কপিরাইটিং | মানুষের ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে পণ্য বিক্রির পন্থা

“মানুষ শুধু পণ্য আর সেবা কেনে না, তার সাথে কেনে সম্পর্ক, গল্প, ও ম্যাজিক” – সেথ গোডিন, আমেরিকান লেখক।

বর্তমানে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মার্কেটিং এ অনেক নতুন নতুন উদ্ভাবন হয়েছে। ফিজিক্যাল ক্যাম্পেইন থেকে শুরু করে ডিজিটাল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট, রাস্তায় ঝুলানো ব্যানারই হোক অথবা পছন্দের ব্র‍্যান্ডের কভার ফটো, সবজায়গাতেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মার্কেটিং এর ছাপ থাকে। সেই আদিকালের পত্রিকার পাতায় ছাপানো রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞাপন “সুলেখা কালি, এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো” থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের “Innovation and you, philips”, একইভাবে কাস্টমারকে আকর্ষণের চেষ্টা করছে তার ভাষা ও ভঙ্গির মাধ্যমে। আজ আমরা এই ভাষা ও ভঙ্গির মত অনন্য পদ্ধতি কীভাবে মার্কেটিং এ এলো, কীভাবেই তা আধুনিক যুগে সমানভাবে দাপট দেখাচ্ছে, তা নিয়েই কথা বলব। এই ইউনিক মার্কেটিং এর পিছনে যার অবদান, সেই স্কিলকে আমরা বলি “কপিরাইটিং”।

কপিরাইটিং আসলে কী?

কপিরাইটিং এর নাম আমরা অনেকেই শুনেছি, কিন্তু এর সম্পর্কে গভীর ধারণা কি আমাদের আছে? কপিরাইটিং হচ্ছে পারসুয়েসিভ মার্কেটিং ও প্রমোশনাল ম্যাটেরিয়ালের উপর লেখা, যে লেখা পড়ে কাস্টমার আপনার প্রোডাক্ট কিনতে, ডোনেশন দিতে অথবা সার্ভিস নিতে উৎসাহী হবে।

যেমন মনে করুন, বাংলাদেশের বিখ্যাত ইলেকট্রনিকস কোম্পানি ওয়ালটন, তাদের ট্যাগলাইন হচ্ছে “ওয়ালটন, আমাদের পণ্য” এই ট্যাগলাইনের মাধ্যমে তারা ক্রেতার কাছে ম্যাসেজ পৌঁছে দিচ্ছেন যে, তাদের এই পণ্য সম্পূর্ণভাবে দেশের মানুষের হাতে তৈরি। এর ফলে, টার্গেটেড ক্রেতারা তাদের প্রোডাক্ট কিনতে আগ্রহী হবে এই কারণে যে, তাদের প্রোডাক্ট এর সাথে জুড়ে থাকছে দেশপ্রেমের আবেগ। এই ছোট্ট ট্যাগলাইনটা কিন্তু পারসুয়েসিভ মার্কেটিং এর একটা খুব বড় উদাহরণ। এ ধরনের পারসুয়েসিভ আইডিয়া খুঁজে বের করা এবং তাকে সফলভাবে কাজে লাগাতে পারাই কপিরাইটার এর কাজ।

কপিরাইটিং

কপিরাইটিং ও কন্টেন্ট রাইটিং কি এক?

কপিরাইটিং ও কন্টেন্ট রাইটিংকে সম্পূর্ণ এক বলা যায় না, আবার আলাদাও বলা যায় না। মূলত কন্টেন্ট রাইটিং এর একটা আলাদা শাখাই হলো কপিরাইটিং। কন্টেন্ট রাইটিং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে করা যায়। কিন্তু কপিরাইটিং এর মূল উদ্দেশ্যই হলো কাস্টমার আকর্ষণ আর সফলভাবে প্রভাব ফেলা। এছাড়াও দুটোর ধরনেও রয়েছে কিছু পার্থক্য। কন্টেন্ট রাইটিং এ “রাইটিং” একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে। কিন্তু কপিরাইটিং এ লেখা, বলা, অভিনয় করে দেখানো ইত্যাদি সবই থাকে। তাই, লেখা কন্টেন্ট সবসময়ে লেখা হিসেবে দেখা গেলেও কপিরাইটিং এর কন্টেন্ট লেখা হিসেবে, অভিনয় করা নাটক, সিনেমা, অ্যাডভার্টাইজিং হিসেবে, শুধুমাত্র ছবি বা অডিও হিসেবেও দেখা যায়। মূলত এইসব ম্যাটেরিয়ালের লেখার অংশ বা স্ক্রিপ্টকে বলা হয় কপি, তাই এর নাম কপিরাইটিং।

কপিরাইটিং এর মূল উদ্দেশ্য হলো পটেনশিয়াল কাস্টমারের মনোযোগ আকর্ষণ, প্রভাব ফেলা এবং তাকে প্রোডাক্ট কিনতে আগ্রহী করা। এক্ষেত্রে কাস্টমার যে কোনোভাবে আগ্রহী হতে পারে, হয়ত কোনো লেখা পড়ে অথবা কন্টেন্ট দেখে। এছাড়াও ব্র‍্যান্ড অ্যাওয়ারনেস বাড়াতে, ইভেন্ট বা টার্গেট কজ প্রমোট করতে (যেমন চ্যারিটি), কাস্টমারকে প্রোডাক্ট সম্পর্কে আরো তথ্য দিতেও এটি বেশ কাজে লাগে।

কপিরাইটিং এর ইতিহাস

মডার্ন মার্কেটিং এ কপিরাইটিং একটি বেশ নতুন শব্দ হলেও এটা অনেক বছর ধরে মার্কেটিং এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্টাডি ও অ্যানালাইজ করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম ফুলটাইম কপিরাইটার জন এমোরি পাওয়ারস ১৮৭০ সালে তার কপিরাইটিং এবং অ্যাডভার্টাইজিং ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। তবে কপিরাইটিং এর ইতিহাস আরো অনেক অনেক আগের।

একটু ভাবুন তো সেসব দিনের কথা, যখন সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট, উন্নত টেকনোলজি এমনকি টেলিফোন কল কিছুই ছিল না, তখন কীভাবে ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা নিজেদের প্রোডাক্ট সম্পর্কে প্রচারণা চালাতেন? যখন খবরের কাগজই ভরসা তাও আবার সবাই পড়েন না, তাহলে কীভাবে অ্যাডভার্টাইজিং এর মাধ্যমে  ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করা হতো?

ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে ব্যবসায়ীদের পোটেনশিয়াল কাস্টমারদেরকে খুঁজে বের করতে হয়েছে এবং তাদের সাথে ঠিকঠাক কমিউনিকেশনের মাধ্যমে প্রোডাক্ট সেল করতে হয়েছে।

এমন কি এটা এখনকার দিনের জন্যও সত্য, বিশেষ করে এখন যখন যেকোনো কাজে প্রচুর কম্পিটিশন। ক্রেতার সাথে সঠিকভাবে যোগাযোগ না করতে পারলে ক্রেতাদের হাতে অনেক অনেক অপশন থাকে এবং ক্রেতারা সেইসব দিকে আগ্রহী হয়ে পড়েন। তাই অন্যান্য সব বিজনেস থেকে আপনাকে আলাদা করতে পারে ক্রিয়েটিভ কপিরাইটিং। কারণ কপিরাইটাররাই একটা বিজনেসকে স্মার্ট মার্কেটিং ম্যাটেরিয়াল দিতে পারে, যা তাদের পটেনশিয়াল কাস্টমারদেরকে আগ্রহী করবে এবং কম্পিউটার কোম্পানিগুলো থেকে তাদেরকে আলাদা ও বিশেষভাবে দেখাবে।

কপিরাইটার কারা?

কপিরাইটার

যে প্রফেশনাল লেখকরা মার্কেটিং আর প্রমোশনাল ম্যাটারিয়ালে ব্যবহার করা লেখা, স্ক্রিপ্ট অথবা কপিগুলো লেখার দায়িত্ব নেন মূলত তারাই কপিরাইটার।

আমরা লেখকদের ব্যাপারে প্রায়ই কিছু মিথ শুনে থাকি, যার মধ্যে একটা হচ্ছে যে “লেখকরা তাদের লেখার গুণ জন্ম থেকেই পেয়ে যান, কেউ অনেক চেষ্টা করেও লেখা শিখতে পারেন না” এবং “লেখালেখিতে আসলে তেমন কোনো গুণ দরকারই হয় না, যে কেউ চেষ্টা ছাড়াই লেখালেখি করতে পারে”।

যখন কপিরাইটারদের কথা আমরা ভাবছি তখন এই দুটো মিথই আসলে অসত্য। কপিরাইটাররা প্রফেশনাল এবং তারা তাদের এই স্কিল বেশ ভালোভাবে শিখে এবং প্র্যাকটিস করে নেন। আসলে কেউই জন্ম থেকেই চমৎকার লেখা জেনে বড় হয় না। তবে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ স্কিল যেটা কেউ চেষ্টা করলে অবশ্যই শিখতে পারেন।

কিন্তু, একজন কপিরাইটের ঠিক কী করেন?

কপিরাইটার শুনলে হয়তো আপনার মনে ভেসে উঠবে এলোমেলো গোছের একজন মানুষ সারাদিন ঘাড় গুঁজে লিখেই চলেছেন। তবে একজন কপিরাইটের কাজ এর চাইতে আরো অনেক বেশি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়।

যেকোনো কিছু লেখার আগেই প্রয়োজন বেশ গভীর রিসার্চ ওয়ার্ক করে নেওয়া। আপনি কোনো একটা বিষয় লিখতে চান কিন্তু সে সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না, জানলেও খুব ভাসা ভাসা ধারণা, এমন হলে কীভাবে হবে? কোনো কিছু না জেনেই লিখে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই কপিরাইটারদের কাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল রিসার্চ। এটা অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে অথবা সরাসরি বইপত্র ও ডকুমেন্ট থেকে করা যায়।

ক্লায়েন্টের সাথে রেগুলার যোগাযোগ করাও কপিরাইটারদের আরেকটা কাজ। আপনার ক্লায়েন্ট কী চাচ্ছেন, তার ভিশন কী, কোথায় কোন মোডিফিকেশন বা অ্যাডিশন দরকার, এমন কোনো ম্যাসেজ আছে কিনা যা মিস করা যাবে না, প্রয়োজনীয় ছবি বা ভিডিও খুঁজে বের করা অথবা প্রয়োজনে নিজেই বানানো, এরপরে সংশোধন আর রিভিশন করা এগুলো সবই কপিরাইটারের কাজের মধ্যে পড়ে।

এছাড়াও বিশেষত ফ্রিল্যান্স কপিরাইটারদের ক্ষেত্রে নিজেদের কাজের হিসাব রাখা, আলাদা ইনভয়েসিং করা, নিজের জন্য মার্কেটিং ম্যাটেরিয়াল বানানো ও নিজের প্রমোশন করা, পেমেন্ট সম্পর্কিত কাজকর্ম ইত্যাদি সবই করতে হয়।

কাদের কপিরাইটার প্রয়োজন?

সোজাভাবে বলতে গেলে প্রায় সব বিজনেস, অর্গানাইজেশন বা অন্যান্য সেক্টরেই কপিরাইটার প্রয়োজন। ছোট বা বড় কোম্পানি এক্ষেত্রে কোনো ব্যাপার নয়। ভালো মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিতে গেলে সব কোম্পানিরই দরকার একজন ভালো কপিরাইটারের। এক্ষেত্রে স্মল বিজনেস, এন্ট্রোপ্রিনিওর, মার্কেটিং এজেন্সি, বড় এন্টারপ্রাইজ, স্টার্টআপ, রিটেইল স্টোর, নন প্রফিট অর্গানাইজেশন, অনলাইন শপ এদের সবারই কাস্টমার বেসড ব্যবসা, আর কাস্টমার বেসড ব্যবসায় কাস্টমারকে আকর্ষণ করার জন্য দরকার উপযুক্ত মার্কেটিং। যে কারণে এইসব অর্গানাইজেশনের কপিরাইটার অবশ্যই দরকার।

কীভাবে চিনবেন “গুড কপিরাইটিং”?

গুড কপিরাইটিং

কপিরাইটারদের নিয়ে তো অনেক কিছুই বলা হলো, এখন গুড কপিরাইটিং নিয়ে কিছু বলা যাক।. কীভাবে বুঝবেন কোন কপিরাইটারের কাজ দিয়ে আপনার উদ্দেশ্য সফল হবে, আর কাকে দিয়ে হবে না? কী ধরনের কাজই বা আপনার নিজের পছন্দ? এছাড়াও কোন ধরনের কপিরাইটিং আপনার নিজের মনে প্রভাব ফেলছে? এখানে আমরা গুড কপিরাইটিং এর কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব।

১) দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয় এমন

মাঝে মাঝে কিছু ম্যাসেজ আমরা এড়িয়ে যাই কারণ সেগুলো আমাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয় না। আমরা প্রায়ই সব ধরনের মার্কেটিং ম্যাসেজ ব্লক করে রাখি, তারমধ্যে আলাদা কিছু পাইও না। ভালো কপিরাইটিং এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাধারণ ম্যাসেজকে সামান্য একটু পরিবর্তন করে এমন করে তোলা যাতে তা মানুষের মনে দাগ কাটে। যেমন- শুধুমাত্র নুডুলসের ছবির প্যাকেটসহ একটি বিজ্ঞাপন আমাদের মন কাড়বে না, কিন্তু আপনি যদি সেখানে দুই লাইন যোগ করে দেন “বিকেলের নাস্তা এখন ঝটপট”, এতে ক্রেতার মনে হবে তার নাস্তা বানানোর একটা সমস্যা সমাধান এই নুডুলস কিনলে হয়ে যাবে। কপিরাইটারের কাজ হচ্ছে এমনভাবে গল্প বলা যাতে তার সাথে ক্রেতার ভাবনা মিলে যায়, ক্রেতা রিলেটেবল কিছু পায়, এতে করে তার প্রোডাক্ট এর কথা মনে থাকবে।

২) কানেকশন খুঁজে পাওয়া যায়

১৯৯৬ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্টিভ জবস বলেন, “ক্রিয়েটিভিটি হচ্ছে সবকিছুকে একসাথে কানেক্ট করা, যখন ক্রিয়েটিভ কাউকে জিজ্ঞেস করবেন “আপনি এটা কীভাবে করলেন?” তিনি কিছুটা গিলটি ফিল করতে পারেন কারণ তাদের মনে হয় আসলে তারা সেটা করেননি। তারা হয়ত এমন কিছু দেখেছেন যেটা অন্য কেউ দেখেনি এবং কিছু সময় পর অন্যদের কাছে সেটা স্পষ্ট হয়েছে।”

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা বিভিন্ন মিউজিক স্ট্রিমিং সার্ভিস দেখি। যদি চিন্তা করা হয় তাদের বেশিরভাগের অ্যাডভার্টাইজিং প্রায় একরকম। এক্ষেত্রে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ নিয়েছে স্পটিফাই। তাদের বিভিন্ন অ্যাডেই বৃষ্টির সময় লং ড্রাইভে যাওয়ার সিনারিওকে তুলে ধরা হয়। আমরা বেশিরভাগ মানুষই বৃষ্টির সময়, অথবা কোথাও জার্নি করার সময় গান শুনতে পছন্দ করি। এই জায়গায় মানুষ তাদের অ্যাডের সাথে কানেকশন খুঁজে পায়। এছাড়াও স্পটিফাই বিভিন্ন জাতি ও এলাকা অনুযায়ী মিউজিকের প্রমোশন করে থাকে, এতে সেই বিশেষ এলাকা ও জাতীয়তার মানুষ স্পেশাল ফিল করে এবং স্পটিফাইয়ের প্রতি তাদের পজিটিভ মনোভাব তৈরি হয়।

এটা কাস্টমার কানেকশনের খুব স্ট্রং একটি উদাহরণ। একজন ভালো কপিরাইটার মানুষের মধ্যে থাকা কানেকশন খুঁজে বের করতে পারেন এবং তাকে বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে নিজের কপিরাইটিং অ্যাডের মধ্যে সংযুক্ত করে দিতে পারেন।

৩) একটা স্ট্রং লিড থাকবে

আপনি যদি আপনার বিজনেসের জন্য কোনো কন্টেন্ট অথবা ট্যাগ লাইন ব্যবহার করতে চান অবশ্যই সেটা এমন হতে হবে যাতে তা হয় থট প্রভোকিং এবং শুনেই মানুষের মনে হয় এর সম্পর্কে আরো জানতে হবে। একটা ক্যাচি হেডলাইন কাস্টমার আকর্ষণ করার জন্য খুব জরুরী। হেডলাইনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনাকে বাকিটা পড়তে প্রায় বাধ্য করা। যদি সেটা আকর্ষণীয় না হয় তাহলে বাকিটা জানতে আপনার মন চাইবে না। এ জায়গাতেই কপিরাইটারের মুন্সিয়ানা।

৪) এটা ফিডব্যাক থেকে আসবে

মনে করুন আপনি নতুন একটা রেস্টুরেন্ট খুলতে চান, কিন্তু অন্যান্য অনেক রেস্টুরেন্ট থেকে আপনারটা কীভাবে আলাদা? এই জায়গায় কাজে আসবে কিছু রিসার্চ, যার একটা বেশ বড় অংশ হলো কাস্টমার ফিডব্যাক। আপনি যদি এলাকায় অন্যান্য রেস্টুরেন্টে যাওয়া কাস্টমারদের থেকে ফিডব্যাক ও পরামর্শ নেন যে তারা কী চায়, একটা নতুন রেস্টুরেন্টে যেতে তাদের এক্সপেক্টেশন কী থাকে, খাবার সার্ভিস প্রাইসিং ইত্যাদি কেমন হবে ইত্যাদি সবই এক্ষেত্রে কাজে আসবে। এটাই হলো কাস্টমার ফিডব্যাক। কপিরাইটিং এর ক্ষেত্রে রিসার্চে আপনি যদি কাস্টমার এর ফিডব্যাক মাথায় রাখেন এবং সে অনুযায়ী ডেলিভারি দেন, তাহলে তা কাস্টমার আকর্ষণ করবেই। কাস্টমার সবসময়ই তাদের সমস্যার সমাধান এবং তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রোডাক্ট চান। তাদের এই চাহিদা পূরণ করার জন্য অবশ্যই তাদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেওয়া এবং কপিরাইটিং এ তা বুদ্ধিদীপ্তভাবে ব্যবহার করা জরুরী।

৫) বড় বড় জটিল শব্দ থাকবে না

কপিরাইটিং এর উদাহরণ

যুগান্তকারী, বিপ্লবী, অব্যর্থ সমাধান, ১০০% সফলতা, গবেষণার দ্বারা প্রমাণিত, একবার এই কার্যকরী — কি, শুনতে শুনতে বিরক্তি লেগে যাচ্ছে না?

এমন প্রায়ই হয় যে লেখকরা কোম্পানির স্পেশাল কিছু বর্ণনা করতে গিয়ে তেমন কিছু খুঁজে পান না। তখন তারা এইরকম বড় বড় জটিল শব্দ ও অতিসায়ন ব্যবহার করেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, ভালো কপিরাইটিং এ এসব বড় বড় জটিল শব্দ এবং বিশেষণ ব্যবহারের দরকারই হয় না। এমনকি বেশিরভাগ কাস্টমার এসব শব্দ ব্যবহারে বিরক্ত হন এবং লেখা না পড়েই চলে যান।

ভালো কপিরাইটিং এ ভাষা হবে সরল সুন্দর ও সহজ। কাস্টমারের সাথে তাদের ভাষাতেই কথা বলতে হবে। এমনভাবে যেন তারা সহজে বুঝতে এবং অনুভব করতে পারেন। যেমন- কেএফসি’র ট্যাগলাইন হচ্ছে “ফিঙ্গার লিকিং গুড” — একটা খাবারের দোকান হিসেবে তাদের পাঠানো ম্যাসেজ কাস্টমার খুব সহজেই ধরতে পারেন এবং এ কারণেই কেএফসি বর্তমানে সবচেয়ে বড় চেইন রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে একটা।

কপিরাইটিং এর ধরন

১) মার্কেটিং

মার্কেটিং কপিরাইটিং এ প্রয়োজন হয় ক্রিয়েটিভ মাইন্ডের, কন্টেন্ট ডিজাইন করতে হয় এমনভাবে যাতে তা কাস্টমারের মন ছুঁয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কাস্টমার যত আকর্ষিত হয় ততই আসলে ভালো। যেমন- পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বিভিন্ন জিংগেল স্লোগান এবং অ্যাডে ছিল কপির সরব প্রচারণা। যদিও এসব এখন তুলনামূলকভাবে কম চলে, তবু অনেক ব্র্যান্ডকেই প্রায়ই নস্টালজিয়াকে কাজে লাগিয়ে আগের স্টাইলে মার্কেটিং করতে দেখা যায়।

বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বেশিরভাগক্ষেত্রে অল্প সময়ের সিনারিও, ফটো ফ্লায়ার ইত্যাদির মাধ্যমে মার্কেটিং বেশি চলে। কপিরাইটারকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে এসব কন্টেন্ট সাজাতে শিখতে হয়, যাতে প্রথম দেখাতেই কাস্টমার এর মন কেড়ে নেয় এবং ব্র্যান্ডের প্রতি কাস্টমার আরো বেশি আকর্ষিত হয়। মার্কেটিং কপিরাইটারদের রিসার্চ এর ক্ষমতা, ক্রিয়েটিভ মাইন্ড, এক্সপেরিয়েন্স, টাইম ম্যানেজমেন্ট স্কিল, কাস্টমার সাইকোলজি ইত্যাদি সব মাথায় রেখে কাজ করতে হয়।

২) এসইও

এসইও এর মানে হচ্ছে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন। কিছু কিছু কপিরাইটার এই ব্যাপারে বিশেষ দক্ষ থাকেন। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজড কপি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে অডিয়েন্স মানুষের সাথে সাথে সার্চ ইঞ্জিনগুলোকেও সঠিকভাবে ট্রিগার করতে পারে।

এর কারণ কী? এর কারণ হলো, ইন্টারনেটে হাজার হাজার ওয়েবসাইট এবং কন্টেন্ট রয়েছে। বিশেষভাবে অপটিমাইজ না করতে পারলে হাজার হাজার কন্টেন্টের ভিড়ে আপনার কন্টেন্টও হারিয়ে যাবে। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন এর ফলে আপনার কন্টেন্ট সার্চ ইঞ্জিন রেজাল্টে উপরের দিকে আসবে, এর ফলে আপনার পেজের ট্রাফিক বাড়বে, যাতে ক্লোজ সেল এর অপরচুনিটি বাড়বে।

এসইও এর জন্য কপি রেডি করতে এসইও সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানতে হয়, ঠিকঠাকভাবে কিওয়ার্ড বসাতে হয়, যথাযথ হেডলাইন ব্যবহার করতে হয় এবং একই সাথে যথেষ্ট ইনফরমেশনও থাকতে হয়। সাধারণত ওয়েব কন্টেন্ট, প্রোডাক্ট ডেসক্রিপশন, সার্ভিস ডেস্ক্রিপশন, আর্টিকেল, ব্লগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে এসইও ব্যবহার করা হয়।

৩) সেলস কপিরাইটিং

সেলস কপিরাইটিং

মার্কেটিং কপিরাইটিং আর সেলস কপিরাইটিং কাছাকাছি হলেও এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ভিন্ন। মার্কেটিং কপিরাইটিং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কাস্টমার আকর্ষণ করা, আর সেলস কপিরাইটিং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সরাসরি সেল করায় ফোকাস করা। এক্ষেত্রে শুধু পোটেনশিয়াল কাস্টমার টানলেই হবে না, পোটেনশিয়াল কাস্টমারকে একচুয়াল কাস্টমারও বানাতে হবে।

সেলস কপিরাইটারদের বুঝতে হয় একটা প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কীভাবে কাস্টমারের কাজে আসবে, কাস্টমারের সাবকন্সাস মাইন্ড সম্পর্কে জানতে হয় এবং সেটা কীভাবে কাজ করে, কাস্টমার ঠিক কেন কিছু কেনে, তাকে কীভাবে ট্রিগার করলে সে কিনবেই ইত্যাদি সবই।

কাস্টমারের চাহিদা এবং ইচ্ছার জায়গাগুলো বুঝে কীভাবে প্রোডাক্টটা তাদের চাহিদা পূরণ করবে, সেইভাবে সেলস কপি রেডি করতে হয়। সেলস কপি সাধারণত ওয়েবসাইট, সেলস পেজ, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাড, গুগল অ্যাড, প্রোডাক্ট পেজ, প্রিন্ট অ্যাড, বিলবোর্ড অ্যাড ইত্যাদির জন্য দরকারি।

৪) ক্রিয়েটিভ কপিরাইটিং

ক্রিয়েটিভ কপিরাইটিং এ শুধুমাত্র ইনফরমেশন দেয়া নয়, ইনফরমেশনটা এমনভাবে দিতে হয়, যাতে সেটা মনোযোগ আকর্ষণ করে। ইন্টারেস্টিং ইনফরমেশন মানুষের মনে থাকে। এর জন্য বিশেষ স্ট্র্যাটেজি ও ভিন্ন রকম চিন্তার দরকার হয়। এধরনের কপিরাইটিং স্লোগান, হেডলাইন, জিংগেল, ব্লগ কনটেন্ট ইত্যাদির ক্ষেত্রে দরকার হয়।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি কপিরাইটিং এর মার্কেট দখল করে নিচ্ছে?

এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বর্তমানে আমাদের জীবনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স খুব ভালোভাবে জড়িয়ে গেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ধারণা একেবারেই নতুন, কিন্তু সফলতার হার কম নয়। অনেকে এটাও মনে করছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ফলে রিয়েল ইন্টেলিজেন্স, অর্থাৎ মানুষের গুরুত্বই ক্রিয়েটিভ ডিপার্টমেন্টে কমে আসবে। আসলেই কি তাই?

বেশিরভাগ কপিরাইটাররাই কিন্তু অন্য কথা বলবেন। তাদের মতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কপিরাইটিং এর ধারণা পরিবর্তন করলেও তা করেছে ভালোর দিকেই। বেশিরভাগ এআই বেসড টুলগুলো এখন রাইটাররা নিজেরাই ব্যবহার করেন। নতুন নতুন আইডিয়া খুজে পেতে, রিসার্চ করে তথ্য খুঁজে পেতে, বিভিন্ন প্রজেক্ট করতে, ছোটখাটো অটোমেশনের কাজগুলো এআই অনেক সহজ করে দিয়েছে। বেশ কিছু ম্যানুয়ালি করা কাজ এআই এর মাধ্যমে অটোমেটিক ভাবে করে ফেলা যায়। এতে সময় বাঁচে এবং রাইটাররা সেই সময়টা অন্য কিছুতে ব্যয় করতে পারেন।

কিন্তু তার মানে কি এই যে এআই একদিন মানুষের জায়গা নিয়ে নেবে?

২০২৪ সালে প্রায় ১৪০০ মার্কেটিং প্রফেশনালদের উপরে করা হাবস্পট এর একটি সার্ভে থেকে জানা যায়,

  • অন্তত ৮৪% পারসেন্ট মানুষ বলেছেন, এআই এর ব্যবহারে কনটেন্টের কোয়ালিটি উন্নত হয়েছে
  • ৮৪% বলেছেন, এআই টুল তাদের কাজের ক্ষমতা বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতি কন্টেন্টে তিন ঘন্টা এবং প্রতিদিন আড়াই ঘন্টা করে সময় বাঁচিয়েছে।
  • ৮২% বলেছেন, এআই এর সাহায্য নিয়ে তারা আরো বেশি কনটেন্ট ক্রিয়েট করতে পারছেন।
  • ৭৭% বলেছেন, এআই এর সাহায্যে তারা আরো বেশি পার্সোনালাইজ কন্টেন্ট তৈরি করতে পেরেছেন।

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, এআই মার্কেট আরো কম সময়ে আরো ভালো কোয়ালিটির কন্টেন্ট তৈরিতে সাহায্য করতে পারে।

এ আই ও কপিরাইটিং

কিন্তু এর মানে কি মানুষের দাম কমে গেল?

মোটেও তা নয়। কারণ একজন মানুষই অন্য একজন মানুষের সাথে পার্সোনাল ও ইমোশনাল লেভেল এ ডিলিট করতে পারেন। এআই টুল হিসেবে খুবই কার্যকরী, এবং অনেক লম্বা প্রসেসকে কম সময় করে ফেলে, তা ঠিক। কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের যে আবেগের সম্পর্ক তা এআই কপি করতে পারে না। মানুষ বেশিরভাগ সময়ে কেনাকাটা করেন তার ইমোশন থেকে। নিউরো মার্কেটিংয়ের দৌলতে আমরা জানি, মানুষ প্রথমে ইমোশন ও সাব কন্সাস মাইন্ড ব্যবহার করে ডিসিশন নেয়, তারপর তাকে লজিক দিয়ে জাস্টিফাই করে। একজন মানুষই আরেকজন মানুষের সাব কন্সাস মাইন্ডকে বুঝতে পারে।

এছাড়াও এআই সব সময় মেশিন বেসড থাকবে। এআই এর মূল শক্তি হচ্ছে ডাটা অ্যানালাইজ করা এবং প্যাটার্ন স্টাডি করে তা কপি করা। এ কারণে মনে হতে পারে এআই মানুষের মতো লিখতে পারে। কিন্তু সেটা মানুষের মতোই হবে। এআই নিজ থেকে মানুষের মতো করে কিছু তৈরি করতে পারবে না। এমনকি এআই রাইটিং টু চালাতেও মানুষ কপি রাইটারদেরই দরকার হবে। তাই কপিরাইটারদের ইউনিক স্কিল সেট, ক্রিয়েটিভিটি এবং ট্যালেন্টের সবসময়ই চাহিদা থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *