ছবি আঁকতে বা ছবি আঁকা এই ব্যাপারটাকে পছন্দ করে না এমন মানুষ এই সময়ে এসে খুব সম্ভবত পাওয়া মুশকিল। সত্যি বলতে ছবি আঁকা মোটেই আজকালের চর্চা না। সেই আদিমযুগ থেকেই মানুষ গুহাচিত্র,পাথর খোদাই থেকে শুরু করে কতভাবে এঁকেই না তাদের মনের ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে কাগজ- কলম, রঙতুলি, ক্যানভাস, কাপড়, এমনকি বর্তমান যুগের আরো বড় চমক ডিজিটাল মিডিয়া পর্যন্ত ছবি আঁকা পৌছে গিয়েছে। কতটা আগ্রহের জায়গা থাকলে এমনটা হয় তা নিশ্চই আঁকার প্রসারতা দেখেই আমরা ধারণা করতে পারি। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে যেকোনো প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ, ছবি আঁকতে কে ই বা অপছন্দ করে। সৃজনশীল, মননশীল এই কাজ আমাদের মনের ভাব প্রকাশে সাহায্য করে, আমাদের সুন্দর সময়ের সাক্ষী হয়।পাশাপাশি ভালো কাজ চর্চায় আগ্রহী করে তোলে। আঁকাআঁকির এই জার্নি আরো সহজ করে দিতে আমরা ইদানীং বেশ কিছু মাধ্যম ব্যবহার করি। এই মাধ্যমগুলো সম্পর্কেই আরো বিস্তারিত চলুন জেনে নেয়া যাক।
ছবি আঁকার যত মাধ্যম
কল্পনাশক্তি সমৃদ্ধ সুন্দর মন
ছবি আঁকা শুরু করার আগে সবার আগে কল্পনাশক্তি সমৃদ্ধ একটি সুন্দর মন হওয়া খুব জরুরি। একটা সৃজনশীল, মননশীল মন থাকা মানে সেটা ছবি আঁকার সবচেয়ে সুন্দর উপকরণ। কারণ এমন মনই ভাববে সব সুন্দর, স্নিগ্ধ জিনিস সম্পর্কে। কীভাবে ক্যানভাসে রঙের ছড়াছড়ি হবে, কোথায় কোন রঙ ফুটবে, কোন আবেগ কোন রঙ দিয়ে রাঙাবে, আকাশের বিশালতা আঁকলে কেমন হবে, বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের সেই স্নিগ্ধতা, গ্রামের পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আনন্দ করা শিশুর হাসি, দু:খের সাগরে ডুব দেয়া কিশোরির উড়নচণ্ডী মন – এই সবকিছু রঙতুলিতে ফুটিয়ে তুলতে পারবে একমাত্র একটা সুন্দর মন। যার কল্পনাশক্তি সেই কিশোরীর চোখ ভেদ করে ভেতরে চলে যেয়ে তার দু:খ ছোঁয়ার ক্ষমতা রাখবে।
কাগজ
কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ গুহাচিত্রে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিলো। এরপর প্যাপিরাস নামের একধরনের গাছে লেখা, আঁকার একটা আইডিয়া বের করলো মিশরীয়রা। যার মাধ্যমে মূলত পৃথিবীতে প্রথম চিত্র সংগ্রহের শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে কাগজ আবিষ্কার হওয়া শুরু করে। সেই কাগজের মূল অংশটুকু কিন্তু গাছ থেকেই আসে। গাছে লেখার পাশাপাশি পুরোদমে শুরু হলো আঁকার চর্চাও। রঙ ও রঙের ধরন অনুযায়ী কাগজেরও আলাদা রকম ব্যবহার শুরু হলো। যেমন-জলরং এর জন্য হ্যান্ডমেড পেপার, অ্যাক্রেলিক কালার এর জন্য কার্টিজ পেপার, ক্রাফটিং এর জন্য বিভিন্ন রকমের কালার পেপার, ব্রাউন পেপারে কয়লা দিয়ে কালার সহ আরো বিভিন্ন GSM অনুযায়ী পেপার আছে যতটুকু আপনার প্রয়োজন ততটুকু টেক্সচার দেয়ার জন্য। যাতে করে রঙ অনুযায়ী আঁকা যায়।
ক্যানভাস,ক্যানভাস পেপার
প্রফেশনাল আর্ট করার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে ক্যানভাস। ক্যানভাস কাপড়ে কাঠ দিয়ে বাধাই করা ফ্রেমকেই আমরা মূলত ক্যানভাস বলে থাকি। যেখানে বিভিন্ন ধরনের আর্ট তুলে ধরেন শিল্পী এবং ঘর সাজানোতে সুন্দর উপস্থাপনের সাক্ষী হন। এছাড়াও ক্যানভাস পেপারও পাওয়া যায়। যেটিও মূলত আঁকাআঁকির কাজে ব্যবহার করা হয়। এই কাগজগুলো নরমাল কার্টিজ বা হ্যান্ডমেড পেপার থেকে একটু মোটা হয়, যার ফলে ভারী কাজ করার জন্য একদম উপযোগী এই পেপার।
রঙ
কাগজের মতো রঙ এর মধ্যেও বেশি কিছু ভ্যারিয়েশনস আছে। যেমন- মোম রঙ, পেন্সিল রঙ, অ্যাক্রেলিক রঙ, জলরঙ, তেল রঙ, প্যাস্টেল রঙ। সব সার্ফেসে কিন্তু সব ধরনের রঙ ব্যবহার করা যায় না। যার জন্যই মূলত প্রয়োজন অনুযায়ী এত বিভাজন। তাছাড়াও ফেব্রিকের উপর কাজ করার জন্য ফ্রেবিক কালারও ইদানীং বেশ জনপ্রিয়। নিজেদের মতো করে হাতে টাই ডাই করে বিভিন্ন রকম কাজ করা যায় বাসায়তেই। ছোটবেলায় যখন আমরা রঙ করা শুরু করি তখন আমাদেরকে মোম রঙ বা পেন্সিল রঙ এর মতো সিম্পল মিডিয়ামগুলোই দেয়া হয়। আস্তে আস্তে কাজের ধরন অনুযায়ী, প্রফেশনালিজম এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে তখন পরবর্তীতে অ্যাক্রেলিক বা তেলরঙ, অয়েল প্যাস্টেল এগুলো বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করা হয়। হ্যান্ডমেড পেপারে ব্যবহারের জন্য যেমন জলরঙ সবচেয়ে বেশি উপযোগী, তেমনই প্রফেশনাল কাজে ব্যবহারের জন্য সবার প্রথম চয়েস কিন্তু অ্যাক্রেলিক কালারই। কারণ এটি খুব অল্প সময়েই শুকিয়ে যায়। তাই কম সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়। আবার যদি ব্যাপারটা এমন থাকে বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে, মনের ভাবনার সাথে আস্তে আস্তে খাপ খাইয়ে অনেক ভেবেচিন্তে কোনো পেইন্টিং উপস্থাপন করা হবে তবে তার জন্য উপযুক্ত হচ্ছে তেল রঙ। কারণ তেল বা পানি মিশিয়ে কাজ করতে হয় এই রঙ এ। তেলটাই বেশি ব্যবহার করা হয়, সুতরাং শুকোতেও একটু সময় নেয় এই রঙ দিয়ে করা কাজ।
তুলি
বিভিন্ন ধরনের তুলি আজকাল পাওয়া যায়। জিরো সাইজ থেকে তুলির স্ট্যান্ডার্ড শুরু হয়। একদম সরু সাইজের তুলিটাকেই জিরো সাইজ তুলি বলে। এছাড়াও গোলাকার, চারকোণা, লম্বা, কোণাকৃতিরসহ নানা ধরনের তুলি ব্রা ব্রাশ পাওয়া যায়। বড় ক্যানভাসে কাজ করার জন্য বড় চারকোণা হেইভি তুলির প্রয়োজন হয়, আবার ডিটেইলিং করার জন্য দরকার হয় জিরো বা দুই তিন সাইজের তুলি। কাজ অনুযায়ী তুলির ধরনও সম্পূর্ণ আলাদা।
পেন্সিল, ইরেজার, শার্পনার
সবচেয়ে বেসিক পেইন্টিং ইন্সট্রুমেন্ট খুব সম্ভবত পেন্সিল। পেন্সিল ছাড়া যে কোনো ছবি আঁকার শুরুটাই তুলে ধরা অসম্ভব প্রায়। পেন্সিল দিয়ে প্রথমে স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়েই পরবর্তীতে মূল কাজ করা হয়। আর সেই কাজের ভুল স্টেপ মুছতে আমরা ব্যবহার করে থাকি ইরেজার এবং পেন্সিল শার্প করে আবার ব্যবহার উপযোগী করতে শার্পনার ব্যবহার করি। বিভিন্ন ধরনের পেন্সিল পাওয়া যায়, যেমন- HB, 2B, 4B, 6B, 8B, 10B পর্যন্ত। কাজ অনুযায়ী পেন্সিলও আলাদা হয়। হালকা কাজের জন্য হালকা কালার দিবে এমন পেন্সিল,গাঢ় ডিটেইলিং এর জন্য গাঢ় পেন্সিল।
ডিজিটাল মিডিয়া
হাতেকলমের আঁকা তো বেশ অনেক কালের ইতিহাস। নতুন এই টেকনোলজির যুগে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম বর্তমানে হচ্ছে ডিজিটাল মিডিয়া, যেখানে অনায়াসেই হাতে কলমের এত উপকরণ ছাড়াই বিভিন্ন ধরনের ,বিভিন্ন মাধ্যমের পেইন্টিং তৈরি করা যায়। এই ধরনের কাজের প্রসারতাও কিন্তু ইদানীং ব্যাপক। বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার রয়েছে আঁকার জন্য, যেমন- অ্যাডোবি ইলাস্ট্রেশন। এছাড়াও ইদানীং মোবাইল অ্যাপগুলাও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গ্রাফিক্স ট্যাবও পাওয়া যায় যেগুলোয় আঁকাআঁকি করা সবচেয়ে স্মুথ।
ইজিল বা পেইন্টিং স্ট্যান্ড
পেইন্টিং স্ট্যান্ড সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং একটা পেইন্টিং ইন্সট্রুমেন্ট। যে স্ট্যান্ড এর সাথে অ্যাটাচ করে কাগজ বা ক্যানভাস রেখে আমরা আঁকি সেটাই মূলত ইজিল বা পেইন্টিং স্ট্যান্ড। কাঠের, মেটালের বিভিন্ন সাইজের পেইন্টিং স্ট্যান্ড পাওয়া যায়। যার যার হাইট অনুযায়ী সেরকম প্রয়োজন অনুযায়ী সবাই স্ট্যান্ড বেছে নিতে পারেন। অথবা কিছু কিছু ইজিল ছোট বড়ও করা যায়, চাইলে সেগুলোও কিনে নেয়া যায়। কাঠের ইজিল এককালে বেশ জনপ্রিয় থাকলেও ধীরে ধীরে মেটাল বা স্টিলের ইজিলের দিকে মানুষ ঝুঁকছে, কারণ সেগুলো বেশি টেকসই কিন্তু আবার লাইট ওয়েট, একাধারে মেকানিক্যাল কারসাজি থাকায় ছোট বড় করে, খুলে নিয়েও ক্যারি করা যায়।
প্যালেট
যে প্যালেটে করে রঙ নেয়া হয় আঁকার জন্য সেটিই মূলত প্যালেট। বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন শেইপের প্যালেট পাওয়া যায়। জলরঙ এর জন্য গোলাকার মাঝে জায়গা বেশি প্যালেট পাওয়া যায়, যাতে পানিসহ গড়িয়ে না পড়ে। এছাড়াও অ্যাক্রেলিকের জন্য কয়েক বক্স করা প্যালেট, অয়েলের জন্য কাঠের প্যালেট সহ নানাধরনের নানা শেইপের প্যালেট পাওয়া যায় মার্কেটে।
ছবি আঁকার মাধ্যমগুলো সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। কেউ হয়তো এখনও ছবি আঁকা শুরু করবেন ভাবছেন, কেউ শুরু করেছেন, আবার কেউবা প্রফেশনালি কাজ করছেন। আপনি কোন মাধ্যমে কাজ করতে বেশি কমফোর্টেবল? যেটাই হোক, ছবি আঁকা কখনো বন্ধ করবেন না। এটা কিন্তু আপনার মন ভালো রাখার অন্যতম একটি উপায়!
ছবিঃ সংগৃহীত