কর্মক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যাল সেফটি নিশ্চিত করা কেন জরুরি?

আমরা রোজ সকালে অফিস যাই, কাজ করি, চলে আসি। সাইকোলজিক্যাল সেফটি যে নিশ্চিত করতে হয় ভালোভাবে কাজ করার জন্য, সেটি সম্পর্কে কয়জন জানি? আজকের আর্টিকেলে জানাবো এ সম্পর্কেই।

সাইকোলজিক্যাল সেফটি কী এবং কেন এটি জরুরি?

এর অর্থ হচ্ছে আপনি যেখানে কাজ করছেন, সেখানে আপনার চিন্তা, আইডিয়া কতটুকু প্রকাশ করতে পারবেন, ভয় ছাড়া কাজ করতে পারবেন সেই বিষয়ের নিশ্চয়তা দেয়া। একটি টিমের সবাই কতটুকু নিরাপত্তার সাথে ইন্টারপারসোনাল রিস্ক নিতে পারে সেটাই এই সেফটির আলোচিত বিষয়। কর্মক্ষেত্রে কেন এটি জরুরি চলুন জেনে নেই-

কর্মীদের এংগেজমেন্ট বাড়ায়

কর্মীরা যখন কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করে, তখন তার জন্য কাজে এংগেজ হওয়া সহজ হয়। অফিসিয়াল যে কোনো মিটিং, যে কোনো সমস্যা সমাধানে, প্রজেক্ট কোলাবরেশনে, অন্য কাস্টমার বা ভেন্ডরদের সাথে এংগেজ – যে কোনো ভাবেই কর্মীদের এংগেজমেন্ট বাড়তে পারে। সেই সাথে কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতির দিনও বেশি থাকে।

সাইকোলজিক্যাল সেফটি

সবাই নিজেকে এক ভাবে

কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি মেম্বার নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাববে, নিরাপদ বোধ করবে এটা খুব জরুরি। নিরাপত্তা পেলে কর্মীরাও একসাথে থাকতে পছন্দ করে। এ ধরনের টিমে ধর্ম, বর্ণ, জাত, ব্যক্তিগত বা পলিটিক্যাল কোনো ইস্যু কখনো ভেদাভেদ তৈরি করতে পারে না।

ক্রিয়েটিভিটি বাড়ায়

ক্রিয়েটিভিটি হোক বা নতুন কোনো আইডিয়া, দুটোর যে কোনোটাই বাড়ানোর জন্য কর্মীদের মন খুলে কথা বলার পরিবেশ থাকা খুবই জরুরি। একবার চিন্তা করে দেখুন তো, আপনি যে টিমে কাজ করছেন, সে টিমে যখন কোনো সহকর্মী নিজের আইডিয়া প্রকাশ করতে না পারে, তখন বুঝুন কত আইডিয়া শেয়ার না করা অবস্থায় থেকে যায়?

কর্মীর মেন্টাল হেলথ ভালো রাখে

মেন্টাল হেলথ ভালো থাকলে যে কোনো কাজ করা সহজ হয়। কর্মীরা যখন মেন্টালি হেলদি থাকবে, তখন তারা তাদের বেস্ট দিয়ে কাজ করবে এবং যে কোনো স্ট্রেস থেকে দূরে থেকে সফলভাবে কাজ সম্পন্ন করতে পারবে।

কর্মক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যাল সেফটি

অর্গানাইজেশনের পারফরম্যান্স ভালো হয়

যেসব কোম্পানি সাকোলজিক্যাল সেফটি নিশ্চিত করতে পেরেছে তারা প্রোডাক্ট তৈরি করে রেভেনিউ যেমন পেয়েছে, ঠিক তেমন কাস্টমার স্যাটিসফেকশনও অর্জন করেছে। যেসব কর্মীরা এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, তারাই তাদের জন্য বড় অ্যাম্বাসেডর। তাহলে কাস্টমারের কাছ থেকে পজিটিভ এক্সপেরিয়েন্স কেন আসবে না বলুন?

সাইকোলজিক্যাল সেফটির স্টেজ

সাইকোলজিক্যাল সেফটির ৪টি স্টেজ আছে। সেগুলো হচ্ছে-

স্টেজ ওয়ান- এই স্টেজে কর্মীদের নিজেদের মধ্যে কানেক্টিং হয়। কর্মীরা নিজেদের নিরাপদ ভাবে এবং তারা নিজেরা যেমন সেভাবেই মানিয়ে নেয়।

স্টেজ টু- এই স্টেজকে বলা হয় লার্নার সেফটি। এখানে কর্মী নিরাপত্তার সাথে নতুন কিছু শিখতে আগ্রহ পায়, প্রশ্ন করতে পারে, এক্সপেরিমেন্ট করতে পারে। আপনি কাউকে ফিডব্যাক দিতে এবং নিজেও ফিডব্যাক নিতে পারেন। এমনকি ভুল করলে সেটিকেও নিরাপদ ভাবেন।

স্টেজ থ্রি- এই পয়েন্টে এসে আপনার মনে হবে এবার আপনি নিজস্ব স্কিল দিয়ে কন্ট্রিবিউশন রাখার জন্য প্রস্তুত।

স্টেজ ফোর- এটাকে বলা হয় ফাইনাল স্টেজ। এখানে এসে আপনি যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ নেয়ার জন্য প্রস্তুত। সেই সাথে নতুন যে কোনো বদল বা উন্নতির জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকেন।

সাইকোলজিক্যাল সেফটির ৪টি স্টেজ

লিডাররা নিজ নিজ টিমে যেভাবে এই সেফটি নিশ্চিত করবেন

কর্মক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যাল সেফটি নিশ্চিত করার জন্য লিডারশিপ ডেভলপমেন্ট করা খুব জরুরি। ডেভেলপমেন্ট করার ক্ষেত্রে নিচের এই দক্ষতাগুলো নিজের মধ্যে ইনক্লুড করা খুব জরুরি-

১) কমিউনিকেশন স্কিল গড়ে তুলুন 

টিম মেম্বারদের তাদের নিজস্ব চিন্তা ও যোগ্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন। এটা এক ধরনের প্র্যাকটিস। বিভিন্ন জনের অপিনিয়নের সাথে নিজেরটা মিলিয়ে কাজ করা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। সেই সাথে গভীরভাবে চিন্তা করা, অন্য টিমের মেম্বারদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা, ফিডব্যাক নেয়া এগুলোও করতে হবে। আপনার মতের সাথে মিল না হলেই যে বাকি সবাই ভুল মোটেও ব্যাপারটি এমন নয়। অপিনিয়ন শোনা এবং টিম মেম্বারদের থেকে নতুন কিছু শেখাও কিন্তু এই স্কিলের একটি অংশ। আরও একটি কাজ আপনাকে খুব ভালোভাবে করতে হবে। সেটি হচ্ছে মন দিয়ে কথা শোনা। আপনি যত কথা শুনবেন, তত সদস্যরা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাববে এবং টিমের জন্য কন্ট্রিবিউট করতে প্রস্তুত থাকবে।

২) উদাহরণ তৈরি করুন

যিনি দায়িত্বে আছেন তার উপর কোম্পানিতে নতুন উদাহরণ তৈরির জন্য অনেকটাই দায়ভার এসে পড়ে। এই দায়িত্ব বর্তায় সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট, টিম লিডার এমনকি ম্যানেজারদের উপরও। যদি এদের প্রত্যেকে তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, তাহলে কোম্পানিতে তারা নিজেদের আচরণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারবেন। যেমন- ফিডব্যাক নেয়া শিখুন, ভুল স্বীকার করুন, নিজের চাইতে ভিন্ন হলেও অন্যের অপিনিয়ন নিতে শিখুন, অন্যকে প্রশ্ন করতে বলুন।

আপনি যদি নিজেকে দিয়ে উদাহরণ তৈরি করতে না পারেন তাহলে ঠিক এমন আচরণ আপনি দলের অন্য সদস্যদের থেকেও আশা করতে পারেন না। তাই যখন ভুল করছেন সেটি স্বীকার করুন, কম্যুনিকেশন বাড়ান, এমপ্যাথি দেখান এবং অবশ্যই আপনার যা প্রয়োজন সেটি জানান।

৩) কনফ্লিক্ট রিজল্যুশন স্কিল বাড়ান 

কোনো মেম্বার যদি নিজেকে ছোট ভাবে, শেমিং এর শিকার হয়, অথবা এমন কোনো আচরণের মুখোমুখি হয় যেখানে সে কথা বলতে আগ্রহ পায় না – এমন হলে কোনোভাবেই সে পরিস্থিতি এড়ানো যাবে না। তার এমন আচরণের মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। তার ভেতর কী কী ইনোভেশন ও ক্রিয়েটিভিটি দক্ষতা আছে, কী কী প্রশ্ন আছে – সব জানার চেষ্টা করুন।

কনফ্লিক্ট রিজল্যুশন

৪) মাইন্ডসেট ডেভেলপ করুন

আপনি কি জানেন আপনার টিম কীভাবে অপারেট করে? কে কোন কাজ করে? সবাই কি সমানভাবে কথা বলার সুযোগ পায়? এমন কেউ কি আছে যে অন্যদের চেয়ে কম কথা বলে? তবে এবার আপনার কাজ হচ্ছে সবাই যেন সমানভাবে কথা বলার সুযোগ পায় সেটি নিশ্চিত করা। এজন্য সবার আগে আপনার মাইন্ডসেট ওপেন হতে হবে। কাউকে জাজ করা যাবে না এবং দলের সবার মধ্যে রিলেশনশীপ অবশ্যই স্ট্রেন্থ রাখতে হবে। আমরা আমাদের চোখ দিয়ে যা দেখি, জরুরি নয় যে তাদেরকেও সেভাবেই দেখতে হবে। যেভাবে ওয়ার্কপ্লেসে ওপেন মাইন্ডসেট ক্রিয়েট করতে পারেন-

  • টিমের সবাইকে একে অন্যের সাথে ফিডব্যাক শেয়ার করার জন্য আগ্রহী করে তুলুন
  • অন্যের কাজে কীভাবে রেসপন্স করতে হয় জানান
  • ফিডব্যাক দেখে অবশ্যই টিমের প্রশংসা করুন

৫) স্বচ্ছ থাকুন

যেটা আপনি জানেন এবং যা জানেন না দুটো ব্যাপারই শেয়ার করুন অন্যদের সাথে। এতে আপনি মোটেই ছোট হয়ে যাবেন না। আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন দলের সদস্যদের আপনি কতটা সাহায্য করতে পারবেন। যে কমিউনিকেশন যত খোলাখুলি ও সৎ হয়, তত সাইকোলজিক্যাল সেফটি নিশ্চিত হয়। আপনার কথাই কাজে পরিণত হবে। তাই যতটা সম্ভব নিজের কথা দিয়ে স্বচ্ছ থাকুন।

সেফটি নিশ্চিত করেছেন কিনা যেভাবে বুঝবেন

কীভাবে বুঝবেন যে সেফটি নিশ্চিত করতে পেরেছেন?

১) যখন দেখবেন কর্মীরা তাদের ম্যানেজারের কাছে সব ধরনের অপিনিয়ন শেয়ার করতে পারছে

২) কাউকে আঘাত না করে সরাসরি ও সম্মানজনক ভাষায় অন্যের মতামত নিয়ে আলোচনা করছে

৩) একজন ফিডব্যাক চাইলে অন্যজনও তারটা বলছে, সেটা হোক পজিটিভ বা নেগেটিভ

৪) নেগেটিভ ফিডব্যাককে কনস্ট্রাক্টিভ ক্রিটিসিজম হিসেবে ধরা হচ্ছে এবং সেখান থেকেই নতুন কিছু শেখা, কোলাবোরেট করা বা মেন্টরিং এর সুযোগ রয়েছে

৫) এমপ্লয়ি ফিডব্যাকের জন্য মাল্টিপল চ্যানেল রয়েছে

৬) যে প্রজেক্টগুলো ভালো চলছে না বা ঝুঁকি আছে সেগুলো নিয়ে মিটিং এ সবাই নিজেদের মতামত দিচ্ছে

একটি প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে শুধু লাভ ক্ষতির চিন্তা করলেই হয় না। সেখানে কর্মীরা কেমন আছে, তাদের মেন্টাল হেলথ ভালো আছে কিনা এমন সব বিষয়েই খেয়াল রাখা জরুরি। কারণ তারাই যদি ভালো না থাকে, প্রতিষ্ঠান কীভাবে এগিয়ে যাবে? এবার আপনি বলুন, আপনার প্রতিষ্ঠানে সাইকোলজিক্যাল সেফটি আছে তো?

ছবিঃ সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *