উদ্যোক্তাদের জন্য মানি ম্যানেজমেন্ট টিপস ফলো করা কেন জরুরি?

ব্যবসা মানেই ঝুঁকি। আর উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা যখন করেই ফেলেছেন তখন এই ঝুঁকিকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। উদ্যোক্তা জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে মানি ম্যানেজমেন্ট। আপনি যত চিন্তাভাবনা করেই ব্যবসায়িক জগতে পা রাখুন না কেন, যদি এই জায়গাতে অটল না থাকতে পারেন তাহলে কোনোভাবেই ব্যবসায় সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়। যখন থেকেই বিজনেস প্ল্যান শুরু করবেন তখন থেকেই বাজেট নির্ধারণ করে নিতে হবে। কারণ এই প্ল্যানিং এর উপরেই নির্ভর করবে আপনার বিজনেস কতটুকু গ্রো করবে। সেই সাথে বিজনেস এর পুরো প্রসেসে ফাইন্যান্সিয়াল বা মানি ম্যানেজমেন্ট তো ঠিক রাখতে হবেই। প্রত্যেক উদ্যোক্তাকেই জানতে হবে কীভাবে টাকার সদ্ব্যবহার করা যায়। আজ এই বিষয় নিয়েই বেশ কিছু টিপস শেয়ার করবো আপনাদের সাথে।

উদ্যোক্তাদের জন্য মানি ম্যানেজমেন্ট টিপস

১) বাজেট ঠিক করা

যে কোনো ব্যবসার সফলতার জন্য বাজেট ক্রিয়েট করা খুব জরুরি। বাজেটে সব ধরনের খরচ এমনকি ভবিষ্যতে কত আয় হতে পারে সেটাও ইনক্লুড করতে হবে। বাজেট এমনভাবে অর্গানাইজ করা প্রয়োজন যেন সেটা ফ্লেক্সিবল হয় ও সহজে বোঝা যায়। উদ্যোক্তাদের জন্য মানি ম্যানেজমেন্ট এর এই পার্টটি ফলো করা এজন্য জরুরি যে, এটা না করলে বিজনেস ক্যাপিটাল, ফান্ডিং ও খরচগুলো হিসাবের বাইরে চলে যাবে। আর এতে ম্যানেজমেন্টে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।

বাজেট পরিচালনার মাধ্যমে নিয়মিত আর্থিক স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করা যায় এবং ব্যবসার যাবতীয় খরচের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সহজ হয়। বাজেটের জন্য আপনি কিছু টুলস বা সফটওয়্যার ইউজ করতে পারেন। সাধারণত মাইক্রোসফট এক্সেল বা গুগল শীট ব্যবসার রেকর্ড রাখা ও বাজেট করার জন্য বেশি ব্যবহার করা হয়। শুরুর দিকে বাজেট করার জন্য প্রফেশনাল কাউকে নিয়োগ দেয়ার দরকার নেই। অনলাইনে অনেক ধরনের রিসোর্স আছে যেখান থেকে আপনি বাজেট এবং ডেইলি রেকর্ড মেইনটেইন করার জন্য বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন।

উদ্যোক্তাদের জন্য মানি ম্যানেজমেন্ট টিপস

২) ক্যাশ ফ্লো অর্গানাইজ রাখা

ব্যবসাতে যে আয় ও ব্যয়ের খাতিরে যে টাকা পয়সার আসা যাওয়া এটাকেই বলে ক্যাশ ফ্লো। কয়েকটি ক্যাটাগরিতে একে ভাগ করলে বোঝা সহজ হয়। এই ক্যাটাগরিগুলো হচ্ছে – অপারেটিং, ফাইন্যান্সিং ও ইনভেস্টিং অ্যাক্টিভিটি।

অর্গানাইজড ক্যাশ ফ্লো আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে আপনার বিজনেস বর্তমানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাশ ফ্লো নেগেটিভ হলে আপনাকে ঋণ শোধ করার জন্য আরও ইনকাম করতে হবে। পজিটিভ হলে ঋণ শোধ করা হয়ে গিয়েছে এবং বিজনেস ভালোভাবে চলছে। অর্গানাইজড ক্যাশ ফ্লো’র কয়েকটি টিপস হচ্ছে-

  • ক্যাশ ফ্লো রেগুলার মনিটর করুন
  • বাড়তি খরচ বাদ দিয়ে দিন
  • যে অ্যাসেটগুলো কখনো লাগবে না সেগুলো বিক্রি করে দিন
  • মোবাইল পেমেন্টের মতো লেটেস্ট টেকনোলজিগুলো ইউজ করার চেষ্টা করুন
  • যে কোনো ক্রাইসিসে পড়ার আগে ঋণ শোধ করে ফেলুন

৩) সতর্কতার সাথে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা

ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে অটোমেটিক্যালি সব লেনদেনের হিসাব রাখা যায়। সব ট্রানজেকশনের হিসাব কার্ডেই থাকবে। ম্যানুয়ালিও হিসাব রাখা যায়, তবে তাতে ভুলের সম্ভাবনা বেশি থাকে। যদি কোনো কারণে সেগুলো হাতছাড়া হয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় তখন ব্যবসাতে বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই উদ্যোক্তাদের জন্য মানি ম্যানেজমেন্ট টিপস এর আরও একটি পয়েন্ট হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড।

বিজনেস যখন শুরু করবেন তখন একটি একাউন্ট খুলে নিন। কর্মীদের বেতন দেয়া থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক যত লেনদেন আছে সবকিছুর জন্য একটি কার্ড ব্যবহার করুন। তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে এর সঠিক ব্যবহার না করলে ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসও তৈরি হতে পারে। তাই সব সময় ক্রেডিট লিমিটের মধ্যে থেকেই খরচ করতে হবে। আর কোন মাসে কত খরচ করলেন সেটার হিসাবও মান্থলি রাখার চেষ্টা করবেন।

ক্রেডিট কার্ড

৪) ইমার্জেন্সি ফান্ড তৈরি রাখা 

ইমার্জেন্সি ফান্ডকে অনিশ্চিত পরিকল্পনার ফান্ডও বলা হয়। ব্যবসাতে সব সময় কিছু টাকা নিরাপত্তার খাতিরে আলাদা করে রাখতে হয়। কোনো বিপদে এই টাকা ব্যবহার করা যায়। বেশিরভাগ এক্সপার্টদের পরামর্শ হচ্ছে অন্তত ৩ থেকে ৬ মাসের জন্য পর্যাপ্ত টাকা আলাদা করে রাখা। এই এমাউন্ট অবশ্য কত সেটা নির্দিষ্ট করা নেই। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসার সিকিউরিটি রাখা।

৫) প্রতিটি ট্র্যানজেকশনের ট্র্যাক রাখা 

তরুণ উদ্যোক্তাদের জানা উচিত কোথায় কোথায় টাকা খরচ হচ্ছে এবং কীভাবে হচ্ছে। মানি ট্র্যাক করা হলে বিজনেসের অ্যাকুরেট ছবি দেখা যায়। সেই সাথে অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন ডেইলি ট্রানজেকশনকে আরও সহজ করে দিয়েছে।

৬) ফুল টাইম কর্মী নিয়োগ না দেয়া

ব্যবসার শুরুতেই অনেক উদ্যোক্তা ভাবেন তারা একদম প্রথম থেকেই এক্সপার্ট ও প্রফেশনালদের নিয়োগ দিবেন এবং তারাই বাকি কাজ করবে। অথচ তারা খরচের বিষয় নিয়ে তেমন একটা ভাবে না। এ সময় ব্যবসায়ীদের শুধু বেসিক স্যালারি নিয়ে ভাবা উচিত, এর বাইরে অন্য কিছু নয়। যেমন- অফিস ভাড়া, জিনিসপত্রের খরচ, ব্যবসায়িক বিভিন্ন পরিকল্পনা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে আপনাকে বাঁচাতে পারে আউটসোর্সিং। আপনি খুব বেশি কর্মী ফুল টাইমের জন্য নিয়োগ না দিয়ে ফ্রিল্যান্স হিসেবে কয়েকজনকে নিয়োগ দিতে পারেন। এখন অনেকেই ঘরে বসে কাজ করতে চায়। তাদেরকে নিয়োগ দিলে অফিসে এসে কর্মী সামলানোর ঝামেলাও অনেকতা কমে গেলো, আবার কাজও হয়ে গেলো।

৭) ডিজিটালি মনিটরিং করা 

বর্তমান যুগ ডিজিটালের। আপনার যদি স্ট্রং ডিজিটাল প্রেজেন্স থাকে, তাহলে এই ওয়ার্ল্ডে আপনি বেশ ভালো করতে পারবেন। সোশ্যাল মিডিয়া মনিটাইজেশন এখন দ্রুত এগোচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট দিয়ে আপনি এখন অনেক রেভেনিউ জেনারেট করতে পারবেন। ডিজিটালি যে কাজগুলো আপনি করতে পারেন-

  • অনলাইন কোর্স ক্রিয়েট করুন এবং ফলোয়ারদের এডুকেশন প্রোভাইড করুন
  • প্রোদাক্ট সেল করুন এবং ফলোয়ারদের সার্ভিস অফার করুন
  • ফেইসবুক শপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া শপ ক্রিয়েট করুন
  • অ্যাফিলিয়েট মার্কেটার হয়ে যান
  • সম্ভব হলে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংও করতে পারেন
  • মার্কেটিং এর জন্য নিজস্ব ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন

ডিজিটালি মনিটরিং

৮) ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক খরচ আলাদা রাখা 

ব্যবসায়িক যত খরচ হবে তাতে কখনো ব্যক্তিগত খরচ ইনক্লুড করবেন না। দুটো খরচ আলাদা থাকলে ট্যাক্স দিতেও সুবিধা হয়। এই রুল ফলো করার সময় আপনি কিছু টেকনিক ফলো করতে পারেন-

  • বিজনেসের জন্য একটি আলাদা আইনি পরিচয় বা লিগ্যাল আইডেনটিটি তৈরি করুন
  • Employer Identification (EIN) নিয়ে রাখুন
  • বিজনেসের আলাদা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড রাখুন
  • বিজনেস থেকে নিজেকে স্যালারি দিন
  • আপনাকে যে বেতন দেয়া হচ্ছে সেগুলোর রিসিটও আলাদা করে রাখুন
  • বিজনেস বা নিজের জন্য যে খরচগুলো হচ্ছে সেগুলোর ট্র্যাক রাখুন

৯) অবগত থাকা ও শেখা

উদ্যোক্তা জীবন মানে জীবনভর শেখার একটি প্রস্তুতি। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি যখন মাঠে নেমেছেন, তখন আপনাকে আপনার সেক্টর নিয়ে যথেষ্ট ভালো জানাশোনা থাকতে হবে এবং টেকনোলজি ও বিজনেস ইকোনমি বদলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে সেই পরিস্থিতিতে সাথে সাথে সিদ্ধান্ত বদলানোর মানসিকতাও থাকতে হবে।

উদ্যোগ মানেই নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ করা, সমস্যার সমাধান করা, নেটওয়ার্ক তৈরি করা এবং সমাজ বদলানোর মানসিকতা রাখা। এটা তখনই সম্ভব যখন আপনি সমস্যা সম্পর্কে জানবেন, লেটেস্ট টেকনোলজি, ইউজার, প্রোডাক্ট মার্কেট ও বিজনেসের চেঞ্জিং ন্যাচার সম্পর্কে জানতে পারবেন। বর্তমানে জানার জন্য আর্টিকেল, পডকাস্ট, ম্যাগাজিন, অনলাইন কোর্স, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মতো অনেক সুযোগ আছে। তবে হ্যাঁ, সব তথ্যই যে গ্রহণযোগ্য তা নয়। এর মধ্যে যেটা গ্রহণযোগ্য সেটাই আপনাকে গ্রহণ করতে হবে।

মানি ম্যানেজমেন্ট এর ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা কোন ভুলগুলো বেশি করেন?

মানি ম্যানেজমেন্ট মিসটেকস

ব্যবসার শুরুতে উথান পতন থাকেই। বিশেষ করে না বুঝে শুরু করলে পথে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। জানলে ও বুঝলে সাধারণত এই ঝুঁকিগুলো এড়ানো যায়। মানি ম্যানেজমেন্টে উদ্যোক্তারা সাধারণত যে ভুলগুলো করেন-

  • সময়মত ফান্ড কালেক্ট করলেও বিল পেমেন্টে দেরি করে
  • পেমেন্ট প্রসেসে সুবিধা রাখে না
  • অ্যাডভান্স কোনো টাকা অর্গানাইজ করে রাখে না
  • ইমার্জেন্সির জন্য ফান্ড রাখে না
  • ছোট ছোট খরচগুলোর রেকর্ড রাখে না
  • পর্যাপ্ত ক্যাপিটাল থাকে না
  • বিজনেসের উথান পতনে নজর রাখে না
  • ফ্রি রিসোর্সগুলো ইউজ করে না

এটা সত্যি যে কাজ শুরু করলে কমবেশি কিছু না কিছু ভুল আপনার হবেই। এই ভুল থেকেই শিখতে হবে। কিন্তু যদি শেখার ইচ্ছাই না থাকে, তাহলে পরবর্তী ধাপে আপনি কীভাবে পৌঁছাবেন?

সদ্য যারা উদ্যোক্তা হচ্ছেন তাদের জন্য মানি ম্যানেজমেন্ট বেশ চ্যালেঞ্জের হতে পারে। তাই আপনাকে বেসিক কিছু মানি ম্যানেজমেন্ট প্রিন্সিপাল সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে। সেই সাথে বাজেট, ট্র্যাক, রেকর্ড ও বিজনেস ফাইন্যান্স অ্যানালাইজ করার জন্য ডিজিটাল টুলসের ব্যবহারও বাড়াতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *