যে কোনো চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় ‘নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন’। আমরা তখন বেশ ঘাবড়ে যাই। যার কারণে কী বলব বা কী না বলব তা নিয়ে কনফিউশন তৈরি হয়। অনেক চাকরিপ্রার্থীর কাছে প্রশ্নটি এখনও বেশ কঠিন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারা মানে আপনার লক্ষ্য, গুরুত্ব ও কাজের আগ্রহ সম্পর্কে চাকরিদাতা আপনার সম্পর্কে জানতে পারেন। এতে আপনার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এই টপিকটি মূলত হাইলাইট করে আপনার বিভিন্ন স্কিল ও অভিজ্ঞতার উপর এবং আপনি এই জবের জন্য কতটুকু পারফেক্ট সেটা বুঝতে সাহায্য করে।
এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য দুটি উপায় আছে। প্রথমটি হচ্ছে Primarily Chronological। সহজ ভাষায় বলা যায়, আপনার কাজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে আপনি প্রথম প্রশ্নটির উত্তর দিবেন। দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর হবে আপনার বিভিন্ন স্ট্রেন্থ, স্কিল ও ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারের লক্ষ্য নিয়ে। প্রতিটি উত্তর আপনার সিচুয়েশন অনুযায়ী কম বা বেশি ইফেক্টিভ হতে পারে। এর পুরোটাই নির্ভর করছে আপনি আসলে কতটুকু স্ট্রেন্থ নিয়ে প্রশ্নটির জবাব দিচ্ছেন তার উপর। চলুন তাহলে ‘নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন’ এর জবাবে কীভাবে উত্তর দিবেন সে সম্পর্কে কিছু টিপস জেনে নেয়া যাক।
‘নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন’ এর উত্তরে যা যা বলবেন
১) জব সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে জানান
যে কোনো চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার আগে সে কোম্পানি সম্পর্কে ভালোভাবে রিসার্চ করে নিন। ইন্টারভিউ এর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় জবের সাথে সম্পর্কিত থাকে এমন জবাব দিন। তাদেরকে বোঝান কোন কোন স্কিলগুলো নিয়ে আপনি কাজ করতে পারবেন। এছাড়া কেন এই কোম্পানিতে অ্যাপ্লাই করেছেন সেটা সম্পর্কেও জানান। জবের সার্কুলারে যে কি ওয়ার্ড ও ভ্যালু মেনশন করা ছিল, সেগুলো সম্পর্কেও যদি বলতে পারেন, তাহলে তারা বুঝবেন যে আপনি আপনার জব সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। এরপর তাদের কোম্পানি নিয়েও বলুন। এতে তারা বুঝবেন যে আপনি তাদের সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই রিসার্চ করে গিয়েছেন।
২) অভিজ্ঞতা ও কাজ সম্পর্কে জানান
আপনি যখন আপনার কথা বলবেন, তখন অবশ্যই আপনার ক্যারিয়ারের মূল কাজ, অভিজ্ঞতা ও সফলতা সম্পর্কে তাদেরকে জানাবেন। সেটা হতে পারে আপনার প্রমোশন, নির্দিষ্ট কোনো সমস্যার সমাধান, অথবা দারুণ কিছু প্রজেক্টের কাজ। যাই হোক না কেন সেগুলো সম্পর্কে অবশ্যই মেনশন করবেন। এই কাজগুলো কীভাবে তাদের কোম্পানির সাথে রিলেটেড সেটাও আপনাকেই বুঝতে হবে। বিভিন্ন অ্যাচিভমেন্ট সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার সময় খেয়াল রাখুন যে পোস্টের জন্য আপনি অ্যাপ্লাই করবেন সেগুলোর সাথে এগুলো কতটুকু রিলেট করছে। যেমন- আপনি যদি লিডারশীপের জন্য অ্যাপ্লাই করে থাকেন, তাহলে লিডার হিসেবে আপনি কোন কোন বড় প্রজেক্টে কাজ করেছেন সেগুলোতে ফোকাস করুন।
৩) জবাব দেয়ার আগে প্রস্তুতি নিয়ে যান
আপনার নিজের সম্পর্কে নিজেকেই আগে খুব ভালোভাবে কনফিডেন্ট হতে হবে। ফোকাস হারিয়ে ফেললে বা কী বলবেন সেটা বুঝতে না পেরে চুপ থাকলে যারা ইন্টারভিউ নিচ্ছেন তারা বুঝে যাবেন যে আপনি আগ্রহী নন অথবা আপনি প্রস্তুতি নিয়ে আসেননি। তাই এমনভাবে কথা বলুন যেন প্রতিটি উত্তর স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। একইসাথে উত্তেজিত না হয়ে নরমালভাবে কথা বলুন।
৪) পজিটিভ থাকুন
ফার্স্ট ইমপ্রেশন বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কেন আপনাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হলো বা কেন আপনি এখন চাকরি করছেন না – এই বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। ‘নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন’- ইন্টারভিউতে এটাই আপনার প্রথম প্রশ্ন হতে পারে। তাই নিজের বেস্ট কোয়ালিটি দিয়ে এই টপিকে ফোকাস করার চেষ্টা করুন। এতে ইন্টারভিউ বেশ ভালোভাবেই এগোবে এবং আপনার সম্পর্কেও তারা ভালো আইডিয়া পাবে। এরপর আপনি বলতে পারেন কেন আপনি এই মুহূর্তে চাকরি করছেন না অথবা কেন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। সেই সাথে আগের কোম্পানি বা কর্মীদের নিয়ে খারাপ কথা বলা থেকেও বিরত থাকুন। এতে আপনি নিজেকে আনপ্রফেশনাল ও রুড হিসেবেই প্রমাণ করবেন। যেটা ইন্টারভিউতে আপনার ইম্প্রেশন খারাপ করে দিবে।
৫) সৎ থাকুন এবং নিজের মতো থাকুন
জব ইন্টারভিউতে নিজের মতো থাকা বেশ কঠিন একটা কাজ। কারণ যত যাই হোক, দিন শেষে আপনি এমন কিছুই করতে চান যেখানে আপনার ভালো লাগা আছে এবং সেই কাজ সম্পর্কে আপনি প্যাশনেট। আপনি যদি ইন্টারভিউতে সৎ না থাকেন এবং শুধু তাদেরকে ইমপ্রেস করার জন্য মিথ্যা বলে থাকেন, তাহলে এটা আপনার জন্য পরবর্তীতে খারাপ হবে। জব ইন্টারভিউটা হচ্ছে একটা চান্স যেখানে আপনি সবাইকে বোঝাতে পারবেন কেন আপনি তাদের টিম ও কোম্পানির জন্য বেস্ট। সত্য কথা না বললে এবং নিজের মতো না থাকলে পরে এটা নিয়ে নানা ধরনের ক্ল্যাশ হতে পারে।
৬) নতুন নতুন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত থাকুন
আপনি প্রথম ইন্টারভিউ দিচ্ছেন নাকি প্রফেশনাল, সেটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়। জব ইন্টারভিউ সব সময়ই স্ট্রেসফুল। কিন্তু একে আসলে স্ট্রেসের বানানো যাবে না। এজন্য আগে থেকে প্রশ্ন ও তার উত্তর তৈরি করে রাখুন। এতে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার সময় আপনি বেশ রিল্যাক্সড থাকবেন। কারণ ইন্টারভিউতে সাধারণত কমন কিছু প্রশ্ন থাকে। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে আগেরবার কঠিন লেগেছিল, সেগুলোকেই এবার ঝালাই করে নিন। যেমন ধরুন- ‘কেন আপনি আপনার আগের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন?’ এই প্রশ্নটা খুব কমন। এমন ধরনের প্রশ্নের উত্তর আগে থেকেই প্রস্তুত করে নিয়ে যান। এতে ভয় অনেকটাই কেটে যাবে।
ইন্টারভিউ দেয়ার সময় কী করবেন এবং কী করবেন না
যা যা করবেন
নিজের দক্ষতা সম্পর্কে জানাবেন- যে চাকরি আপনি করছেন বা আগে করেছেন, সেখানকার তিন থেকে চারটি দক্ষতা সম্পর্কে তাদেরকে জানান। প্রথমত, বিশেষ ও ভিন্ন ধরনের কিছু দক্ষতা সম্পর্কে আগে জানান। এরপর আরও যা যা স্ট্রেন্থ আছে সেগুলো সম্পর্কে বলুন।
আগের অভিজ্ঞতা ও সফলতা সম্পর্কে বলুন- আপনি যখন আপনার স্ট্রেন্থ ও স্কিল সম্পর্কে কথা বলবেন, তখন আগের অর্জনগুলো সম্পর্কেও জানান। অভিজ্ঞতার সাথে সাথে কী কী সফলতা আপনার ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে সেগুলোও জানাতে ভুলবেন না। আসল কথা হচ্ছে, যে গল্পটা আপনি শোনাবেন, সেটা যেন অবশ্যই আপনার সফলতা ও দক্ষতা নিয়ে হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
জব ডেসক্রিপশনের সাথে স্কিল কানেক্ট করে দিন- জব লিস্টিং ভালো করে পড়ুন এবং কি ওয়ার্ডগুলোতে ফোকাস করুন। এরপর এগুলোকে উত্তর হিসেবে সাজিয়ে নিন। যে জবের জন্য অ্যাপ্লাই করবেন সেখানে কী কী স্কিল লাগবে সেগুলোতে ফোকাস করুন।
যা যা করবেন না
খুব ছোট ছোট তথ্য শেয়ার না করা- সকলের সামনে জীবনের সব তথ্য শেয়ার করার প্রয়োজন নেই। তাদের যতটুকু প্রয়োজন শুধু সেটুকুই জানান। তারা আপনার জীবনের বিস্তারিত সম্পর্কে জানতে চায় না। বরং আপনি যদি কাজ সম্পর্কে তথ্য কম দেন, তাহলে মনে হবে আপনি কিছু লুকাতে চাচ্ছেন। তাই এই দুইয়ের মধ্যে অবশ্যই সামঞ্জস্য রাখুন এবং অপ্রয়োজনীয় ও ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
সিভিতে যা যা লিখেছেন সেগুলো বারবার না বলা- আপনার যিনি হায়ারিং ম্যানেজার থাকবেন, তিনি ইন্টারভিউ নেয়ার আগে আপনার সম্পর্কে সিভিতে পড়েই নিবেন। তাই বারবার সেই তথ্যগুলো রিপিট করার প্রয়োজন নেই। এর চেয়ে বরং ইন্টারভিউয়ার আপনার সম্পর্কে জানতে চাইলে নতুন নতুন তথ্য দিন। উত্তর সংক্ষেপে দেয়ার চেষ্টা করবেন। প্রফেশনাল ও পারসোনাল সাকসেসের কথা শেয়ার করতে পারেন। ধরে নিন, আপনার সম্পর্কে যে যে তথ্য আপনি দিবেন সেটাই আপনাকে জানার জন্য এক ধরনের আয়না হিসেবে কাজ করবে।
বেশি ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার না করা- আপনি নিশ্চয়ই ইন্টারভিউতে আপনার বাচ্চার সফলতা বা রাজনৈতিক কোনো ইস্যু নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছেন না। তাই ফ্যামিলি ম্যাটার বা কন্ট্রোভার্সাল টপিক যেমন- ধর্ম বা রাজনীতি নিয়ে কথা বলবেন না। এমন কিছু বলবেন না যেন শুনে মনে হয় কাজের চেয়ে আপনি শখ পূরণ করতেই বেশি ব্যস্ত। এতে তারা ভাবতে পারে আপনি কাজ নিয়ে বেশি সিরিয়াস নন।
এভাবে আপনি ‘নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন’ এর শুরুটা বেশ ভালোভাবে করতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনার ক্যারিয়ার সম্পর্কে অনেক বেশি ডিটেইলস আপনার দেয়ার প্রয়োজন নেই। অল্প কথায় উত্তর দিন। বেশি সময় নেয়া বা অপ্রয়োজনীয় কথা বেশি বলা থেকে বিরত থাকুন। গুরুত্বপূর্ণ ও কাজের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে শুধু কথা বলুন। আশা করি আর্টিকেলটি আপনার জন্য হেল্পফুল ছিল। এবার থেকে ইন্টারভিউ বোর্ডে যাওয়ার আগে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে আর টেনশন হবে না নিশ্চয়ই?