ব্যবসায়িক আলাপ করতে গেলে আমরা তো কত ধরনের ব্যবসা নিয়েই কথা বলে থাকি। অথচ মশলার মতো ছোট্ট রান্নার উপকরণ যে এতবড় সফল ব্যবসার হাতছানি দিতে পারে তা কয়জনের জানা, কজনই বা জানে সেই সফলতার কথা? এমন এক ব্যক্তির কথা যিনি কিনা প্রতিদিন ২০ টাকা আয় থেকে তার সম্পত্তি ২০০০ কোটি টাকায় নিয়ে যান কেবল পরিশ্রম ও একনিষ্ঠতার মাধ্যমে। বলছি ভারতের এমডিএইচ (MDH) কোম্পানির কর্ণধার ধর্মপাল গুলাটির কথা। যিনি কিনা ‘দাদাজি’ বা ‘মশলা কিং’ নামেই বেশি জনপ্রিয় ছিলেন।
ধর্মপাল গুলাটি যেভাবে হয়ে উঠলেন মশলা বাদশাহ
জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে কী কি পরিবর্তনের মাধ্যমে ধর্মপাল গুলাটি মাসালা কিং হয়ে উঠেছিলেন তা নিয়েই আজ আপনাদের জানাবো। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক এই কিংবদন্তী সম্পর্কে।
শুরুটা যেমন ছিলো
১৯২৩ সালের ১৭ মার্চ পাকিস্তানের শিয়ালকোটে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ছোট্ট গুলাটি সাহেব। যদিও তার আগেই তার বাবা চুনীলাল গুলাটি ‘মহশিয়ান দি হাট্টি’ নামে এই মশলার প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। এরপর ১৯৪৭ এ দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পর অনিচ্ছা স্বত্তেও তারা ভারতে চলে আসেন এবং অমৃতসরের রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। পরে সপরিবারে দিল্লিতে কাজের খোঁজে চলে আসেন ধর্মপাল গুলাটি সহ তার পুরো পরিবার, আশ্রয় নেন এক আত্মীয়ের বাড়ি। যদিও সেখানে অনেক সমস্যার স্বীকার হচ্ছিলেন, এই সময় পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সেই ছোট্ট ধর্মপাল গুলাটি রাস্তায় মেহেন্দি বিক্রি করে প্রতিদিন ২০ টাকা আয় করতে শুরু করেন, টানাপোড়েনের এই কঠিন সময়ে তার বাবা তাকে ১৫০০ টাকা দিয়ে সংসারের হাল ধরতে বলেন। তিনি এই টাকা থেকে প্রায় ৬৫০ টাকা দামের ‘টাঙ্গা’ (ঘোড়ার গাড়ি) কেনেন।
কনৌট প্লেস থেকে করোল বাগ অবধি টাঙ্গা চালালেও প্রতিনিয়ত যাত্রীদের অপমান সহ্য না করতে পেরে একদিন বিক্রি করে দেন টাঙ্গা। সবকিছু বাদ দিয়ে অবশেষে পারিবারিক ব্যবসাতেই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
যেভাবে সেই ছোট্ট মশলার ব্যবসা ব্র্যান্ডে পরিণত হলো
যেহেতু পারিবারিক ব্যবসাতেই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন, তাই টাঙ্গা বিক্রির টাকা দিয়ে ১৯৪৮ সালে করোলবাগেই শুরু করেন মশলার ব্যবসা। ফের যাত্রা শুরু করে ‘মহশিয়ান দি হাট্টি’, সংক্ষেপে এমডিএইচ। প্রথমদিকের পেশাগুলোতে টিকতে না পারায় এই ব্যবসা নিয়েও তিনি খুব শঙ্কা বোধ করেন, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে প্রথম দোকানটি বেশ ভালো সাফল্যের দেখা পায়। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে চাঁদনি চকে তিনি দ্বিতীয় দোকান খোলেন। ১৯৫৪ সালে করোল বাগে তৈরি করেন ‘রুপক স্টোর’। এটিই ভারতের প্রথম আধুনিক মশলার দোকান ছিল। ১৯৫৯ সালে দিল্লির কীর্তিনগরে জমি কিনে নিজস্ব মশলার ফ্যাক্টরি শুরু করেন। ‘মহশিয়ান দি হাট্টি’ ছড়িয়ে পড়লো পুরো ভারতে অনায়াসেই। জনপ্রিয় হিন্দি সংবাদপত্র ‘প্রতাপ’-এ বিজ্ঞাপন দিয়ে দোকানের জনপ্রিয়তা বাড়ান। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। বর্তমানে ৬০ ধরনের বেশি মশলা তৈরি করে এই প্রতিষ্ঠানটি। শুধু দেশে নয়, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, জাপান, কানাডা, ইউরোপ, সৌদি আরবের মতো দেশ-মহাদেশেও রপ্তানি করা হয় এমডিএইচ’র মশলা। এছাড়াও প্রায় ১৫টি কারখানায় উৎপাদন করা হয় এমডিএইচ ব্র্যান্ডের মশলা। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে দুবাই ও লন্ডনেও রয়েছে তাদের অফিস।
টিভি পর্দায় ‘দাদাজি’
অনেকেই মনে করেন পরিকল্পিতভাবে বুঝি গুলাটি মহাশয় টিভি পর্দায় নিজের কোম্পানির বিজ্ঞাপনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, পর্দায় ‘দাদাজি’ নামে পরিচিত ধর্মপালের অভিনয় জগতে প্রবেশ একদমই কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ঘটেছিল। বিজ্ঞাপনের শ্যুটিংয়ে এক অভিনেতা অনুপস্থিত থাকায় তিনিই বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই থেকেই এমডিএইচ’র প্রতিটি বিজ্ঞাপনে কোনও তারকা নয়, নিজেই অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নেন। দাদাজির জন্যই যেন আরো বেশি নজরে চলে আসে এমডিএইচ মশলা। ভারতীয় হেঁসেলে তিনিই একজন ব্র্যান্ড।
টিভি খুললেই নয়ের দশকে শিশু থেকে বয়স্ক একটি বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইনে আকৃষ্ট হতো, ‘আসলি মসালে সাচ সাচ… এমডিএইচ’। ছোট ছোট ব্র্যান্ডগুলিও যখন পেশাদার অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের দিয়ে বিজ্ঞাপন করাতেন তখন এমডিএইচের বিজ্ঞাপনে মাথায় পাগড়ি, হুক গোঁফ, চশমা এবং মুক্তার নেকলেস এর সঙ্গে জাতিগত পরিধানে এক বয়স্ক মানুষের মুখ ভেসে আসতো। বিজ্ঞাপনে তাঁর উপস্থিতি ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছিল। তাঁর সাফল্য ভরা জীবনের মূলমন্ত্র ছিলো, ‘পৃথিবীকে তুমি সেরাটা দাও, পৃথিবীও তোমার জন্য তার সেরাটাই ফিরিয়ে দিবে।’
উন্নয়নমূলক কাজ
শুধুমাত্র ব্যবসায় সফলতার জন্য তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এমনটা কিন্তু নয়, বরং ব্যবসার পাশাপাশি নানা সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজেও জড়িত ছিলেন মহাশয়জি। ক্লাস ফাইভের স্কুলছুট মানুষটি তাঁর বেতনের ৯০ শতাংশ দান করে দিতেন স্কুল উন্নয়ন তহবিলে। দিল্লির এনসিআরে একাধিক স্কুল ও হাসপাতাল চলে এমডিএইচ সংস্থার উদ্যোগে। গুলাটি এমডিএইচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মহাশয় চুন্নিলাল সরস্বতী শিশু মন্দির, মাতা লীলাবতী কন্যা বিদ্যালয় এবং মহাশয় ধর্মপাল বিদ্যা মন্দিরসহ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য ২০টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নয়াদিল্লিতে দরিদ্রদের জন্য একটি ৩০০-শয্যার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এবং বস্তিবাসীদের জন্য একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল স্থাপন করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম অনুসারে মহাশয় চুন্নিলাল চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামে একটি চ্যারিটি ফাউন্ডেশন চলে। COVID-19 মহামারী চলাকালীন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থ দিয়েছিলেন এবং দিল্লির কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ৭৫০০ পিপিই কিট দান করেছিলেন।
পদ্মভূষণ পেয়ে সম্মানিত হওয়ার গল্প
ছোট্ট দোকান থেকে যেভাবে তিনি নিজেকে ভারতের অন্যতম সেরা উদ্যোগপতি হিসাবে উন্নিত করেছিলেন, তা ভবিষ্যতের অনেক উদ্যোগপতিকেই উদ্বুদ্ধ করে। ২০১৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে দেশের একজন সেরা উদ্যোক্তা হিসেবে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন।
সদা হাস্যোজ্জ্বল দাদাজির মৃত্যু
বার্ধক্যজনিত কারণে তো বটেই, দীর্ঘদিন হৃদরোগের সমস্যায়ও ভুগছিলেন এই মহাশয়। ২০২০ এর শেষের দিকে অবশেষে ৯৮ বছর বয়সে দিল্লির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ধর্মপাল গুলাটি। সাথে করে নিয়ে যান ছোটবেলার সব স্মৃতি, টিভি পর্দায় আর দেখা যায়নি রাজকীয় কায়দায় মশলার বিজ্ঞাপনে দাদাজির হাসিমুখ। নক্ষত্রেরা বুঝি এভাবেই হারিয়ে যায়।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা
ধর্মপাল গুলাটির মৃত্যুর পর, MDH ব্র্যান্ডের ঐতিহাসিকতা বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ এর বিষয় ছিল এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল যে, মহাশয় গুলাটির জায়গায় কে আসবে ব্র্যান্ড বিজ্ঞাপনে। কিন্তু, এখন একজন নতুন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে এই বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে এবং MDH মশলার নতুন বিজ্ঞাপনে আসা এই ব্যক্তিকে নিয়ে অনেক কিউরিওসিটি রয়েছে।
নতুন MDH আঙ্কেল অন্য কেউ নয়, ধর্মপাল গুলাটির ছেলে রাজীব গুলাটি, যিনি MDH মসলার অধিপতি এবং নতুন বিজ্ঞাপনে তার বাবার জায়গায় কাজ করছেন। ধর্মপাল গুলাটির মৃত্যুর পর, তার ছেলে রাজীব গুলাটিই মূলত এখন MDH দেখাশুনা করছেন, যিনি MDH কে আরো আন্তর্জাতিক মানে ওঠাতে কাজ করে যাচ্ছেন এবং এ কাজে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এখন প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, জাপান, ইউএই এর মতো দেশেও প্রসারতা পাচ্ছে এবং শারজাহেও তাদের একটি উদ্যোগ আছে।
প্রধান মশলা তৈরি কোম্পানি MDH লিমিটেডকে নিয়ে কিছুদিন পূর্বে গুজব ছড়ায় যে তারা প্রতিষ্ঠান বিক্রি করার কথা ভাবছেন। তাদের ব্যবসা বিক্রি করার এই তথ্য সম্পর্কে মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তারা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন। এরকম প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী নিউজহাব HUL এর সাথে তাদের ব্যবসা বিক্রির সম্ভাবনা নিয়ে কোনো আলাপ না হওয়ায় তারা এ ব্যাপারে সতর্কতার কথাও জানিয়েছেন। এর জন্য MDH তাদের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা বার্তাতে এমন নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং মানুষকে বলেছে, “এমন অসত্য, তৈরিকৃত খবর কেউ বিশ্বাস করবেন না”। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি বেশ ভালোভাবেই তাদের কার্য পরিচালনা করছেন, ধর্মপাল গুলাটির ছায়ায় থেকে যেমন ঠিক তেমনই।
একটি উক্তি দিয়ে শেষ করা যাক,”He who controls the spice, controls the universe.” অর্থাৎ মশলা যার নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর মালিকানা তার। ফ্রাঙ্ক হারবার্টের এই স্মরণীয় উক্তিটি ‘মশলা সম্রাটের’ ক্ষেত্রেই সত্যিকার অর্থে প্রযোজ্য। মশলার জগতে কয়েক দশক ধরে কর্তৃত্ব করে চলা এমডিএইচ মশলা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অধিপতি ধর্মপাল গুলাটি যেন তারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত।