বেশিরভাগ মানুষই তাদের আর্থিক দিক সামলাতে হিমশিম খেয়ে যান। এর মূল কারণ হচ্ছে নিজেদের লাইফস্টাইল নিয়ন্ত্রণ করতে এবং খরচের ব্যাপারে সঠিক নিয়ম না মানা। তাই কোনো ব্যবসা শুরু করার আগে অথবা কোনো ব্যাপারে যদি আর্থিক লেনদেনের দায়িত্ব আপনার উপর থাকে তাহলে কিছু বিষয় সম্পর্কে আপনাকে আগেই সতর্ক হতে হবে। তবেই আর্থিক ব্যাপারে বিভিন্ন ভুল করা থেকে আপনি বিরত থাকতে পারবেন। এজন্য জরুরি হচ্ছে প্রাথমিক ভুলগুলি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে নেয়া। এতে ভবিষ্যতে আর্থিক যে কোনো ভুল এড়িয়ে চলা যেমন সহজ হবে, তেমনই সময়ও নষ্ট হবে না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার বাড়তি দুশ্চিন্তা করা থেকে আপনি রেহাই পাবেন। চলুন তাহলে ভুলগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
আর্থিক ব্যাপারে যে ভুলগুলো ক্ষতির কারণ হতে পারে
১) আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে
আপনি যতটুকু আয় করছেন তার চেয়ে যদি আপনার ব্যয় বেশি হয়ে থাকে, তাহলে এক সময় যেয়ে আপনি আপনার কাজকে অপছন্দ করা শুরু করবেন। মনে হতে থাকবে, খরচ কুলানোর জন্য আপনি যা আয় করছেন তা যথেষ্ট নয়। এজন্য অভিজ্ঞরা সব সময় বলেন, যতটুকুই আয় করুন না কেন, খরচ অবশ্যই তার চেয়ে কম করুন। এতে আর্থিক নিয়ম বজায় থাকবে। আপনি যদি টাকা-পয়সা সামলাতে না পারেন, তারপরও কোনো ধরনের ঋণের চক্করে ভুলেও পড়বেন না। এটা এক ধরনের ফাঁদের মতো। একবার পা দিলে আর বের হওয়া যাবে না।
২) ৫০:৩০:২০ রুল ফলো না করা
প্রতিটি মানুষের একটি বাজেট প্ল্যান থাকা উচিত। এই প্ল্যান হতে হবে মাসেরটা মাসেই, এবং আপনাকে এই ব্যাপারে একদম স্ট্রিক্ট থাকতে হবে। প্রতিটি আয় বাজেটিং রুল অর্থাৎ ৫০:৩০:২০ অংশে ভাগ করতে হবে। এর মানে হচ্ছে ৫০ শতাংশ আপনি খরচ করবেন আপনার প্রয়োজনে (যেমন- নিত্যদিনের বাজার সদাই, বাসা ভাড়া, ইএমআই, ইউটিলিটি এবং আরও যা দরকার), ৩০ শতাংশ খরচ হবে চাহিদাতে (জিম মেম্বারশীপ, বাইরে যাওয়া ও খাওয়া এবং অন্যান্য), এবং বাকি ২০ শতাংশ জমা করা। আপনি যখন ইমার্জেন্সি সিচ্যুয়েশনে পড়বেন, তখন এই ২০ শতাংশ জমানো অর্থই আপনাকে অনেক বড় সাহায্য করবে।
৩) সময়মত বকেয়া পরিশোধ করতে না পারা
প্রতি মাসে এমন কিছু বকেয়া হত আপনার রয়ে যায় যেগুলো আপনি কখনোই সময়মত পরিশোধ করতে পারেন না। এ ধরনের বকেয়াগুলোকে গুরুত্ব দিন। কারণ পেমেন্ট যদি মাসেরটা মাসে শোধ করতে না পারেন তাহলে এক ধরনের চক্রে আপনি আটকে যাবেন। যেখান থেকে বের হওয়াটা খুব কঠিন হয়ে ওঠে। যখনই বিল পরিশোধ করতে যাবেন, দেখা যাবে পুরনো বিলই পরিশোধ করে যাচ্ছেন। সময়মত আর টাকা দেয়া হচ্ছে না।
এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই পুরনো সব বিল ক্লিয়ার করে ফেলার চেষ্টা করুন। এবার এই হিসাব অনুযায়ী মাসের বাজেট ঠিক করে নিন। শুরুতে আয় ব্যয়ের হিসাবে কিছু সময়ের জন্য ব্যাঘাত ঘটলেও পরের সময়ের জন্য এটাই হবে বেস্ট উপায়।
৪) ধার নেয়া
পরিচিতজনদের থেকে ধার নেয়া মানে নিজের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তাদের কথা বলার সুযোগ করে দেয়া। তারা চাইলে যে কোনো প্রয়োজনে সেই টাকা ফেরত চেয়ে বসতে পারেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, টাকা ধার নিয়ে সেটা সময়মত ফেরত না দিলে সম্পর্কও খারাপ হয়ে যায় এক সময়। তাই কিছু প্রয়োজন হলেও বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়ার মানসিকতা দূর করুন।
৫) বেশি ক্রেডিট কার্ড রাখা
ক্রেডিট কার্ডকে উচ্চ পর্যায়ের ঋণ হিসেবে ধরা হয় যেটা সবাই হ্যান্ডেল করতে পারে না। এটা শুধু তাদের জন্যই যারা এটা সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারে। ক্রেডিট কার্ডে হয়ত দারুণ কিছু ডিসকাউন্ট ও ডিল অফার করা হয়, কিন্তু আপনি যদি সময়মত এসব পেমেন্ট না করেন, তাহলে এগুলো কোনো কাজেই আসবে না, বরং শুধু ইন্টারেস্ট বাড়াবে। যেই অংক একটা সময় অনেক বড় হয়ে যাবে। তাছাড়া বেশি ক্রেডিট কার্ড থাকলে আপনি টাকার হিসাব মেলাতে পারবেন না, এক সময় পেমেন্ট মিস করে ফেলবেন। তাই সতর্ক হতে হবে এ বিষয়েও।
৬) বাজেট তৈরি করতে না পারা
প্রতি মাসে সবারই একটি বাজেট মেনে চলা প্রয়োজন। যদি মাসের পর মাস আপনি বাজেট ছাড়া চলতে থাকেন, তাহলে এক সময় আর্থিক ব্যাপারে কোনো কিছুই আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এতে খুব ভালো আয় করলেও আর্থিক সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হয় না। তাই যে বাজেট করবেন সেটা প্রতি মাসে মেনে চলার চেষ্টা করুন।
৭) অনাকাঙ্ক্ষিত চাকরি করতে থাকা
আপনি বর্তমানে যে চাকরি করছেন হতে পারে সেটি আপনি কোনো অভাবে বা বিপদে পড়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের চাকরিতে বেশি সময় থাকলে আপনারই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য যে চাকরিতে আপনি আর্থিক ও পেশাগতভাবে উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না সেখান থেকে বের হয়ে আসুন। তবে এর আগে অবশ্যই জেনে নিন নতুন চাকরিতে জয়েনের আগে কোন কোন বিষয়ে আপনাকে দক্ষ হতে হবে। এরপরই পরিকল্পনা সাজিয়ে নিন।
৮) ভবিষ্যতের জন্য অর্থ না জমানো
সময় কীভাবে শেষ হয়ে অবসর চলে আসবে আপনি বুঝতেও পারবেন না। আপনি কি সে সময়ের জন্য প্রস্তুত? অনেকে আর্লি রিটায়ারমেন্টেও চলে যান। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য সেভিংস শুরু করাটা জরুরি। সেই সাথে আপনার যদি স্বপ্ন থাকে নিজের পছন্দের একটা বাড়ি বানানোর বা ব্যবসা শুরু করার, তাহলেও অর্থের জোগান রাখা জরুরি। এর সবগুলোই আসলে ভবিষ্যৎ জীবনের লক্ষ্য, যার জন্য আপনার বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি ভালো রাখতে হবে।
৯) ভয় বা চাপ থেকে কোনো আর্থিক সিদ্ধান্ত নেয়া
আপনি যখন কোনো বিষয় নিয়ে বেশি ভয় পান, তখন যে সিদ্ধান্তগুলো নেন, সেখান থেকে ভুল হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এতে দ্রুত কাজ করার চিন্তা থাকে বলে বিকল্প যে আরও সুযোগ থাকতে পারে তা আর ভেবে দেখা হয় না। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে কাছের মানুষদের সাথে কথা বলুন। চাপের মুখে পড়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভুলেও ভাববেন না। বিশেষ করে হুট করে লোন নিয়ে ফ্ল্যাট বা গাড়ি কেনা, বিয়ে করা বা সন্তান নেয়া- এই অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্তগুলো চাপের মুখে পড়ে নিবেন না। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় হয়ত এগুলোকে তেমন ভুল বলে মনে হবে না, বা ভাবতে পারেন সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন হলে দেখবেন এই সিদ্ধান্তগুলোই আপনার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
১০) অর্থ ও সম্পত্তি সংক্রান্ত কাগজপত্র ঠিক না থাকা
আমাদের বেশিরভাগ মানুষের খামখেয়ালি থাকে অর্থ ও সম্পত্তি সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে। এগুলো যেমন ঠিক থাকে না, তেমন ভবিষ্যতে ঝামেলা বাড়তে থাকে। উইল তৈরি করা না থাকলে বা উত্তরাধীকারদের জন্য কাগজপত্র ঠিক না থাকলে আপনার পরিবার আর্থিক অনিরাপত্তায় ভুগতে পারে।
১১) নিজের সাধ্যের বাইরে খরচ করে বেঁচে থাকা
আর্থিক ব্যাপারে সতর্ক না থাকলে এই সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে। আপনি যখন এমন কোনো খরচ করে ফেলেন যেটা আসলে আপনি এফোর্ড করতে পারবেন না, তখন কি আপনি অনুশোচনায় ভোগেন? যদি উত্তর হয় হ্যাঁ, তাহলে বোঝা যাবে আপনি এক সময় নিজেকে শুধরে নিতে পারবেন। কিন্তু যদি উত্তর হয় না, তাহলে এটা এক সময় আপনার অভ্যাস হয়ে দাঁড়াবে। যেমন- আপনি যদি অতিরিক্ত বাইরে খাওয়াদাওয়া করেন বা ভ্যাকেশনে যান যেটা আপনি নিয়মিত এফোর্ড করতে পারছেন না- তাহলে এক সময় আপনি সব কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবেন। এজন্য আয় বুঝে ব্যয় করাটা জরুরি।
আমরা সবাই জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা চাই। কিন্তু শুধু চাইলেই হবে না, এজন্য আর্থিক ব্যাপারে সচেতন থাকাটাও জরুরি। উপরে যে ভুলগুলোর কথা আলোচনা করলাম, চেষ্টা করবেন এগুলো না করতে। তবেই নিজের ও পরিবারের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন।