ডিজিটাল মার্কেটিং এর সেক্টরগুলোর মধ্যে এফিলিয়েট মার্কেটিং বর্তমানে পরিচিত একটা সেক্টর। এফিলিয়েট মার্কেটিং খুব জটিল কোনো বিষয় নয়, বরং আপনার ওয়েব মাধ্যমে কোনো ব্লগ, ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল বা সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে একটা একাউন্ট থাকলে আপনি শুরু করতে পারবেন এফিলিয়েট মার্কেটিং। এটা এখন ফ্রিল্যান্সিং, এডসেন্সের মতই টাকা আয়ের একটা লাভজনক ও প্রচলিত উপায়। চলুন তাহলে, আর দেরি না করে মার্কেটিং এর গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরটি সম্পর্কে আজ জেনে নেয়া যাক।
এফিলিয়েট মার্কেটিং কী?
মনে করুন, আপনার পড়শি খুব ভালো কেক বানাতে পারেন, তিনি কেক বিক্রির ব্যবসা শুরু করতে চান। কিন্তু তার তেমন পরিচিতি কেউ বা লিংক নেই ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। এজন্য আপনি ও আপনার মতো আরো কয়েকজন তার প্রচারের দায়িত্ব নিলেন, বিনিময়ে আপনাদের রেফারেন্সে যারা কিনবে, তাদের কাছ থেকে পাওয়া লাভের অংশ আপনারা পাবেন। এই ছোট কাহিনীটাই মোটামুটি এফিলিয়েট মার্কেটিং এর ধরন বুঝতে আমাদের সাহায্য করে।
সোজা কথায়, এফিলিয়েট মার্কেটিং হলো একটা মাধ্যম, যেটার দ্বারা আমরা অনলাইনে কোন শপের পণ্য বা সেবা, ডিজিটাল প্রোডাক্ট বা ফিজিক্যাল প্রোডাক্ট, অথবা অন্য কোনো জিনিস যা অনলাইনে কেনা যায়, সেগুলো নিজেদের মাধ্যমে প্রচার করব, আমাদের এফিলিয়েটের জন্য আলাদা লিংক থাকবে এবং সেই লিংক ব্যবহার করে যারা পণ্য কিনবেন তাদের লাভ থেকে আমরা একটি কমিশন পাবো। আপনি একটা প্রোডাক্টের লিংক থেকে ঢুকে একাধিক প্রোডাক্ট কিনলে আমি একাধিক প্রোডাক্টের কমিশন পাবো।
এফিলিয়েট মার্কেটিং কেন জনপ্রিয়?
এফিলিয়েট মার্কেটিং জনপ্রিয় হওয়ার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। যেমন—
১) কম খরচে ও কম ঝুঁকিতে টাকা আয়ের উপায়
এখনকার ইকোনমিতে নতুন করে একটা ব্যবসা শুরু করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়াও একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে প্রাথমিকভাবে অনেক খরচ হয়, যেমন- পণ্যের খরচ, যাতায়াত খরচ, অফিস নিতে হলে সেই অফিসের ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, কর্মচারীদের বেতন ইত্যাদি। এতকিছু করার পরেও নতুন ব্যবসা প্রায়ই লাভের মুখ দেখতে দেখতে বেশ সময় লেগে যায়। হতে পারে লোকসানও। এর চেয়ে এফিলিয়েট মার্কেটিং অনেকটাই রিস্ক ফ্রি এবং কম খরচের। আপনি অন্যান্য ব্যবসারই প্রমোট করছেন এতে করে দুপক্ষেরই লাভ হচ্ছে, বাড়তি খরচ ছাড়াই আপনার আয় হচ্ছে। প্রয়োজন কেবল একটি প্রচারমাধ্যম। কাজেই প্রচলিত ব্যবসার চেয়ে এফিলিয়েট মার্কেটিং কম ঝুঁকিপূর্ণ।
২) অনেক অপশন
আপনি যদি নিজে চাকরি বা ব্যবসা করেন, তাহলে আপনার আয়ের পথ একদিকেই থাকে। যদি এফিলিয়েট মার্কেটিং এ যুক্ত হন, তাহলে আপনি একই সাথে অনেক কোম্পানির প্রোডাক্ট প্রমোট করতে পারবেন এবং কয়েকটা ক্ষেত্র থেকে কমিশন পাবেন যা আপনার জন্যই ভালো।
৩) পরিচিতি
এফিলিয়েট মার্কেটিং এ আপনি যখন কাজ করবেন, তখন যে শুধু আপনি অন্য কোম্পানির পণ্যের প্রমোশন করবেন তা কিন্তু নয়, আপনার নিজেরও একইসাথে পরিচিতি বাড়বে। আপনার প্রমোট করা পণ্যের মান যদি ভালো হয়, তবে ক্রেতা আপনার প্রমোট করা পণ্যটির পাশাপাশি আপনাকেও মনে রাখবে, এতে করে ভবিষ্যতে আপনার প্রমোট করা অন্যান্য পণ্যের উপর ক্রেতার ভরসা তৈরি হবে এবং এর ফলে আপনার প্রমোটা করা পণ্যের সেল এবং আপনার কমিশন দুটোই বাড়বে। এছাড়া কোম্পানিগুলোও আপনাকে লক্ষ্য করবে ফলে কাজের মাত্রা ও আয়ের মাত্রাও বাড়বে।
৪) অর্গানিক রিচ
এফিলিয়েট মার্কেটিং হতে পারে আপনার অর্গানিক রিচ বাড়ানোর এক চমৎকার উপায়। আপনি যদি একজন ব্লগার বা ইউটিউবার হয়ে থাকেন, এমনকি ফেসবুক বা ওয়েবসাইটেও এফিলিয়েট মার্কেটিং এর কাজ করে থাকেন, তাহলে এটা সম্ভাব্য ক্রেতাদের আকৃষ্ট করবে। ক্রেতারা একই একাউন্টে বিভিন্ন ধরনের ভালো প্রোডাক্টের সাজেশন পেয়ে আপনার দিকে আগ্রহী হবে এবং এটি আপনার অর্গানিক রিচ বাড়াতে সাহায্য করবে।
৫) নেটওয়ার্কিং ও পার্টনারশিপ
এফিলিয়েট মার্কেটিং এর ফলে আপনি বিভিন্ন স্তরের বড় বড় বিজনেস এর সাথে সংযুক্ত হতে পারবেন যা আপনাকে ভবিষ্যতে বড় কোনো সুযোগ পাইয়ে দিতে পারে। এই প্লাটফর্মে প্রোডাক্ট প্রমোট করে আয়ের পাশাপাশি কানেকশন ও নেটওয়ার্কিং করতে পারাও একটা বড় সুযোগ, যা আপনাকে পরবর্তীতে বড় কোনো পার্টনারশিপ বা ক্যারিয়ারে সুযোগ দিতে পারে। এছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন সেক্টরে পরিচিতি বৃদ্ধি তো থাকলোই।
৬) রিমোট ওয়ার্ক
এফিলিয়েট মার্কেটিং করতে আপনার কোনো অফিসে যেতে বা ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে না। যাতায়াতে কোনো সময় নষ্ট হবে না অথবা আলাদা কোনো খরচ নেই। আপনি নিজের ঘরে বসেই সম্পূর্ণ কাজ করে আয় করতে পারেন।
৭) পারফরমেন্স বেইজড ইনকাম
এফিলিয়েট মার্কেটিং এ আপনার আয় নির্ধারিত হবে আপনার কাজের উপরে। যতজন আপনার লিংক ফলো করবে ততটুকুই আপনার আয় হবে, সেটা কম বেশি করতে পারা আপনার উপর নির্ভর করবে। এটা ৯-৫টা অফিসের মত নয়, যেখানে আপনি যে পরিমাণ কাজই করেন না কেন বেতন সেই একই থাকছে। বরং এখানে আপনি কাজের দক্ষতার উপর নির্ভর করে অতিরিক্ত ইনকামও করতে পারেন।
এই মার্কেটিং কয় ধরনের?
এই মার্কেটিং মূলত তিন ধরনের। এগুলো হচ্ছে-
১) Unattached affiliate marketing
এটি মূলত অ্যাডভার্টাইজ বেজড এফিলিয়েট মার্কেটিং, এ মডেলে আসল বিক্রেতার সাথে ক্রেতার কোনো যোগাযোগ থাকে না। এটায় শুধুমাত্র প্রোডাক্ট এর লিংক কপি করে অ্যাডভার্টাইজ করেই কমিশন পাওয়া যায়। অ্যাটাচমেন্ট না থাকার কারণে পণ্যের ব্যবহার বা উপকারিতা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নাও থাকতে পারে।
২) Related affiliate marketing
এর মানে হচ্ছে পণ্য বা সেবার সাথে যুক্ত থেকে এফিলিয়েট মার্কেটিং। এই ক্ষেত্রে আপনি পার্সোনালি পণ্যটির বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারেন এবং ক্রেতাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে পণ্যের ভাল খারাপ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন। এভাবে প্রচার চালাতে হলে আপনাকে দক্ষ হতে হবে, ক্রেতাদের উপর প্রভাব থাকতে হবে এবং পণ্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আপনার জানা থাকতে হবে।
৩) Involved affiliate marketing
এই ধরনের এফিলিয়েট মার্কেটিং এ আপনি পণ্যের সাথে সরাসরি সংযুক্ত থাকবেন। এক্ষেত্রে আপনি পণ্য ব্যবহার করে তার উপকারিতা ও ফলাফল সম্পর্কে নিজে জানবেন এবং আপনার অভিজ্ঞতা ক্রেতাদেরকে জানাবেন। এ ধরনের মার্কেটিং বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করে কারণ মানুষ তথ্য জানার চেয়ে সরাসরি ফলাফল দেখে বেশি আকৃষ্ট হয়। সাধারণত ভ্লগাররা ও ইনফ্লুয়েন্সাররা এভাবে এফিলিয়েট মার্কেটিং করে থাকেন।
কীভাবে শুরু করবেন এই মার্কেটিং?
এফিলিয়েট মার্কেটিং নিজ থেকে শুরু করার জন্য আগে কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হবে।
১) আপনার অবশ্যই একটা প্রচারমাধ্যম থাকতে হবে, হতে পারে সেটা ব্লগ, ইউটিউব চ্যানেল, টুইটার, ফেসবুক অথবা ইনস্টাগ্রাম পেইজ বা অন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়া এ কাজের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত কারণ এখানে অনেক ধরনের মানুষের উপস্থিতি থাকে এবং সম্ভাব্য ক্রেতার পরিমাণও বেশি থাকে।
২) এবার আপনি খুঁজবেন একটি ভালো এফিলিয়েট প্রোগ্রাম। সাধারণত বড় বড় শপিং ওয়েবসাইটগুলো যেমন- অ্যামাজন, শপি, বাংলাদেশে দারাজ এর মতো ওয়েবসাইটগুলো এফিলিয়েট প্রোগ্রাম দেয়। এফিলিয়েট প্রোগ্রাম মানে আপনাকে এফিলিয়েট পার্টনার হওয়ার ও তাদের জিনিসের প্রমোশনের বিনিময়ে কমিশন দেয়ার সুযোগ দেয়া। প্রোগ্রামে জয়েন করার পর আপনি নিজস্ব এফিলিয়েট লিংক পাবেন।
৩) প্রোডাক্ট বাছাই করা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আপনি কোন ধরনের প্রোডাক্টের প্রমোশন করবেন এবং একই ধরনের প্রডাক্টের ভিড়ে কোন শপের প্রমোশন করবেন এটা বাছাই করতে হবে। একেবারে অপরিচিত শপ বা প্রোডাক্ট প্রমোশন করা রিস্কের ব্যাপার হতে পারে, এর চাইতে আপনি আগে ব্যবহার করেছেন বা সে সম্পর্কে জানেন এমন প্রোডাক্ট বেছে নিলে আপনার জন্য ভালো হবে। এছাড়া যেসব প্রোডাক্ট মোটামুটি প্রচলিত ও জনপ্রিয়, সেই ধরনের প্রোডাক্ট কিন্তু একটু অপরিচিত ধরনের শপ বেছে নিতে পারেন, এতে করে আপনার প্রমোশনে শপের সেল বেড়ে যাবে এবং আপনার কমিশনও বাড়বে।
৪) প্রোডাক্ট বেছে নেয়ার পর আপনি পাবেন আপনার নিজস্ব এফিলিয়েট লিংক যেটার দ্বারা আপনাকে প্রমোশন করতে হবে। এই লিংকে ক্লিক করামাত্র যে কেউ সরাসরি ওয়েবসাইট বা শপে প্রোডাক্ট এর পেজে পৌঁছে যাবে। আর সে থেকে সেল হলে সেই সেলের প্রমোশন আপনি পেয়ে যাবেন। লিংকটা আপনি পোস্ট করতে পারেন আপনার নির্দিষ্ট প্রচারমাধ্যম থেকে, যেটি পৌঁছাবে সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে।
এফিলিয়েট পেমেন্ট মডেল
এফিলিয়েট মার্কেটাররা বিভিন্ন হিসেবেই পেমেন্ট পেয়ে থাকেন, তবে একেক প্লাটফর্ম বা শপ হিসেবে সেটা একেকরকম হতে পারে। কখনো সেটা সেল এর হিসেবে আবার কখনো সেটা ক্লিকের হিসেবে ধরা হতে পারে। সাধারণত যে কয়েকটি উপায়ে এফিলিয়েট মার্কেটাররা পেমেন্ট পেয়ে থাকেন-
১) পে পার সেল
এটা সাধারণত শপ এফিলিয়েট সিস্টেমে পেমেন্ট করে। এই প্রোগ্রামে আপনি যে পণ্যের প্রমোশন করবেন, আপনার লিংক থেকে সেই পণ্যের সেল হলে আপনি একটা নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজে কমিশন পাবেন। এ মডেলে কাজ করতে হলে আপনার আসলেই ক্রেতাকে পণ্য কিনতে প্রভাবিত করতে হবে।
২) পে পার লিড
এই সিস্টেমে সেল নয়, লিড হলো মুখ্য৷ এটা সাধারণত সরাসরি ফিজিক্যাল পণ্য নয়, বরং ডিজিটাল সেবার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে আপনার ক্রেতাকে বিক্রেতার ওয়েবসাইটে একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রভাবিত করতে হবে। সেটা হতে পারে মার্চেন্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে একটা ফর্ম ফিল আপ করা, সার্ভেতে অংশ নেয়া, কোনো ফাইল বা সফটওয়্যার ডাউনলোড করা, নিউজলেটারের জন্য সাবস্ক্রাইব করা, কোনো ট্রায়াল প্রজেক্টের জন্য সাইন আপ করা, লাইক বা শেয়ার করা ইত্যাদি।
৩) পে পার ক্লিক
এই ধরনের মডেলে কোনোকিছু বিক্রি হওয়া বা সাইন আপ করা জরুরি নয়, ক্লিক হলেই হয়। এটা সাধারণত ওয়েবসাইটে ট্রাফিক বা রিচ বাড়ানোর জন্য হয়ে থাকে। এ সিস্টেমে ক্রেতা বা সম্ভাব্য গ্রাহক আপনার এফিলিয়েট লিংকে ক্লিক করে মার্চেন্ট ওয়েবসাইটে ঢুকবেন। প্রতি ক্লিকের জন্য আপনি পার্সেন্টেজ পাবেন। অর্থাৎ আপনার লিংক কতজন ভিজিট করছেন সে হারে আপনি পার্সেন্টেজ পাবেন।
৪) পে পার ইনস্টল
এই সিস্টেম হচ্ছে সাধারণত অ্যাপ বা সফটওয়্যার এর জন্য। এক্ষেত্রে যদি কাস্টমার আপনার লিংক ব্যবহার করে মার্চেন্ট এর ওয়েবসাইটে গিয়ে নির্দিষ্ট পণ্য ডাউনলোড করেন, তাহলে আপনি সেই পণ্যের কমিশন পাবেন।
গুগলে বা সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে এফিলিয়েট মার্কেটিং এর অনেক সুযোগ রয়েছে যা আপনি একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন। বর্তমান সময়ে ঘরে বসে কম ঝুঁকিতে টাকা আয়ের জন্য এফিলিয়েট মার্কেটিং একটি নির্ভরযোগ্য উপায়। এ সম্পর্কে আরো জানতে ইউটিউবে গিয়ে খুঁজতে পারেন বা কোনো এফিলিয়েট মার্কেটিং কোর্সে ভর্তি হতে পারেন।