বিশ্বব্যাপী জাপানীরা তাদের উন্নত ও সুন্দর লাইফস্টাইলের জন্য বিশেষ পরিচিত। তাদের দীর্ঘায়ু ও দীর্ঘদিন তারুণ্য ধরে রাখার রহস্য খুঁজেছেন অনেকেই। খুঁজে পাওয়া গেছে জাপানিদের দারুণ সাজানো ও উন্নত জীবনের কিছু বৈশিষ্ট্য, যা যে কারো জীবনকে করে তুলতে পারে আরো সুন্দর। তাই আপনি যদি চান জীবনকে সুন্দর করে তুলতে এবং দীর্ঘায়ু লাভ করতে, তাহলে এই ৮ টি অভ্যাস গরে তুলতে হবে আপনাকে। চলুন জেনে নেই সে অভ্যাস কোনগুলো।
জীবনকে উন্নত ও সুন্দর করার কয়েকটি জাপানি অভ্যাস
১। শিনরিন ইয়োকু
জাপানি ভাষায় শিনরিন অর্থ বন, ইয়োকু অর্থ স্নান বা গোসল। তাই শিনরিন ইয়োকু অর্থ হয় বনস্নান। এটি এক ধরনের ইকোথেরাপি। হাঁটাহাঁটি বা দৌড়ানোর জন্য বাইরে যাওয়ার পরিবর্তে এই অনুশীলনটি বরং আপনার মনের সাথে প্রকৃতির মেলবন্ধন ঘটায়। এই পদ্ধতিতে মূলত আপনি বন বা গাছপালা এবং আশেপাশের পরিবেশ নিজের মধ্যে ধারণ করবেন। আপনি যদি কোনো সবুজ ছায়াঘেরা জায়গায় যান এবং ভালো করে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেন তবে বাতাসের শব্দ শুনবেন, শুনবেন পাখির কিচিরমিচির, গাছের পাতা নড়ার শব্দ ইত্যাদি। আপনি আরো মনোযোগের সাথে খেয়াল করলে রোদের কোমল স্পর্শ আপনার শরীরে অনুভব করবেন, ঘাসের বিভিন্ন রঙ দেখতে পারবেন- এভাবে প্রকৃতির সাথে নিজে বিলীন হয়ে যাওয়ার পদ্ধতিটিই মূলত শিনরিন ইয়োকু। গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে ১২০ মিনিট প্রকৃতির কাছে কাটালে নানারকম স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। তাছাড়া এই পদ্ধতিটি আপনার স্ট্রেস আর ডিপ্রেসনও কাটাতে সাহায্য করে। এছাড়াও এরকম প্রাকৃতিক ইকোথেরাপি শরীরের সাধারণ নানারকম রোগ নিরাময় করে, ব্যথা কমায়, ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণ করে, ডিমেনশিয়া (ভুলে যাওয়া রোগ) ও স্থুলতা (ওবেসিটি) হওয়া থেকে রক্ষা করে। তাই সুস্থ সুন্দর একটি জীবন পেতে জাপানী এই পদ্ধতিটি অবলম্বন করে, ব্যস্ত শহুরে জীবনের ফাঁকে মাঝে মাঝে ঘুরে আসুন অনাবিল সবুজের মাঝে। প্রকৃতিকে উপভোগ করুন প্রাণ ভরে আর নিজের জীবনকেও সুন্দর করে তুলুন।
২। হারা হাচি বু
জাপানের ওয়াকিনাওয়ানরা চাইনিজ দার্শনিক কনফুসিয়াস এর শিক্ষা থেকে হারা হাচি বু পদ্ধতিটি শিখে এবং নিজেদের জীবনে তা কাজে লাগায়। হারা হাচি বু এর অর্থ করলে দাঁড়ায় “ততক্ষণ পর্যন্ত খাও যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার পেট প্রায় না ভরে”। অর্থাৎ পুরোপুরি পেট ভরে নয়, বরং ৮০% পেট ভরে খাওয়া। এর মানে হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত খান, যতক্ষণ আপনার খাবারটি খেতে তৃপ্তি লাগে, কিন্তু পুরোপুরি পেট ভরে বা খেয়ে নড়াচড়া করা যাচ্ছে না এমনভাবে খাবেন না। স্থুলতা, ডায়বেটিস ইত্যাদি অনেক রোগ যা অতিরিক্ত খাওয়ার জন্য হয় বা বেড়ে যায়, সেগুলো থেকে খুব সহজেই নিস্তার পাওয়া যায় এই কৌশলে। এছাড়া ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকে পরিমিত খাওয়ার ফলে।
৩। গ্রীন টি
আমাদের এশিয়া অঞ্চলে চা বেশ জনপ্রিয়। সকালে বিকেলে এক কাপ চা খাওয়া আমাদের যেন ঐতিহ্য। খুব কম মানুষই আছেন যারা চা পছন্দ করেন না। দুধ চা, লাল চা, মসলা চা নানারকম চা আমরা খাই। জাপানীদের জীবনেও চা দৈনন্দিন জীবনে বেশ জনপ্রিয় এক পানীয়। তবে জাপানী জীবনে গ্রীন টি খাওয়ার অভ্যাসই বেশি। জাপানীরা সাধারণত গ্রীন টি পান করে থাকে। গবেষণায় স্বাস্থ্যের জন্য গ্রীন টি এর নানারকম উপকারিতা পাওয়া গেছে। গ্রীন টি তে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও গ্রীন টি ইনফ্ল্যামেশন কমাতে এবং ব্রেনের কার্যকারিতা বাড়াতেও সাহায্য করে। দৈনন্দিন জীবনে অ্যাকটিভ ও হাসিখুশি থাকতে সুস্থ দেহের কোনো বিকল্প নেই। তাই যদি প্রতিদিন চা খাওয়ার অভ্যাস থাকেই, তবে গ্রীন টি এর অভ্যাস করে ফেলুন। স্বাস্থ্য ও মন দুটোই ভালো থাকবে।
৪। শক্তিশালি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক
মানুষ স্বভাবগতভাবেই সামাজিক প্রাণী। তাই মানুষের মানসিক ও শারীরিক দিকে সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলো অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। ‘ইনোভেশন ইন এজিং’ এ প্রকাশিত ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসকল পরিবারে পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী এবং যারা হ্যাপিলি ম্যারিড, তারা তুলনামূলকভাবে সুস্থ বেশি থাকেন এবং দীর্ঘদিন বাঁচেন। জাপানিরা পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দারুণ অ্যাকটিভ। তাদের পারিবারিক বন্ধন বেশ দৃঢ়। তারা নিয়মিত পরিবারের সাথে সময় কাটান। বন্ধুবান্ধব এবং পাড়া প্রতিবেশিদের সাথেও সকলে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। যার ফলে মানসিকভাবে সুখী থাকতে পারেন জাপানবাসীরা। আর এ কারণেই শারীরিক সুস্থতা ও দীর্ঘজীবন লাভ করেন তারা।
৫। ইকিগাই
ইকিগাই মূলত একটি ধারণা। জাপানি এই শব্দটির অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “বেঁচে থাকার কারণ”- অর্থাৎ জীবনের অর্থ খুঁজে বের করা। আপনার জীবনের কাজ, পেশা, দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুর মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করবে এই ধারণাটি। আপনাকে কোন জিনিস আনন্দ দেয়, কোন কাজে আপনি অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, কাকে দেখলে আপনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ওঠেন সেগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার করুন। ইকিগাই যেহেতু মানসিক ধারণা, তাই বলা যায় যে আপনি আপনার জীবনকে অর্থবহ করার জন্য যে সকল পজিটিভ জিনিস করে থাকেন, সেগুলোকেই চিন্তা করাটা ইকিগাই। এতে মানসিক স্বাস্থ্যে বেশ প্রভাব পড়ে, অনেকটা মেডিটেশনের মত। তাই ইকিগাই অনুযায়ী পজিটিভ জিনিসগুলোকে বেশি বেশি প্র্যাকটিস করুন এবং নেগেটিভ জিনিসগুলোকে পরিত্যাগ করুন।
৬। পরিমিত খাবার
জাপানিজরা খাওয়ার সময় সাধারণত ছোট ছোট বাসনপত্র ব্যবহার করে। তাছাড়া খাওয়ার সময় চপস্টিকের ব্যবহারও করে। এই চপস্টিকে একসাথে খুব বেশি খাবার ওঠে না, তাই খাবারের পরিমাণ পরিমিত হয়। তাদের খাওয়ার একটি নিয়ম হলো প্রতি চামচে আগের চেয়ে কম খাওয়া। অর্থাৎ তারা প্রতি চামচে আগের চেয়ে একটু কম করে খাবার তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবে পরিমিত খাওয়ার অভ্যাসের জন্য তাদের মধ্যে অতিরিক্ত খাওয়ার জন্য যেসকল রোগ হয়ে থাকে তা তূলনামূলকভাবে কম। কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, স্থুলতা ইত্যাদিও কম। ফলে জাপানিজরা সুস্থ জীবন লাভ করে বেশি।
৭। দৈনন্দিন জীবনে শারীরিক পরিশ্রম
জাপানিজরা প্রচন্ড পরিশ্রমী। তারা দৈনন্দিন জীবনে বেশ শারীরিক পরিশ্রম করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৯৮ ভাগেরও বেশি জাপানিজ শিশুরা হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়। এছাড়াও জাপানের ছোট বড় নির্বিশেষে সকলেই কাছাকাছি কোথাও যাওয়ার জন্য, বা অফিসে যেতে সাইকেল চালানো ও হাঁটাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। এতে করে পরিবেশ দূষণ যেমন কম হয়, তেমন শারীরিক পরিশ্রমের কারণে শরীরও সুস্থ থাকে। তাছাড়া জাপানিজরা ছোটকাল থেকে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রমের এ সকল কাজ যেমন হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটাকে তাদের জীবনের দৈনন্দিন রুটিনে করে থাকে। তাছাড়া তাদের গণপরিবহনও বেশ জনবান্ধব, রয়েছে সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা ফুটপাথ। তাই তারা অনেকাংশেই সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন লাভ করে। কাজেই যদি আপনারও ইচ্ছা থাকে সুন্দর, সুস্থ দীর্ঘ একটি জীবনের, আজ থেকেই লিফটের বদলে ব্যবহার করুন সিঁড়ি, প্রতিদিনের রুটিনে যোগ করুন হালকা ব্যায়াম। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে সময় বের করে কেটে ফেলুন সাঁতার অথবা সাইকেল চালিয়ে কিছু পথ পাড়ি দিন। এরকম ছোট ছোট শারীরিক পরিশ্রমের জন্য কেটে যাবে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি, ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিও কমবে, ডায়বেটিস থাকলে সেটিও থাকবে নিয়ন্ত্রণে।
৮। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং চিকিৎসার সুন্দর ব্যবস্থা
জাপান অন্যতম পরিষ্কার একটি দেশ। এর শহর ও গ্রাম অঞ্চলগুলো অত্যন্ত সুসজ্জিত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জাপানিজরা দৈনন্দিন জীবনে প্রচন্ড হাইজিন মেইনটেইন করে চলে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার কারণে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত নানা প্রকার রোগ থেকে রক্ষা পায় তারা। তাছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে মনও ভালো থাকে। এছাড়া জাপানের চিকিৎসা ব্যবস্থাও অত্যন্ত উন্নত। যার ফলে যে কোনো রোগ থেকে তাদের মুক্তি পাওয়াও সহজ হয়।
ল্যানসেট রিসার্চ পেপার অনুযায়ী ১৯৫০-৬০ সালে জাপান সরকার “পাবলিক হেলথ কালচার” নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পে তারা সাধারণ স্বাস্থ্যকর কিছু সিস্টেম তৈরি করে, যেখানে দৈনন্দিন জীবনের হাইজিন মেইনটেইন এর নিয়মকানুনও ছিলো। তার উত্তম ফলাফল বর্তমানে জাপানে দেখা যাচ্ছে।। তাই যদি নির্বিঘ্নে কাটাতে চান সুন্দর সুস্থ একটি জীবন, আজ থেকেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জীবনে অভ্যস্থ হোন।
ছবিঃ সংগৃহীত