প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে এসে ব্র‍্যান্ডিং কেমন হওয়া উচিত?

প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে এসে ব্র‍্যান্ডিং কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে আলাপ শুরুর আগে আমরা প্রথমেই একটু ব্র‍্যান্ডিং নিয়ে জেনে নেই। ব্র‍্যান্ডিং হলো এমন একটি উপায় যা কোনো ব্র‍্যান্ড বা কোম্পানিকে তার পরিচয় প্রকাশে সাহায্য করে। আরেকটু বিস্তারিত বললে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, নির্দিষ্ট একটি ব্র‍্যান্ড সম্পর্কে জানার জন্য যতগুলো বাস্তব ও স্পষ্ট তথ্য রয়েছে, যে উপায়ে সেগুলো বাকিদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় নিজেদের স্বকীয়তা প্রকাশ করার জন্য সে সবগুলো জিনিসই ব্র‍্যান্ডিং এর আওতায় পড়ে।

আরো সহজ করে বললে, ধরুন আপনি একজন শিল্পী। আপনার নাম (X)। এখন কেউ এসে আমার কাছে আপনার ঠিকানা জানতে চাইলো, আপনার নাম ও পেশা সম্পর্কে বললো। তখন আমি ভেবে দেখলাম এই নামে এই পেশায় আরো ৪ জন মানুষ রয়েছেন, এরপর তিনি আপনার গড়ন, স্বভাব এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বললো যা দিয়ে আমি বুঝেই গেলাম উনি আসলে ঠিক কাকে চাচ্ছেন। তারপর তথ্য দিয়ে উনাকে আপনি পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করলাম। এই যে বৈশিষ্ট্যগুলো আপনাকে আপনার সমান আরো ৪ জন ব্যক্তি থেকে আলাদা করে তুললো, আপনার নিজস্বতা প্রকাশ করলো সেগুলো তৈরি করাই হচ্ছে ব্র‍্যান্ডিং। প্রতিটি ব্র্যান্ডের কিছু মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ব্যক্তিত্ব, চেহারা, অনুভূতি এবং সম্পদ রয়েছে, যা এটিকে তার প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করতে সাহায্য করে।

প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে এসে ব্র‍্যান্ডিং এর উদ্দেশ্য

প্রত্যেকটা ব্র‍্যান্ড টিকে থাকারই উপায় প্রথম ও একমাত্র উপায় হচ্ছে সেলস বা প্রোডাক্ট বিক্রি হওয়া। কিন্তু একটা সত্যিকার অর্থের ব্র‍্যান্ডের উদ্দেশ্য কি খালি সেলস বাড়ানো? না! ব্র‍্যান্ডিং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্র‍্যান্ড ভ্যালু তৈরি করা, স্বতন্ত্রতা তৈরি করে সবার মাঝে থেকেও নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরা, সেই কাস্টমার পর্যন্ত পৌঁছানো যারা আসলেই এমন একটি ব্র‍্যান্ডকেই চায়, কোনো লোকাল মার্কেটের হাজার কপি প্রোডাক্ট না কিনে। উদাহরণ হিসেবে বললে যেমন নিউ মার্কেট, যেখানে একই জিনিস হাজারটা আছে। একই কারখানা থেকে হাজারটা একই রকমের জিনিস বানিয়ে মার্কেটে নিয়ে আসা হচ্ছে, কিন্তু কেউ কি জানতে পারছে তারা কারা? জানতে পারছে না। এই গ্যাপটা পূরণ করাই ব্র‍্যান্ডিং এর কাজ। খালি সেলস বাড়ানো আর হাজার হাজার কপি আইটেম বিক্রি করা না, বরং প্রোডাক্ট বিক্রির পাশাপাশি আইডেন্টিটি তৈরি করাও।

প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে এসে ব্র্যান্ডিং

 

ব্র‍্যান্ডিং এর ভিশন

ব্র‍্যান্ডের ভিশন হচ্ছে ব্র‍্যান্ড কই পৌঁছাবে তা ঠিক করে মাঠে নামা। অর্থাৎ গোল সেট করা। আগামী দশ বছর পর আপনি আপনার কোম্পানিকে কোথায় দেখতে চান তা সেট করা। নিশ্চয়ই আপনার ক্রেতার সাথে আপনার ব্র‍্যান্ডের ভিশনের কোনো সম্পর্ক নাই, কারণ তারা জানেন না আপনি কী চাচ্ছেন। তবুও তারাই আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ নির্দিষ্ট ফ্যানবেইজ করে ক্রেতা তৈরি করতে পারলে তারাই আপনাকে আপনার সেই ভিশন পর্যন্ত যেতে সাহায্য করবে।

ব্র‍্যান্ডিং এর মিশন

নামের সাদৃশ্য দেখে মনে হতে পারে ভিশন আর মিশন বুঝি একই। একই না হলেও দুটি জিনিস একে অন্যের পরিপূরক। যখন আপনি আপনার ব্র‍্যান্ডের জন্য ভিশন সেট করেন যে- এত সময় পর আমি আমার কোম্পানিকে এই জায়গায় দেখতে চাই, সেই পর্যন্ত নিয়ে যেতে আপনি ছোটবড় যতগুলো পদক্ষেপ নেবেন সবই মিশন, স্বপ্ন সত্যি করার মিশন।

যেমন – প্রযুক্তির এই যুগে গুগল সব মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী, তাদের ভিশন হচ্ছে মানুষের সব ধরনের তথ্য সহায়তার জন্য শেষ পর্যন্ত বেস্টটা দিয়ে যাওয়া, আর এর জন্য তারা যে কাজগুলো করছে, যেভাবে কোম্পানিটি পরিচালনা করছে সেগুলোই মিশন। এই আধুনিক যুগে এসে উদ্দেশ্যহীনভাবে কোনোরকম চালিয়ে নেয়ার চিন্তা করে কোনো ব্র‍্যান্ডই দাঁড়াতে পারবে না। নিজের অবস্থান শক্তপোক্ত করতে প্রয়োজন মিশন ও ভিশনের দারুণ সমন্বয়।

ব্র‍্যান্ডিং আসলে অনেক কিছুরই হয়, যেমন – প্রোডাক্ট ব্র‍্যান্ডিং, পার্সোনাল ব্র‍্যান্ডিং, কোম্পানি ব্র‍্যান্ডিং। তাই এবার আসি কীভাবে এই ডিজিটাল আর প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে আমরা ব্র‍্যান্ডিং এর ধারা ধরে রেখে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পারি-

১) সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং

এই অনলাইনভিত্তিক দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস এখন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোই। তাই এগুলো কতটা আমার ব্র‍্যান্ডিং প্রসেসের অনুকূলে আছে তা মাথায় রাখা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা খুবই জরুরী। সোশ্যাল মিডিয়া ব্র‍্যান্ডিং এর ক্ষেত্রে কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে। এর মধ্যে (পোস্টার বা ব্যানারের ক্ষেত্রে) হলো – ১. মূল বিষয়বস্তু (Main Content), ২. বিষয়ের টেক্সট (Subject Text), ৩. ব্র্যান্ডিং এরিয়া (Branding Area), ৪. যোগাযোগের এরিয়া (Contact Area), ৫. ব্যাকগ্রাউন্ড (Background) ইত্যাদি। এই পাঁচটি বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হলে আপনার পোস্টার বা ব্যানার খুব সহজে যেকোনো সোশ্যাল মিডিয়াতে গুরুত্ব বহন করবে। যার মাধ্যমে আপনার ব্যানার বা আপনার প্রদর্শনী সংক্রান্ত তথ্য সুন্দরভাবে ফুঠে উঠবে, কাস্টমারের চোখে আসবে। পাশাপাশি এখন রিলস, ভিডিও, ছবি, পোস্ট বুস্ট সহ বিভিন্ন ধরনের মার্কেটিংকে কাজে লাগিয়েও প্রোডাক্ট প্রমোশনের কাজ করা হয়। তবে এতে অবশ্যই থাকতে হবে ভিন্নতা, যাতে করে অন্যদের থেকে আপনার ব্র‍্যান্ডকে আলাদা করা যায়। কাস্টমারের কাছে নিজেদের আলাদা হিসেবে মনে রাখার মতো ব্যবস্থা করা, যাতে করে কেউ দেখলেই বুঝতে পারে এটা কোন ব্র‍্যান্ডকে রিপ্রেজেন্ট করছে।

Social media marketing

২) ব্র‍্যান্ড প্রমোটার

যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া বা ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রচার প্রসারের কথা আমরা আলোচনাই করছিলাম, বর্তমানে অনলাইন জগতে ব্র‍্যান্ডগুলোকে দাঁড় করাতে এক নতুন পেশার উদয় হয়েছে। আর তারা হলেন ‘ব্র‍্যান্ড প্রমোটার’। যারা বিভিন্ন উপায়ে কোনো একটি ব্র‍্যান্ডের প্রোডাক্ট, ইনফো, সেবা সম্পর্কে মানুষকে তাদের নিজেদের প্লাটফর্মে অথবা সেই ব্র‍্যান্ডের প্লাটফর্ম গুলোতে তুলে ধরে। এটি হতে পারে ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়েও। একেকজন প্রমোটার একসাথে অনেকগুলো ব্র‍্যান্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারেন আবার শুধুমাত্র একটির সাথেও হতে পারেন। ব্র‍্যান্ডগুলোকে ইতিবাচভাবে পরিচয় করানোর জন্য তারা কাজ করে থাকেন এবং এই প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে এসে এই পদ্ধতি কিন্তু বেশ সাড়া ফেলেছে এবং অনেক সেল ও হচ্ছে এর মাধ্যমে। আমরা এটিকে ব্র‍্যান্ডিং এর একটি ভালো উপায় হিসেবেই নিতে পারি।

৩) ইনফ্লুয়েন্সার পিআর

ইনফ্লুয়েন্সার হচ্ছে তারাই যারা মানুষকে কোনোকিছুতে ইনফ্লুয়েন্স করে বা প্রভাবিত করতে পারে, তাদের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করিয়ে আর সেই বার্তা মানুষকে পৌঁছে দিয়ে যে পাবলিক রিলেশন তৈরি করা হয় সেটিই মূলত পিআর(PR)। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্র‍্যান্ড প্রমোটিং এর পাশাপাশি ইনফ্লুয়েন্সার পিআরও এখন তুমুল জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে কোনো ব্র‍্যান্ড তাদেরকে ওই ব্র‍্যান্ডটির পণ্য বা সেবা পাঠায় এবং তারা তাদের কাজের মধ্যে সেটি সম্পর্কে আলাপ করে, প্রদর্শন করে, তুলে ধরে। এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরাসরি লাইভ থাকে না তবে কন্টেন্ট নির্ভর কাজ থাকে। পাশাপাশি ব্র‍্যান্ড আর ইনফ্লুয়েন্সারের মধ্যে চুক্তি থাকে তারা কীভাবে রিপ্রেজেন্ট করাবে সেটি কি ছবি হবে, নাকি ভিডিও হবে নাকি এক ঝলক দেখানো হবে ইত্যাদি। এখন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোতে প্রচুর ইনফ্লুয়েন্সার এবং তারা অনেক ভালো ভালো কাজ করছে, কাস্টমারকে সত্যিকার অর্থেই প্রভাবিত করতে পারছে। এখানে তারা কাজে লাগিয়েছে পার্সোনাল ব্র‍্যান্ডিং, প্রথমে তারা নিজেদের আইডেন্টিটি বানিয়েছে, এরপর তা দিয়ে ব্র‍্যান্ডগুলোর বানাচ্ছে।

৪) ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসেডর

পার্সোনাল ব্র‍্যান্ডিং নিয়ে যখন আমরা কথা বলেই ফেললাম তখন আরেকটা আধুনিক যুগের ব্র‍্যান্ডিং সিস্টেমের কথা বলি তা হলো ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, অর্থাৎ যার পার্সোনাল ব্র‍্যান্ডিং এর কারণে সে হয়ে ওঠে ওই প্রতিষ্ঠান এর মুখপাত্র বা ফেইস। শুধুমাত্র তার ফেইসভ্যালুর উপর ওই ব্র‍্যান্ডের অনেক কিছু নির্ভর করে। সেলস, ইম্প্রেশন, ব্র‍্যান্ড হিসেবে দাঁড়ানোর প্রবণতা এমন অনেক কিছুই। এরকম মুখপাত্র হয়ই সাধারণত যারা দেশব্যাপী পরিচিত বা বিশ্বব্যাপী। যারা সবার কাছে আলোচনার টপিক কোনো না কোনোভাবে। তবে সব ব্র‍্যান্ডই চায় যে ইতিবাচকভাবে আলোচিত তাকেই আনতে, তাকেই মুখপাত্র বানাতে যিনি এই ব্র‍্যান্ডের হয়ে কথা বলবে, পরিচিতি দিবে। যেমন- খেলোয়ার, অভিনেতা অভিনেত্রী, ইনফ্লুয়েন্সার, কোনো বড় মোটিভেশনাল স্পিকার বা বাণিজ্যিক সফল ব্যাক্তি, রাজনীতিবিদও হতে পারে। তবে অবশ্যই এমন কেউ যার অনেক অনেক প্রভাব রয়েছে সমাজে।

ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর

৫) টেলিভিশন বিজ্ঞাপন

প্রযুক্তির শুরুর দিকে যখন মানুষের কাছে ইন্টারনেট ছিল না তখন মানুষ টিভিই দেখতো, টেলিভিশনে যে ধরনের পণ্যগুলোর প্রচার হতো তার দিকেই ঝুকত। আস্তে আস্তে ইন্টারনেট আসার পর এই প্রচারমাধ্যমের প্রভাব কমে গেলেও অবশ্যই এখনো অনেকেই টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের প্রতি অনেক আগ্রহী। ব্র‍্যান্ডগুলোও এখনো এ ধরনের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরার কাজ করছেন।

৬) ক্যাম্পেইন

পাহাড়ে গিয়ে তাবু টাঙ্গিয়ে ক্যাম্প করার মতো ক্যাম্পেইন এটি না। বরং অনলাইন, অফলাইন সম্ভাব্য সব জায়গায় নিজেদেরকে অন্য ব্র‍্যান্ড থেকে আলদাভাবে প্রচার করার জন্য, নিজেদেরকে তুলে ধরার জন্য যত ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট বুস্ট, রোডসাইড মার্কেটিং, স্কুল কলেজ ভিত্তিক ক্যাম্পেইন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কোলাবোরেশান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর, বিভিন্ন ট্যাগলাইন প্রচার সবই এসব ক্যাম্পেইন এর অংশ। নিজেদের অবস্থান শক্তপোক্তভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরার প্রক্রিয়া।

এছাড়াও ইমেইল মার্কেটিং, টেক্সট মার্কেটিং এর মতো উপায়েও আমরা অনেক ব্র‍্যান্ডকে নিজেদের সম্পর্কে জানাতে, তথ্য প্রদান করতে দেখি। এই প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে নিজেদেরকে তুলে ধরার মূলনীতি হিসেবে আমরা বুঝতেই পারছি যতবেশি প্রযুক্তির সাথে যুক্ত জিনিসগুলোতে আমরা আমাদের অবস্থান শক্ত করতে পারবো ততবেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবো। নিশ্চয়ই এতে কোনো সন্দেহের সুযোগ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *