ধরেন, আপনি কোনোকিছু বিক্রি করেন এবং খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে আপনার কাস্টমারদের কাছে জানান দিতে চান যে, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আমার পণ্যটাই সবচেয়ে ভালো’। কিন্তু আপনি কীভাবে এটা নিশ্চিত করবেন তারাও ঠিক একইভাবে আপনার পণ্য নিয়ে কনফিডেন্ট ফিল করবে? আবার বাকিদের তোয়াক্কা না করেই আপনার থেকেই কিনবে? কাস্টমারদের কাছে নিজ পণ্য সম্পর্কে এই অথোরিটিটা তৈরি করাকেই মূলত আমরা ‘অথোরিটি মার্কেটিং’ হিসেবে বলছি।
আরেকটু সহজ ভাষায় যদি বলি, মানুষের মনে নিজের জন্য বা নিজ সেল করা পণ্যের জন্য যে অথোরিটি তৈরি করা হয় সেটাকেই মূলত আমরা অথোরিটি মার্কেটিং বলতে চাই। ভাবখানা এমন থাকবে, আরেহ আমি বলেছি মানেই এতে কোনো ভেজাল নাই, ভুল নেই। নিঃসন্দেহে আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে কিছু সুপরিচিত ব্র্যান্ডের কথা। যেমন- আড়ং। আড়ং মানুষের মনে তাদের ব্যাপারে এমন একটা পজিটিভ মনোভাব তৈরি করছে, মানুষ এক কথাতেই আড়ং থেকে যেকোনো জিনিস কিনতে সাহস পান এবং তারা তাদেরকে মোটামুটি দেশীয় পণ্যের রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে উপস্থাপন করে ফেলেছে সবার কাছে। সবাই আড়ং বলতেই চোখ বন্ধ করে মেনে নেয় জিনিসটা সুন্দর, এস্থেটিক এবং দেশীয় ঘরোনার হবে, সেই সাথে ভালোও হবে। আড়ং থেকে কেনা জিনিস খারাপ হতেই পারে না। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, তারা কতটা শক্তপোক্তভাবে নিজেদের অথোরিটিটা তৈরি করতে পেরেছে।
আবার, যেমন-রকমারি। বইয়ের অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর কথা বললে রকমারি সবসময়ই সবার শীর্ষে। রকমারি গত কয়েক বছরে তাদের বেস্ট সেলার অ্যাওয়ার্ড দেয়া শুরু করেছে। যেখানে দেখা যায় যারা বেস্ট সেলার অ্যাওয়ার্ড পান তারা কোনো না কোনোভাবে আগে থেকেই তাদের লিখা কনটেন্ট বা তাদের যেকোনো পজিটিভ কাজের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন। তাই তাদের বই কিনতে মানুষ দ্বিতীয়বার ভাবে না, খারাপ হবে কি না ভালো হবে এই ভয়ে ভোগেন না। হয়তোবা অনেকেই অতি আবেগী হয়ে সূচিপত্রটাও ঠিক করে দেখেন না। তারা বিশ্বাস করেন এই ভদ্রলোক যেহেতু লিখেছে তাহলে ভালোই হবে।
আমরা অনেকবার নিজের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে কনফিডেন্ট তৈরি করা নিয়ে আলাপ করছি। কিন্তু এই কনফিডেন্টটা তৈরি হয় কীভাবে আসলে? কেনই বা কেউ আপনাকে অথোরিটি হিসেবে মেনে নিবে? এর একটাই কারণ আর তা হলো নলেজ বা জ্ঞান। আমার কাজের এক্সপিরিয়েন্স ও জ্ঞান দেখেই তখন আমাকে মানুষ ততটুকু গুরুত্ব দিবে এবং যখন আমার জ্ঞানকে তাদের এই বিশ্বাসের সোর্স হিসেবে মেনে নিবে তখনই আমি তাদের মনে নিজের জন্য সেই অথোরিটিটা তৈরি করতে পারব। আর তখনই ঠিক বড় একটা অডিয়েন্স আমার তৈরি হবে, পাশাপাশি তাদেরকে আমি আমার টার্গেটেড কাস্টমারে পরিণত করতে পারবো।
এ ব্যাপারে যে গবেষণাগুলো রয়েছে তার মধ্যে বেশ ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা হচ্ছে এরকম যে, এখন লেখক তার বইয়ের গল্পগুলো নিয়ে পাঠকসভা করেন। অর্থাৎ গল্পগুলোর কিছু কিছু অংশ সুন্দর করে তার পাঠকদের সামনে তুলে ধরেন এবং এর মাধ্যমে পাঠকদের সাথে একটি কনফিডেন্সিয়াল সম্পর্কে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে যায়। যাতে করে তার বই অনায়াসেই তারা কেনার ব্যাপারে আগ্রহী হন।
সবগুলো উদাহরণ থেকে আসলে বোঝাই যায় যে, কোম্পানি হোক বা কোন ব্যক্তি হোক, অথোরিটি মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে সেলফ ব্র্যান্ডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি কোনোকিছু নিয়ে কাজ করতে চান সে ব্যাপারে প্রতিদিন বা সপ্তাহে একটু সময় করে সোশ্যাল মিডিয়াতে অডিয়েন্স এর সাথে সে বিষয়গুলো নিয়ে শেয়ার করেন। এই ইন্টারেকশন এর মাধ্যমে অথোরিটি তৈরি হওয়া খুব সহজ। বড় বড় ইনফ্লুয়েন্সার পার্সোনলিটিরা কিন্তু তাই ই করে। যেমন ধরেন, কেউ ইংলিশ নিয়ে কিছু কনটেন্ট, তথ্য দিয়ে এ ব্যাপারে তার এক্সপার্টাইজ এর জায়গাটা আপনার সামনে তুলে ধরলো আর পরবর্তীতে সে বিষয়ে আবার বই বের করলো। তখন আপনি বা আমি বাজারের সব বই বাদ দিয়ে সবার আগে তারটাই কেনার চেষ্টা করবো। কারণ আমরা জানি বা ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে তার জ্ঞান বা জানার জায়গা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে ফেলতে পেরেছি। তাই আমরা জানি তিনি যা লিখবেন তাতে ভালো লিখার সম্ভাবনাই বেশি।
এক্ষেত্রে নিজেকে কীভাবে স্ট্যান্ড আউট ফ্রম দ্য ক্রাউড রাখা যায়?
১) সবসময় এটা মাথায় রাখা যেতে পারে আপনার টার্গেট অডিয়েন্সের জীবনে কোনো না কোনো সমস্যা বা জিজ্ঞাসা থাকবেই।
আপনি কী চাইলেই তাকে সাহায্য করতে পারবেন? যদি সত্যিকার অর্থেই পারেন তাহলে এই সুযোগকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কারণ আপনি যদি সত্যি নিজেকে একজন এক্সপার্ট বলে দাবি করতে চান, তবে অবশ্যই আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনার সমাধান মানুষের জীবনে সত্যিকার ভ্যালু অ্যাড করতে পারছে।
২) আপনার সাবজেক্ট এরিয়াতে নিজেকে এক্সপার্ট হিসেবে নিজের রেপুটেশন তৈরি করতে ‘গেস্ট পোস্টিং’ একটা অসাধারণ আইডিয়া। এখন এই গেস্ট পোস্টিং টা কী? সহজ কথায় বললে, অন্যের প্লাটফর্মে গিয়ে নিজের কনটেন্ট পোস্ট করে আসা। মানে, নিজের তো একটা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম বা কাজের জায়গা থাকবেই সেই সাথে অন্যদের সাথে যুক্ত হয়েও নিজের মতাদর্শের একটা প্রভাব বিস্তার করে আসা। কনটেন্ট এর ভাষায় এটাকে অনেকটা ‘কোলাবোরেশন’ও বলা যেতে পারে। এভাবে পুরো সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের একটা ফুটপ্রিন্ট তৈরি করা। তবে কোথায় গেস্ট হিসেবে কন্টেন্ট বা লিখা দিচ্ছেন সে বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। যাতে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে ব্লগপোস্ট বা সাইটেও লিখার প্র্যাকটিস করা।
ইন্ড্রাস্ট্রি লিডারদের সাথে কানেক্টিভিটি তৈরি করা
আপনি কাদের সাথে চলাফেরা করেন তাদের বিরাট একটা প্রভাব অবশ্যই আপনার ব্যক্তিত্বে পড়ে। তাই ইন্ড্রাস্ট্রি লিডারদের গাইডেন্স নেয়ার চেষ্টা করুন, তাদের সাথে কাজে যুক্ত হওয়া ও এর পাশাপাশি নিজের কনটেন্টে তাদের যুক্ত করার চেষ্টা করুন।
এখানে আরেকটা দারুণ টার্ম আছে – ব্র্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন। যখন আপনি নিজে কোনো ব্র্যান্ড এখনো হয়ে উঠতে পারেননি, তাহলে কোনো একটি ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করা শুরু করুন। দেখবেন সেই ব্র্যান্ডের প্রভাবেই আপনিও ছোটখাটো একটা ব্র্যান্ডে পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন। যেমন- কোথাও আপনি পড়ান এবং সে জায়গায় খুব সুনাম যে তারা ভালো পড়ায়। যখন আপনি সেখানে পড়ানোর কাজে যুক্ত হচ্ছেন তখন আপনাকেও মানুষ চিনতে শুরু করবে যে উনি ভালো পড়ান। তখন ওই প্ল্যাটফর্ম বা ব্র্যান্ড ছাড়াও আপনারই একটা আলাদা মার্কেট ডিমান্ড তৈরি হয়ে যাবে।
অথোরিটি গেইমে বাজিমাত করার আরেকটা উপায় হচ্ছে, মানুষ তথা আপনার অডিয়েন্সের মনে নিজের ব্র্যান্ড পার্সোনালিটি একটা পিলারের মতো তৈরি করে গেঁথে দেয়া। ব্র্যান্ড পার্সোনালিটি আবার কী? ধরেন, আপনি আপনার স্কুল- কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক বন্ধুর নাম মনে মনে ভাবলেন। ভাবামাত্রই আপনার চোখের সামনে সেই বন্ধুর একটা পার্সোনালিটি ভেসে আসবে। কোনো একটা বন্ধু হয়তো খুব লাজুক, কেউবা আবার অতিরিক্ত কথা বলে। এইযে বন্ধুর জন্য আপনার মনে একটা পার্সোনালিটি তৈরি হয়েছে, ঠিক এরকম একটা পার্সোনালিটি আপনার মনের মধ্যেও তৈরি হতে হবে এবং সেই পার্সোনালিটি আপনার ডোমেইনকে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে। সেজন্য আপনি তৈরি করতে পারেন অথোরিটি কনটেন্ট, যদিও এটা একটা লং টার্ম প্রসেস।
অথোরিটি মার্কেটিং যেমন সুবিধার, তেমন অসুবিধাও তো আসলে তৈরি করতে পারে। আপনি যেমন আপনার সেলফ ব্র্যান্ডিং এর সূত্র ধরে অনেক এগিয়ে যেতে পারেন, তেমনি আপনার যেকোনো ব্যক্তিগত ভুলের অনেক বড় প্রভাব পড়বে আপনার কাজের ক্ষেত্রেও। তাই একজন মানুষ অথোরিটি মার্কেটিং তৈরি করতে হলে সেভাবেই পার্সোনালিটি বিল্ড আপে মনোযোগী হতে হয় যাতে করে বড় কোনো ক্ষতির সম্মুখীন না হতে হয়। এই ‘ডু অর ডাই’ গেইমে টিকে থাকা কঠিন হলেও, টিকে গেলেই সফলতা খুব সুন্দর।