মানুষ হিসেবে আপনার মধ্যে দুই ধরনের দক্ষতা থাকতে পারে। কারিগরিক ও মানবিক। কারিগরিক দক্ষতা পড়াশোনা বা কাজের ক্ষেত্রে জানা এবং প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু এর বাইরের দক্ষতাগুলোও আমাদের কারিগরি জীবনেরই পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তিগত জীবনে আপনি যেখানেই পড়াশোনা করেন না কেন, যে ধরনের কর্মক্ষেত্রেই যান না কেন, আপনার মধ্যে বেশ কিছু মানবিক দক্ষতা থাকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যার মাধ্যমে আপনার কর্মজীবন হয়ে উঠতে পারে আরো সাফল্যমণ্ডিত, বরং এই দক্ষতাগুলো না থাকলেই ক্যারিয়ারে সফল হওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে। তাই আজ আপনাদের জানাবো ক্যারিয়ারে সফলতার জন্য কোন দক্ষতাগুলো জরুরি তা নিয়ে।
ক্যারিয়ারে সফলতার জন্য যে দক্ষতাগুলো থাকতে হবে
১) যোগাযোগ দক্ষতা
পড়াশোনার বিষয় যেমনই হোক, যেকোনো ধরনের পেশাই হোক আপনার থাকতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত যোগাযোগ দক্ষতা বা কমিউনিকেশন স্কিল। আপনি যার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন তাকে শারীরিক ভাবভঙ্গি এবং মানসিকভাবে ইতিবাচক ইঙ্গিত করা, সুন্দরভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে তার মনোযোগ ধরে রাখা, শোনার আগ্রহ তৈরি করা, অনেক মানুষের সামনেও নির্ভয়ে গল্প আকারে আপনার তথ্য ফুটিয়ে তোলা, নিজের বক্তব্য তুলে ধরা, যেকোনো ধরনের অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যম জানা এবং সঠিক ব্যবহার করতে পারা খুবই গুরুত্ব বহন করে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় বা যেকোনো ধরনের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের শুরু থেকেই এসব দক্ষতা বিকাশে মনোযোগী হওয়া জরুরি, পাশাপাশি বেশি বেশি চর্চার মাধ্যমে জড়তা কাটিয়ে নিতে হবে।
২) আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্বাস
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আপনি কেমনভাবে কাজ করছিলেন এবং পরবর্তীতে আপনার মধ্যে কী কী পরিবর্তন এসেছে, দিন দিন আপনি কতটুকু নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারছেন এ ধরনের আত্মসমালোচনার মাধ্যমেই আপনি নিজেকে আরো যোগ্য একজন কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। পাশাপাশি সবসময় ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে হবে যে, একজন যোগ্য কর্মী হিসেবে আমি নিজেকে গড়ে তুলতে পারবোই। নিজের মধ্যে নিজের জন্য এই ধরনের আস্থা ও সাহস তৈরি করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যাতে আপনি যে প্রতিষ্ঠান বা যার সাথে কাজ করবেন, আপনার নিজের প্রতি আস্থা তাকেও আপনার প্রতি আস্থা জোগাতে সাহায্য করে।
৩) নিজেকে উপস্থাপন করতে পারা
কর্মক্ষেত্রে নিজেকে অন্যের সামনে উপস্থাপন করতে পারাও একটি বড় গুণ। এমন যাতে না হয় যে আপনি খুব ভালো কিছু গুণাবলির অধিকারী, কিন্তু শুধুমাত্র ভালো উপস্থাপনার অভাবে আপনি সেগুলো অন্যের সামনে তুলে ধরতে পারছেন না। আপনার শক্তি ও দক্ষতার জায়গাগুলোকে কাজে লাগিয়েই অন্যের সামনে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা শিখতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে।
৪) শেখার আগ্রহ এবং রপ্ত করতে পারা
সবচেয়ে সফট স্কিল হচ্ছে শেখার আগ্রহ থাকা এবং শিখে তা কর্মক্ষেত্রে বা বাস্তবিক জীবনে প্রয়োগ করা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ভালো একটি ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়ার পর আমাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ অহমিকা তৈরি হতে পারে যে আমরা এখন অনেক কিছু জানি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন জিনিস শেখা যায়। সেইসব জিনিস শিখে ফেলার আগ্রহ এবং তা খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলার স্পৃহা নিজের মধ্যে থাকতে হবে।
৫) পেশাগত দক্ষতা ও দলগত কাজ
পেশাগত জীবনে দক্ষতা বলতে যে প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করবেন সেখানের সকল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, দলগতভাবে যেকোনো মিটিং, কাজের পরিকল্পনা, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা, সমমানের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারেও সজাগ থাকা বোঝায়। দলগত কাজে নেতৃত্ব দেয়া হলে তা আস্থার সাথে পরিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৬) নেতৃত্বের গুণাবলি ও সততা
যেকোনো ক্যারিয়ারেই নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলি থাকা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি একজন যোগ্য নেতা হতে চান তাহলে আপনাকে একসাথে অনেকগুলো ব্যাপার দেখভাল করার মানসিকতা রাখতে হবে। সেটি হতে পারে দলগত যেকোনো কাজ। যেমন- দল গঠন, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ ভাগ, বাকিদেরও নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি করে দেয়া, পরামর্শ আদান-প্রদান। এছাড়াও একজন নেতা হিসেবে আপনাকে হতে হবে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী, যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষমতা রাখতে হবে, সকল ধরনের কূটনীতি, মতামত সাহসিকতার সাথে সমঝোতা করে তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। সর্বোপরি আপনার অবস্থানে আপনাকে হতে হবে সততার দৃষ্টান্ত। কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি ঘরানার মনোভাব ধারণ করা যাবে না।
৭) তথ্য বিশ্লেষণ ও সমস্যার সমাধান
তথ্যভিত্তিক এই সময়ে কর্মক্ষেত্র কেন্দ্রিক পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য আপনার কাছে থাকতে হবে। সে তথ্য অনুযায়ী সেগুলোর বিশ্লেষণ, বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণই পারবে আপনাকে যেকোনো ধরনের জটিল সমস্যা থেকে বের করে আনতে। কর্মক্ষত্রে এ ধরনের জটিলতা প্রায়ই তৈরি হয়। তাই যখনই আপনি তা সমাধানের মতো যোগ্য করে নিজেকে তৈরি করবেন, আপনার প্রতি কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি থাকা অনিবার্য।
৮) সৃজনশীল ও উদ্ভাবন ক্ষমতা
কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য অন্যতম হলো সৃজনশীল ক্ষমতা এবং সে অনুযায়ী উদ্ভাবন। সময় গতিশীল এবং তার সাথে সাথে আমরাও। তাই আশেপাশের পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে কাজ না করলে আমরা কখনোই নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবো না। ফলে অন্যান্য সমমানের কর্মক্ষেত্রের সাথে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায়, আপনি যখন কর্মক্ষেত্রে সৃজনশীল কোনো পথ জানাতে পারবেন তখনই অন্যদের ভীড় থেকে নিজেকে আলাদা করা সম্ভব হবে এবং সে অনুযায়ী উদ্ভাবনের মাধ্যমে তা ধরে রাখতে হবে।
৯) প্রযুক্তি জ্ঞান
একুশ শতকে এসে মুখোমুখি হওয়ার মতো অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তি। কারণ এখন সবকিছুই অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর। প্রতিষ্ঠান যত বড়, তার প্রযুক্তি নির্ভরতা ঠিক ততই বেশি। তাই যদি কোনোভাবে আপনি প্রযুক্তিগত দিক থেকে দুর্বল থাকেন তা হতে পারে কর্মেক্ষেত্রে আপনার জন্য ক্ষতিকর। তাই একটি কর্মক্ষেত্রে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে একজন ব্যক্তির যতগুলো প্রযুক্তি জ্ঞান দরকার তা আপনাকে রপ্ত করতে হবে। যেমন- মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্ট, ওয়ার্ড, এক্সেল, জুম, ই-মেইল ইত্যাদি।
১০) ধৈর্য ও সহানুভূতি
একই সাথে কাজ করতে গেলে অনেক সময়ই সহকর্মীদের সাথে মনোমালিন্যের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে যখনই আপনি উত্তেজিত না হয়ে ধৈর্যের পরিচয় দিবেন এবং তার প্রতি সহনশীলতা প্রকাশ করবেন, তখনই অপর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি আক্রমণাত্মক হওয়ার প্রবণতা কমে যেতে থাকবে। এক পর্যায়ে অন্যান্য সহকর্মীরাও আপনার সাথে সহনশীলতার পরিচয় দিবে, যা কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসবে শান্তি ও সমৃদ্ধি।
লেখাপড়া শেষ করে ক্যারিয়ারে সফল হতে কে না চায়? কিন্তু নিজের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, সঠিকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে না পারা এমন নানা কারণে পিছিয়ে যেতে হয়। কী কী কাজ করলে ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে তা নিয়েই কিছু আলোচনা করলাম আজকের আর্টিকেলে। আশা করি আর্টিকেলটি হেল্পফুল ছিল। এবার তাহলে এই পরামর্শগুলো আপনিও একবার ঝালাই করে নিন। দেখুন ক্যারিয়ার অনেকটাই গোছানো হয়ে গিয়েছে।
ছবিঃ সংগৃহীত