আমরা সাধারণত চাই, আমাদের জীবনে যা করা দরকার, যত সাফল্য আসা দরকার তার সবই ২০-২৫ বছর বয়সেই যেন আসে৷ পঞ্চাশ এর কোঠায় বয়স গেলে ধরেই নিই যে এটি রিটায়ারমেন্টের সময়। কিন্তু বার বার অনেক সাফল্যমন্ডিত ব্যক্তিরা পঞ্চাশ এর পর সফলতা অর্জন করে দেখিয়েছেন যে সাফল্যের পথে বয়সের অঙ্কটা না কোনো বাঁধা, না ফিক্সড। চেষ্টা আর কঠিন অধ্যবসায়, জীবনের যে কোনো বয়সেই এনে দিতে পারে আকাশচুম্বী সাফল্য।
ঠিক এমনই একজন উদাহরণ হলেন ভারতের মুম্বাইয়ের ফাল্গুনি নায়ার। গুজরাটি পরিবারে জন্ম নেয়া এ গুনী নারী প্রমাণ করেছেন যে মানুষ যদি চেষ্টা করে তবে যেকোনো বয়সেই সাফল্য অর্জন করতে পারে। আজ আমরা এই গুনী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেই জানবো।
ফাল্গুনি নায়ার এর জন্ম ও পরিচয়
ফাল্গুনি নায়ার ১৯৬৩ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারী, ভারতের মুম্বাইতে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম মূলত গুজরাটি পরিবারে। তার বাবার ছিলো বিয়ারিং এর কোম্পানি যেটি তার মা এবং বাবা মিলে সামলাতেন।
পড়াশোনা ও ব্যাংকিং এর জগতে প্রবেশ
পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারের দিক থেকে এই গুনী নারীর অবস্থান কিন্তু বেশ দৃঢ়। তিনি সিডেনহাম কলেজ অফ কমার্স এন্ড ইকোনমিক্স থেকে বি.কম পাশ করেন। এরপর মুম্বাইয়ের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী লাভ করেন।
ফাল্গুনির কর্মজীবন শুরু হয় অর্থের জগতে, যেখানে তিনি অত্যন্ত মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি ICICI ও কোটাক মাহিন্দ্রা ব্যাংকের মত ইন্ডিয়ার প্রথম সারির ব্যাংকগুলোতে চাকরি করেছেন।
এ.এফ ফার্গুসন এন্ড কোং এ কনসালটেন্ট এর চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর ফাল্গুনি ১৯৯৩ সালে কোটাক মাহিন্দ্রা গ্রুপের সাথে কাজ শুরু করেন। তিনি মার্জার্স এন্ড একুইজিশন টিমের প্রধান হিসেবে যুক্ত হোন। এরপর তিনি এটির প্রাতিষ্ঠানিক ইকুইটি শাখা অফিস খোলেন লন্ডন এবং নিউ ইয়র্কে। ২০০১ সালে তিনি আবার ভারতে ফিরে আসেন। ২০০৫ সালে কোটাক মাহিন্দ্রা ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন।
একটি কঠিন সিদ্ধান্ত ও ‘নাইকা’ র জন্ম
২০১২ সালে কোটাক মাহিন্দ্রার এই অসাধারণ পদটি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন ফাল্গুনি। সেই সাথে আরো একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে তার নিজের জমানো ২ মিলিয়ন ডলার দিয়ে “Nykaa” বা “নাইকা” প্রতিষ্ঠা করেন।
নাইকার যাত্রা ও সংগ্রাম
২০১২ সালে অনেক ঝুঁকির মুখে ফাল্গুনি নায়ার নাইকা প্রতিষ্ঠা করেন। একদম শুরুতে মাত্র তিনজন মানুষকে নিয়োগ করেন তিনি। আর এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় তার বাবার ছোট্ট অফিসে।
নাইকা মূলত ইন্ডিয়ান ই-কমার্স কোম্পানি, যারা বিউটি আর ফ্যাশান প্রোডাক্টস বিক্রি করে থাকে। বর্তমানে নাইকার নিজস্ব মোবাইল এপ সহ রয়েছে ১০০ এর উপর দোকান। অথচ একদম শুরুতে ১০০টি অর্ডার এ পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই নাইকা’র ওয়েবসাইট ক্রাশ করে, ফলে একটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয় এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে থেমে থাকেননি ফাল্গুনী আর তার ছোট্ট দলটি। ২০১৩ সাল থেকে নাইকার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
২০২১ সালে নাইকার মূল্য ছিলো ২.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ফাল্গুনি নায়ারকে কিরণ মজুমদার এর পাশাপাশি ভারতের স্ব-নির্মিত মহিলা ধনকুবের তালিকায় বসায়। ২০২১ এর ১০ নভেম্বর নাইকা পাবলিক হলে, এর মূল্য এসে দাঁড়ায় ১৩ বিলিয়ন ডলারে।
নাইকা প্রকাশ্যে আসার পর পরই নায়ারের মোট সম্পদ ৬.৫ বিলিয়নে বেড়ে যায়, যা তাকে ভারতের সবচেয়ে ধনী মহিলাতে পরিণত করে এবং মোট মূল্যের দ্বারা ভারতের শীর্ষ ২০ ধনী তালিকায় নিয়ে যায়। ২০২২ সালে ফাল্গুনি নায়ার ফোর্বস ইন্ডিয়াতে আত্মপ্রকাশ করেন।
তবে এই জার্নিটা এত সহজ ছিলো না। ২০১৯ সালে আবারও নাইকার ওয়েবসাইট হ্যাক করার চেষ্টা করা হয়। এছাড়াও নানা সময়ে নানারকম জটিলতা কাটিয়ে উঠে নাইকা আজকে এত বড় একটি জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে।
ইন্ডিয়ান ই-কমার্সের পথিকৃৎ ও নারীর ক্ষমতায়নের অনন্য উদাহরণ
“নাইকা” শুধু একটি অনলাইন সাজসজ্জা বিক্রির প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং ইন্ডিয়ান ই-কমার্সের একটি অন্যতম ধারক। নাইকা যে সময় প্রতিষ্ঠিত হয় তখনো ইন্ডিয়া সেভাবে ই-কমার্সের সাথে পরিচিত হয়নি। ‘নাইকা’র চিন্তাভাবনা যে শুধু সে সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রগামী ছিলো তাই-ই নয় বরং নাইকা একটি নতুন যুগের সূচনায় বড় অবদান রেখেছে। প্লাটফর্মটি আধুনিক প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করেছে ও এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ডিজিটাল কেনাকাটার অভিজ্ঞতা দিয়েছে গ্রাহকদের। নাইকার আরো একটি বড় ব্যাপার যে, এটি শুধুমাত্র শহরকেন্দ্রিক না, বরং ছোটখাটো শহর, শহরতলী এমন কি গ্রামেও পৌঁছে গেছে।
‘নাইকা’ তৈরির সময় ফাল্গুনি নায়ার শুধুই একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবেননি, বরং মাথায় রেখেছেন নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিও। ২০২০ সালে নাইকা নেটফ্লিক্সের সাথে কোলাবরেশন করে তৈরি করেছে “বিউটি ইন হার স্টোরি” যা মেয়েদের সব শক্তিশালী গল্পগুলো দেখিয়েছে। এই গল্পগুলোতে তারা সেই সকল শক্তিশালী নারীদের সৌন্দর্য গল্পে তুলে এনেছে যারা নিজেদের স্বপ্ন জয় করতে ভেঙেছে হাজার বারণ, পেরিয়েছে হাজার ঝড়। নাইকা নানাভাবে মেয়েদেরকে উৎসাহ দিয়ে থাকে তাদের বাউন্ডারি ভেঙে নিজের স্বপ্নের পথে যাওয়া। নিজেকে নিজে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে নিজের পরিচয় গড়ার। বিভিন্নরকম প্রচারণা, ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নারীদেরকে উৎসাহিত করে আসছে নাইকা।
‘নাইকা’ র বর্তমান
“নাইকা” ছোট থেকে শুরু করলেও বর্তমানে ইন্ডিয়ার নাম করা কোম্পানিগুলোর সাথে সমানে টেক্কা দিয়ে চলেছে। গোদরেজ, এস বি আই কার্ডস, ভারত পেট্রোলিয়াম বা কোল ইন্ডিয়ার মত বড় বড় সব কোম্পানিগুলোর চেয়েও ই-কমার্সের এই কোম্পানিটির রেভিনিউ বেশি। নাইকা মাত্র ৪ বছরের মাথায় ই-কমার্স এ বিউটি রিটেল প্লাটফর্মে যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তা প্রমাণ করেছে।
তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে নাইকার ১৭ মিলিয়নেরও বেশি সক্রিয় সদস্য রয়েছে এবং প্রতিমাসে তারা ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি অর্ডার প্রসেস করে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতে নাইকার ১০৫ টিরও বেশি ছোট বড় দোকান রয়েছে। ভারতের ১১ টি শহর জুড়ে রয়েছে ২৩ টি স্টোরহাউজ, যেখানে নাইকা ৪০০০ এরও উপরের বিউটি ব্রান্ডের জিনিস স্টোর করে।
বর্তমানে এই কোম্পানিটির সিইও হিসেবে আছেন- ফাল্গুনী নায়ার, আনচিত নায়ার, আদ্বিতা নায়ার। নাইকার ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আছেন সবার পরিচিত জাহ্নবী কাপুর।
‘নাইকা’ র নায়িকার কথা
ফাল্গুনি নায়ার অবশ্যই কঠোর প্ররিশ্রমী মানুষ। অধ্যবসায়, চেষ্টা ও হাল না ছাড়ার কঠিন ব্রতের পরই জীবনের অনেকটা পার করে এসেও নিজের এমন শক্ত অবস্থান দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বলেন, “বড় চিন্তা করুন কিন্তু শুরু করুন ছোট থেকে।”
নারীদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, “আমি সেইসব নারীদের পাশে দাঁড়াতে চাই, যারা নিজের জন্য নিজেকে সুন্দর করতে চায়, কোন পুরুষ বা অন্য নারীর জন্য নয়।“
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই ব্যবসায়ী হিসেবেও ফাল্গুনি নায়ার অনন্যা। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে আমাদের কন্টিনেন্টের একটি ভুল ধারণা যে মেয়েরা ব্যবসা করতে পারে না। ফাল্গুনি জানান- “ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যে শুধু পুরুষেরাই রিস্ক নিতে পারে- এটি সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা।”
ফাল্গুনি নায়ার তার জীবনের স্বপ্ন পূরণে, কোনোদিকে না তাকিয়ে, বড় ঝুঁকি নিয়ে অনেকটা পথ পার করে এসেছেন, কিন্তু তার স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মূলমন্ত্র কী? তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে এভাবেই তিনি জানান- “জীবনে একবার হলেও নিজের স্বপ্নের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য একনিষ্ঠ ও কঠিন পরিশ্রম করেই এটিকে সত্য করা সম্ভব।“
ফাল্গুনি নায়ার আমাদের জন্য একজন দারুণ উদাহরণ। তিনি দেখিয়েছেন যে আমরা যেকোনো বয়সেও সফল হতে পারি শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাস ও কঠোর অধ্যবসায় এর মাধ্যমে। তাই যদি আজকে আপনার মনে হয় আপনার জীবনের কোনো স্বপ্ন পূরণ করার আর সময় নেই, তবে আরো একবার ভেবে দেখুন, বিশ্বাস করে দেখুন নিজের ও নিজের স্বপ্নের উপর। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতা ধরা দিবেই।