয়েছিলেন, তবে সবচাইতে পরিচিতি পায় এ সম্পর্কটিই।

রিভেরাও যে সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত ছিলেন সম্পর্কে এমন নয়। তিনিও বিবাহের পরেও বিভিন্ন জায়গায় সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন যার মধ্যে ছিলেন তার সহকর্মী চিত্রশিল্পী, মডেল, রাজনৈতিক কর্মী এমনকি ফ্রিদার ছোটবোনের সাথেও রিভেরার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। এর ফলে ফ্রিদা-রিভেরার সম্পর্কে অদ্ভুত টানাপোড়েনের সূচনা হয় যেখানে ভালোবাসা, ঘৃণা, আনন্দ, বেদনা, হিংসা আবার সহমর্মিতা সব মিলে অনেক জটিল হয়ে ওঠে। তার সম্পর্কের এই জটিল রূপ ফ্রিদার চিত্রকর্মে অনেকাংশেই স্থান পেয়েছে।

দ্য টু ফ্রিদা'স

১৯৩৯ সালে ফ্রিদা আর রিভেরার ডিভোর্স হয়ে যায়, যদিও তাদের মধ্যে ভালোবাসা তখনো শেষ হয়ে যায়নি। এ সময়ে ফ্রিদা বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য “দ্য টু ফ্রিদা’স”। এ চিত্রে ফ্রিদা তার দুই সত্তাকে আলাদা করে দেখান। ধারণা করা হয় রিভেরার সাথে থাকাকালীন সময়ে তার যে নিজস্ব পরিচয়, বিচ্ছেদের সাথে সাথে তা ছিন্ন হয়ে গেছে বুঝাতে চেয়েই ফ্রিদা ছবিটি আঁকেন। বিচ্ছেদের যন্ত্রণাকে তিনি এই ছবিতে ধরতে চেয়েছেন।

এ বিচ্ছেদ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৪০ সালে ফ্রিদা আর রিভেরা আবার বিয়ে করেন। বিয়ের পরেও তারা আলাদা বাড়িতে আলাদা জীবনযাপন করতেন, কিন্তু জীবন থেকে একে অন্যকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারেননি। দ্বিতীয়বার বিয়ের পরেও তাদের বিবাহিত জীবনের টানাপোড়েন চলতেই থাকে।

প্রথম একক প্রদর্শনী

বিবাহিত জীবনের বাইরে ফ্রিদা ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। ১৯৩৮ সালে তার প্রথম একক প্রদর্শনী হয় নিউইয়র্কের জুলিয়েন লেভী গ্যালারিতে। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে তার আঁকা ছবি আমেরিকার দর্শকদের কাছে পৌঁছায়। বিখ্যাত পরাবাস্তববাদী শিল্পী আন্দ্রে ব্রেটন তার মেক্সিকো ভ্রমণের সময় ফ্রিদার কাজ দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে পরাবাস্তববাদী বলে আখ্যা দেন এবং পরবর্তীতে ফ্রিদার আন্তর্জাতিক পরিচিতিতে ভূমিকা রাখেন।

জীবনের শেষ সময়

এতকিছুর মধ্যে ফ্রিদার শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছিল। জীবনের প্রথমভাগের সেই দুর্ঘটনার জের তাকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে জীবনের শেষ পর্যন্ত। তার শারিরীক এই যন্ত্রণা ঘোচাতে তাকে করাতে হয়েছে অনেকগুলো সার্জারি, যেতে হয়েছে মেডিকেল প্রসিডিওর এর মাঝে দিয়ে। জীবনের অনেকটা সময়ই তাকে কাটাতে হয়েছে হাসপাতালে, শুয়ে বসে অথবা হুইলচেয়ারে। তার শারীরিক এই যন্ত্রণা ও কষ্ট তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন “দ্য ব্রোকেন কলাম” এবং “দ্য উন্ডেড ডিয়ার” সহ আরো অনেক চিত্রকর্মে। শারীরিকভাবে সক্ষমতা কম থাকলেও রাজনীতিতে ফ্রিদা সক্রিয় ছিলেন এবং তার চিত্রকর্মেও তার রাজনৈতিক মনোভাবের প্রকাশ পেতে দেখা গেছে।

যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য ফ্রিদা অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মদ ও ব্যথানাশক ঔষধকে। শেষদিকে তার চলাফেরার জন্যও সাহায্যের প্রয়োজন হত এবং এ সময়কার আত্মপ্রতিকৃতিতে তাকে হুইলচেয়ারে দেখা যায়।

ব্লু হাউজ

১৯৫৪ সালের ১৩ই জুলাই, তার জন্মদিনের এক সপ্তাহ পরে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে কিংবদন্তী ফ্রিদা কাহলো তার “ব্লু হাউজ” এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় পালমোনারি এম্বোলিজম বলা হলেও অনেকেই ধারণা করেন ফ্রিদা তার জীবনের যন্ত্রণা কমাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। মৃত্যুর আগে ফ্রিদা প্রায়ই মৃত্যুর কথা ভাবতেন, এ সম্পর্কে তার ডায়েরিতেও লিখতেন।

মেক্সিকো সিটিতে ফ্রিদার প্রিয় “ব্লু হাউজ” এখন ফ্রিদার অনুরাগীদের জন্য জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। সেখানে ফ্রিদার ব্যবহার করা জিনিসপত্র রাখা আছে, যাতে তার ভক্তরা সেখানে গিয়ে সময় কাটাতে এবং প্রিয় শিল্পীর সম্পর্কে জানতে পারেন। মৃত্যুর পর ফ্রিদার জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়, বিশেষত ১৯৭০ সালের পর, যেটাকে কিছু বিশেষজ্ঞরা “ফ্রিদাম্যানিয়া” বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন।

তার অন্যরকম জীবনযাপন, দুঃখ বেদনা, প্রেম, রাজনৈতিক মনোভাব সবমিলিয়ে ফ্রিদা কাহলোর নাম মৃত্যুর পরেও অনন্য সাধারণ হয়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *