সন্তানের উপর প্যারেন্টিং এর প্রভাব | কীভাবে হবেন ভালো অভিভাবক?

সন্তান শব্দটাই বাবা মায়েদের জন্য এক প্রশান্তির বাহক। স্রষ্টার অন্যতম নিয়ামত হচ্ছে সন্তান। সন্তান বাবা-মার চোখের শীতলতা, অন্তরের প্রশান্তি, জীবনের পরিপূর্ণতা এবং সব আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সন্তানের সঠিক লালন-পালনের জন্য তাদের জন্মের পর থেকে প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বাবা-মাকে একটি বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়, যার ওপর নির্ভর করে সন্তানের সুষ্ঠু গঠন, সুন্দর বিকাশ, সত্যিকারের শিক্ষা ও সুপ্রতিষ্ঠা।

প্যারেন্টিং কী?

Parenting ইংরেজি শব্দ। এর প্রতিশব্দ Child rearing অর্থাৎ সন্তান প্রতিপালন। পরিভাষায় প্যারেন্টিং হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সন্তান জন্মের পর থেকে তার এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাবা-মা থেকে নির্দেশনা পায় এবং মানসিক, শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ইত্যাদি দিক দিয়ে তাকে সহযোগিতা করা হয়। এক কথায়, সন্তান প্রতিপালনে বাবা-মার দায়িত্ব কর্তব্যই প্যারেন্টিং।

একটি সন্তান তার জীবনে কতটুকু ভালো মানুষ হবে, তাকে ঘিরে থাকা সমস্ত কিছু কতটা ভালোভাবে পরিচালনা করবে এগুলো অনেকটাই সে ছোট থেকেই শিখে ফেলে। বাবা-মার দেয়া শিক্ষা এবং কার্যকলাপের প্রতিফলন যেকোনো সন্তানের জীবনেই সারাজীবন ছায়ার মতো কাজ করে। তাই এক্ষেত্রে বাবা-মার ভূমিকা রাখা উচিত অত্যন্ত সচেতনতার সাথে। কারণ এখান থেকেই সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে, অধিকারবোধ, বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য তৈরি হবে। ভালো প্যারেন্টিং এর উপরেই সন্তানের ইহকাল ও পরকালের জীবনের সফলতার অনেকগুলো বিষয় থাকে।

প্যারেন্টিং

সন্তানের উপর প্যারেন্টিং এর প্রভাব  

উন্নত দেশগুলোতে প্যারেন্টিং এই টার্মটা খুবই জনপ্রিয় বা গুরুত্বের সাথে দেখা হলেও আমাদের দেশে অধিকাংশ বাবা-মা এ ব্যাপারে অজ্ঞই বলা চলে। তারা তাদের সেকেলে ধারণা নিয়েই বাচ্চাদের বড় করতে চান, আগে থেকে চলে আসা সামাজিক রীতিনীতি, আত্মীয় স্বজন থেকে প্রাপ্ত ধ্যানধারণাগুলো দিয়েই তারা প্যারেন্টিং অংশটিকে ব্যাখ্যা করত চান। আমাদের অনেকে প্যারেন্টিং বলতে সন্তানের জন্য নামী-দামি খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা এবং তাদের জন্য উচ্চ বিলাসী এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করাকেই বোঝেন শুধু। কেউ শুধু সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। তারা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সন্তানকে বিভিন্ন কোচিং ও প্রাইভেট টিউটরের পেছনে বাচ্চাকে নিয়ে ছুটতে থাকেন। সন্তানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখার মতো একটা বিষয় তারা মোটামুটি এড়িয়ে যান। বাচ্চাটি কি এত কোচিং টিউটরের কাছে দৌড়ে কিছু অর্জন করতে পারছে কি না, এটা তার জন্য বারডেইন হয়ে যাচ্ছে কিনা এমন বিষয়গুলো নিয়ে তারা কখনোই ভাবেন না।

কিছু অভিভাবক সন্তানের কোনো বিষয়েই খবর রাখেন না। কিন্তু পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হলেই শুরু করেন বকাঝকা, মারধর, ভাত বন্ধ করে দেয়ার হুমকিসহ নানা শাস্তি। আবার কেউ কেউ সন্তানকে নামী-দামি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েই নিজেকে দায়মুক্ত মনে করেন। এরপর তারা শুধু সন্তানের চাহিদা মতো টাকার জোগানই দেন। এ টাকা কোথায় ব্যয় হয় তারা কিছুই জানেন না। অনেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সন্তানের পেছনে ছায়ার মতো লেগে থাকেন, কিন্তু এরপর তাদের আর কোনো খোঁজ রাখেন না।

আবার দেখা যায়, কেউ হয়তো শুধু নিজের রুটি-রুজি, ব্যবসা-বাণিজ্য আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। সন্তানের কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ তার নেই। তাদের ধারণা, বাড়ি-গাড়ি সবই আছে, এগুলো দেখভাল করলেই সন্তানের জীবন অনায়াসে পার হয়ে যাবে। কিছু প্যারেন্ট শুধু সন্তানের বাইরের উন্নতি-অবনতির দিকে নজর রাখেন। তাদের চারিত্রিক শুদ্ধাচার ও পারলৌকিক সফলতা নিয়ে কিছুই ভাবেন না। কিছু প্যারেন্ট শুধু সন্তানের চারিত্রিক শুদ্ধাচার নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না। এ জাতীয় চিন্তার কারণে তারা নিজেরাই যে ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন করছেন, সে দিকেও তাদের খেয়াল নেই।

আবার সংখ্যায় কম হলেও কিছু প্যারেন্ট তাদের সন্তানের সুষ্ঠু গঠন, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দেন। তারা সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে খুবই যত্নবান। এরা সন্তানের সব প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি স্নেহের শাসনও করেন। তারা সন্তানকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসেন; কিন্তু কোনো অন্যায় কর্ম ও আবদারকে প্রশ্রয় দেন না। এরাই যথার্থ প্যারেন্টস। যেহেতু শুধুমাত্র একটি বিষয় নিয়ে সচেতন হয়েই যোগ্য অভিভাবক হওয়া সম্ভব না, তাই সত্যিকার অর্থে অভিভাবক হয়ে উঠতে হলে কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে। প্যারেন্টিং অনেকগুলো প্রকার, অনেকগুলো ধাপ রয়েছে।

সন্তানের উপর প্যারেন্টিং এর প্রভাব

প্যারেন্টিং এর প্রকারভেদ

বাবা-মা দুইজন আলাদা মানুষ, তাদের অনুশাসনে যখন কোনো সন্তান বড় হয় নিশ্চয়ই সেখানেও অনেক ধরনের আচরণগত, অনুশাসনগত পার্থক্য থাকে। সেটা সন্তানের জন্য কল্যাণকর নাকি ক্ষতিকর তা নিয়েই আলোচনা করা যাক-

১) অথোরিটেরিয়ান বা স্বৈরাচারী (Authoritarian Parenting)

এই স্বভাবের বাবা মায়েরা সন্তানের জন্য কঠোর ধরনের নিয়মে রাখতে চান, তাদের উপর সবকিছু চাপিয়ে দিতে চান, এমনকি নিয়ম না মানলে শাস্তিও দিয়ে থাকেন। তারা মনে করেন, সন্তান তাদের সবধরনের আদেশ, নিষেধ মানতে বাধ্য। তারা যা বলবেন, সন্তান সেটাই করবে। তাদের কথামতো না চললে সন্তানকে তারা আর আদরের চোখে দেখতে অপারগতা প্রকাশ করেন কিছুটা।

২) অথোরিটেটিভ বা কর্তৃত্বপরায়ণ (Authoritative Parenting)

ধারণা করা হয়, এই স্বভাবের অভিভাবকরা সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। বাচ্চাদের যেসব নিয়ম মেনে চলা উচিত তারা তারা সেই সব নিয়ম কানুন শিখিয়ে থাকেন। তবে তারা প্রচণ্ড কঠিন হওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করেন না। প্রয়োজনে একটু ছাড়ও দেন। কখনো বাচ্চারা কোনো নিয়ম ভাঙলে বা কোনো অপরাধ করলে তারা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন এবং সামনে যেন এমন ঘটনা না হয় সেদিকে মনোযোগী হোন। এখানে তারা কিছুটা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স দিয়েও সবকিছু সমাধান করে নিয়ন্ত্রণ করেন।

৩) পারমিসিভ বা সহনশীল (Permissive Parenting)

এই ক্যাটাগরিতে যে ধরনের অভিভাবকরা মূলত পড়েন, তারা মূলত সন্তানদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না বা কোনো জোর-জবরদস্তি করেন না। এই স্বভাবের অভিভাবকরা সন্তানদেরকে সাধারণত প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। তারা সন্তানের প্রতি আশাও কম রাখেন। তারা সন্তানের সাথে অভিভাবক হিসেবে নয় বরং অনেকটা বন্ধুর মতো আচরণ করেন।

প্যারেন্টিং এর ধরন

৪) আনইনভলভড বা বিচ্ছিন্ন (Uninvolved Parenting)

এই ক্যাটাগরির অভিভাবকদের সাথে সন্তানদের সম্পর্কটা অনেক দুর্বল হয়। তারা সন্তানের সাথে সেভাবে যোগাযোগ করেন না, কথাবার্তা বলেন না। সন্তানদের প্রতি তাদের তেমন কোনো আশাও নেই, সন্তানদেরকে নিয়ে কোনো স্বপ্নও নেই। তারা নামকাওয়াস্তে বাবা-মা হিসেবে সন্তানের জীবনে বিরাজ করেন মাত্র। মূলত অতিরিক্ত কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত বাবা-মা যারা মনে করেন টাকা এবং বিলাসিতাই সন্তানের জীবনের একমাত্র প্রাপ্য তারা এমনটা হয়ে থাকেন।

কীভাবে সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা যায়?  

প্যারেন্টিং কতটা সঠিকভাবে করা যাবে এটা অনেকটাই নির্ভর করে অভিভাবকেরা বাচ্চাদের সাইকোলজি বা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো আসলে কতটুকু আন্দাজ করতে পারেন। তাই ভালো প্যারেন্টস বা অভিভাবক হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে সন্তানদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো কেমন হতে পারে, কোন বয়সে তারা কীভাবে চিন্তা করে, কী ধরনের ইমোশনাল চেঞ্জ এর মধ্য দিয়ে যায় এগুলো সম্পর্কে আগাম পড়াশোনা করা বা জ্ঞান রাখা।

আমাদের দেশে বাচ্চাদের ছোটবেলাতেই অনেক কিছু শিখিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ব্যাপারটা হলো এমন- বাচ্চারা সাত বছর পর্যন্ত কেবল সবকিছু অনুকরণ করে। এ ক্ষেত্রে আরেকটা মজার বিষয় হলো তাদেরকে খেলনা, বিনোদনের জিনিস দিয়েও কোনো লাভ হয় না। তারা মূলত তার আশেপাশের বড়রা যা করছে তাই অনুকরণ করার চেষ্টা করে। তাই ছোট থেকেই শিশুটির সামনে শব্দচয়নে সচেতন হওয়া, পারিবারিক দ্বন্দ্ব তাদের সামনে না আনা, দৈনন্দিন জীবনের কাজে তাদের অংশগ্রহণসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়ে সুন্দর শৈশব দিয়ে প্যারেন্টিং এর প্রথম ধাপ শুরু করা যেতে পারে।

সন্তানেরা অন্যের প্রতি কতটুকু রেসপেক্টিভ হবে এটাও অনেকটাই নির্ভর করে বাবা-মার উপর। তাই সন্তানদেরকে কথা বা শব্দচয়ন শেখানোর সময়ও আপনি করে কথা বলা, সম্মান দেয়ার বিষয়গুলো, ফর্মাল আলাপ সহ ইত্যাদি কমিউনিকেশন স্কিলও ছোট থেকেই একটু একটু করে ধরিয়ে দেয়া উচিত। সন্তানের বয়স যখন সাত থেকে বারো তেরোর দিকে থাকবে তখন থেকেই তাকে পড়াশোনা, বিভিন্ন জ্ঞানচর্চার ধরন, বিভিন্ন কালচারাল অ্যাক্টিভিটি নিয়ে আগ্রহ তৈরি করে দেয়া যাতে সবকিছুর মধ্য থেকে সে বুঝতে পারে ঠিক কোন পার্টিকুলার বিষয় নিয়ে সে আগ্রহ অনুভব করছে এবং পরবর্তীতে সেটি নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। লেখাপড়ার মাপকাঠি বোঝানো, নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনার অভ্যাস করানো, অতিরিক্ত চাপ না দেয়া, আগ্রহের সাথে পড়ার জন্য পড়াকে হাসিখুশিভাবে তুলে ধরাও প্যারেন্টিং এর বড় একটি অংশ।

প্যারেন্টিং

শুধুমাত্র লেখাপড়া বা কাজ করতে পারাই একমাত্র শিক্ষা নয়। সন্তানটি কতটুকু নৈতিক গুণাবলি অর্জন করছে, কতটুকু সামাজিকতা ধরে রাখছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াচ্ছে, যেকোনো বাজে কাজ থেকে কীভাবে নিজেকে দূরে রাখছে- এগুলো শেখানোও প্যারেন্টিং এর অংশ। বাবা-মা যদি সন্তানকে শুরু থেকেই নৈতিক গুণাবলির গুরুত্ব, ধর্মীয় শিক্ষা না দিয়ে থাকেন তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই সন্তান দ্বারা সমাজের ক্ষতি হয়, সে নিজের ক্ষতিও করে। অনেকেই বড় হয়ে নিজে থেকেই অনেক কিছু শেখে তবে তার সংখ্যা কম।

ভালো অভিভাবক এর উপরই অনেকটাই নির্ভর করে তাদের সন্তান পৃথিবীতে কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনবে বা কতটুকু ভালো কাজে ভূমিকা রাখতে পারবে। জন্মের পর থেকে যেহেতু বাবা মাকেই সন্তান দেখে বড় হয় তাই তাদের আচার আচরণ সবকিছুই তারা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে ফেলে। শুধু সম্পদ বা চাহিদা পূরণ করেই বাবা-মা হওয়া যায় না বরং দরকার প্রচুর সময় দেয়া, পজিটিভ এফোর্ট দেয়া এবং সচেতন জ্ঞান থাকা। সন্তানের উপর প্যারেন্টিং এর প্রভাব যেহেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই ভালো বাবা-মায়ের ভূমিকা পালন করাও অবশ্য করণীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *