আপনি যখন আমার এই লেখাটি পড়ছেন, তখন একটি কন্টেন্ট পড়ছেন। এই কন্টেন্ট পড়েই জানতে পারছেন এটি আসলে কী এবং কেন জরুরি। আমি যে আপনাকে তথ্য দিচ্ছি এটা কন্টেন্টের মূল বিষয়বস্তু। বর্তমান বিশ্বে কন্টেন্ট রাইটিং প্রতিষ্ঠিত একটি পেশা। আপনি অন্যের লেখা পড়ার পাশাপাশি যদি নিজে কন্টেন্ট লেখা শুরু করতে পারেন, তাহলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কাজ পাওয়ার সাথে সাথে ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিংও করতে পারবেন। বর্তমানে বিভিন্ন রকম কন্টেন্টের মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের কাছে নিজেদের কাজ, পণ্য ও সেবা সম্পর্কে তুলে ধরছে। গ্রাহক আকৃষ্ট হলে বাড়ছে বিক্রি। আর ঠিক এ জন্যই দিন দিন কন্টেন্ট রাইটারদের চাহিদা বাড়ছে।
কন্টেন্ট রাইটিং কী?
কন্টেন্ট রাইটিং হচ্ছে কোনো একটি বিষয়কে লেখার মাধ্যমে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা যেন পাঠক সে সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে পারেন। এটা যে কোনো টপিকের উপরই হতে পারে। আমরা যখন কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে চাই, তখন গুগলে সার্চ দিলে যে লেখাগুলো সামনে পাই সেগুলোই কন্টেন্ট রাইটিং। এটা লেখার বিশেষ একটি গুণ, যা লেখকের মেধা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার মাধ্যমে বিশেষ একটি রূপ পায়। বর্তমানে ডীজিটাল যুগে এই পেশার গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে।
এই পেশার গুরুত্ব ও যোগ্যতা
বর্তমানে আমাদের অধিকাংশ সময় কাটে অনলাইনে। তাই যে কোনো ধরনের যোগাযোগ, প্রচার, প্রমোশন বা মার্কেটিং এর জন্য অনলাইনকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। অনলাইনে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া, ওয়েবসাইট, ব্লগ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। আর এসবের জন্য প্রচুর কন্টেন্ট প্রয়োজন হয়। যার কন্টেন্ট যত ভালো সেই এই নেট জগতে রাজত্ব করে। সহজ ভাষায় বললে, কন্টেন্টই পারে যে কোনো যোগাযোগ মাধ্যমকে সহজ করে তুলতে।
এই পেশার জন্য নির্ধারিত কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ট্রেনিং এর দরকার নেই। শুধু বিষয়ভিত্তিক লেখার বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়। একজন কন্টেন্ট রাইটার মূলত আর্টিকেল, ব্লগ, পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে কাজ করে থাকেন। আপনি যদি লেখালেখিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন, তাহলে ব্যাকরণগত ত্রুটি, লেখায় যে কোনো ভুল সহজে চোখে পড়বে এবং এডিটিং এও দক্ষ হয়ে উঠবেন।
কত ধরনের কন্টেন্ট রয়েছে?
লেখালেখির কোনো নির্দিষ্ট ছক নেই। কাজের ধরন ও বিষয়ের উপর নির্ভর করে এরও রয়েছে নানা ধরন। আপনি যখন কোনো বিজ্ঞাপন দেখছেন তখন সেটা এসেছে একটা স্ক্রিপ্ট থেকে, আর সেই ক্রিপ্টও একটি কন্টেন্ট। আবার যখন জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে কোনো গবেষণাপত্র পড়বেন সেটাও একটা কন্টেন্ট। কাজের প্রয়োজনে এসব কন্টেন্টের ধরন ও ফরম্যাটে যে কোনো সময় পরিবর্তন আসতে পারে।
এবার চলুন জেনে নেয়া যাক কন্টেন্ট রাইটিং এর বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে।
ব্লগিং
ব্লগিং এর মাধ্যমে আপনি নিজের লেখার একটি জগত তৈরি করে নিতে পারবেন। আপনার ব্লগ থাকা মানে সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে লেখার স্বাধীনতা শুধুই আপনার। বর্তমানে অনেকেই ব্লগের মাধ্যমে নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করছেন। বর্তমানে বিষয়ভিত্তিক ব্লগিংকেই অনেকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে ব্লগের বিষয় যাই হোক না কেন, নিয়মিত লিখলে এবং লেখার মান ভালো হলে পাঠকশ্রেণী এমনিতেই তৈরি হয়ে যাবে। তখন সাইটের নিয়ম অনুযায়ী ভিউয়ারশিপ বা পেইড কন্টেন্টের মাধ্যমে আপনি আয় করতে পারবেন।
কপিরাইটিং
কপিরাইটিং পুরোটাই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। একজন ক্লায়েন্টের রিকয়ারমেন্ট অনুযায়ী কাজ করে দেয়া হয় এই সেক্টরে। তবে এখানে লেখার ধরন ও কন্টেন্ট কী হবে সেটা নির্ভর করে সর্বশেষ প্রোডাক্টটি কোন প্ল্যাটফর্মে যাচ্ছে তার উপর। ধরুন, আপনি একটি বিজ্ঞাপনের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, আবার ফেইসবুকে সেই বিজ্ঞাপনটি শেয়ার দেয়ার জন্য ক্যাপশন লিখেছেন- দুটো দু ধরনের কাজ হলেও দুটোই কপিরাইটিং এর অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপন ও ট্যাগ লাইন লেখার জন্য দক্ষ কপি রাইটার নিয়োগ দেয়।
ঘোস্টরাইটিং
নাম শুনেই হয়তো বুঝতে পারছেন ব্যাপারটি খানিকটা ঘোস্ট বা ভুতুড়ে। মানে হচ্ছে ভূত যেমন খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি এই সেক্টরে রাইটারকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। এই রাইটাররা ফিকশন, নন ফিকশন, রিসার্চ, ইতিহাসমূলক বই, তথ্যবহুল যে কোনো বিষয়ের উপর লিখে থাকেন। এসবের জন্য তারা এককালীন বা স্বত্ত্বের ভাগ হিসেবে সম্মানী পান। এ কারণে লেখাটি তাদের নিজেদের থাকে না।
টেকনিক্যাল রাইটিং
এ ধরনের রাইটিং মানে যে শুধু প্রযুক্তি সংক্রান্ত লেখা লিখতে হবে, তা নয়। জটিল যে কোন বিষয়কেই এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আপনার যদি এ জাতীয় টপিকে আগ্রহ না থাকে, তাহলে আপনি পড়লেও বুঝতে পারবেন না বইয়ে কী লেখা হয়েছে। এ ধরনের লেখার পাঠক সাধারণত নির্দিষ্ট একটি শ্রেণি হয়ে থাকে।
স্ক্রিপ্ট রাইটিং
যে কোনো নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, ভিডিও এর জন্য স্ক্রিপ্টের প্রয়োজন হয়। স্ক্রিপ্টে গল্পের চরিত্র, তারা কী বলছে, কীভাবে বলছে, কীভাবে নড়ছে, এই পুরো ঘটনার সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে কী হচ্ছে- সবকিছু স্ক্রিপ্টে উল্লেখ থাকতে হয়। এজন্য ক্রিয়েটিভ থিংকিং ও ভালো গল্প বলার দক্ষতা থাকতে হবে।
ক্রিয়েটিভ কন্টেন্ট রাইটার
এটা নিজস্ব পারদর্শিতার বিষয়। তবে কন্টেন্ট রাইটিং এর সব শাখাতেই ক্রিয়েটিভিটির প্রয়োজন আছে। কিছু কিছু জায়গায় এই বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- ম্যাগাজিন বা কোনোসাহিত্য প্ল্যাটফর্মে লেখা।
মার্কেটিং এর জন্য কন্টেন্ট রাইটিং
মার্কেটিং সেক্টরে কন্টেন্ট এর ভূমিকা অনেক বেশি। বর্তমানে প্রায় সব কোম্পানিতেই ডিজিতাল মার্কেটিং এর উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়। ইমেইল মার্কেটিং, ওয়েবসাইটে ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রমোশন সবকিছুর জন্যই এর প্রয়োজন রয়েছে।
কমিউনিকেশন ম্যাটারিয়াল লেখক
যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের লেখার প্রয়োজন হয়। তাদেরকে কমিউনিকেশন ম্যাটারিয়াল লেখক বলা হয়। ইমেইল, ফোনে তেক্সট, নিউজলেটার, প্যাম্ফলেটে, প্রেস রিলিজের মত অফিশিয়াল লেখা এখানে লেখা হয়। এসব লেখায় নির্দিষ্ট কিছু ফরম্যাট থাকে।
অ্যাসাইনমেন্ট ও রিপোর্ট রাইটিং
নিজেদের লেখাপড়ার বাইরে অনেকেই অন্যের অ্যাসাইনমেন্ট করে দেন। এর বিনিময়ে অর্থও আয় করা সম্ভব। আমাদের দেশে এর প্রচলন কম। অন্যান্য দেশ যেমন- আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক অ্যাসাইনমেন্টগুলো অন্য কাউকে দিয়ে করায় অর্থাৎ আউটসোর্স করে থাকে।
প্রোডাক্ট রিভিউ
আপনি যখন কোন পণ্য কিনতে চান তখন সবার আগে তার রিভিউ দেখেন। এই রিভিউগুলো লেখাও এক ধরনের কন্টেন্ট রাইটিং। সাধারণত ই-কমার্স ওয়েবসাইট বা মার্কেটপ্লেসগুলোতে বিভিন্ন প্রোডাক্ট বা সার্ভিস সম্পর্কে রিভিউ দেয়ার সুযোগ থাকে। যেগুলো দেখে ক্রেতারা সে প্রোডাক্টগুলো কেনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। অ্যামাজন, ই-বে থেকে শুরু করে অনেক ওয়েবসাইটে প্রোডাক্ট রিভিউ লেখা হয়। এসব লেখায় প্রোডাক্টের ডেসক্রিপশন, ব্যবহারের নিয়ম, ভালো ও মন্দ দিক বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে হয়। এসব এলখা শুরুর আগে প্রোডাক্ট সম্পর্কে ভালোভাবে পড়ে জেনে নিতে হয় এবং ক্লায়েন্টের প্রয়োজন অনুযায়ী কন্টেন্ট তৈরি করতে হয়।
কীভাবে কন্টেন্ট রাইটিং এ দক্ষ হওয়া যায়?
প্রচুর পড়তে হবে
আপনি যখন লেখাকে পেশা হিসেবে নিতে চাচ্ছেন, তখন লেখার প্রতি আপনার প্রবল আগ্রহ থাকতে হবে। যে বিষয়ে আর্টিকেল লিখবেন সে বিষয়ে আপনাকে প্রচুর পড়তে হবে এবং সমসাময়িক টপিক নিয়েও রিসার্চ করতে হবে।
ব্লগ চালু করা
নিজের একটি ব্লগিং সাইট চালু করতে হবে। নিয়মিত নিজের লেখা লিখলে ক্লায়েন্টকেও সেই প্যাটার্ন সহজে বোঝাতে সক্ষম হবেন। আর লেখার বিষয়ে আপনি কতটা দক্ষ সেটাও বোঝা যাবে।
সাবলীলভাবে লেখা
ভাষাগত জ্ঞান, শব্দচয়ন, বাক্য গঠন, বানান ইত্যাদি সম্পর্কে দক্ষতা জরুরি। সেই সাথে সাবলীল ভাষায় লেখা জানতে হবে। এজন্য নিয়মিত ভাষার চর্চা করুন।
এসইও বোঝা
বর্তমানে কন্টেন্ট রাইটিং এর জগতে এসইও খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। গুগল র্যাংক বাড়াতে এটি খুবই কাজে আসে। বিশেষ করে, কীওয়ার্ড কী, কেন প্রয়োজন, কীভাবে লেখায় এর ব্যবহার করতে হবে, নিশ কী, এর গুরুত্ব, লিংক বিল্ডিং এসব সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে।
প্রতিক্রিয়া নেয়া
আপনি যদি লেখালেখিতে প্রফেশনাল হতে চান, তাহলে প্রফেশনালদের কাছ থেকে ফিডব্যাক, সাজেশন, রিভিউ, এমনকি সমালোচনাও গ্রহণ করতে হবে। এগুলো আপনার লেখার মান বাড়াতে সাহায্য করবে। কাছের যে কোনো মানুষকে লেখা পড়তে দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানুন। ভুল ধরিয়ে দিলে সেটা সংশোধনের চেষ্টা করুন।
কমফোর্ট জোন থেকে লেখা শুরু করা
যখন কোনো বিষয় নিয়ে নতুন লেখা শুরু করবেন, তখন জানাশোনা আছে এমন বিষয় দিয়ে শুরু করুন। তাহলে লেখাটা ততটা কঠিন লাগবে না। কোনোকিছুকে প্রফেশনালি নেয়ার আগে অনুশীলন করে আয়ত্তে আনাটা জরুরি। শুরুতেই হয়ত লেখা মনের মতো হবে না। তবে সময়ের সাথে সাথে অবশ্যই উন্নতি হবে।
কোথায় কাজ খুঁজবেন?
চাকরির বিভিন্ন ওয়েবসাইট
বর্তমানে এই পেশার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই বিভিন্ন কোম্পানিতেও প্রচুর নিয়োগ দেয়া হয়। চাকরির ওয়েবসাইটগুলোতে সার্চ করলেই দেখবেন কন্টেন্ট/কপি রাইটার/স্ক্রিপ্ট রাইটার – এমন পজিশনে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এসব কোম্পানিতে শুরুতে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ শিখে পরে ফুল টাইম হিসেবে যোগদান করতে পারেন।
ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস
অনলাইন মার্কেটপ্লেসে এখন কন্টেন্ট রাইটিং এর বাজার এখন বেশ বড়। ফ্রিল্যান্সিং বিভিন্ন সাইটের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার, ফাইবার ইত্যাদি।
ব্লগিং/পাবলিশিং ওয়েবসাইট
নিজের লেখা পাবলিশ করার বেস্ট জায়গা হচ্ছে ব্লগিং বা পাবলিশিং ওয়েবসাইট। নিজের নামে একাউন্ট খুলে, লেখা পাব্লিশ করে, ওয়েবসাইটের পলিসি অনুযায়ী আয় করা সম্ভব।
প্রকাশনী
অনলাইন ছাড়া নিজের নামে বই প্রকাশ করতে চাইলে প্রকাশনীগুলোর কাছে আপনাকে যেতে হবে। পান্ডুলিপি থেকে বই তৈরি করতে হলে বেশ ধৈর্য নিয়েই লেগে থাকতে হবে।
পত্রিকা ও ম্যাগাজিন
দেশে অনেক পত্রিকা ও ম্যাগাজিন রয়েছে। যেখানে আপনি নিজের নামে লেখা প্রকাশ করতে পারবেন যদি লেখালেখিতে দক্ষ হোন। দেশের প্রায় সব পত্রিকাতেই কন্টেন্ট রাইটার হিসেবে আলাদাভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
কন্টেন্ট রাইটিং এর প্রয়োজনীয়তা এখন শুধু দেশে নয়, বিশ্বজুড়েও। আপনি যে কোনো ভাষায় দক্ষ হলেই এই কাজটা বেশ ভালোভাবে করতে পারবেন। বিশেষ করে ইংরেজিতে পারদর্শী হলে যে কোনো টপিকেই লেখা সহজ। আর লিখতে পারলে আয় নিয়েও ভাবতে হবে না। মনে রাখবেন, দুনিয়াতে যতদিন ব্যবসা আছে, ততদিন কন্টেন্টের চাহিদাও আছে। তাই পড়ুন, জানুন, লিখুন। হয়ে উঠুন দক্ষ কন্টেন্ট রাইটার।