অরিগ্যামির আদ্যোপান্ত | সুনিপুণ দক্ষতায় শিখুন কাগজের ভাঁজ

‘কাগজের নৌকা, কেউ বানিয়েছে তা’ – এমন সুন্দর লাইনে যে কাগজের নৌকার কথা বলা হচ্ছে, তার একটি স্বীকৃত নাম রয়েছে। একে বলা হয় অরিগ্যামি। ছোটবেলায় কাগজ কেটে বিভিন্ন ফুল, পাখি, নৌকা বানায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া একটু কষ্টকরই। মজার ব্যাপার হলো, আমরা অনেকেই জানি না ভিজ্যুয়াল আর্ট এর অনেক পুরাতন একটি ফর্ম হচ্ছে অরিগ্যামি। চোখের সামনে কাগজ দিয়ে হাতে তৈরি এক অনন্য সুন্দর শৈল্পিক কারুকাজ এটি। আজ আমরা জানবো অরিগ্যামির আদ্যোপান্ত এবং সুনিপুণ দক্ষতায় কীভাবে এই কাগজের ভাঁজ শিখবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত।

অরিগ্যামির আদ্যোপান্ত  

প্রথম অরিগ্যামির ধারণা পাওয়া যায় জাপান থেকে। অরিগ্যামি শব্দটি জাপানি শব্দ থেকেই আবিষ্কার করা হয়েছে, যার অর্থ হলো কাগজের ভাঁজ। তবুও অনেক গবেষকই ধারণা করেন, এর উদ্ভব চীন থেকেও হতে পারে, যদিও এই শিল্পের প্রসারতার হাতেখড়ি জাপানেই। অবিশ্বাস্য হলেও অনেক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী এ দাবি করা হয়, এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে অরিগ্যামির আবিষ্কার হয় মজার ছলে কাগজ বা চামড়া কেটে বিভিন্ন আকৃতির নানা জিনিস ফুটিয়ে তুলতে। পরবর্তীতে এই শিল্পের বিস্তৃতি এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে এই শিল্পের কদর এখনও টিকে রয়েছে। জাপান থেকে ছড়িয়ে এখন পুরো বিশ্বের বাচ্চাদের কাছে অরিগ্যামি অত্যন্ত আগ্রহের একটি শিল্প হয়ে উঠেছে।

অরিগ্যামির জনক  

অরিগ্যামির আদ্যোপান্ত

জাপানের আকিরা ইয়োশিজাওয়াকে আধুনিক অরিগ্যামির জনক বলা হয়। জাপানি শব্দ অরি (Ori) মানে হচ্ছে ভাঁজ করা বা মোড়ানো আর কামি (kami) মানে হচ্ছে পেপার। পরবর্তীতে কামি (kami) থেকে শব্দটা গ্যামি (gami) হয়েছে। এইভাবে কাগজ ভাঁজ করে নতুন কিছু বানানোর শিল্পের নাম হয়েছে অরিগ্যামি। ধারণা করা হয়, যেহেতু কাগজ নিয়েই কাজ তাই অবশ্যই কাগজ আবিষ্কার এর পরই অরিগ্যামি প্রসারতা পায়। এখানে কিন্তু কাগজ কাটা যায় না, বরং ভাঁজে ভাঁজে কাগজকে ভেঙে বিভিন্ন আকৃতি ফুটিয়ে তুলতে হয়। এদিকে কাগজ কেটে আঠার মাধ্যমে জোরা লাগিয়ে যা তৈরি করা হয় তা হলো কিরিগ্যামি। দুটোর মধ্যে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। জাপান ছাড়াও চীন, জার্মানী, ইতালি ও স্পেনেও এটি জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী শিল্প।

কীভাবে বানাতে হয়?

অরিগ্যামি শিখতে কাগজ ছাড়া আর তেমন কিছু দরকার নেই। তবে একদম নিখুঁতভাবে বানাতে গেলে একটা স্কেল আর কেঁচি বা ছুড়ির দরকার পড়তে পারে। কাগজ কী ধরনের নিবেন সেটা নির্ভর করে আপনি কী বানাতে যাচ্ছেন তার উপর। কাগজের পুরুত্ব আর রঙ এই দুটাই মূলত দেখার বিষয়। চাইলে সাদা কাগজ দিয়েই আপনি সবকিছু বানাতে পারেন, তারপর তাতে ইচ্ছেমত রঙ করে নিতে পারেন। তবে তার থেকে সহজ হচ্ছে রঙিন কাগজ নেয়া। বর্তমানে মানসম্মত রঙিন কাগজের অভাব নেই, যা দিয়ে সুন্দরভাবেই বিভিন্ন জিনিস বানানো যায়। বিভিন্ন দোকানে আলাদাভাবে এখন অরিগ্যামি পেপারই পাওয়া যায়। প্যাকেট খুলে কোনো ধরনের কাটাকাটি ছাড়াই পছন্দের অরিগ্যামি বানিয়ে ফেলা যায় এখন।

কত ধরনের ভাঁজ থাকে এতে?

অরিগ্যামির আদ্যোপান্ত

কী ধরনের শেইপ আপনি তৈরি করবেন, তার জন্য অবশ্যই জানতে হবে কাগজের ভাঁজ। পাখি, ফুল, খেলনা, নৌকা, এয়ারপ্লেন সবই বানানো যাবে এক টুকরো কাগজ দিয়ে। শুধু জানতে হবে ভাঁজ। কাগজের কয়েক ধরনের ভাঁজের নাম চলুন জেনে নেয়া যাক-

  • ভ্যালি ফোল্ড (Valley fold)
  • মাউন্টেইন ফোল্ড (Mountain fold)
  • বেলুন ফোল্ড (Balloon fold)
  • কাইট ফোল্ড (Kite fold)
  • ফিশ ফোল্ড (Fish fold)
  • নেইল ফোল্ড (Nail fold)
  • র‍্যাবিট ইয়ার ফোল্ড (Rabbit ear fold) ইত্যাদি

আবার যদি একটা কাগজকে সমান তিনভাগে ভাগ করতে চান তাহলে ঐটিকে বলে জেড ফোল্ড (Z fold)। চারভাগ করতে চাইলে বলে গেইট ফোল্ড (Gate fold)। পাঁচভাগ করতে চাইলে সেটি হবে স্টেয়ার ফোল্ড (Stair fold)। পাশাপাশি কিছু শেইপের কথা জানতে হবে।

এই শিল্পের প্রয়োজনীয়তা

অরিগ্যামি সব বয়সের মানুষের জন্যই উপযুক্ত ও আনন্দদায়ক, কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর বয়স থেকে অরিগ্যামি শেখানোর, শৈল্পিক উপায়ে আশেপাশের জিনিস ফুটিয়ে তোলার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই বয়স থেকেই তাদের মধ্যে কাগজ ভাঁজ করে একটি আকৃতি তৈরি করার যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। যার কারণে তারা নৌকা, বিমান, নানা ধরনের পাখি, বিভিন্ন প্রাণী তৈরি করার জন্য যে ফোল্ডিংগুলো করার প্রয়োজন হয় সেগুলো করতে পারে।

অরিগ্যামি করতে হয় বেশ মনোযোগ দিয়ে। এটি চর্চার মাধ্যমে স্থিরতা বজায় রাখতে হয় বলে ধৈর্য বাড়ে। আপনার সন্তান যদি এই শিল্পটি চর্চা করে, এটুকু বলা যায় যে তাদের যেকোনো কাজে মনোনিবেশ করার আগ্রহ বাড়বে।

এটি স্মৃতিশক্তি বাড়ায়, কারণ এমন এমন কিছু জটিল অরিগ্যামি চিত্র আছে যা আপনাকে কীভাবে শেষের দিকে যেতে হবে তা আগে থেকেই মাথায় ছক করে মনে রাখতে হবে। এছাড়াও অরিগ্যামি সৃজনশীলতা বাড়ায়। শিশু হোক বা বয়সে বড় কেউ, তারা যখন আগ্রহী হয়ে বিভিন্ন জিনিস বানানোর চেষ্টা করবে, তখন তার সৃজনশীলতা আরো বৃদ্ধি পাবে। নিজের মতো কল্পনা করে কোনোকিছু ফুটিয়ে তোলার দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে। এর পাশাপাশি হাত ও চোখের যৌথ পরিচালনায় সমন্বয় তৈরি হবে, যা যেকোনো কাজকেই সুন্দরভাবে পরিচালনা করার দক্ষতা বাড়াবে।

অরিগ্যামি শেখার আধুনিক উপায়

অরিগ্যামি

যেকোনো কিছু শেখার আধুনিক উপায়ই বলা চলে ইন্টারনেট, ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন প্রোগ্রাম। যেমন- ইউটিউব। অরিগ্যামি শেখার ক্ষেত্রে এটি ব্লেসিং এর মতো কাজ করবে। তার কারণ, কোনোকিছুর ছবি দেখে অতটা আন্দাজ করা না গেলেও সময় নিয়ে প্রত্যেকটা জিনিস ধাপে ধাপে দেখলে নিশ্চয়ই তা সম্পর্কে আর বিস্তর ধারণা পাওয়া যাবে। সে কাজটাই করে ইউটিউব। টিউটোরিয়াল এর মাধ্যমে ডিটেইলস প্রত্যেকটা জিনিস দেখা যায় এবং এর সাথে সাথে তখনই বানানো যায়। আবার ইন্টারনেট এভেইলেবল হওয়ার কারণে চাইলে অনেকবারও দেখা যায়, কোনো ধরাবাঁধা ব্যাপার থাকে না। যা প্র্যাকটিস করতে অনেক সাহায্য করে।

সামাজিকভাবে অরিগ্যামি চর্চা

বর্তমানে আর্টের প্রসার অনেক বেশি। এক্ষেত্রে অরিগ্যামিও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের প্রথম প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকেই যেমন বিভিন্ন রকম আকাআঁকি শেখানো হয়, তেমনই কাগজ কেটে ফুল পাখিও বানানো শেখানো হয়। কিন্তু তা এখন শুধুমাত্র পারিবারিক পর্যায়েই নেই। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এখন নিয়মিত প্রি স্কুল বাচ্চাদের অরিগ্যামি ক্লাস রাখা হয়, সেখানে প্রশিক্ষিত শিক্ষক সব বাচ্চাদের এক করে আনন্দ উৎসবের মত অরিগ্যামি চর্চা করেন। তাছাড়াও নানা ধরনের ওয়ার্কশপ আয়োজন করে বিভিন্ন আর্ট স্টুডিও, যেখানে যেকোনো বয়সের মানুষই চাইলে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে অরিগ্যামি চর্চা করতে পারেন। এছাড়াও সামাজিক অন্যান্য আয়োজনে মাঝে মাঝেই অরিগ্যামি আর্ট এর মাধ্যমে করা বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করা হয়, সাজানো হয়। যেমন- যেকোনো এক্সিবিশন, জন্মদিন, বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানেও আজকাল অরিগ্যামির উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো।

অরিগ্যামি করার জন্য কিছু পরামর্শ

অরিগ্যামির জন্য পরামর্শ

উন্নত মানের কাগজ ব্যবহার করুন: অরিগ্যামি কাগজের শিল্প হলেও সব ধরনের কাগজ দিয়ে এটি তৈরি করা যায় না। ভালো কাজ করতে হলে অবশ্যই ভালো মানের কাগজ কেঁচি ব্যবহার করতে হবে।

প্রচুর প্র্যাকটিস করুন: ভালো অরিগ্যামি বানানোর জন্য অনেক প্র্যাকটিস করা প্রয়োজন। কোনো জিনিস গঠনমূলকভাবে উপস্থাপন করা দক্ষতা বাড়ানোর কাজে সাহায্য করবে, ফলে পজিটিভ রেজাল্ট বেশি হবে। কাজে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা কমবে।

টিউটোরিয়াল দেখুন: অরিগ্যামি আকৃতির নিদর্শনসহ অনেক বই এবং অনলাইন টিউটোরিয়াল রয়েছে। এগুলি আপনাকে এই শিল্প সম্পর্কে আরও দক্ষ হতে এবং নতুন নতুন আইডিয়া পেতে সাহায্য করবে।

আর্ট যতবেশি সার্বজনীন করা যায় সেই আর্ট ততই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। অরিগ্যামির ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে বোঝা যায়। বহুবছর থেকে অরিগ্যামি চর্চার ফলাফল হচ্ছে এটাই, সার্বজনীনতা। অনেক ধরনের শিল্পই আছে যা অনেক কঠিন, অনেক দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের ব্যাপার। চাইলেই যে কেউ সেই আর্ট ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। কিন্তু অরিগ্যামির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরোটাই বিপরীত, এক টুকরো কাগজ নিয়ে যেকোনো বয়সের যে কেউ বেশ কয়েকটি ধাপ জানলেই খুব সুন্দর করে অরিগ্যামি আর্ট তৈরি করতে পারবেন, এখানেই এটির স্বার্থকতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *