বাংলাদেশের লাখো মানুষের নির্ভরতা, আস্থা, ভরসা ও আবেগের নাম ‘বম্বে সুইটস’ (Bombay sweets)। বম্বে সুইটসের পণ্য কখনো কেনেনি বা তাদের চেনে না এমন কাউকে মনে হয় এ সময় খুঁজে পাওয়া যাবে না। হয়ত প্রতিষ্ঠানের নাম জানা না থাকলেও তাদের তৈরি পণ্য কখনো না কখনো অবশ্যই কিনেছেন। প্রায় শতবছর ধরে খাদ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানি হিসেবে বম্বে সুইটস এর যাত্রা এদেশে বিদ্যমান থাকলেও নব্বই দশকের কিশোরকিশোরীদের জীবনে এর সম্পৃক্ততা এতটাই বেশি যে, তাদের কৈশোরের স্মৃতি তুলে ধরলেই সেখানে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করে নেবে বম্বের রিং চিপস, চানাচুর, বম্বে পটেটো ক্র্যাকার্স, মিস্টার টুইস্ট, ডালমুঠ এর মতো কালজয়ী প্রসেসড ফুড। ৭৪ বছরের পথচলায় বম্বে এখনও দেশের সবচেয়ে বড় খাদ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর একটি হিসেবে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
বম্বে সুইটস এর শুরু
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে সুইটস বা মিষ্টান্ন জাতীয় খাবারের একটা প্রভাব এই নামের ওপর রয়েছে। বম্বে যখন যাত্রা শুরু করে তখন এই দেশ বলে কিছু ছিলো না, বরং সাব কন্টিনেন্ট বা ভারতীয় উপমহাদেশ ছিলো, সেই ১৯৪৮ সালে। সে সময়টায় এই অঞ্চলে বারফি বা রসগোল্লার মতো বেশ কিছু মিষ্টি খুবই জনপ্রিয় ছিল। মিষ্টির প্রোডাকশনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা প্রথম প্রস্তুতকারক খাদ্য হিসেবে যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে চানাচুর দিয়েই শুরু করেন, তিনি ঐতিহ্য ধরে রাখায় যেমন মিষ্টিকে প্রাধান্য দেন, তেমনি ঝাল ব্যাপারটি উপস্থাপনের বাহন হিসেবে বম্বে নামকরণ করেন। তখনো তিনি জানতেন না এটি হতে চলেছে সাব কন্টিনেন্টসহ পরবর্তী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোর একটি। ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার নবাবপুরে ছোট্ট একটি কুটিরঘর থেকে চানাচুর প্রোডাকশন এর মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে বম্বে সুইটস। বর্তমানে কোম্পানিটির পরিচালক করিম শের আলী জিদানি এবং ঢাকার বম্বে সুইটস কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার জাহিদ হোসেন।
ডেভেলপমেন্ট ও গ্রোথ
যেহেতু শুরু থেকেই বম্বে সুইটস এর চানাচুর অসম্ভব ভালো সাড়া পেয়েছিলো (মিষ্টি এবং চানাচুর দুটোই বলতে গেলে), পরবর্তীতে তিনি প্রসেস ফুডের দিকেই সম্পূর্ণ রূপে মনোনিবেশ করেন। নবাবপুরের সেই কারখানার পাশাপাশি বায়তুল মোকাররম এ তিনি সত্যিকার অর্থেই নতুন একটি শো-রুম দিয়ে বসেন, এরপর সেখানেও খুব ভালো সাড়া পাওয়ার পরে পরবর্তীতে নিউ মার্কেটে তিনি আরেকটি শো-রুম দেন। যেহেতু এগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগের সময়কার কথা, ১৯৭১ এর স্বাধীনতার পর এটি সত্যিই বম্বের জন্য যুগান্তকারী একটি পরিবর্তন ছিলো। এর পরপরই তারা তাদের বিজনেস পুরোপুরি রূপে এক্সটেন্ড করে এবং বিভিন্ন রকম প্রসেস ফুড তৈরির দিকে মনোনিবেশ করে। তখনই তারা বিস্কুট, ড্রাই ফ্রুট কেক, পাইন্যাপেল স্কোয়াশ ইত্যাদি পণ্য বানানো শুরু করে। তখন তাদের আরো কারখানার প্রয়োজন হলে পুরান ঢাকার ক্যাপ্টেইন বাজার, বনোগ্রাম, র্যাংকিং স্ট্রিট, ফকিরাপুল সহ বিভিন্ন জায়গায় তারা নতুন কিছু কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে ১৯৮৮ এর দিকে পুরোদমে পূর্ণাঙ্গ কারখানা প্রোডাকশন শুরু করে।
বম্বে সুইটস এর পণ্যসামগ্রী
বম্বের যাত্রা গুটি কয়েক পণ্য দিয়ে হলেও প্রায় সব ধরনের প্রসেস ফুডই তারা এখন মোটামুটি তৈরি করছে বলেই ধারণা করা হয়। ১৯৪৮ সালে চানাচুর উৎপাদন শুরু করলেও এর পরপরই তারা আর তেমন কোনো পণ্য বাজারে আনেনি। প্রায় ৪০ বছর পর ১৯৮৫ সালে রিং চিপস, ১৯৮৮ সালে আলুর চিপস, ১৯৯৬ সালে মিস্টার টুইস্ট সহ পণ্যগুলো বাজারে নিয়ে আসে। এছাড়াও বম্বের আরেকটি জনপ্রিয় পণ্য আলুজ চিপস তারা তৈরি করা শুরু করে ২০১২ সালে। তাদের সম্প্রতি তৈরি খাবারের তালিকায় রয়েছে পাস্তা চিপ্স, যা তারা ২০১৭ সালে প্রস্তুত ও বাজারজাতকরণ শুরু করে। বর্তমানে বম্বের অন্যান্য পণ্যগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তার তালিকায় রয়েছে- নাগা চিপ্স, প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন ধরনের মশলা, খিচুড়ি মিক্স, শাহী হালিম মিক্স, ফালুদা মিক্স, সরিষার তেল, ডালমুঠ, সুগন্ধি চিনিগুড়া চাল, বিরিয়ানি মিক্স, আলুজের বিভিন্ন ফ্লেভার, ম্যাংগো জুস, পাস্তা, ঝাল মুড়ি, চিপস্টার পটেটো স্টিক চিপস, বিস্কুট, ড্রাই কেক, ফ্রোজেন ফুড ইত্যাদি আরো অনেক অনেক পণ্যসামগ্রী।
সহপ্রতিষ্ঠানসমূহ
বম্বের কিছু নিজস্ব বা সহপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে যারা বড় পরিসরে বম্বের চাহিদা মেটানো সহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। যেমন-
১) বম্বে এগ্রো লিমিটেড
BAGL বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। Bombay Agro প্রধানত তার মূল কোম্পানি Bombay Sweets এর কাঁচামালের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য কৃষিজাত পণ্য চাষ করে এবং সেটা সঞ্চয় করে।
২) ট্রাইসপ্যাক লিমিটেড
সতেজতার জন্য বম্বে খাদ্য ও পানীয় রক্ষা করার জন্য এই প্যাকেজিং কোম্পানিটি মূল বম্বে সুইটসকে সহযোগিতা করে। Tricepack Ltd ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কোম্পানিটি স্থানীয় ও বিদেশি বাজারের জন্য বিভিন্ন ধরনের নমনীয় প্যাকেজিং উপকরণ তৈরি করে।
৩) কুলিয়ারচর ডেইরি কমপ্লেক্স
১৯৮৩ সাল থেকে বম্বে সুইটস মানসম্পন্ন পনির তৈরি করে আসছে। কুলিয়ারচর ডেইরি কমপ্লেক্স (কেডিসি) কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর পি.এস.এ এই প্রোডাকশনটি অবস্থিত। এই এলাকাটি ‘মিল্ক পকেট’ হিসেবে সারাদেশে বেশ পরিচিত।
৪) তাকধুম লিমিটেড
শিশু ও তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষিত ও বিনোদন দেয়ার উদ্দেশ্যে এবং তাদের জীবনে ভাল মূল্যবোধ আনার উদ্দেশ্যে এটি যাত্রা শুরু করে।
TAKDHUM হল একটি ভিডিও অনলাইন ক্লাসরুম যেখানে শিক্ষার্থীরা আমাদের বহুস্তরের শিল্প নির্দেশনা প্রোগ্রামের মাধ্যমে সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাসের বিকাশ ঘটায়। তারা ভিডিও পাঠ অফার করে, যা যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায়- ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বা স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে। প্রতিটি কার্যক্রমই সহশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার মান আরো উন্নয়নে চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণ পাওয়া যাচ্ছে এমন অনেকগুলো আউটলেটও শহরজুড়ে রয়েছে এই প্রজেক্টের আওতায়।
বিদেশে বাজারজাতকরণ
বর্তমানে বম্বে সুইটস এর বিশাল এক্সপোর্ট এরিয়া হচ্ছে আমেরিকা ও মিডেল ইস্ট। এছাড়াও জার্মানি, ইউকে, ইতালির মতো দেশগুলোও ইদানীং বম্বের পণ্য ইম্পোর্ট করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তবে আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতেও বম্বের প্রক্রিয়াজাত এই পণ্যগুলোর বেশ চাহিদা থাকলেও তারা চায় অনেক সুলভ মূল্যে এই পণ্যগুলো কিনতে, এখানে কোয়ালিটি যেমনই হোক না কেন তারা সেটি নিয়ে তেমন আগ্রহী না। তবে এখনো এমন কিছু ঘটতে দেখা যায়নি। বম্বে তার নিজস্ব গতিতেই এখন পর্যন্ত সেখানে পণ্য পাঠিয়ে যাচ্ছে।
মার্কেটিং নাকি আইকন?
বম্বের শুরুর দিকে অবশ্যই তেমন কোনো মার্কেটিং করতে হয়নি, কারণ যেকোনো কিছুর নতুন আবিষ্কারে সবসময়ই মানুষ খুব কৌতূহল প্রকাশ করে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে মাত্র একটি পণ্য অর্থাৎ চানাচুর দিয়েই তারা তাদের জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছে যায় এবং পরবর্তীতে তারা অন্যান্য পণ্য বাজারজাতকরণে আগ্রহী হয়। সেদিক থেকে হিসেব করলে নির্দ্বিধায় বলা যায় বাজারজাত পণ্যের জগতে বম্বে সুইটস এখন বাংলাদেশের জন্য আইকন এবং তাদের পটেটো ক্র্যাকার্স, মিস্টার টুইস্ট, ডালমুঠ, চানাচুর, রিং চিপস এর মার্কেটকে এতদিন পরেও কেউ হারাতে পারেনি, তাদের সেল কমাতে পারেনি।
বর্তমানে খাবার প্রস্তুতকারক অনেক কোম্পানি মার্কেটে বিস্তার লাভ করেছে। সেদিক থেকে বলতে গেলে কিছুটা প্রতিযোগিতামূলক মার্কেট তো তৈরি হয়েছেই। সেই সাথে বম্বেও তাদের প্রচার প্রসারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন, টেলিভিশন অ্যাড, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের কার্যকলাপ এর মাধ্যমে তাদের মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং চালু রেখেছে।
বর্তমান সময়ে এসে প্রতিযোগিতায়
বর্তমানে এসে বম্বের দেশীয় ও বিদেশী দুই মার্কেটেই সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হলো প্রাণ। প্রাণও বাংলাদেশের লিডিং প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর একটি এবং তাদেরও অনেক সহপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে হাজারো প্রতিযোগিতার ভিড়েও বম্বের চাহিদাকে আসলে কেউই বিট করতে পারেনা। মানুষের কাছে এখনো বম্বে আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে অনেক এগিয়ে।
বম্বে যখন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে গিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে তখনকার সময়টাই নব্বই দশক বা তার কাছাকাছি কোনো সময়। ঠিক তখনকার সময়ের কিশোরদের জীবনের সাথে বম্বের মনে হয় যে একই সাথেই শক্তপোক্ত বেড়ে ওঠা। কিশোর বয়সের আবেগের আরেক নাম হয়ে ওঠে বম্বের পটেটো ক্র্যাকার্স। স্কুলে গেলে টিফিন টাইমের জন্য মায়েদের কাছ থেকে চেয়ে আনা পাঁচ টাকা দিয়ে কেনা সেই চিপস এর আনন্দ হয়তোবা এখন হাজার টাকার স্ন্যাকসও পূরণ করতে পারে না। সময়ের সাথে বম্বেও আরো বড় হয়েছে, দেশীয় মার্কেট থেকে বিদেশেও নিজেদের পণ্য রপ্তানি করছে, সময়ের সাথে সাথে চিপসের দাম বেড়েও পাঁচ থেকে দশ টাকা হয়েছে, আমাদের নব্বই দশকের আবেগের ও পরিবর্তন এসেছে বৈকি। ৭৪ বছরের বম্বে নিঃসন্দেহে শতবর্ষ পার করবে, এদেশে তাদের রাজত্ব, জনপ্রিয়তা ধরে রাখবে, আরো নতুন পণ্য নতুন প্রজন্মদের উপহার দিতে থাকবে। কারণ, সত্যিকার অর্থে আইকন কখনো হারায় না। বম্বে সুইটস তার দীর্ঘসময়ের প্রতিযোগিতামূলক পথচলায় বারবার তাই প্রমাণ করে দিয়েছে।