ধরুন আপনি একজন নতুন উদ্যোক্তা অথবা আপনার পুরোনো একটি ব্যবসা আছে, কিন্তু সেটিকে আপনি নতুন করে সাজাতে চাচ্ছেন- সেক্ষেত্রে একটি সঠিক ব্যবসায়িক মডেল নির্বাচন করা ব্যবসা শুরু করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দীর্ঘমেয়াদী আয়, কোম্পানীর মূল নীতি ও লক্ষ্য ঠিক রাখা, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক ব্যবসায়িক মডেল নির্বাচন হতে পারে আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের সাফল্যের অন্যতম কারণ। যে কোনো ব্যবসাতে একটি স্পষ্ট মডেল থাকলে ব্যবসাটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হয়।
ব্যবসায়িক মডেল কী?
সাধারণত যে কোনো জিনিসের মডেল বলতে আমরা বুঝি সেটির একটি বস্তুত ধারণা। অর্থ্যাৎ জিনিসটি দেখতে কেমন হবে, কীভাবে কাজ করবে এটির একটি সাম্যক ধারণা। ব্যবসায়িক মডেলও এমনই। সোজা কথায় বলতে গেলে আপনার ব্যবসা কোন উপায়ে চলবে, কীভাবে উৎপাদন হবে, কীভাবে পণ্য বাজারজাত হবে, কীভাবে আয় করবেন সেটি থেকে, কাস্টমার সার্ভিস, বিজ্ঞাপন বা মার্কেটিং, লজিস্টিক্স ইত্যাদি কেমন হবে এরকম ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সকল দিকের একটি খসড়া ধারণা বা মডেল। খসড়া ধারণা হলেও এটিকে হালকাভাবে নেয়ার কিছু নেই কারণ কোনো বিনিয়োগকারী সংস্থার সাথে কাজ করতে গেলে অথবা আপনার ব্যবসার সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি।
যদি কোনো বিনিয়োগকারী সংস্থার সাথে কাজ করতে চান সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই আপনার ব্যবসায়িক মডেলটি যে লাভজনক হবে তা প্রমাণ না করতে পারলে হয়তো একসাথে কাজও করতে পারবেন না। একটি ব্যবসায়িক মডেল তৈরীর পর এটি ব্যবসার সাথে সাথে উন্নত ও বিকশিত হয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক মডেলটি গুরুত্বের সাথে বাছাই করা উচিত। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক মডেলের ব্যাপারে জানা ও শেখা আপনাকে সাহায্য করবে সঠিক লাভজনক ব্যবসায়িক মডেল বাছাই করতে। যেটি থেকে আপনি আরো বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক মডেল একটি কোম্পানিকে প্রতিযোগীতামূলক বাজারে দীর্ঘদিন টিকে থাকতেও সাহায্য করে।
কয়েকটি ব্যবসায়িক মডেল সম্পর্কে ধারণা
ব্যবসায়িক মডেল হতে গেলে যে বিষয়গুলো তার মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে তা হলো-
১) ব্যবসায়িক মডেলে অবশ্যই মূল্য ও মুনাফার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা থাকবে। পণ্যের কাঁচামাল এর খরচ থেকে শুরু করে মূল্য নির্ধারণ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া উল্লেখ থাকবে।
২) চার ধরনের ব্যবসায়িক মডেলের মধ্যে মূল সম্পদ ও লাভ, কাস্টমার ভ্যালু প্রপোজিশন (যে প্রক্রিয়ায় কোনো কোম্পানি তাদের পণ্য বা সেবা কাস্টমারকে কেনার জন্য রাজি করায়), এবং লাভের সূত্র- এই উপাদানগুলো থাকবে।
৩। যেকোনো কোম্পানি ফ্রিমিয়াম (ফ্রি+প্রিমিয়াম), সাবস্ক্রিপশন ও রিসেলসহ অনেক স্ট্যান্ডার্ড অথবা হাইব্রিড ব্যবসায়িক মডেল ব্যবহার করতে পারে।
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসায়িক কিছু মডেলের ধারণা
১) সাবস্ক্রিপশন মডেল
সাবস্ক্রিপশন মডেল বর্তমানে যত ব্যবসায়িক মডেল আছে তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সাফল্যজনক। যেহেতু বর্তমানে ই-কমার্স ব্যপকহারে প্রসারিত হচ্ছে তাই সাবস্ক্রিপশন মডেলের ব্যবহারও বাড়ছে। এটি সফল হওয়ার আরো বড় কারণ হচ্ছে, এটি একবার চালু করলে পরবর্তীতে এটি থেকে আয় চলমান থাকে। এই মডেলটি সাপ্তাহিক, মাসিক অথবা বার্ষিক সাবস্ক্রিপশন ফি এর বিনিময়ে গ্রাহকদের একটি পরিষেবা বা পণ্যের নিয়মিত এক্সেস বা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। নিয়মিত গ্রাহক ধরে রাখতে এবং নির্দিষ্ট ক্যাশ ফ্লো ধরে রাখতে এটি একটি দুর্দান্ত উপায়। বর্তমানে জনপ্রিয় ই-কমার্সে সাবস্ক্রিপশন মডেল সবচেয়ে সফল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই মডেলের দারুণ সব উদাহরণের মধ্যে আছে আন্তর্জাতিকভাবে সফল নেটফ্লিক্স, হুলু, আমাজন প্রাইম, ডিজনী প্লাস ইত্যাদি। সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে আপনি এই ওইয়েসাইট বা অ্যাপস এর বিভিন্ন কন্টেন্ট দেখতে পারবেন বা ব্যবহার করতে পারবেন। আমাদের দেশও এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। আমাদের দেশীয় এ ধরনের সাবস্ক্রিপশন মডেল বেইজড প্ল্যাটফর্ম এর মাঝে আছে বিঞ্জ, চরকি ইত্যাদি। পাশের দেশ ভারতে রয়েছে হইচই।
এটি যে শুধু বিনোদন মাধ্যমের মাঝে কাজ করে এমন নয়, বরং নানা রকম সফটওয়্যার কোম্পানীও এই মডেল ব্যবহার করে থাকে। আবার সাধারণত ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানীগুলোও এ ধরনের মডেলের উপরই কাজ করে থাকে। আশেপাশে আমরা একটু খুঁজলেই এরকম নানারকম জনপ্রিয় ওয়েবসাইট, অ্যাপস অথবা কোম্পানী। যারা এই মডেলটি ব্যবহার করে আজ সফলভাবে তাদের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে।
২) ফ্রিমিয়াম মডেল
সফটওয়্যার ও অ্যাপস ডেভেলপারদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় একটি মডেল হলো ফ্রিমিয়াম মডেল। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটি মূলত ফ্রি ও প্রিমিয়াম দুই ধরনের কন্টেন্টের সংমিশ্রণে করা একটি মডেল। মূলত এই মডেলে কিছু প্রাথমিক সার্ভিস ব্যবহার করা যায় একদম বিনামূল্যে আর প্রিমিয়াম ফিচারগুলো ব্যবহার করতে গেলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য বা ফি দিতে হয়। যেহেতু এই মডেলের মাধ্যমে কোনো অ্যাপস বা সফটওয়্যারের কিছু অংশ বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায় তাই এটি অনেক বেশি কাস্টমার আকর্ষণ করতে পারে এবং কাস্টমারের মাঝে সেবাটি ব্যবহারের আগ্রহ তৈরী করে। একবার কাস্টমার বিনামূল্যে ব্যবহার করে যদি আগ্রহ পেয়ে যায় এবং সন্তুষ্ট হয় তবে নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে প্রিমিয়াম কন্টেন্ট ব্যবহারেও তারা আগ্রহী হবে। এই মডেলের সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো আপনার সেবা বা পণ্যটিকে আকর্ষণীয় করে তৈরী করা। এ ধরনের মডেলের ব্যবসাসফল অ্যাপস, সফটওয়্যার, ওয়েবসাইটের হাজার হাজার উদাহরণ বর্তমানে আছে।
যেমন- ধরা যাক সাটারস্টক (Shutterstock) সাইটের কথা। আন্তর্জাতিকভাবে বহুল প্রচলিত এই সাইটটি গ্রাফিক্স ডিজাইনার বা ফটোগ্রাফি এডিটিং এর সাথে যারাই যুক্ত আছেন তারাই চেনেন। এই সাটারস্টকের কিছু কন্টেন্ট বিনামূল্যে ব্যবহার করা গেলেও অনেক কন্টেন্টই নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে এক্সেস করে নিতে হয়। এরকম আরও অনেক প্রচলিত সাইট এর মাঝে আছে ফ্রিপিক (freepik), ছবি এডিটের জন্য জনপ্রিয় এন্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপস পিক্সার্ট (Picsart), মিউজিকের জন্য হালের জনপ্রিয় অ্যাপস স্পটিফাই (Spotify) ইত্যাদি। বর্তমানে অনেক নিউজপেপার বা আর্টিকেল বেজড সাইটও এ ধরনের মডেল ব্যবহার করে থাকে। তাই বলা যায় ই-কমার্সের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কাস্টমার পেতে চাইলে ফ্রিমিয়াম মডেলটি হতে পারে একটি দারুণ ব্যবসাসফল মডেল।
৩) অন-ডিমান্ড সার্ভিস মডেল
বর্তমানের ব্যস্ত বিশ্বে আরেকটি দারুণ লাভজনক ব্যবসায়িক মডেল হলো অন-ডিমান্ড সার্ভিস মডেল। অর্থাৎ কাস্টমার চাওয়ামাত্র যে সার্ভিস পায় সেটিই হলো অন-ডিমান্ড সার্ভিস। এর অনেক জনপ্রিয় উদাহরণ হলো উবার ও ফুডপান্ডা। আপনি অফিসে যাবেন, নিজস্ব যানবাহন নেই, ডেকে নিলেন উবার সার্ভিস। যখন তখন খাবার পৌঁছে দিবে আপনার ঘরের দুয়ারে- ফুডপান্ডা। নির্দিষ্ট ভাড়া বা ফি এর মাধ্যমে এই কোম্পানিগুলো থেকে আপনি আপনার পছন্দমতো সার্ভিস নিতে পারবেন। এছাড়া আমাদের দেশে পাঠাও সহ এরকম নানারকম সার্ভিস জনপ্রিয় হচ্ছে। বর্তমানে সারাবিশ্বেই এ ধরনের লন্ড্রি, গ্রোসারী বা কাঁচাবাজারের সার্ভিস, হাউজ ক্লিনিং সহ নানারকম অন-ডিমান্ড সার্ভিস বেশ সফলভাবে ব্যবসা করছে। তবে এই মডেলে আপনার একটি শক্তিশালী লজিস্টিক ও টিম এর প্রয়োজন হবে। কারণ এ ধরনের সার্ভিস একটি সুন্দর ও নিয়মতান্ত্রিক টিমওয়ার্ক ছাড়া উন্নত করা সম্ভব না। তাই আপনার যদি একটি দারুণ টিম চালানোর দক্ষতা থাকে এবং শক্তিশগালী লজিস্টিক্স থাকে তবে অন-ডিমান্ড সার্ভিস আপনি বেছে নিতেই পারেন।
৪) কনজুমার-টু-কনজুমার (C2C) মডেল
যে প্ল্যাটফর্মগুলো তার ইউজারদের মধ্যে পণ্য বা সেবা বিক্রির সুবিধা দেয় সেগুলো C2C মডেলের উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা। সাধারণত এ ধরনের প্ল্যাটফর্মগুলোতে পণ্য বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট ফি দিয়ে সেলার (seller) অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। তবে কেনার ক্ষেত্রে এ ধরনের অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণ ব্যবহারকারী যে কেউই কিনতে পারে বিক্রেতাদের থেকে তবে প্রতি পণ্যের বিক্রির মাঝে প্ল্যাটফর্মটি কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো আন্তর্জাতিকভাবে বহুল পরিচিত আলী এক্সপ্রেস (AliExpress), ইটসি (ETSY) কিংবা ইবে (EBay)। আবার আমাদের দেশেও এরকম ব্যবসাসফল একটি প্ল্যাটফর্ম হলো দারাজ। যেহেতু এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে কেনাবেচায় খুব বেশি ঝামেলা নেই, তাই প্রচুর পরিমাণে কাস্টমার আকর্ষণ করা যায় এই মডেলের মাধ্যমে। আপনার যদি নিজে কম ঝামেলার মাধ্যমে একটি নিশ্চিত আয়ের মডেলের প্রয়োজন হয় তবে C2C মডেল হতে পারে একটি সেরা অপশন।
৫) মার্কেটপ্লেস মডেল
ই-কমার্সের সাথে যারা জড়িত তারা মার্কেটপ্লেস শব্দটি শুনেই থাকবেন। আরেকটি দারুণ ব্যবসায়িক মডেল হলো মার্কেটপ্লেস মডেল। মডেলটি অনলাইন বা অফলাইন দুইভাবেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। C2C মডেল মার্কেটপ্লেসের সাথে জড়িত হলেও মার্কেটপ্লেস এর সাথে এর মূল পার্থক্য হলো এটিতে শুধুমাত্র কাস্টমাররা কিনে এবং বিক্রেতারা বিক্রি করে। অর্থাৎ যেকোনো ব্যবহারকারীই বিক্রি করতে পারে না। সোজা কথায় লোকাল বাজারের মতো এখানে নির্দিষ্ট দোকান থাকে এবং সেখান থেকে কাস্টমাররা কিনে থাকে। তবে মার্কেটপ্লেস মডেলেরও নানারকম ধরন রয়েছে।
যেমন ধরুন, বিজনেস টু কাস্টমার (B2C) কনসেপ্ট তার মধ্যে একটি। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এটিতে যে কোনো বিক্রেতা সরাসরি তার পণ্য বা সেবা কাস্টমারের কাছে বিক্রি করে থাকেন। এখানে মার্কেটপ্লেস একটি মাধ্যমের মতো ব্যবহৃত হয়। মার্কেটপ্লেস মিডিয়া বিক্রেতা থেকে কাস্টমারের হাতে পণ্য বা সেবা পৌঁছানোর জন্য ডেলিভারি প্রসেস, পণ্যের গুনগত মান নিশ্চিতকরণ এ ধরনের কাজ করে থাকে। যেমন- অ্যামাজন (Amazon)। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই প্ল্যাটফর্মটি মার্কেটপ্লেস B2C মডেলের একটি দারুণ উদাহরণ। এছাড়া আছে বিজনেস টু বিজনেস (B2B) মডেল। এই মডেলের প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাণিজ্যিক লেনদেন সহজ করা। এই ধারণা অনুযায়ী বাজারে সাপ্লায়ার, প্রস্তুতকারক কোম্পানী, পাইকারী বিক্রেতা এবং ডিস্ট্রিবিউটার এমন সংস্থা বা কোম্পানিগুলোকে কানেক্ট করে। ফলে তাদের নেটওয়ার্কিং আরো জোরালো হয় এবং তারা আরো বেশি গ্রাহকদের খুঁজে বের করতে পারে। যেমন- আলীবাবা (Alibaba) ও আপওয়ার্ক (Upwork)। এছাড়া পিয়ার টু পিয়ার (P2P) অন ডিমান্ড মার্কেটপ্লেস মডেলগুলোও বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
৬) রেজর-ব্লেড মডেল
১৯০০ সালের গোড়ার দিকে রাজা সি. জিলেট এই দারুণ ব্যবসায়িক মডেলটি দাঁড় করান। তিনি সাশ্রয়ী মূল্যে জনসাধারণের কাছে রেজর বিক্রি করতেন। তবে তার লাভ মূলত উঠে আসতো রেজরে রিপ্লেসেবল ব্লেড বিক্রি করে। ব্যবসার মডেলটি এত সফল ছিলো যে আজও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটি তুমুল জনপ্রিয়। আর জিলেটের কোম্পানি রেজর এবং ব্লেডের ক্ষেত্রে যে সারা বিশ্ব সমাদৃত তা তো আপনারা জানেনই। মূলত এই মডেলে প্রধান পণ্য বা সেবাটি অত্যন্ত কম মূল্যে বা বলতে গেলে ফ্রিতেই দেয়া হয়। তবে এর সাথের অংশ বা ব্যবহার করতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য থেকে মূল লাভ উঠে আসে। যেমন- এই রেজরের কথাই ধরুন, একটি রেজরের দাম কত হতে পারে? একটি রেজর একবার কিনলে বার বার আপনার কেনা প্রয়োজন হচ্ছে না, তবে আপনি বার বার কিনবেন এর ব্লেড। এই ব্লেডটি থেকেই কোম্পানী মূল আয় করে থাকে।
গেমিং ইন্ডাস্ট্রিও এই মডেলটি ব্যবহার করে থাকে। যেমন ধরুন, মাইক্রোসফট তাদের প্রথম এক্সবক্স ১ মাত্র ৪৯৯ ডলারে সেল করতো যা থেকে তাদের কোনো লাভই আসতো না। তবে এক্সবক্সের প্রতিটি ভিডিও গেমের মূল্য ছিলো ৬০ ডলার, মূল লাভ এখান থেকেই উঠে আসতো তাদের। একইভাবে ফটোকপি মেশিন, প্রিন্টিং মেশিন কোম্পানীগুলোও লাভ করে থাকে। মূল মেশিনের দাম বেশি না হলেও এর প্রয়োজনীয় পার্টস, কালি ইত্যাদি থেকে তাদের মূল অর্থ আয় করে। তাই আপনি যদি বড় আকারের কোনো মেশিন বা এ ধরনের প্রস্তুতকারক কোম্পানি তৈরী করতে চান, জিলেটের এই দারুণ মডেলটি ব্যবহার করতে পারেন।
৭) বিজ্ঞাপনভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেল
বর্তমানে আমরা নানারকম সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে থাকি। সাধারণত এ ধরনের সব প্ল্যাটফর্মগুলোতে অ্যাকাউন্ট খোলা বা ব্যবহার করা সম্পূর্ণই ফ্রি। তাহলে এ কোম্পানীগুলো কীভাবে তাদের ব্যবসা থেকে আয় করে? তাদের মূল আয় এসব প্ল্যাটফর্মের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন থেকে। ফেসবুক এ মডেলের সবচেয়ে জনপ্রিয়। আমরা সচরাচর ফেসবুক ব্যবহার করছি এজন্য আমাদের কোনো অর্থ বা ফি প্রদানের প্রয়োজন হচ্ছে না। তবে আমাদের ব্যবহারের মাঝেই আমরা নানারকম কোম্পানির বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখতে পাই, ফেসবুক মূলত এ সকল কোম্পানিগুলো থেকেই আয় করে থাকে এবং টার্গেটেড অডিয়েন্স সিলেক্ট করে তাদের পছন্দ অনুযায়ী পণ্যের বিজ্ঞাপন তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকে। ইউটিউব, টুইটার এমন কি পিন্টারেস্টও এ ধরনের মডেলের উপর তৈরী। এ মডেলটি অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসার জন্য একটি সফল মডেল। তবে এক্ষেত্রে এখন প্রতিযোগীতা একটু বেশি। যেহেতু ব্যবহারকারীর উপর এটির আয় অনেক বেশি নির্ভর করে তাই আকর্ষণীয় প্ল্যাটফর্মের সাথে সাথে বিজ্ঞাপনের সংখ্যাও সীমার মাঝে রাখতে হয়। এছাড়া অনেক সময় অনেক ব্যবহারকারী অ্যাড ব্লক ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনবিহীন প্ল্যাটফর্মও ব্যবহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন যেন বিরক্তির কারণ না হয়, আকর্ষণীয় ও ব্যবহারকারীর জন্য প্রয়োজনীয় হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হয়।
৮) রিসেলার মডেল
রিসেলার মডেলটি বর্তমানে এফিলিয়েট মার্কেটিং এবং ড্রপশিপিং এর কারণে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। মূলত যখন আপনি নিজে কোনো পন্য বা সেবা সরাসরি বিক্রি করেন না বরং উৎপাদক কোম্পানির বিভিন্ন অফার বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কাস্টমারের কাছে বিক্রি করে থাকেন সেটিই হলো রিসেলিং। যেমন ধরুন, আপনার স্থানীয় কিছু কৃষক যারা ফল উৎপাদন করে থাকে, আপনি তাদের সাথে চুক্তি করলেন। আপনার একটি দোকান আছে, সেটিতে আপনি বিজ্ঞাপন দিলেন তাজা এই ফলগুলো বিক্রির। এখন আপনি কৃষকদের থেকে একটি মূল্যে ফলগুলো কিনে এনে আপনার কিছু লভ্যাংশ যোগ করে বিক্রি করলেন। এটিই রিসেলিং। অর্থাৎ কোনো কোম্পানি একটি পণ্য বিক্রি করে, আপনি তাদের থেকে পণ্যটি কম দামে পান, এবং যে দামে কিনবেন সেখান থেকে আপনার লভ্যাংশ যোগ করে আপনি কাস্টমারের বিক্রি করে থাকেন- এটিই হলো রিসেলিং মডেল।
বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে এই রিসেলিং মডেলের ব্যবহার হচ্ছে। যেহেতু এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো বেশ জনপ্রিয় তাই রিসেলিং মডেলের ক্ষেত্রে যোগাযোগ, পণ্য আনা নেয়া, পণ্যের প্রচার সহজলভ্য হয়েছে। ফলে কোম্পানি থেকে কাস্টমারদের কাছে বিক্রি করাও রিসেলারদের জন্য বেশ সহজ হয়ে উঠেছে, তাই ই-কমার্সে বেশ সফল আরেকটি মডেল হিসেবে রিসেলিংকে আপনার লিস্টে রাখতেই পারেন।
যেকোনো ব্যবসা সফল করার ক্ষেত্রে ধৈর্য্য, অধ্যবসায় যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন সঠিক প্ল্যান ও সেই অনুযায়ী কাজ করা। একটি ব্যবসায়িক মডেল আপনার ব্যবসার আদ্যোপান্তের একটি খসড়া আপনার সামনে তুলে ধরে। যার ফলে ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে ফোকাস করতে আপনার সুবিধা হয়। এছাড়া ব্যবসার গতিবিধিও আপনার নজরে থাকবে ফলে পণ্য বা সেবার উৎপাদন, বিক্রি বা ব্যবসা থেকে অর্থ উপার্জন সবই একটি নিয়মের মাঝে চলবে। প্রতিটি ব্যবসায়িক মডেলের রয়েছে নিজস্ব গতিবিধি ও সুবিধা। সাথে আছে কিছু অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতাও। আপনার ব্যবসার জন্য কোন মডেলটি সবচেয়ে উপযুক্ত হবে সেটি নির্ধারণ করতে আপনার ব্যবসায়ের বাজার, প্রতিযোগীতা, পণ্যের সহজলভ্যতা, আপনার টার্গেট কাস্টমার, আপনার ব্র্যান্ড বা কোম্পানীর মূল লক্ষ্য এগুলো বিবেচনা করুন। এই ব্যবসায়িক মডেলগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে ভাবুন, চিন্তা করুন যে আপনার ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে কোনটি সবচেয়ে বেশি লাভজনক হবে। একটি সঠিক ব্যবসায়িক মডেলই পারে টেকসই ব্যবসায়িক উদ্যোগের ভিত্তি স্থাপন করতে। তবে ব্যবসায়িক মডেল তখনই সফলভাবে কাজ করে যখন আপনই আপনার ব্যবসা বা উদ্যোগ থেকে নিয়মিত অর্থ উপার্জন করতে পারেন। তাই শেষ পর্যন্ত মুনাফা ধরে রাখতে পারলেই বোঝা যাবে আপনি সঠিক ব্যবসায়িক মডেলটি বেছে নিতে পেরেছেন।