যেকোনো ব্যবসার সাফল্যের জন্য একটা ভালো মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ভালো করার বেশ কিছু উপায় রয়েছে, তার মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো কিছু নির্দিষ্ট মার্কেটিং নীতি মেনে চলা। মার্কেটিং প্রিন্সিপাল বা নীতি হচ্ছে কিছু নির্দেশনা যেগুলো মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে সাহায্য করে। ভালো মার্কেটিং সিস্টেম বিভিন্নভাবে ক্রেতাকে আকর্ষণ করে, যেমন- আপনার পণ্য সম্পর্কে কাস্টমারকে ধারণা দিবে, কাস্টমারের পছন্দমত প্রোডাক্ট বাছাই করার পরামর্শ দিবে এবং কাস্টমার স্যাটিসফেকশন নিশ্চিত করবে। একইভাবে আপনার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি যদি খারাপ হয়, সাময়িক লাভ হলেও ভবিষ্যতে সেটাই হবে ক্ষতির কারণ। মার্কেটিং ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে সম্পর্ক ও বিনিময়ে সাহায্য করে যাতে উভয়পক্ষেরই লাভ হয়।
কিছু মার্কেটিং প্রিন্সিপাল অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ও সমাদৃত। মার্কেটিং এর চারটা মূল প্রিন্সিপাল রয়েছে যাদের বলা হয় 4P। এই প্রিন্সিপালগুলো হাভার্ডের একজন মার্কেটিং এর প্রফেসর প্রথম উল্লেখ করেছিলেন। বিখ্যাত সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এইসব প্রিন্সিপাল ব্যবহার করেই তাদের অবস্থার উন্নতি করেছে। এই চারটি মূল জিনিস বিভিন্নভাবে সাজিয়ে মিলিয়ে আপনি নিজের সুবিধা অনুযায়ী স্ট্র্যাটেজি করে নিতে পারেন। নির্দিষ্ট ধরনের ব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট ক্রেতাদের দরকার হয়, সে অনুযায়ী আপনাকে আপনার স্ট্র্যাটেজি তৈরি করে নিতে হবে।
মার্কেটিং প্রিন্সিপাল কয়টি ও কী কী?
মার্কেটিং এর বেসিক চারটি প্রিন্সিপাল হচ্ছে-
১. প্রোডাক্ট
২. প্রাইস
৩. প্লেস
৪. প্রমোশন
তবে ১৯৮১ সালে মার্কেটিং প্রিন্সিপাল সংখ্যায় বাড়ানো হয়েছে এবং কিছু কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নতুনগুলোকেও সমান গুরুত্ব দেয়। নতুন প্রিন্সিপালগুলো হচ্ছে-
৫. পিপল বা পজিশনিং
৬. প্রসেস
৭. প্যাকেজিং বা ফিজিক্যাল এভিডেন্স
প্রিন্সিপালগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত
প্রোডাক্ট
প্রোডাক্ট মার্কেটিং নীতিগুলোর মাঝে প্রথম ও প্রধান। বিজনেস বা সেলস শুরুই হয় প্রোডাক্টের উপর। প্রোডাক্ট বলতে আমরা বুঝি এমন বস্তু যা একজন কাস্টমারের ইচ্ছা বা চাহিদা পূরণ করবে৷ তা হতে পারে কোনো দ্রব্য, ডিজিটাল সেবা বা ফিজিক্যাল সেবা।
আপনি যদি আপনার প্রোডাক্টকে লাভজনক করতে চান, তাহলে এ সম্পর্কে মার্কেট রিসার্চ করে নিতে হবে। কাস্টমারের চাহিদা বোঝার জন্য প্রথমে কাস্টমারকে বুঝে নিতে হবে এবং তারপর সে অনুযায়ী প্রোডাক্টের সঠিকভাবে প্রচার চালিয়ে টার্গেটেড কাস্টমারের কাছে পৌছাতে হবে। একইসাথে আপনার প্রোডাক্টের প্রয়োজনীয়তা, বিশেষত্ব, গুণগত মান, নিরাপত্তা এসব খেয়াল রাখতে হবে।
আপনি প্রোডাক্ট সম্পর্কে মার্কেট রিসার্চ করতে কিছু মেথড ব্যবহার করতে পারেন। যেমন- কাস্টমার সার্ভে, ইন্টারভিউ, কাস্টমার স্যাটিসফেকশন, কম্পিটেটিভ এনালাইসিস ইত্যাদি।
প্রাইস
প্রাইস বা মূল্য হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় মার্কেটিং প্রিন্সিপ্যাল। প্রাইস বলতে আমরা বুঝবো কাস্টমার প্রোডাক্ট এর জন্য মোট কত টাকা খরচ করতে রাজি। প্রোডাক্টের প্রাইস নির্ধারণ করা মোটেও সোজা ব্যাপার নয়, এক্ষেত্রে বেশ্ কয়েকটি জিনিস খেয়াল করতে হয়। যেমন- পণ্যের মান আর উৎপাদন খরচ, প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত দাম, আপনার নিজের লাভ ইত্যাদি। এজন্য মার্কেটিং রিসার্চ এর প্রয়োজন হয়।
উপযুক্ত প্রাইসিং সেট করার জন্য আপনি বেশ কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। প্রথমে আপনার পণ্যের পিছনে মোট কত খরচ সেটা বের করতে হবে, এর মধ্যে শুধু উৎপাদন খরচ নয়, প্রমোশন আর প্যাকেজিং, তৈরির সময়, অন্যান্য খরচ যেমন ইলেকট্রিক বিল বা কর্মীদের বেতন, নষ্ট হয়ে যাওয়া পণ্যের খরচ ইত্যাদি অনেক কিছু রয়েছে। এরপর পণ্য প্রতি খরচ হিসাব করে তাতে আপনার লাভের পার্সেন্টেজ হিসাব করে মূল্য ঠিক করতে হবে।
এটা একটা বহুল প্রচলিত মডেল, এটা লংটার্মে ভালো ফল দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি যদি বাজারে সাবান কিনতে যান, তাহলে দেখবেন পণ্যের বিশেষত্ব আর মান অনুযায়ী এক ধরনের পণ্যের দাম অনেকটা কাছাকাছি। এটা কম্পিটিশন আর মার্কেট রিসার্চের ফলাফল।
প্লেস
প্লেস হচ্ছে সেই জায়গা যেখান থেকে কাস্টমার আপনার পণ্য বা সেবা নিতে পারবেন। এটা হতে পারে লোকাল মার্কেট, সুপারশপ, আপনার নিজের দোকান এমনকি আপনার ওয়েবসাইট বা ফেসবুক মার্কেটপ্লেস। পণ্য বিক্রির জন্য সঠিক প্লেস নির্ধারণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মূল আইডিয়া হচ্ছে কাস্টমারের জন্য পণ্য কেনা যতটা সহজ হয় তার ব্যবস্থা করা। আজকাল অনেক মানুষই অনলাইন শপিং এ অভ্যস্ত, এটা দূরত্বের সীমাবদ্ধতা কমিয়ে দেয় এবং কাস্টমারের সংখ্যা বেড়ে যায়।
প্রোডাক্ট প্লেস সঠিকভাবে নির্ধারণ করার জন্য আপনার প্রথমে ভাবতে হবে, আপনার টার্গেটেড কাস্টমাররা কোথায় বেশি সময় দেন, এই ধরনের প্রোডাক্ট কোথায় বেশি চলে ইত্যাদি।
প্লেস নির্ধারণ করতে আপনি বেশ কিছু ভালো স্ট্র্যাটেজি নিতে পারেন। যেমন- আপনার শপ যদি ফিজিক্যাল শপ হয়, অন্যান্য একই ধরনের বা একইসাথে কাজে লাগে এমন পণ্যের সাথে দিতে পারেন, বিভিন্ন মেলা বা উৎসবে স্টল দিতে পারেন, অনলাইনে হলে নিজের বিজনেস প্লেস বা ওয়েবসাইটের বাইরে অন্যান্য ডিজিটাল প্লাটফর্ম ও মার্কেটপ্লেস যেমন- আমাজন, ইবে, ইটসি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দারাজ এছাড়াও বিভিন্ন বিজনেস গ্রুপে প্রচার করতে পারেন। এতে পণ্যের বিক্রি ও পরিচিতি দুটোই বাড়বে।
উদাহরণ হিসেবে আমাদের সবার পরিচিত ব্র্যান্ড প্যারাসুটের কথাই ধরা যাক। এদের পণ্য লোকাল দোকান থেকে শুরু করে দারাজ বা সাজগোজের মত অন্যান্য প্লাটফর্মেও রয়েছে, এতে মানুষ সহজেই পণ্য সম্পর্কে জানতে ও কিনতে পারে।
প্রমোশন
প্রমোশন মানে হচ্ছে আপনার পণ্যের প্রচারণা। পণ্যের প্রচার এমনভাবে করতে হবে যাতে তা টার্গেটেড অডিয়েন্সের কাছে পৌছায়। এর মাঝে রয়েছে টার্গেট অডিয়েন্সের সাথে যোগাযোগ আর আপনার পণ্যকে তাদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দেয়া। প্রমোশন ব্যবসার সফলতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ভুল প্রমোশন থেকে নেগেটিভ মার্কেটিংও হতে পারে।
প্রমোশনের বেশ কিছু ধরন আছে। যেমন-
- সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং— ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার ইউটিউব ইত্যাদি
- পাবলিক রিলেশন— কাস্টমারদের সাথে যোগাযোগ
- কন্টেন্ট মার্কেটিং— ব্লগ পোস্ট, ভিডিও বা ইবুক
- ইমেইল মার্কেটিং— পটেনশিয়াল কাস্টমারদের ই মেইল পাঠানো
- এডভার্টাইজিং— রেডিও, টেলিভিশন বা মোবাইলে বিজ্ঞাপন দেয়া
- সেলস প্রমোশন— বিশেষ অফারে ছাড় দেয়ার মাধ্যমে
- কোলাবরেশন— অন্য কোনো কোম্পানির সাথে কোলাবরেশনের মাধ্যমে
প্রমোশন ঠিকভাবে করতে আপনার কাস্টমারের চাহিদা সম্পর্কে জানতে হবে। চলমান ট্রেন্ড সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকলে আপনি সেটা ব্যবহার করে পণ্যের প্রমোশন করতে পারবেন।
পিপল (বা পজিশনিং)
পিপল বলতে যারা আপনার পণ্য নিয়ে কাজ করছেন, যারা প্রচারণা করছেন এবং যারা ব্যবহার করছেন, সবাই এক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ ও মেধাবী লোকজন নিয়োগ করা আর কাস্টমার সার্ভিস ভালো করা পিপল এর অন্তর্ভুক্ত।
কিছু কিছু রিসার্চার পিপলকে পজিশনিং বলতে পছন্দ করেন, এর মানে সঠিক পজিশনে সঠিক ক্রেতাদের সামনে পণ্য উপস্থাপন করা।
এই মার্কেটিং নীতি বাস্তবায়নে আপনার কাস্টমার সার্ভিস উন্নত করতে হবে। কাস্টমারের সাথে যোগাযোগ এ ক্ষেত্রে জরুরি। কমিউনিকেশনে দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিতে হবে যারা কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারবে। এক্ষেত্রে লাইভ চ্যাট বা হেল্পলাইন ভালো অপশন।
প্রসেস
প্রসেস হচ্ছে প্রোডাক্টের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া। এর মাঝে কাঁচামাল কেনা থেকে শুরু করে তৈরি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও কাস্টমারের কাছে প্রোডাক্ট কেমন সার্ভিস দিচ্ছে এর সবই অন্তর্ভুক্ত। এটাকে কাস্টমারের এক্সপেরিয়েন্স জার্নিও বলা যায়, আপনার কোম্পানি থেকে একজন পণ্য বা সেবা কিনে কী পাচ্ছেন। আপনার লক্ষ্য হবে এই প্রসেসকে যতটা সম্ভব ঝামেলাহীন করা।
এটি বাস্তবায়নের জন্য আপনাকে কোম্পানির ইন্টারনাল প্রসেস ঢেলে সাজাতে হবে। প্রয়োজনে কিছু বাদ দিয়ে কিছু যোগ করতে হবে। এর ফলে কাজের মান আর প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে।
কর্মীদের দিকেও নজর দিতে হবে, প্রয়োজনে কিছু জায়গায় প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে মেশিনারী বা অটোমেশন যুক্ত করতে পারেন, কর্মীদের প্রয়োজনীয় ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে পারেন।
প্যাকিং (বা ফিজিক্যাল এভিডেন্স)
ফিজিক্যাল এভিডেন্স বা প্যাকিং বলতে আমরা বুঝব কাস্টমার যা দেখছে এবং অনুভব করছে। যেমন- আপনার স্টোরের পরিচ্ছন্নতা, ওয়েবসাইটের ডিজাইন আর অপশনস, কাস্টমার রিভিউ, প্রোডাক্টের প্যাকেজিং ইত্যাদি। এই দিকগুলো পোটেনশিয়াল কাস্টমারকে আপনার সম্পর্কে ধারণা দেবে এবং আপনার পণ্য কিনতে আগ্রহী করে তুলবে। যদি আপনার ব্যবসা সেবাকেন্দ্রিক হয়, তাহলে ফিজিক্যাল এভিডেন্স এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেবার মান সম্পর্কে কাস্টমারকে ধারণা দিতেও সাহায্য করে। ফিজিক্যাল এভিডেন্স আপনার পণ্য বা সেবা সম্পর্কে কাস্টমারকে প্রাথমিক ধারণা দেয়। তাই এগুলো সুন্দরভাবে অর্গানাইজ করা খুব জরুরি।
কিছু কিছু রিসার্চাররা প্যাকেজিংকেও ফিজিক্যাল এভিডেন্সের মাঝে ধরেন, কারণ তারা নির্দেশ করছেন যে প্যাকেজিং এর মাধ্যমে কাস্টমারের কাছে আপনার প্রোডাক্ট প্রেজেন্ট করা হয়। ইউএস এর ৭২% গ্রাহক মনে করেন পণ্যের প্যাকেজিং এর ডিজাইন, ম্যাটেরিয়াল এসব তাদের কেনা বা না কেনার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে। এ থেকে বোঝা যায় ফিজিক্যাল এভিডেন্স হিসেবে প্যাকেজিং এর গুরুত্ব। ফিজিক্যাল এভিডেন্স যেকোনো কিছুই হতে পারে। কাস্টমারের রিভিউ থেকে শুরু করে কাস্টমার সার্ভিসে রেসপন্স রেট বা একটা দ্রুত ডেলিভারি। এটা ইন্ডাস্ট্রি আর বিজনেস অনুযায়ী নির্ভর করে। আসলে প্রোডাক্ট এর প্রসেস সুন্দরভাবে মেনটেইন করা হলে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ফিজিক্যাল এভিডেন্স হিসেবে কাজ করে। যেমন- প্যাকেজিং নিয়েই যদি বলা হয়, ডিজাইন সাধারণ কিন্তু নজরকাড়া হলে ভালো হয়, যেমন আড়ং এর ব্র্যান্ডিং। অনেকগুলো রঙ ব্যবহার না করে অল্প কয়েকটা মূল রঙ ব্যবহার, প্যাকেজিং এ ইকো ফ্রেন্ডলি ম্যাটেরিয়াল যেমন কাগজ, কার্ডবোর্ড এর বক্স ইত্যাদি ব্যবহার, প্যাকেজিং এর গায়ে বা প্রোডাক্টের সাথে কার্ড-নোট দিয়ে পণ্যের সম্পর্কে তথ্য দিয়ে দেয়া, তার যত্ন বা ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া ইত্যাদি কাস্টমারের মনে ভালো প্রভাব ফেলে।
মার্কেটিং প্রিন্সিপাল সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে দিলাম আজকের আর্টিকেলে। এবার এগুলো ফলো করে আপনিও বাড়াতে পারেন আপনার ব্যবসার প্রচার, প্রসার ও বিক্রি। তাহলে আর অপেক্ষা কীসের?